দুর্গাপূজার পোষাকবদল
পোষাকগুলো সবরকমেই বদলে গেছে। দিল্লিতে এখন কি হয় জানা নেই তবে উনিশশো নব্বই এর দশকেও যখন দিল্লির সম্পূর্ণ ভাসানটাই নিগমবোধ ঘাটে হোত তখনো দেখেছি কাশ্মীরী গেট এর বাবুরা স্পটলেস সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরে গুটি গুটি হাঁটছেন নিগম বোধ ঘাটের দিকে সঙ্গে একটা ঢাউস হরিয়ানভী গরুর গাড়ী তার ওপরে জলাভিষেকে উন্মুখ দেবীপ্রতিমা। একটা কথা মনে হযেছিল। এইটাকেই সঠিক বলা যায় দিল্লির দুর্গাপূজা যেটা সংযত, স্থিরচিত্ত, দিল্লির বাঙালির। একশ বছর আগের দিল্লির বাঙালির একটা নতুন জমিতে এসে নিজেকে চেনার প্রযাস। দিল্লির ঐ হরিয়ানভী বলদটানা গরুর গাড়ী বাঙালির দূর্গাপূজাকে মহান করেছে। পাটনা, বারাণসী, এলাহাবাদ, রায়পুর, বিলাসপুর, জব্বলপুর, কানপুর সহ উত্তর ও মধ্য ভারতের অনেক শহরেই দুর্গাপূজা মানেই বাঙালির দুর্গাপূজা। এই প্রত্যেকটি দুর্গাপূজার নিজস্ব এক একটা চেহারা আছে।
আজকের দিল্লিতে অধিষ্ঠিত বাঙালিয়ানার মাথাছাতারা প্রায় প্রতি আসরেই কান টেনে মনে করিয়ে দেন ওহে উজবুক দিল্লির বাংলা সাহিত্য বলে কিছু হয না। দিল্লিতে বাঙালি হযে থাকতে হলে আবহাওযার খবরের দিকে সর্বক্ষণ চোখ রাখতে হবে - আর ছাতার দিকেও। কলকাতায় বৃষ্টি নামা মাত্র ওটা খুলতে হবে নাহলে তোমার বাঙালিয়ানা খতরে মেঁ। দিল্লির কথা উঠতেই কাশ্মীরী গেট এর ঐ দুর্গাপূজার কথা মনে হয। বহুদিন আগেই সে দুর্গাপূজা শতবর্ষ অতিক্রম করেছে। একা কাশ্মীরী গেটই নয, তিমাড়পুর সহ দিল্লির আরো কয়েকটি দূর্গা পূজাও শতাব্দীর মাইলফলক পেরিয়ে চলে এসেছে বিগত কয়েক বছরেই। আর এই সময়কালের অনেক আগেই দিল্লির দুর্গাপূজা তার নিজস্বতা অর্জন করে নিয়েছে। সুচিত্রা সেন যখন তাঁর খ্যাতি ও জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ছিলেন, তখন দিল্লি আসতেন দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে। আর শুনেছি, ওটা কেবলমাত্র সুখের চাইতে স্বস্তি পাওয়ার তাগিদে ছিল না। ওঁর ভালোও লাগত দিল্লির দুর্গাপূজা।
অনেক কাল আগে আমার যখন শৈশব ছিল, ঐ শস্যশ্যামল, বর্ষায় আস্টেপৃষ্ঠে সিক্ত, গ্রীষ্মে রুক্ষ, বাংলারই কোথাও। তখন প্রতি বছর পূজো আমার কাছে আসত না। ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড অনেক কিছুই কেড়ে নিতে আসত দূর্গাপূজা আমার থেকে। কিন্তু তখন কি জানতাম দুর্গাপূজা পূজা কেবল নয, দুর্গাপূজা আরো অনেক কিছু। আজকের দিনে এসে এত পূজা দেখার পর এখন আমার ধারণা দুর্গাপূজা অনেক কিছুই। শুধু পূজা নয। কিছুদিন হোল এই কথাটাই বলে বেড়াচ্ছি যে দুর্গাপূজা বাঙালির একটা সাংস্কৃতিক পরব। ধর্ম বা হিন্দুয়ানির চিহ্ন থেকেও বড়ো হযে উঠেছে তার সাংস্কৃতিক আবেদন।
গ্রামের পূজো, পাড়ার পূজো, এইসব বিধিবাঁধনের শেকল খুলে পড়ার পর মাসমাইনের জোয়ালে বাঁধা কাজেকর্মের ভীড় হতে হঠাতই শুনলাম পূজো। পূজো আসার ব্যাপারটা এত নিঃশব্দে কখনো পাই নি। তার আগে তো ছিলাম বাডিতে যখন পূজো আসার প্রতিটি আওয়াজে, প্রতিটি টোকায় চোখকান সজাগ থাকত। তার বাইরে সেই প্রথম আসা। তখন ছিলাম বিশাখাপত্তনমএ। এমন নয যে সেখানে কাশ ফুটত না বা বর্ষাকাল পেরিয়ে আবহাওয়াতে শীতল ঢেওএর শিরশিরানি নেই। কিন্তু আমার সময় এবং পারিপার্শ্বিক বাতাবরণ এতোই অন্য রকম হয়ে ঘিরেছিল যে পূজোর ব্যাপারটাই অবান্তর হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। হয়তো ভেবেই নিয়েছিলাম যে এই বিদেশ বিভুঁই, এটা আমার নয়। কাজেই বাংলা, শিউলি, কাশফুল, রবীন্দ্রসংগীত, আব্বাসউদ্দিন, ঢাকবাদ্যি, বাউল, সব এখানে অলীক। এখানে পুজোটুজো হয় না। সে সময়, ঐ কাজে কর্মের মাঝখানেই, একটা পার্শ্বেল এলো ডাকপিওনের হাত দিয়ে। খুলে দেখি নতুন দু সেট ধুতি পাঞ্জাবি। জ্যাঠামশাইএর পাঠান। 'তোমার মাপের শার্ট প্যান্ট নিজেই কিনিয়া লইবে। সপ্তমী- অষ্টমীতে নববস্ত্র অবশ্যই পরিবে'। জ্যাঠামশাই অবশ্যই জানেন যে মাইনে পাই, কিন্তু কতটা পাই বা তাতে আমার থাকাখাওয়া- গ্রাসাচ্ছাদন - ঠিকঠাক চলে কি না সে নিয়ে তাঁর সন্দেহ থাকা আশ্চর্য নয। বাডীর ছেলেটা দুর্গাপূজায় নতুন জামা পরবে না এটা কি করে মেনে নেবেন আমার জ্যাঠামশাই! তবে কিনি নি যে তাতে ভুল ছিল না। সেটা টাকা ছিল না বলে নয। পুজোটা যে এখনো সেই শরতকালের শুক্লপক্ষেই হয বা বাড়ীতে এখন কী ধরণের উত্তেজনা সেটার আন্দাজ হযনি বলেই। চিঠিপত্রও তো দেরি হোত আসতে। এক দু মাসও এখনো আসা হয় নি।
সেদিনই বাজারে গেলাম ছোট ছোট ভাইবোনদের জামাকাপড় কিনতে। বাজারে কিছু উত্তেজনা আলোড়ন ছিল। যদিও দোকানপাট সাজে নি। ।এখানের বাজারে তেলুগু ভাষা ও তার সঙ্গে চলে একটা বিকৃত হিন্দী। আজ শুনলাম বাংলা। আর বাংলা শোনার সঙ্গে সঙ্গে পূজো এসে গেল আরো অনেক কাছা কাছি - একেবারে মণ্ডপেই পৌঁছে গেলাম। এটাও জানলাম দুর্গাপূজা এখনো শুরু হয নি। কাল ষষ্ঠী, পরশু সপ্তমী। সমুদ্রের মুখোমুখি একটা বিশাল হলে এখানকার বাঙালি দের দুর্গাপূজা। ঐ মহলটা কোনো প্রাক্তন রাজার সম্পত্তি । সে জায়গাটা পূজো করার জন্য কটা দিন ছেড়ে দেওয়া হয়।
যেটা তখনো জানা ছিল না যে সব বাঙালি পরিবারগুলি পুজোর কটা দিন ঐ মণ্ডপেই কাটায়। কাজেই অবাধ মেলামেশা, বন্ধুত্ব, এসব ছিলই - আমি সদ্য বাড়ির বাইরে বেরিয়ে কিছুটা বাধ বাধ। সেটা কদিনেই কেটে গেল। অনেক নতুন আলাপ, অনেক নতুন বন্ধু, সবাই বাঙালি। এখান থেকেই দুর্গাপূজা সম্পর্কে আমার পুরো ধারণাটাই পাল্টে গেল। দুর্গাপূজা কয়েকটা চিহ্নকে জড়ো করে করে সাজালে তবে হয়। ঐ সাজানোটায় অনেক দম লাগে। দম কথাটার অর্থও তো আজকের দিনে কেউ বুঝবে না। আমাদের ছেলেবেলায় মানে যখন আমরা কিশোর তখন ঘরে ঘরে শোভা বাড়াতো গ্রামোফোন, এখন যেমন গাড়ী, রকমারি বাহারি মডেলের গাড়ী। সেই গ্রামোফোনএ দম দিতে হোত হাতল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে। দুর্গাপূজা যাঁরা রচনা করেন তাঁরা জানেন কত কাঠখড় পোড়ে একটা সামাজিক উত্সবকে চেহারা দিতে। অতো চোখ মেলে দেখার ক্ষমতা ছিল না সে সময় তাই জানি না ঐ বিচ্ছিন্ন বন্দর শহর বিশাখাপত্তনম এ প্রতিমা কোথা থেকে এসেছিল? কে এনেছিল পুরোহিত ও ঢাক। কিন্তু প্রতিমা সেজেছিল ঐতিহ্যময় ডাকসাজে তার গায়ে ধবধবে সাদা শোলার গয়না ছিল। সপ্তমীতে খেলাম খিচুড়ি ভোগ রাত্রে লুচি। অষ্টমীর দিন শঙ্খধবল এক রাণী এলেন ভিজিয়ানাগ্রামের। তখন জানলাম ইনি কুচবিহারের প্রাক্তন রাজার কন্যা। সম্ভবত ইনি বাঙালি এই পূজার আয়োজনে মদত জোগান। কুচবিহারের রাজপরিবারেরও একটা প্রাচীন ঐতিহ্য আছে দুর্গা পূজার । জিয়ানাগ্রাম এখান থেকে 60 কিলোমিটার দূরে। এঁদের রাজত্ব না থাকুক বৈভব এখনো কিছু কম নেই। শীর্ণ, বয়সের ভারে ন্যুব্জ, সেই রাজকন্যা আমাদের পাতে পাতে দিলেন পোলাও, মুগের ডাল, বেগুন ভাজা, মিষ্টান্ন।
সমুদ্রেই প্রতিমার ভাসান হয। এই ভাসানের সময়েই দেখা গেল আরো কটি দুর্গা পূজা হয বিশাখাপত্তনমএ তার ভেতর একটি হোল রামকৃষ্ণ মিশনের দুর্গা পূজা ।
আর শিশুকালে কেউ বুঝিয়ে ছিল চক্ষুদান হওয়া পর্যন্ত প্রতিমায় প্রাণ আসে না। পরে দেখেছি প্রতিমা, ঢাককাঁসর, এসবের ওপরে আরো অনেক কিছুকে জড়ো করলে সত্যি সত্যিই প্রতিমায় প্রাণ আসে - উতসবেও। যেমন কলাবৌ, অষ্টমী পূজোর প্রদীপের মেলা, চণ্ডীপাঠ, নতুন শাডীর গন্ধ, প্রজ্বলিত শিখাদের একে অপরের থেকে ওপরে ওঠার মৃদু প্রচেষ্টা। ভাসান। সব মিলিয়েই তবে গড়ে ওঠে দুর্গা পূজার মহিমা।
তারপরেও কত জাযগার পূজোতে। ভোপালে, পাটনায়, চেন্নাইয়ে, ব্যাঙগালুরুতে। পাটনার পূজোতে ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমীর রাতগুলিতে সারারাত ধরে মার্গ সঙ্গীতের আসর বসে। তিন রাত লোয়ার রোড, মছুআটোলি, রাজেন্দ্র নগর সহ বিশাল এক এলাকায় মানুষ রাস্তাগুলি দখল করে নেয় গান শোনার জন্য। ভোপালের বাঙালিদের দিন রাত খাওয়া দাওয়া চলে। বাংলার বাউলগান, লোকগীতি ছাড়াও ছোট ছেলেমেযেদের নাচগান ছিল, কবিতায় রবীন্দ্র নজরুল ছিল, আর ছিল বয়স্কদের নাটক। তাতে দাদারা, বৌদিরা, অফিস করা দিদিরা আর এদের সঙ্গে কাকুরা। শিং ভেঙে বাছুরদের দলে জেঠুরাও এসে জুড়ে যেতেন যেটা দিল্লির দুর্গাপূজাতেও দেখেছি।
এছাড়া ভোপালের বাঙালিদের দেখেছি, অন্তত ভোপালের যেখানে গিয়ে আমি ভিড়েছিলাম সেখানটায় সরকারের কাজকর্মের মানুষেরা। এই ভীড়ের মধ্যমণি ছিলেন তরুণ কুমার ভাদুড়ী। এখানে আড্ডা হোত বাড়িতে বাড়িতে। এগুলি ছোট ছোট কর্মচারিদের কোয়ার্টার সেখানে বড় বড় অফিসার রাও আসতেন। কেউ আপ্যায়ন করতে আসত না। বড় অফিসারদের বড় বড় বাংলোতেও এই আড্ডাগুলো হোত। সেখানেও এক ই নিয়ম। যিনি আগে আসবেন তিনি সোফায বসবেন, তার পরের জনরা বসবেন কারপেটে তার পরেও যদি কেউ আসেন তিনি বাকিদের সঙ্গে দাঁড়িযে থাকতেন। তরুণকুমার ভাদুড়ী থাকতেন প্রোফেসারস কলোনীতে। তাঁর কোয়ার্টারটা বড়ো ছিল আর আড্ডাও চলত অনেক সময় নিয়ে। নাটকের রিহার্সাল ও চলত সেখানে।
বাঙালি নিজের মাটি ছাড়লেও যেখানেই যায় সেখানেই আপন সংস্কৃতিকে প্রতিস্থাপন করে নিজের জন্যই। অন্যের ওপর সে বোঝা চাপানর জন্য নয। এটাই বাঙালির বিশ্বজয়ের সন্তুষ্টি যার সার্থকতম উপকরণ হোল দুর্গা পূজা । বাঙালি জীবনেও আধ্যাত্মিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, সাংগঠনিক সার্থকতার চিহ্ন ও এই দুর্গা পূজা । বাংলার মাটিতে অনুষ্ঠিত দুর্গা পূজা আর বাংলার বাইরেকার দুর্গা পূজার যে কারণে বিস্তর ফারাক রয়েছে।
অসাধারণ
উত্তরমুছুন