জয়তী অধিকারী

মায়াজম
0
হিমাচলের মহিষাসুরমর্দিনী...


বাঙালীর পুজো মানেই একটা দলের কাছে নতুন জামা-কাপড় পরে প্যান্ডেল হপিং করা আর ‘গুড-ব্যাড’ খাওয়া-দাওয়া। অন্য দলটার কাছে সারা বছর ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে দিন গোনা। তারপর পুজোর দিন পনেরো আগে স্যাক নামিয়ে রোদ্দুর খাইয়ে গোছগাছ শুরু করা। আমি এই দ্বিতীয় দলে পড়ি। এ’রকমই পুজোর সময়, ১৯৯৭ সালে, সদলবলে প্রথমে কালকা মেল আর তারপর শিবালিক এক্সপ্রেস চেপে পৌঁছে গেলাম হিমাচলের রাজধানী, সিমলা। সিমলার সাইট-সিইং ছাড়াও ট্যুর প্ল্যানে ছিল কুলু-মানালি-চন্ডীগড় ঘুরে দিল্লী হয়ে ঘরের বাছা ঘরে ফেরা। কিন্তু বেড়ানোর ক্ষেত্রে আমি ভাগ্য খুব মানি। বেশ কয়েকবারের অভিজ্ঞতা-সমৃদ্ধ ভাবনাটা হল, যদি কোথাও যাওয়া ভাগ্যে থাকে, যেভাবেই হোক পৌঁছে আপনি যাবেনই। না হলে, চাক্কিব্যাংকের টিকেট হাতে ডালহাউসি যাওয়ার প্ল্যানে জম্মু-কাটরা হয়ে বৈষ্ণোদেবী-দর্শন ঢুকে পড়ে কি করে! যাই হোক, আমাদের সিমলা থেকে মানালি পর্যন্ত গাড়ির সারথী, মহেশজী রাস্তায় নানা বিষয়ে বকবক করতে করতে হঠাৎই শোনালেন হাটেশ্বরী মায়ের গল্প। আমরাও হৈ হৈ করে গাড়ি ঘুরিয়ে চললাম সিমলা থেকে রোহরু অভিমুখে, ১০৫ কিমি. দূরের হাটকোটি গ্রামে।




সিমলা-থেওগ-কোটখাই-খাড়া পাত্থর হয়ে রোহরু। মাখনের মত রাস্তা ধরে সাড়ে তিন ঘন্টায় রোহরু পৌঁছে আমরা যখন গাড়ি থেকে নামলাম, মহেশজীকে ধন্যবাদ না জানিয়ে পারলাম না। এমনিতেই হিমাচল আমার খুব প্রিয়। এদের গাছ বাঁচিয়ে রাস্তা তৈরী করা দেখলে অভিভূত হয়ে পড়ি। তার সাথে আছে নীল আকাশের সামিয়ানা আর সবুজ গালচের মাঝে তুষারমুকুট পরা পর্বতের সারি। কিন্তু রোহরুতে না এলে হিমাচলের চিবুকে আঁকা তিলটাই মিস করতাম। সবুজ উপত্যকার মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা উচ্ছল পাব্বার নদী দেখতে দেখতে স্থান-কাল-পাত্র ভুলে যেতে হয়। অনেকেই ট্রাউট মাছ ধরার নেশায় নদীর ধারে এসে বসে থাকেন শুনলাম। কিন্তু আমার মনে হল আসলে রথ দেখার সাথে কলাও বেচেন আর কি। জুব্বল তেহ্‌শিলের অন্তর্গত রোহরু’র কাছে নীল আকাশের প্রশ্রয়ে আধিপত্য বিস্তার করে থাকা সবুজ এই উপত্যকার মাঝেই অবস্থিত হাটকোটি মন্দির। পাহাড় দিয়ে ঘেরা ধানক্ষেতের পাশ দিয়ে বয়ে চলা উচ্ছল পাব্বারের কলকলানি শুনতে শুনতেই চোখ চলে যায় পাথর কেটে তৈরী পিরামিডাকার এই মন্দিরটির দিকে। হিমাচলের অন্যান্য মন্দিরের মতই এটিও অত্যন্ত নয়নাভিরাম। এখানেই বিষকুলটি, রানবতী আর পাব্বার নদীর ত্রিধারা সঙ্গম - যা হিন্দুদের কাছে এক পবিত্র ক্ষেত্র। সঙ্গম আর মন্দির এই দু’য়ের আকর্ষণে ভক্তরা যেমন ছুটে আসেন এখানে, ঠিক তেমনই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের টানে ছুটে আসেন আমার মত নিখাদ প্রকৃতি-প্রেমীরাও।
মন্দিরের গেটের বাইরেই ছোট ছোট দোকানে পুজোর ডালা আর ‘চুনরি’ সাজিয়ে বসে আছে স্থানীয় দোকানদার। সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই কপালে হাত ঠেকিয়ে অভিবাদন জানানোটা যেন অলিখিত নিয়ম৷ গেট দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়ে সুন্দর করে সাজানো পার্ক...সবুজ গাছপালার মাঝ দিয়ে পাথরের সরু রাস্তা এঁকেবেঁকে ঢুকে গেছে। মন্দিরের মূল প্রবেশদ্বারে ঘন্টা বাজিয়ে মন্দির চত্বরে পা রাখতেই পাথুরে শীতলতা যেন শরীরের মধ্যে দিয়ে মনেও হিমেল পরশ ছুঁইয়ে যায়। অদ্ভুত একটা শান্তি, বলে বোঝানোর মত ভাষা অমিলান। দেবী দুর্গা আর দেবাদিদেব মহাদেব পূজিত হন এখানে। দেবী এখানে পার্বতীর অবতার মহিষাসুরমর্দিনীরূপেই বিরাজমান। দেবীমার মূর্তি দেখে মনে হয় শিল্পী যেন সারা বিশ্বকে এক আধারে এনে ফেলতে চেয়েছেন। দশহাতে অস্ত্র এবং পদ্ম ধারণ করে সিংহবাহিনী দেবী এখানে রক্ষাকর্ত্রী। মায়ের মূর্তিমুখে প্রলংকরী ভাব ফুটে উঠেছে। ভক্তরা বিশ্বাস করে দেবী মা প্রকৃতির সাথে সাথেই নিজের অভিব্যক্তিও পাল্টান…কখনও তিনি মৃদুহাসিনী, কখনও আবার ভয়াল ভয়ংকর, ক্রুদ্ধ। মূর্তির দুইপাশে ব্রাহ্মী লিপিতে কিছু খোদাই করা আছে।
১.২০ মিটার দীর্ঘ অষ্টধাতুর মূর্তিটি অন্ধকারেও ভাস্বর। ভক্তদের চোখে দেবীর অনন্ত জ্যোতির আসল রহস্য যদিও ব্রোঞ্জ ধাতুতেই লুক্কায়িত। স্থানীয় মানুষদের বিশ্বাস এখানেই দেবীমা এক প্রবল যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে পাপের বিনাশ করেন। পাব্বার নদীর ডান তীরে বিস্তীর্ণ ধানক্ষেতের মধ্যে অবস্থিত এই মন্দিরে বিরাজমান মাতা হাটেশ্বরী দেবী। হাটকোটির প্রতিটা মানুষই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে যে উত্তর ভারতে পূজিত সমস্ত দেব-দেবীদের মধ্যে গুরু আদি শঙ্করাচার্য প্রতিষ্ঠিত দেবী হাটেশ্বরীই সবচেয়ে ক্ষমতাশালী। কেউ কেউ বলে এই মন্দির নাকি দ্বাপর যুগ থেকেই এখানে শোভা পাচ্ছে। তবে এ’ব্যাপারে কোন প্রামাণ্য দলিল পাওয়া যায় না। কিন্তু মহাভারতের যুগে যে এই মন্দির ছিল সেটা অনেকটাই বিশ্বাসযোগ্য। মন্দির চত্বরে চারপাশে সারি দিয়ে অনেকগুলো মন্দির আছে। আছে কীর্তন-ঘর, ধর্মশালা এবং যজ্ঞশালাও। মূল নাটমন্দিরে সিদ্ধিদাতা এবং ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশের মূর্তির সামনে হোমকুন্ডটিও দেখার মত। মন্দির চত্বরেই আছে একটি বিশাল ভবন, সৎসঙ্গ ভবন। এখানে সাড়ে তিনশ ভক্ত একসাথে বসে প্রার্থনা করতে পারেন। সম্পুর্ণ মন্দির চত্বরের তিনদিক ১২ ফুট উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। এপ্রিল মাসে চৈত্র নবরাত্রি আর অক্টোবরে আশ্বিন নবরাত্রি পালিত হয় মহা ধুমধামে। ফুল আর “হালুয়া” দিয়ে পুজো দেয় ভক্তরা।



দুর্গামন্দিরের প্রবেশপথে একটি প্রাচীন তাম্রকলস শিকল দিয়ে বাঁধা আছে। শিকলের অপর প্রান্ত একটি গনেশমূর্তির সাথে সংযোজিত। এই কলসের সাথে জড়িয়ে আছে একটি মিথ। একবার নাকি এই কলস, যাকে স্থানীয়রা “চারু” বলে, তার একটি সঙ্গী সৃষ্টি হয়েছিল। ভাদ্রমাসের এক ঝড়জলের রাত্রে, সারা পৃথিবী যখন প্রবল বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে, স্থানীয় মানুষজন মনে মনে বরুণদেবকে প্রণতি জানাচ্ছিল সমস্ত পাপ ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে দেওয়ার জন্য। ঠিক সেই সময়ে নাকি কলসদ্বয় নিজেদের শিকলমুক্ত করে লাফাতে লাফাতে ফুঁসে ওঠা পাব্বার নদীর দিকে ছুটে চলেছিল। তখন তাদের মধ্যে থেকে শিসের শব্দও শোনা গিয়েছিল। যেন দুটি মুক্ত বিহঙ্গ মুক্তির আনন্দে গান গেয়ে উঠেছে! পূজারীদের সময়মত হস্তক্ষেপে একটি ‘চারু’কে উদ্ধার করে আনা সম্ভব হয়। সেই মিথ অনুযায়ী, আজও শ্রাবন-ভাদ্রমাসের কোন এক ঝড়-জলের রাত্রে, যখন পাব্বার নদী কানায় কানায় ভরে ওঠে, প্রবেশদ্বারের সম্মুখে থাকা সেই ‘চারু’ নাকি প্রবলভাবে নড়তে থাকে। তার মধ্যে থেকে ভেসে আসে সেই শিসের শব্দ। মনে হয় যেন সে নিজেকে বন্ধনমুক্ত করে তার সেই সঙ্গী, যে হারিয়ে গিয়েছিল পাব্বারের জলে, তার সাথে মিলিত হতে চাইছে। ভক্তরা বিশ্বাস করে যদি কখনও এই শিকল খুলে দেওয়া হয়, ওই কলসটি নাকি অদৃশ্য হয়ে যাবে!
পাশেই রয়েছে শিবালয় মন্দির। মন্দিরের মধ্যে পাথরের বিগ্রহটি দেখলে মনে ভক্তিভাব জাগে। কিন্তু আমার মত নাস্তিক মানুষের চোখে ভাসে মুগ্ধতা। অপূর্ব নির্মাণশৈলী দেখে স্তম্ভিত হতে হয়। প্রতিটি মন্দিরের ভেতরে ও বাইরে যে অসাধারণ স্থাপত্যের নিদর্শন আছে, শুধুমাত্র সেটা দেখার জন্যই যাওয়া যায় হাটকোটি। মন্দিরের অভ্যন্তরে এবং একপাশে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে পাঁচখানা পাথরের মন্দির...এগুলো পঞ্চপান্ডবের উদ্দেশ্যে নির্মিত। তাই প্রথম মন্দিরের থেকে দ্বিতীয়টি লম্বায় সামান্য ছোট, তৃতীয়টি আরও একটু এবং ক্রমান্বয়ে বাকী দুটিও। দেবীমায়ের দ্বারপাল, নিকটস্থ পাহাড়বাসী দেবতা লাংকরা নাকি বিরাটরাজের পাকশালার দায়িত্বে ছিলেন। স্থানীয় লোককথা অনুযায়ী পান্ডবরা তাঁদের অজ্ঞাতবাস বিরাটরাজের রাজ্যসীমায় অবস্থিত এই হাটকোটিতেই কাটিয়েছিলেন। পান্ডবদের সেইসময়কার গল্প এখনও স্থানীয়দের মুখে মুখে ফেরে। তার মধ্যে অন্যতম হল গোগি নামের এক কুমোরের পোষা গবাদি পশুদের চড়ানোই ছিল পান্ডবদের অজ্ঞাতবাসকালীন প্রধান কাজ। তাঁদের স্থাপন করা মন্দিরটি বর্তমান মন্দিরের পাশেই সোনপুরী টিলাতে অবস্থিত। এখানেই দেবীমা’র পুরনো পাথরের মহিষাসুরমর্দিনী মুর্তিটি আছে। শিব এখানে অর্ধনারীশ্বর।

জুব্বাল উপত্যকায় পিরামিডের মত ছাদ বেশী দেখা যায়, তার প্রধান উদাহরণ হল হাটকোটির হাটেশ্বরী দুর্গামন্দির আর শিবমন্দির। অবশ্য পাহাড়ী জায়গায় এই ধরণের স্থাপত্যই বেশী দেখা যায়। হাটেশ্বরী মাতার মন্দিরের পূর্বদিকে একটা ছোট পাহাড় আছে, ‘রম্ভাসুর দূর্গ’ নামেই পরিচিত। শোনা যায় রম্ভাসুর দেবাদিদেবের আশীর্বাদ পাওয়ার জন্য এক কঠিন তপস্যা করেন। তারই ফলস্বরূপ তিনি বর দেন যে মহিষাসুর আজীবন অপরাজেয় থাকবে। এই বরের অপব্যবহার করেই মহিষাসুর ত্রিলোক অধিকার করে। পরাজিত দেবতারা এই পাব্বার উপত্যকায় এসে আশ্রয় নেন এবং হাটেশ্বরী মাতার শরণাপন্ন হন। তখন দেবীমা মহিষাসুরকে বধ করেন আর “মহিষাসুরমর্দিনী” রূপে পূজিতা হতে থাকেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)