তামিমৌ ত্রমি - মায়াজম

Breaking

১৭ এপ্রি, ২০২০

তামিমৌ ত্রমি

রূপকথা ও সার্কাস্টিকতা




আয় ঘুম যায় ঘুম/ ঘুমলো গাছের পাতা/রান্নাঘরে ঘুম যায় রে/ মাগুর মাছের মাথা/বৈঠকখানায় ঘুম যায় রে কেলে কুকুর/বিছানাতে ঘুম যায় রে সোনাই ঠাকুর।
অথবা
আয় ঘুম যায় ঘুম/ দত্তপাড়া দিয়ে/ মিত্তিরদের নাতি ঘুমোয়/গামছামুড়ি দিয়ে
কিংবা
ঘুম পাড়ানি মাসিপিসি / আমাদের বাড়ি এসো/ খাট নেই পিঁড়ি নেই / চোখের পাতায় ব’সো
নচেৎ
ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি /আমাদের বাড়ি যেও/ বাটা ভরা পান দেব/ গাল ভরে খেও ...।
সে সোনাই ঠাকুরই হ’ন আর মাগুর মাছের মাথা, কমলা হাস-পুকুর হেম সেলাই সাদা টেপ ঠাকুরাণীই হ’ন বা বৈঠকখানার অলস ঢুলুঢুলুপ্রায় চক্ষুবিশিষ্ট কৃষ্ণকায় সারমেয় – ঘুমের আগে ঠাকুমার ঝুলি ঝেড়ে কিছু রূপকথার মোহরের চকমকিতে চোখ না ঝলসালে আমাদের খোকন-খুকু স্বপ্নগুলো ঠিক জোনাকির রঙে ঝিলমিল হয় না। দুধের সাগরে নাইতে নাইতে কলাবতী রাজকন্যের শুকপঙ্খী না’য়ে কল্পনা ভাসিয়ে ঘুটেকুড়ুনি দুয়োরাণীর দুঃখে কাঁদতে কাঁদতে লালকমল আর নীলকমলের সঙ্গে রাক্ষসদের দেশে গিয়ে লোহার কলাই চিবিয়ে এন্ট্রি নিয়ে দীঘিতে ডুব মেরে রাক্ষসদের প্রাণ ভোমরা ভীমরুলকে কুচি কুচি করে কেটে ঢোল –ডগর বাজাতে বাজাতে সুখে শান্তিতে বসবাস করতে করতে ঘুমিয়ে পড়িনি, এমন পারমাণবিক মণিষ্যি বোধহয় কড়ে আঙ্গুলের কর গুণেও মিলবে না।
ম্যাঞ্চেস্টারের কল থেকে তৈরি হয়ে আসা বিলিতি ফেয়ারি টেলস বা বার্কের ফরাসী বিপ্লবের নোটবুক , নইলে মার্টিনের এথিক্সের প্রভূত আমদানীর বাজারে দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার যে খাঁটি স্বদেশী ঠাকুমার মুখনিঃসৃত ‘মোহন ঝুলি’টি আমাদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন, সেকথা ‘ঠাকুমার ঝুলি’র ভূমিকায় অকুন্ঠ চিত্তে স্বীকার করেছেন রবীন্দ্রনাথ।
ভূমিকার শেষটায় যদি আমরা চোখ বোলাই, তাহলে দেখব,
‘এক্ষণে আমার প্রস্তাব এই যে, বাংলাদেশের আধুনিক দিদিমাদের জন্য অবিলম্বে একটা স্কুল খোলা হউক এবং দক্ষিণাবাবুর এই বইখানি অবলম্বন করিয়া শিশু-শয়ন-রাজ্যে পুনর্বার তাঁহাদের নিজেদের গৌরবের স্থান অধিকার করিয়া বিরাজ করিতে থাকুন।’
উপসংহারটি বড় মায়াময় আর পেলব, সন্দেহ নেই। কিন্তু সত্যিই যদি আজ এই মুহুর্তে একটি স্কুল খোলা যায়, শুধু আধুনিক মা দিদিমা ঠাকুমাদের জন্যই নয়; বাবা দাদামশায় এবং ঠাকুরদাদাদের জন্য, তাহলেও কী ঠাকুমার ঝুলি এমনই মায়ারসসিঞ্চিত ‘মোহন ঝুলি’ই থাকবে? আমরা বরং বিনা ইউনিফর্মেই আমাদের ক্লাসরুমের বেঞ্চগুলো আলো করে বসি? পাঠ্যপুস্তকের মুড়োন নটে গাছের এক একটি পাতা যদি আবার সিধে করা যায় প্যাপিরাস তৎপরতায়, তাহলে কি রূপকথার ছায়ামায়ার আড়ালে আমরা সার্কাস বা সার্কাস্টিকতা’র তুলোট গন্ধ পাব না? সার্কাস হোক বা সারকাসম্‌, দুইই বস্তুতঃ মজার আড়ালে চমকপ্রদ বিদ্রুপাত্মক হাস্যময়তার এপিঠ ওপিঠ বৈ তো নয়। তাহলে ঢং ঢং মন্দ্রে ক্লাস শুরু করা যাক? সব কবিতা ,সব গল্প যেমন সিলেবাসের পরিসরে থাকে না, আমাদের সিলেবাসও নয়তো বিন্দু ছুঁয়েই সিন্ধুর ‘লাবণ্য’ (লবণের ভাব আর কি) আস্বাদন করল।
‘কলাবতী রাজকন্যা’ গল্পে এক রাজার সাত রাণী। তাদের কারোর সন্তান হচ্ছিল না। এসব ক্ষেত্রে যেমনটা হয়,সন্ন্যাসী শেকড়বাকড় দিলেন। সেই শেকড়বাটা সাত রানী ভাগ করে খেলেই তাদের ছেলে হবে। অতঃপর-
‘রাণীরা, মনের আনন্দে তাড়াতাড়ি স্নান করিয়া আসিয়া , কাপড়-চোপড় ছাড়িয়া, গা-মাথা শুকাইয়া সকলে পাকশালে গেলেন। আজ বড়রাণী ভাত রাঁধিবেন, মেজরাণী তরকারি কাটিবেন, সেজরাণী ব্যঞ্জন রাঁধিবেন, ন- রাণী জল তুলিবেন, কনেরাণী যোগান দিবেন, দুয়োরাণী বাটনা বাটিবেন, আর ছোটরাণী মাছ কুটিবেন। পাঁচরাণী পাকশালে রহিলেন; ন– রানী কূয়োর পাড়ে গেলেন। ছোটরাণী পাঁশগাদার পাশে মাছ কুটিতে বসিলেন।’
সেকালে সতীন-কাঁটার সংসারে প্রবীণত্বের অনুপাতে ‘হায়ারারকি’ র কী অপরূপ এক চিত্র পাওয়া গেল। আর এও কথা, রাণীরা যতই রানী হ’ন না কেন, তাদেরও নিয়তি পাকশাল – রজ্জুর বন্ধনে বিড়ম্বিত। তার মধ্যেই আবার শ্রমবিভাজনের স্পষ্ট রূপরেখা। বড়রানী ‘বড়’ হওয়ার সুবাদে অন্নপূর্ণা’ র পোস্ট পেয়েছেন আর ছোটরাণী পেয়েছেন পাঁশগাদার পাশে বসে মাছ কোটার মতো ‘ছোট’ কাজ।
যা হোক, গল্প এগোতে এগোতে দেখা যা দেখা গেল,পাকশালে থাকা পাঁচ রানী শেকড়বাটা ভাগ করে খেয়ে ফেললেন। ন- রানী কুয়ো থেকে জল তুলে এনে দেখলেন বাটিতে তলানী পড়ে আছে মাত্র, তিনি তাই খেলেন। ন- রাণীর পেটে পেঁচা হল। ছোট রানী শিল –নোড়া ধোওয়া জল খেলেন। তার হল ‘বানরচাঁদ’ ছেলে। তারপর কী হল?
‘রাজা আর রাজ্যের সকলে আসিয়া, পাঁচ রাণীকে জয়ডঙ্কা দিয়া ঘরে তুলিলেন। ন-রাণী, ছোট রাণীকে কেহ জিজ্ঞাসাও করিল না।
কিছুদিন পর ন-রাণী চিড়িয়াখানার বাঁদী আর ছোটরানী ঘুঁটেকুড়ানী দাসী হইয়া দুঃখে কষ্টে দিন কাটাইতে লাগিলেন।’
পুত্র নাকি পুন্নাম নরক থেকে পূর্বপুরুষকে উদ্ধার করে, তাই সে পুত্র। সে বিলীয়মান নরক যে আকাশ বাতাস অন্তরীক্ষের কোন সূক্ষ্ম মায়াজালে ঘেরা আছে, তা জানার কোন সদুপায় আছে কি না , তা গভীর নিরীক্ষণের ব্যাপার। কিন্তু পুত্রজন্ম দিতে না পারার অভিশাপে যে গল্পের প্রথম অধ্যায়ের দুই রানী তৃতীয় অধ্যায়ে জলজ্যান্ত নরকে পতিত হলেন, তা ছাপার অক্ষরে স্পষ্ট প্রতীয়মান।
যাহোক, গল্প চলে গল্পের নিয়মে। সেই পাঁচ রাজপুত্র, বুদ্ধু বানর, ভূতুম পেঁচা বড় হল। সেসময়ে একদিন নদীর ঘাটে শুকপঙ্খী নাও ভিড়ল- তার রূপার বৈঠা, হীরার হাল। সোনার শুকের সঙ্গে মেঘবরণ চুলের কূচবরণ কন্যা কলাবতীর তখন জোর গপ্পোগুজব চলছে। খবর পেয়েই পাঁচ রানী নদীর ঘাটে ছুটলেন। কে তার ছেলের সঙ্গে আগে এই মেয়ের বিয়ে দেবেন, এই ভেবেই তারা অস্থির। কিন্তু কলাবতী যে সে মেয়ে নয়, তিনি বিধান দিলেন –‘ তিন বুড়ীর রাজ্য পার হইয়া, রাঙা-নদীর জল পাড়ি দিয়া, কাঁথা- বুড়ীর, আর, অন্ধকুঠরীর হাত এড়াইয়া তাঁহার পুরীতে আসিয়া যে মোতির ফুল নিতে পারিবে, সে-ই তাঁহার স্বামী হইবে।’এইসব কঠিন শর্ত পূরণ যে করবে, সেই স্বামীর ‘বাঁদী’ হয়ে তিনি শ্বশুরঘর করতে আসবেন। শেষপর্যন্ত বানর রাজপুত্র ‘হাটের সওদা ঢোল – ডগরে , গাছের পাতে ফল’ এর দেশ – কলাবতীপুরে পৌঁছে রাজকন্যার খোঁপা থেকে মোতির ফুলটি কৌশলে হরণ করলেন। সবকটি শর্ত পূরণ হল। রাজকন্যা কেঁদেকেটে মাটিতে গড়াগড়ি দিলেন। কিন্তু শর্তপূরণসাপেক্ষে রাজকন্যা বানরের গলায় মালা দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি তার প্রতিজ্ঞা যথাযথ পালন করলেন। রাজকন্যা কলাবতী কিন্তু অন্য ধাঁচের মেয়ে। তিনি নদীতে অভিভাবকহীন যাত্রা করে বেড়ান, বিয়ের জন্য শর্ত রাখেন । তার বাবা- মা’র উল্লেখ গল্পে কোথাও পাওয়া যায় না। সম্ভবতঃ তিনি বাবা- মা’কে হারিয়েছেন। তবু রাজকন্যার মাল্যদানের পর বুদ্ধু যখন তাকে জিজ্ঞেস করে, “রাজকন্যা, এখন তুমি কা’র?” রাজকন্যা উত্তর দিলেন- “আগে ছিলাম বাপের-মায়ের, তা’র পরে ছিলাম আমার; এখন তোমার।”
অর্থাৎ বিবাহ যে একপ্রকার দাসত্ব- সেটা তিনি খুব ভালোই জানেন। সেইজন্য তিনি আগেও শুকপঙ্খী নাও থেকে তার ভাবী শাশুড়িদের উদ্দেশ্যে জানিয়েছিলেন যে তিনি আসবেন স্বামীর ‘বাঁদী’ হয়ে শ্বশুরঘর করতে।
অথচ আমাদের রাজকন্যা সেই ঠাকুমার ঝুলির যুগের মেয়ে। বহু বহু ধূসর মেঘবর্ষ পার হওয়ার পর সিমোন দ্য বুভোয়া’ নাম্নী এক অনুসন্ধিৎসু ও মননশীল দার্শনিক নারী যে মেয়েদের ‘দ্য সেকেন্ড সেক্স’ বলে সম্বোধন করবেন, তা তার জানা নেই। পুরুষরা যে নিজেদের সাপেক্ষে মহিলাদের ‘দ্য আদার’ বা আদার ব্যাপারী ভাবেন, সোজা কথায় আত্মজন বা নিজেদের সমগোত্রীয় না ভেবে ‘অপরজন’ মনে করেন, ব্যুভোয়া আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দিয়েছেন সমাজকে। আমাদের রাজকন্যা এ-ও জানেন না, একদিন বিবাহ নামক আনুষ্ঠানিকতাটি ধিক্কৃত হবে এই মর্মে যে, পুরুষ বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে নারীর যৌনতাকে নিয়ন্ত্রণ করে। এর ফলে নারীকে সার্বিকভাবে হাতের পুতুল তৈরি করে পিতৃতন্ত্রের পরিচারিকায় পরিণত করার বিপুল সুবিধে হয়ে থাকে। কলাবতী কি ভেবেছিলেন, প্রথম নারীবাদী আন্দোলনকারীরা পুরুষদের যৌনসততার উপর গুরুত্ব আরোপ করবেন? এক রাজার সাত রানী হবার ঘটনাটিকে তীব্রভাবে নিন্দা করবেন? ‘এক রাজার সাত রানী’- এর মধ্যেই যে সামাজিক বিষবৃক্ষ রোপণের কাজটি সুচারুভাবে সুসম্পন্ন করে চলা হয়েছে যুগের পর যুগ ধরে, সেই কারসাজিটা তারা ধরে ফেলবেন? সেকেন্ড ফেমিনিস্ট আন্দোলনের নারীরা যে আরও সাহসিনী হবেন , তা বলাই বাহুল্য। তারা বিষমযৌনতাকেই ঘৃণার চোখে দেখলেন এবং নারীসমকামিতাকে নারীমুক্তির উপায় হিসেবে বেছে নিয়ে জন্ম দিলেন ‘লেসবি রাজনীতি’। ফলতঃ বিষমযৌনতাকে কায়েম করার যে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো অর্থাৎ বিবাহ ব্যবস্থা তারই মূলে কুঠারাঘাত করলেন। বিবাহকে হেগেন (Hagan) বললেন ‘intimate colonisation’ । ড্রাইডেন আমাদের কান এবং বিবেক টেনে শিখিয়ে দিলেন বিবাহ থেকে উদ্ভুত সুদূরপ্রসারী বিবিধ সমস্যা,
“Dryden (1999) notes that both mainstream psychology and feminism has largely ignored marriage. She suggests that feminist research in the last 30 years has concentrated on:
The role of the housewife and links to depression (e.g. Friedan, 1963;Oakley,1974;Ussher, 1991)
Division of labour and responsibility for household tasks and childcare (e.g. Van Every, 1995)
Exploitation of women’s unpaid labour(e.g. Delphy and Leonard, 1992) and economic discrimination (e.g.Pahl, 1989)
Domestic violence (e.g.Ussher, 1997).
A fifth category could include work that has considered alternative forms of marriage such as ‘postgender marriages’ (e.g. Risman and Johnson-Summerford,1998), ‘feminist marriages’(e.g. DeHardt,1993) or ‘peer marriages’ (e.g.Bem, 1998)” ১
না। আমাদের রাজকন্যা কলাবতী এতকিছু জানতেন না, তবু জানতেন বিবাহ মানে বাঁদী হওয়া।
তবে সব গল্পেরই শেষ আছে। নানা ঘটনার ঘাত –প্রতিঘাতে চিড়িয়াখানার বাঁদী, ঘুটে-কুড়ানি দাসীর ঘরের সামনে যখন হাট- বাজার বসল, গাছের পাতায় পাতায় ফল ছেয়ে গেল, তখন রাজার চোখ ফুটল। তিনি দুই রাণীকে ঢোল-ডগর বাজিয়ে ঘরে তুললেন। অর্থাৎ শ্রমিক দাসী বাঁদীদের ঘরে যখন তিনি ধনাঢ্য ঝিলমিল দেখলেন, তখন পেঁচা বা বানরের মা হওয়া সত্ত্বেও তাদের ‘ঘরে’ তুলতে অসুবিধে হল না তার। তা, দুই রাণীকে ঘরে তুলতে বাকি পাঁচ রানী গোঁসা ঘরে খিল দিলেন। পাঁচ রাজপুত্র ঘরে কবাট দিলেন। রাজা কী করলেন! তাদের ঘর গুলো স্রেফ কাঁটা দিয়ে মাটি দিয়ে ভরাট করে দিলেন।
কিন্তু রাজার শাস্তিবিধান কে করবে? এ প্রশ্নের কোন উত্তর নেই। রূপকথা’র রাজারা সব অদ্ভুত ভোলাভালা। যেমন – আমাদের সাত ভাই চম্পা’র রাজা । গল্প শুরুই হচ্ছে এমনভাবে- ‘ এক রাজার সাত রানী। দেমাকে, বড়রাণীদের মাটিতে পা পড়ে না। ছোটরাণী খুব শান্ত। এজন্য রাজা ছোটরাণীকে সকলের চাইতে বেশি ভালোবাসিতেন।’
অনেকদিন পর্যন্ত রাজার কোন ছেলে মেয়ে হয় না, অবশেষে ছোট রানী সন্তান সম্ভবা হলে যে রাণীদের দেমাকে মাটিতে পা পড়ে না, তারাই ধাত্রীমায়ের ভার নিলেন – অহং মটমটে রাণীদের এই হঠাত বদান্যতার কারণ অনুসন্ধান করার কোন দরকার পড়ল না রাজার। রাণীরা যখন ফুটফুটে সাত ছেলে আর এক মেয়ের বদলে রাজাকে ইঁদুরের ছানা, ব্যাঙের ছানা দেখাল, তখনও রাজার মনে কোন সন্দেহের বীজ মাথা তোলে না, তিনি শুধুমাত্র একটু ‘আগুন হয়ে’ ছোটরাণীকে রাজপুরী থেকে বের করে দিলেন। ছোটরাণী ঘুঁটে কুড়ুনি দাসী হয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। আবার দেমাকী রাণীদের কুকীর্তি যখন ধরা পড়ল, তখন তিনি তাদের হেঁটে কাটা উপরে কাঁটা দিয়ে পুঁতে ফেলতে আজ্ঞা দিলেন। অতঃপর সাত ভাই চম্পা আর তাদের মা’কে নিয়ে রাজপুরীতে ফিরে গেলেন। এখন কথা হতেই পারে, রাজা ভোলেভালা না হয়ে যদি অন্বেষক হতেন, তাহলে এই গল্পগুলো রূপকথা না হয়ে রহস্য রোমাঞ্চ সাহিত্যের ভান্ডার সমৃদ্ধ করত নিশ্চিত। কিন্তু কথা হল, তবুও নটে গাছটি বা চোখের পাতা দুটি শান্তিতে মুড়োনো যায় না। রূপকথাতেও মেয়েদের জীবন ক্যাকটাসের মতো বিঁধতে থাকে ও বিদ্ধ করতে থাকে। তবে সিলেবাসকে এগিয়ে যেতেই হয় ‘চরৈবেতি’র নিয়মে।
দৈত্যকুলে যেমন দু-একটা প্রহ্লাদ থাকে, তেমন দু একটা রূপকথার গল্পেও থাকে অন্যরকম নারীর গল্প।
‘কাঁকনমালা, কাঞ্চনমালা’ র গল্পে আমরা পাই এক সাম্রাজ্যলিপ্সু নারীর গল্প।
গল্প সেই দ্রোণাচার্য আর দ্রুপদ ঘরাণা’র । রাজপুত্র আর রাখাল বন্ধু। রাজপুত্র রাখালের কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ হলেন, তিনি রাজা হলে রাখালকে মন্ত্রী করবেন। কিন্তু রাজা হয়ে সেসব প্রতিশ্রুতি হাওয়ায় উড়িয়ে তিনি ‘বন্ধু’কে দরজা থেকেই বিদেয় দিলেন। না। এ মহাকাব্য নয় যে রাখাল দ্রোণাচার্যের মতো অস্ত্রগুরুর চাকরি নিয়ে নিজের শ্রেষ্ঠ ছাত্রের কাছে গুরুদক্ষিণা হিসেবে দাবি করবেন, ‘বন্ধু’ অথবা ‘শত্রু’কে বেঁধে আনতে। এ রূপকথা। তাই রাজা বন্ধুকে বিতাড়িত করার পর দিন থেকে আর চোখ মেলে তাকাতে পারেন না। রাজার মুখ, অঙ্গ লাখ লাখ সূঁচে বিদ্ধ হল। ফলতঃ কী হল- ‘সূঁচরাজার রাজসংসার অচল হইল, - সূঁচরাজা মনের দুঃখে মাথা নামাইয়া বসিয়া থাকেন; রানী কাঞ্চনমালা দুঃখে -কষ্টে কোন রকমে রাজত্ব চালাইতে লাগিলেন।’
তা-ও ভালো, রাজসংসার অচল হওয়ায় রানী পর্দার ওপার থেকে অপার হওয়ার একটা অবকাশ পেলেন। কত পর্দাময়ীরা যে জাহানকে নিজের শাসনক্ষমতার নূরে রওশন করে গেছেন, তার কিঞ্চিৎ আভাস আমরা এভাবেই গল্প, রূপকথা আর ইতিহাসের চিক – চকিতে খুঁজে পাই।
তারপর একদিন রাণী ঘাটে স্নান করতে গেলেন। এক পরমাসুন্দরী মেয়ে তার দাসী হওয়ার আর্জি জানাল। রাজার গা থেকে সূচ খুলে দেবার শর্তে রানী তাকে হাতের কাঁকন দিয়ে দাসী কিনলেন। রানী’ র দুঃখে পোড়া অঙ্গ দেখে দাসী তাকে ঘাটে গয়না রেখে ভালো করে স্নান করতে অনুরোধ করল। রাণীর তাতে সায় ছিল না। কিন্তু দাসী জোর করে তার গয়না খুলে ক্ষার – খৈল মাখিয়ে দিল। রানী বাধ্য হয়ে জলে দু – চারটি ডুব দিতে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে কাঁকন দিয়ে কেনা দাসী রাণীর গয়নাগাটি পরে ঘোষণা করল,
“দাসী লো দাসী পান্‌-কৌ।
ঘাটের উপর রাঙ্গা বৌ!
রাজার রানী কাঁকনমালা;-
ডুব দিবি আর কত বেলা?”
অর্থাৎ ছল করে রাণীর হাত থেকে রাজ্যটি দখল করে নিলেন দাসী কাঁকনমালা। রানী আর কী করেন, কপালে চড় মেরে ভিজে গায়ে কাঁপতে কাঁপতে কাঁকনমালার সঙ্গে সঙ্গে গেলেন। রানী কাঁকনমালা প্রথমেই মন্ত্রী, পাত্রের গর্দান নিলেন – রানী নেয়ে আসবেন আর তারা চৌদোলা পাঠায়নি, হাতি ঘোড়া সাজায়নি, এ কি রাজকার্যে অবহেলা!
শেষ পর্যন্ত এই দুর্ধর্ষ ত্রাস সঞ্চারকারিণী স্বৈরাচারিণী পরাস্ত হয়েছিল রাখাল বন্ধুর বুদ্ধিতে। কে যে দাসী আর কে যে রাণী – তা নির্ণয় করার জন্য রাখাল যে বুদ্ধি এঁটেছিলেন, তাতেও নারীদের সেই চিরন্তন চরিত্রটি ধরা পড়ে। রাখাল ‘রানী’ (নকল ) কে ছল করে পিটা – কুড়ুলির ব্রত করতে বললেন। রানী করল আস্কে চাস্কে আর ঘাস্কে পিটা। ‘দাসী’ করলেন চন্দ্রপুলী, মোহনবাঁশি, ক্ষীরমুরলী, চন্দনপাতা। কাঁকনমালা আলপনা দিলেন এখানে এক খাবল,ওখানে এক খাবল। কাঞ্চনমালা আঁকলেন পদ্ম-লতা, ময়ূর, সাত কলস, মা লক্ষ্মীর সোনার পায়ের ছাপ। দুজনের গৃহকর্মে নৈপুণ্য’র বিচার করে রাখাল সহজেই বুঝতে পারল রানী আর দাসীর তফাৎ। অর্থাৎ রানীকে যদি পরিস্থিতিসাপেক্ষে লক্ষ্মীবাই হতেও হয়, তা হলেও তাকে ঘরের লক্ষ্মী হওয়ার প্রাথমিক শর্তটি পুরণ করতেই হবে।
রাখাল – বন্ধুর সহায়তায় রাজা সূঁচের কবল থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন এবং সবক’টি সূঁচ গিয়ে বিঁধে ছিল কাঁকনমালা’র গায়ে। যে লাখ লাখ সূঁচ রাজাকে মারতে পারল না, তা কাঁকনমালাকে যন্ত্রণায় দগ্ধে দগ্ধে মেরে ফেলল। শেষ পর্যন্ত রাজসংসার সচল হতে কাঞ্চনমালা যে অন্তঃপুরিকা সেই অন্তঃপুরিকাতেই পর্যবসিত হলেন, তবু অচলাবস্থায় আমরা পেয়ে গেলাম দুই অনন্যা নারীকে ।
‘শীত বসন্ত’ গল্পে সুয়োরাণী নখের আঁচড় কেটে দুয়োরাণীর সঙ্গে ঘর-কন্না ভাগ – বাটোয়ারা করে নিয়েছেন। সুয়োরাণী র ছেলে – পিলে নেই। দুয়োরাণীর দুই দেবোপম ছেলে – শীত আর বসন্ত। তাই সুয়োরাণীর হিংসার অন্ত নেই।
প্রতিটি গল্পেই আমরা দেখছি সন্তান স্পৃহা কে কেন্দ্র করে হিংসা , কলহ, প্রতিহিংসা – কিন্তু ভাববার বিষয় এটাই, যে এই হিংসার নেপথ্যে দুষ্টু বা সুয়োরাণিদের দায় কতটুকু? যেখানে তারা জানে, তাদের সমগ্র অস্তিত্বই নির্ভর করছে রাজাকে বংশধর দিতে পারা বা না পারার ওপর, যেখানে তারা প্রত্যেকেই মনে মনে অবহিত – সন্তানহীনতা বা হীনসন্তান ( রাজবংশধর হওয়ার নিরিখে) প্রসবের জন্য তারা রাতারাতি মহিষী থেকে চিড়িয়াখানার বাঁদী কিংবা ঘুটে কুড়ানি দাসীতে পরিণত হতে পারে, সেই মুহুর্মুহু মর্মান্তিক আস্তিত্বিক সঙ্কটের পরিপ্রেক্ষিতে সতীনের সন্তান বা সন্তানসম্ভাবনায় হিংসেয় জ্বলে পুড়ে মরা কী নিতান্তই অস্বাভাবিক? তবু আমরা দেখি, যখন ক্রমান্বয়ে দুয়োরাণীকে এবং তার দুই ছেলে শীত আর বসন্তকে সুয়োরাণী রাজ্যছাড়া করলেন, তখন- ‘ তিন রাত যাইতে – না – যাইতে সুয়োরাণীর পাপে রাজার সিংহাসন কাঁপিয়া উঠিল; - দিন যাইতে- না- যাইতে রাজার রাজ্য গেল। রাজপাট গেল। সকল হারাইয়া, খোয়াইয়া, রাজা আর সুয়োরাণীর মুখ দেখিলেন না; রাজা বনবাসে গেলেন।’ অর্থাৎ পাপের দায় শেষ পর্যন্ত সুয়োরাণীর উপর বর্তাল। এবং গল্পের শেষে রাজা, দুয়োরাণী, শীত, বসন্ত, সবাই রইল। এমনকী সুয়োরাণী’র তিনটে পাট-কাঠি হাড়-জিরজিরে ছেলে (পরে সুয়োরাণীও ও সন্তান-সম্ভবা হয়। লক্ষ্যণীয় , দুয়োরাণীকে সুকৌশলে সোনার টিয়ায় রূপান্তরিত করে ভিটেছাড়া করার পর বছর কয়েক বাদে তার তিন – তিনটি সন্তান হয়! তবে কী দুয়োরাণীর প্রতি রাজার অপেক্ষাকৃত অধিক অনুরাগ থাকার দরুণ সুয়োরাণীর দুগ্ধফেণনিভশয্যা শূন্যই থাকত? ধিক, প্রাবন্ধিক, এ রূপকথা, বিরূপকথা নয়। ) যাদের সমুদ্রের ঢেউ ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, তারা কিন্তু ক্ষীরসমুদ্রে তিনটে সোনার মাছ হয়ে ছিল এবং গল্পের শেষে তারা তাদের স্বরূপ ফিরে পায়। কিন্তু সুয়োরাণীর পাপ এতদূর- যে তার প্রতি রূপকথার ঐন্দ্রজালিক ঔদার্যও বর্ষিত হল না। ছেলেদের সমুদ্রগর্ভে লীন হয়ে যেতে দেখে সে কপাল চাপড়ে বুক চাপড়ে মাথায় পাষাণ মেরে নিজের জীবন- জ্বালা জুড়োল যখন- তখন ‘সুয়োরাণীর জন্য পিঁপড়াটিও কাঁদিল না, কুটাটুকুও নড়িল না;’
আবার এই গল্পেই দেখি রাজকন্যা রূপবতীর কথা। তিনি রাজার এক টুকটুকে মেয়ে । অর্থাৎ কলাবতীর মতো অভিভাকহীন নন। কিন্তু পিতার আদুরে দুলালি বা সাদা বাংলায় যাকে বলে, প্যাম্পার্ড। দুয়োরাণীরূপী সোনার টিয়া’র কাছে গজমোতির কথা শুনে তিনি শর্ত দিলেন, যে তাকে গজমোতি এনে দিতে পারবে, তার গলায় তিনি মালা পরাবেন। এখন, গজমোতি আনা কি চাট্টিখানি কথা! কয়েকজন রাজপুত্র হাতীর পায়ের চাপে মারা গেল, বাকিরা ওই পালিয়ে আসার পথটুকুই কোনক্রমে পেল আর কি। যারা পালিয়ে এল, তারা রাজকন্যা রূপবতী’র নফর হয়ে রইল।
কিন্তু এই কথা শীত রাজার ( ততদিনে বিতাড়িত শীত কপালগুণে রাজা হয়েছেন) কানে যেতে প্রতিক্রিয়াটি কেমন হল? শীত বলিলেন- “কি! রাজকন্যার এত তেজ, রাজপুত্রদিগকে নফর করিয়া রাখে- রাজকন্যার রাজ্য আটক কর।”
রাজকন্যা অতঃপর শীত রাজার হাতে বন্দী হলেন।
মেয়েদের বন্দী করে রাখাই যেখানে দস্তুর, সেখানে একটি মেয়ের হাতে রাজপুত্রদের বন্দী হয়ে থাকা! এ তেজস্বিনী কন্যার যে অচিরেই গ্রহণ লাগবে, তাতে আর আশ্চর্য কী! কিন্তু শীত রাজার এই যে ক্ষোভ রাজকন্যা রূপবতী’র প্রতি, তা কি আদৌ ক্ষোভ, না ক্ষমতা হারিয়ে ফেলার ভয়? এই ছাইচাপা ভয়টিকে সুচারু সূক্ষ্মতার সঙ্গে আবিষ্কার করেছেন জন স্টুয়ার্ট মিল।
“Allegedly, women acquiesce to their social condition because their roles guarantee their well-being . Mill retorted that structuring institutions and social practices around ‘the law of force’ is inconsistent with holding that women’s ‘natural path of success and happiness is embodied in the division along gender lines. Men seem to fear that women might prove to be real ‘competitors’. … Men view women as possible ‘struggling rivals’ in the race of life and, hence, they do whatever is in their power to keep women from threatening their superiority and privileges – the ‘bounties and protective duties’ in their favour.” 2
সুতরাং মেয়েরা যতবারই তাদের ‘প্রোটেকটিভ ডিউটি’র বাইরে পা রাখবে , ততবারই তাদের ‘স্ট্রাগলিং রাইভাল’ হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের চারদিকে গন্ডী টেনে দেওয়া হবে।
কিরণমালা’র গল্পে তিন বোনের মধ্যে বড়টির স্বপ্ন ছিল ঘেসেড়া’র স্ত্রী হয়ে মনের আনন্দে কলাইভাজা খাওয়ার। মেজোটির সাধ, সে রাজবাড়ীর রাঁধুনীর স্ত্রী হয়ে সকলের আগে পাকশালের রাজভোগ খায়। ছোটটির মনোগত বাসনা ছিল রাজার ঘরণী হওয়ার। রাজা তিনজনের বাসনা পূর্ণ করলেন। একসময়ে সন্তান –সম্ভবা রাণীর ইচ্ছে হল, আতুরঘরে সে যেন তার দুই দিদির সান্নিধ্য পায়। রাজা শ্যালিকাদের রাজপুরীতে আনলেন। রাজপ্রাসাদে এসে দুই দিদির তো বোনের ঐশ্বর্য দেখে দিশাহারা অবস্থা। অথচ তারা তাদের ইপ্সিত মানুষদের কাছে এতদিন যাবত কাঙ্খিত সংসার –সুখ উপভোগ করে চলেছে। বোনের রানী হবার ইচ্ছের কথা শুনে তারা যে বিদ্রুপাত্মক হাসি হেসেছিল, সাধারণ বাড়ির মেয়ে হয়ে ছোটবোনের মতো তাদের যে অতবড় স্বপ্ন দেখার স্পর্ধা ছিল না- সেই মানসিক দৈন্য’র কথা তাদের মনে রইল না। তারা হিংসায় জ্বলেপুড়ে মরতে লাগল। ছোট বোনের দুই পুত্র ও এক কন্যাকে তারা জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই নদীতে ভাসিয়ে দিল। পরিবর্তে রাজাকে তারা দেখাল এক কুকুরছানা, বিড়ালছানা আর এক কাঠের পুতুল।
এক্ষেত্রে রাজার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্যণীয়-“ রাজ্যের লোক বলিতে লাগিল, - ‘ ও মা! এ আবার কি! অদিনে কুক্ষণে রাজা না –জানা না – শোনা কি আনিয়া বিয়ে করিলেন,- এক নয়, দুই নয়, তিন তিন বার ছেলে হইল- কুকুর ছানা, বিড়াল ছানা আর কাঠের পুতুল! এ অলক্ষনে’ রানী কখখনো মনিষ্যি নয় গো, মনিষ্যি নয়- নিশ্চয় পেত্নী কি ডাকিনী।’
রাজাও ভাবিলেন- ‘তাই তো! রাজপুরীতে কী অলক্ষ্মী আনিলাম- যা’ক, এ রানী আর ঘরে নিব না। ” প্রজানুরঞ্জক রাজা রামের মতো আমাদের গল্পরাজ তার পত্নীকে বিসর্জন দিলেন।
বাকি কাজটুকু সমাধা করার লোকের অভাব ছিল না। রাজ্যের লোকেরাই ডাকিনীকে উল্টো গাধায় চড়িয়ে মাথা মুড়িয়ে ঘোল ঢেলে, রাজ্যের বাইরে বের করে দিয়ে তবে ক্ষান্ত হল।
লক্ষ্য করার বিষয়, এর আগেও রাণীরা বাঁদর ছানা, ব্যাঙের ছানা প্রসব করেছেন, পরিণামে তাদের চিড়িয়াখানার বাঁদী বা ঘুটে কুড়ানি দাসী হতে হয়েছে। কিন্তু ডাকিনী বদনাম নিয়ে উল্টো গাধায় চড়িয়ে রাজ্যছাড়া করার মতো অবমাননার চরম শিখরে তাদের পা রাখতে হয়নি। কেন? তারা রাজার ঘরের মেয়ে ছিলেন বলে? এই গল্পের রাণী এক্কেবারে ছাপোষা সাধারণ ঘরের মেয়ে। নেহাৎ প্রজাদের সুখ- দুঃখ আন্তরিকভাবে ঠাওর করার জন্য হারুণ অল রশিদের মতো ছদ্মবেশে পথে চলতে চলতে তিন বোনের কথা রাজার কানে আসে এবং তিনি দয়া করে তাদের ইচ্ছাপূরণ করেন আর কি! সেই দয়াটুকু যখন রাণীর উপর থেকে সরে গেল, তখন সেই সাধারণী আর দাসী বাঁদীও রইলেন না; সাক্ষাৎ ডাকিনী হয়ে গেলেন। এবার কথা হল, এই যে রাজাবাবু প্রজাদের মুখে এমন অসৈরণ কথাবার্তা শুনে তাদের কড়া করে ধমকে না দিয়ে বরং তাদের কথায় রাণীকেই দরজা দেখিয়ে দিলেন, সে কী তিনি প্রজাবৎসল বলে? এই বাৎসল্যের নেপথ্যে আলো ফেলতে গেলে কিন্তু আমাদের দার্শনিক ফুকোর শরণাপন্ন হতেই হবে। ফুকো বলছেন, ক্ষমতা অক্ষমের উপর ক্ষমতাধরের শক্তিপ্রদর্শনের পারঙ্গমতা নয়; বরং এই ক্ষমতা একটি কৌশল , যা জাল বিছিয়ে রাখে সর্বত্র। উপর থেকে নীচের তলার সকল মানুষ এই জালের ফাঁদে আটক এবং নিজেদের মতো করে ক্ষমতা বিকীর্ণ করে। প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের সম্পর্কই এখানে ক্ষমতাভিত্তিক, যাকে ফুকো বলেছেন ‘পাওয়ার রিলেশন’। মার্কসীয় দার্শনিকদের মতো তিনি মনে করেন না, যে ক্ষমতার প্রবাহ শুধু উপর থেকে নীচের দিকে ধাবিত হয়; বরং এর উল্টোপ্রবাহও এক চরম ও সুক্ষ্ম সত্য।
“Usually, power is understood as the capacity of an agent to impose his will over the will of the powerless… But in Foucault’s opinion, power is not something that can be owned, but rather something that acts and manifests itself in a certain way; it is more a strategy than a possession. … Power is employed and exercised through a netlike organization… Individuals are the vehicles of power, not its points of application. … The multidirectionaility of power , meaning that it does not flow only from the more to the less powerful, but rather ‘comes from below’,even if it is nevertheless ‘nonegaliterian’.”3
কিন্তু কীভাবে ? ক্ষমতার এত ক্ষমতা হয় কী করে, যে সে নীচ থেকে ওপরে ওঠার সাহস পায়। তারও ব্যাখ্যা দিয়েছেন ফুকো।
How? “ In the first volume of Histoire de la sexualite’, Foucault says that ‘where there is power there is resistance.’ This means that the power relations between individuals cannot be reduced to master-slave or oppressor-victim relations, but they are productive relations, because they imply resistance – without which no power relation can be conceived: where is power, there is always someone who resists it.”4
সুতরাং, যেখানে ক্ষমতা আছে, সেখানেই আছে প্রতিরোধ বা ‘রেজিস্ট্যান্স’। ডাকিনীকে বিয়ে করে রাজা যে অনাচার করেছেন, সেই অনাচারের বিরুদ্ধে যদি গড়ে ওঠে প্রজাদের প্রতিরোধ? তারা যদি বলে, ‘অনাচার কর যদি , রাজা তবে ছাড়ো গদি’- তখন?
সুতরাং রাজাকেও ‘রাজা’ সেজে থাকার জন্য পাওয়ার রিলেশন , রেসিস্ট্যান্স –ইত্যাদি বিষয়গুলো মাথায় রেখে ‘প্রজাবৎসল’ হতে হয় বৈকি।
আবার, হানা আরেন্ট ক্ষমতার তত্ত্বকে প্রকাশ করেছেন নতুন আঙ্গিকে। তার মতে, ক্ষমতা আর হিংসা পরস্পর বিপরীত। যখন নির্দিষ্ট কয়েকজন কতগুলি নীতি নিয়ম পারস্পরিক সম্মতিতে স্বীকার করে নেয় এবং সেগুলি পালন করে চলে, সেটাই ক্ষমতা। ক্ষমতা যখন হাত থেকে পিছলে যাবার দশা হয়, তখন তা টিকিয়ে রাখতে হিংসার আশ্রয় নেওয়া হয়।
“‘power and violence are opposites’ since power emerges when the threat of violence is not needed, when all freely consent to a certain action and act of their own volition.
‘violence is an act of desperation on the part of a government that is losing power.’ –Hannah Arendt -5
এখানেও রাজা ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ার আশঙ্কায় রাণীর প্রতি হিংসার আশ্রয় নিলেন!
কিন্তু প্রজাদের সুখী করে গদি বাঁচিয়ে রাজা কি সুখে ছিলেন। এই গল্পে আবার যখন রাজা আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন, তখন তার মনস্তত্ত্ব কেমন? “মনের দুঃখে মনের দুঃখে দিন যায়, - রাজার রাজপুরী অন্ধকার। রাজা বলিলেন, -‘না! আমার রাজত্ব পাপে ঘিরিয়াছে। চল। আবার মৃগয়া যাইব।’ আবার রাজপুরীতে মৃগয়ার ডঙ্কা বাজিল।”
এই যে আমাদের সামনে এক যে আছেন রাজা, তার ভারি দুখ। কেন? তার উত্তরটা খুব সহজ করে আমাদের বলেছেন জন স্টুয়ার্ট মিল।
‘Mill believed that inequality alienates women and men from one another. …. Human beings are not self – sufficient. Power never compensates for the loss of happiness, nor security for the loss of freedom.’6
সবথেকে মর্মস্পর্শী শেষ লাইনটা । নয় কি? নিরাপত্তা স্বাধীনতার অভাববোধের পরিপূরক হতে পারে না। প্রজাদের হাতে রেখে নিজের সিংহাসনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন তিনি। কিন্তু ব্যক্তিক মানুষ হিসেবে স্ত্রী সন্তান নিয়ে দাম্পত্যসুখের স্বাধীনতা থেকে তিনি বঞ্চিত। যদিও মিল পুরুষ ও নারীর মধ্যেকার অসাম্য প্রসঙ্গেই এই কথার অবতারণা করেছেন। তবু, যেকোন পরিপ্রেক্ষিতেই হোক না কেন, অসাম্যমাত্রই বয়ে আনে বঞ্চনা ও বিড়ম্বনা।
এলিয়েনেটেড রাজা’র কথা ছেড়ে আমরা আসি কিরণমালার কথায়। অরুণ, বরুণ, কিরণমালা ইতিমধ্যে বড় হল। তাদের পালকপিতা ব্রাহ্মণ চোখ বুজলেন। রাজার সঙ্গে তাদের প্রাথমিক পরিচয় হল। তাদের দেখে রাজা বাৎসল্য অনুভব করলেন, যদিও তারা যে তারই সন্তান, তা জানতে পেলেই তো দোল, থুড়ি, গল্প ফুরিয়ে যাবে। তারা তিন ভাই বোনে এক অট্টালিকা তৈরি করল, যা দেখে বিশ্বকর্মা অবধি লজ্জায় মুখ ঢাকেন, এমত অবস্থা। একদিন তারা এক সন্ন্যাসীর কাছে শুনল, অট্টালিকা যতই অনুপম হোক, মায়া পাহাড় থেকে সোনার ফল ধরা রূপোর গাছ, মুক্তা-ঝরার জল, সোনার পাখি – এসব যদি অট্টালিকা’র শোভা না বাড়াল, তাহলে আর সে কিসের অট্টালিকা?
প্রথমে অরুণ গেল মায়াপাহাড়ে। সে মৃত একথা জানতে পারলে তারপর গেল বরুণ। কিন্তু অরুণের তলোয়ারে মরচে পড়ার মতো বরুণের ধনুকের ছিলাও যখন ছিঁড়ে গেল, কিরণমালা বুঝল, বরুণের মৃত্যু হয়েছে। দুই ভাইকে হারিয়ে কিরণমালার মনোগত ভাবব্যঞ্জনা কিরকম,‘কিরণমালা কাঁদিল না, কাটিল না, চক্ষের জল মুছিল না; উঠিয়া কাজললতাকে খড় খৈল দিল, গাছ- গাছালির গোড়ায় জল দিল। দিয়া, রাজপুত্রের পোষাক পরিয়া, মাথে মুকুট হাতে তরোয়াল, - কাজললতার বাছুরকে, হরিণের ছানাকে চুমু খাইয়া, চক্ষের পলক ফেলিয়া কিরণমালা মায়া পাহাড়ের উদ্দেশে বাহির হইল।’
কাঁদিল না, কাটিল না, চক্ষের জল মুছিল না। সেই দূরাগত টেপফ্রক-উদ্বেল অথবা আজকের এই শাড়ি -সালোয়ার –গম্ভীরা – যেই হই না কেন-এই ক’টি অক্ষরের মায়াকাজলে এ অধমের চোখ চির আচ্ছন্ন। এই ক’টা অক্ষরের আঁচড়ে কিরণমালা’র চারিত্রিক দৃঢ়তা আমাদের স্তব্ধবাক করে। বুক চাপড়ে, কপাল চাপড়ে, উচ্চৈঃ স্বরে ‘মেয়েলী’ কান্নার প্রগলভতা তার নেই। তার শোকের প্রকাশ অতীব সংযত। তা বলে এমন তো নয় যে তার প্রকাশের চিহ্নটুকুও থাকবে না। সংসারে তার থাকার মধ্যে দুটি ভাই। তারা যখন কেউ রইল না, তখন এই একাকী নিষ্ঠুর ভবসমুদ্রের দু ফোঁটা নোনতা জল তার কোমল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তেই পারে। কিন্তু সেই জল মুছতে যাওয়াও পেলব প্রগলভতা। তাকে যে এখন পুরুষোচিত হতে হবে। নইলে সে রাজপুত্রের পোষাক গায়ে চড়িয়ে মাথায় মুকুট পরে তার আশ্রিতদের পরিচর্যা করে সে বেরোবে কি করে?
“The ideal of masculinity is also premised on devaluing full self – development. It encourages the over – development of men’s intellectual faculties, consistently with a certain view of their ‘nature’ as essentially rational. It starves their emotional constitution, consistently with a certain view of what counts as ‘manly’ behavior. Thus, it perpetuates a conception of men as less than human, but, paradoxically, for that reason better than women!”7
অতএব, মিলের মতে, ‘পুরুষদের’ কাছে পুরুষালি হওয়ার প্রধান লক্ষণ, চরম বাস্তববাদী = চরম আবেগ-শূন্যতা, যা প্রকারান্তরে মনুষ্যত্বের চরম অবমাননা ছাড়া কিছুই নয়। সেই ‘ইমোশনাল স্টারভেশন’ এর জেরেই কিরণমালা কাঁদল না, কাটল না, চোখের জল মুছল না।
তবে আমাদের কিরণমালা ‘ম্যানলি’ হলেও ‘লেস দ্যান হিউম্যান’ নয়। কারণ, সে তো নারী। তাই হরিণ-ছানা টিকে খাওয়া তার চুমু’র মধ্যে সে রেখে গেল মহীয়সী সংহত মায়া ।
এরপর মায়া পাহাড়ে পৌঁছোতেই তাকে দত্যি দানো বাঘ ভালুক সাপ ভূত পেত্নী সবাই ঘিরে ফেলল। তাদের কেউ বা ‘রাজপুত্র’কে গিলে ফেলতে চাইল, কেউ বা খেয়ে ফেলতে চাইল। কিন্তু কিরণমালা কারোর দিকে চাইল না, কারোর কথা কানে নিল না। নেপথ্যে যুক্তিটা কী? না, সে তো ‘রাজপুত্র’ নয়! সত্যিই তো। সে তো এক অগ্নিরূপা কন্যা – যাকে রাজপুত্রের বাড়া হয়ে এগিয়ে যেতে হবে মায়া পাহাড়ে পাথর হয়ে যাওয়া লক্ষ লক্ষ রাজপুত্রকে তাদের স্বরূপে ফেরাতে।
“দেখিতে দেখিতে সকল পাথর লক্ষ লক্ষ রাজপুত্র হইয়া গেল। রাজপুত্রেরা জোড় হাত করিয়া কিরণমালাকে প্রণাম করিল- ‘সাত যুগের ধন্য বীর।’
অরুণ বরুণ চোখের জলে গলিয়া বলিলেন-‘মায়ের পেটের ধন্য বোন’। বাকি রইল রাজা মশায়কে বশ করা। তা সে তো মোহরের পায়েস , মণির মোণ্ডা, মোতির পিঠে রাজাকে পরিবেশন করে ‘মানুষের পেটে কি বিড়ালছানা, কুকুরছানা হয়? ইত্যাদি বলে তার বিবেক- দংশন ঘটানো হল। সেই অভাগিনী ‘ডাকিনী’কেও রাজা ফিরিয়ে নিলেন রাজপুরীতে তিন সন্তানের সঙ্গে। এরপর তারা সুখে শান্তিতে বসবাস করতে লাগলেন, যেমনটি রূপকথায় হয়। এ তো মহাকাব্য নয়, যে সুয়োরাণী, ন’রাণী, ছোট রানী, ডাকিনীরা সমস্বরে বলে উঠবেন- ‘ধরণী দ্বিধা হও’। সীতার মতো পাতাল-প্রবেশের মর্যাদা তাদের ভাগ্যে নেই। নেই বেহুলার মতো স্বর্গে অন্তর্হিতা হওয়ার মহিমা। তাদের আছে মায়া থালায় সোনার পাথরবাটিতে মুক্তা-ফলের সুখ।
1: A marriage of Inconvenience ? Feminist Perspectives on Marriage/ Sara –Jane Finlay and Victoria Clarke
2:The corrupting influence of power by Maria Morales. Regarding subjection of women by John Stuart Mill, a textbook of liberal feminism, Philosophical Perspectives on Power and Domination (Theories and Practices) – Laura Duhan Ka

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র