পুরনো ফোনের ওয়াল পেপারে প্রজাপতি বন্দী করেছিলাম। যেভাবে প্রতিনিয়ত আমরা আমাদের ইচ্ছে অনিচ্ছের বেড়াজালে আটকা পড়ে যাই ঠিক তেমনই কিছু ভাবা যেতে পারে। একদিন লালমাটি ভাঙতে ভাঙতে ঝিরি ঝিরি বৃষ্টির দুপুরে ভুলগুলো ধুয়ে মুছে গেল। আসলে ওভাবে কিছুই বেঁধে রাখা যায় না। ভিজে ঘাসের ওপরে বসে হাঁ করে মেঘলা আকাশ গিলছিলাম, আড়চোখে একটা ছায়া-সুড়সুড়ি সন্তর্পণে আমার গ্রে ম্যাটারে টোকা মারছে, সাবধানে মাথা নামাতে বলছে। একটা লাল কালো ছিট ছিট জীবন্ত প্রজাপতি ওয়াল পেপারের প্রজাপতির গায়ে বসতে চাইছে, আলিঙ্গন করতে চাইছে। আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। ব্যালান্সের খেলাটা জমে গেছে। পাছে শ্বাস প্রশ্বাসের কম্পনে একে অপরের বন্ধনটুকু শিথিল হয়ে যায়। কিছুটা প্রাণসঞ্চারের খেলায় মেতেছিল ওরা। এতটাই হতবাক আমার চোখ, যে পলক ফেলতে ভুলে গেলাম।
পলক বা মুহূর্ত শিখিয়ে যায় মহাকাব্যের সেই সমস্ত অংশগুলো যা প্রতি পদে আমাদের পা ফেলার সঙ্গী হয়ে ওঠে। বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা। তাঁর অঙ্গুলিহেলনেই বায়ুকণা, জলকণা, ক্ষুদ্রাণু প্রাণ, জড় ও জীবের পার্থক্য নির্দিষ্ট হয়ে গেল। স্তরের পর স্তর গঠিত হয়ে দিন রাত্রির সংজ্ঞা তৈরি হল। অথচ তিনি পূজিত হলেন না ভারতবর্ষে। কথিত আছে নিজের কন্যাকে কামের আগুনে পুড়িয়ে মেরেছিলেন তিনি, তাই আজ তাঁর এই পরিণতি। ভারসাম্যের খেলাটাও কিন্তু সেদিনই শুরু হয়ে গেছিল। শারীরিক কাম ও মানসিক অন্ধকার শূন্যে ঝুলে থাকা দোলনা থেকে ছুঁড়ে দিচ্ছিল নিজেদের। ভরসা ছিল একে অপরের উপর। ঘাটতি ছিল অভ্যাসের। মনের অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। সূর্য অস্তাচলে গেল। মানুষ মুখ ফেরাল অভিমানে।
অভিমান সম্পর্কের গল্প বলে। ঠিক দুজনের কথাই বলছি এমন নয়। দুই থেকে চার, ছয় এমন করে বৃহত্তর পৃথিবীর লাখো লাখো সম্পর্কও হতে পারে। শুধু একটাই শর্ত। অদৃশ্য একটা সুতো একজনা থেকে আরেকজনায় ছড়িয়ে বসে আছে। তার উপর একটা সাইকেল চলছে। তাকে চলতেই হবে কারণ ওটাই আমাদের বৃত্ত। এক জায়গা থেকে শুরু করে আবার সেই জায়গাতেই শেষ হতে হবে, তবেই সম্পূর্ণ জবে জীবনচক্র। থেমে গেলেই ছুটি হয়ে যাবে। অকারণ ছুটি। দুটো, চারটে অথবা অগুনতি পা প্যাডেলে চাপ দিয়েই চলেছে। কোন পা ক্লান্ত হলে অন্য পা দুটি আরও আরও বেশি সচল হয়ে উঠছে। একটা দুটো করে রাতপাখি ডেকে উঠছে। পৃথিবীর যে ভাগে অন্ধকার তাঁবু খাটিয়েছে সেই ভাগে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সবাই। তবু পাগুলো চলছে টানা দড়ির ওপর, সাইকেলগুলো এগোচ্ছে বৃত্তাকারে। ছুটি আসলে অভিমানের সমার্থক সব্দ। খুশির সকাল অবসর চায় না।
অবসর মানেই কাটাকুটি খেলা। ক্রশ-শূন্য, ক্রশ-শূন্য। জিতে যাওয়াটাই যেন অস্তিত্বের প্রমাণ রেখে যায়। রিং মাস্টারের হাতে লাঠি। সামনের হিংস্র জন্তুটি সেই লাঠির দাস। দন্ডের ইশারায় চারপেয়ে, মানবজাতির মতো দুই পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা চালায়, বল ছুঁড়ে দেয় বাস্কেট বল পোস্টে, স্বল্পবসনা সুন্দরীর সঙ্গী হয়ে ওঠে। সবচাইতে উন্নত মস্তিষ্কের সমকক্ষ হওয়ার এই তো সুযোগ। কিন্তু জন্তুটি জানে না সুযোগ আসলে সে করে দিচ্ছে রিং মাস্টারকে। এ ছাড়া তার অস্তিত্ব বিপন্ন। তার জীবন নির্বাহ সঙ্কটময়। দর্শকাসনের করতালিই তার জিতে যাওয়া। কাটাকুটি খেলার সম্রাট বা সম্রাজ্ঞী সে। অবসরের যোগ্যতা এখানে তুচ্ছ।
যোগ্যতা বিচারের আসনে আসলে দেবতাও বসতে চান না। ফলাফল পরীক্ষার্থীর মনোমত না হলে নকুলদানাটা, বাতাসাটাও মুখ ফিরিয়ে নেয়। তার চেয়ে হাত তুলে দাও। আমার ভালো, আমার মন্দ আমিই আমার শিক্ষক। খুব দায়ে না পড়লে কে চায় এ মন্দার বাজারে জোকারগিরির চাকরিটা খোয়াতে। দু’বেলা দুমুঠো জুটে তো যায়। চোখ দিয়ে ওয়াটার অফ ইন্ডিয়া বয়ে গেলেও হাসিতে লুটিয়ে পড়ে ভক্তের দল। ঈশ্বরও অলক্ষ্যে হাসেন, তিনিই একমাত্র জানেন তাঁর সমস্ত ক্ষমতাই বামনত্ব গ্রাস করে নিয়েছে।
ক্ষমতাই হল পৃথিবীর শেষ কথা। মাঠে-ঘাটে, বাজারে, গৃহে মায় সোশ্যাল নেটওয়ার্কেও তিনিই সেরা যার ক্ষমতা শক্তিশালী। অর্থ, বিত্ত, সম্পত্তি দিয়ে এর পরিমাপ করা যাবে না, বরং বলা যেতে পারে ক্ষমতা পাইয়ে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে পৃষ্ঠপোষক বাড়িয়ে তোলা। এদেরও অস্তিত্বের সঙ্কট ঘটে। ইঁদুর দৌড়ে টিকে থাকার জন্য হ্যামলিনের বাঁশি বাজাতেই থাকে। কিলবিল কিলবিল করে সমাজের জঞ্জালেরা পেছন পেছন দৌড়তে থাকে, মনে আশা আগামীদিনে আমিও যদি হতে পারি সার্কাস কোম্পানীর মালিক।
সার্কাসই জীবন নাকি জীবনটাই সার্কাস বলা মুশকিল। বরং আপেক্ষিকতার সূত্র মেনে চলা ভালো। ভারসাম্য বজায় থাকে এতে। বিলোতে বিলোতে সন্ন্যাসী কমণ্ডলুও বিলিয়ে ফেলে, পরিবর্তে দুমুঠো খুদ গুঁড়ো হলেও চলে। উভয়পক্ষই ত্যাগের মন্ত্রে দীক্ষিত। তবু গেরুয়া মেলে একজনের ঝুলিতেই। সবই ভাগ্যের খেলা। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এ খেলাতে কম বেশি সামিল সকলেই।
‘ট্রাপিজের মতো শীতঘুম ওঠানামা করে,
ঘড়ির সার্কাস বোঝে ছোটোখাটো স্পর্শ-বিনিময়-‘
সুচিন্তিত মতামত দিন