উত্তম বিশ্বাসের গ্রন্থ আলোচনা - মায়াজম

Breaking

১৭ এপ্রি, ২০২০

উত্তম বিশ্বাসের গ্রন্থ আলোচনা






র্তমান যাপনে নামকরণের আধুনিকতা ধী -শক্তির পরিচয় রাখছে। সে আমাদের সন্তান জন্মের পর নামকরণের ক্ষেত্রেই হোক বা গ্রন্থ শিরোনামের ক্ষেত্রেই হোক। আসলে নামকরণের মধ্যে দিয়ে ব্যক্তিসত্তার প্রজ্ঞা প্রতিফলিত হতে থাকে।

"মাটির সিন্দুক" -নামটা শুনে লেখক শ্রী উত্তম বিশ্বাসকে জানতে চেয়েছিলাম ,মাটির সিন্দুক মানে কি মাটির কাছাকাছি জীবনের গল্প দুই-মলাটের পৃথিবীতে  আবদ্ধ!

তিনি যে উত্তরটি দিয়েছিলেন,চিত্তবৈকল্য ছাড়া বোধকরি ভুলতে পারবো না। তিনি বলেছিলেন, পৃথিবীদেবী বুঝি তার যাবতীয় ঐশ্বর্য গচ্ছিত রেখেছেন মৃত্তিকা-বুক ভরা সিন্দুকে। উৎকর্ষ মেধার চাষে সেই মাটি থেকে পরিশ্রমী হাতে ছেনে ফলিয়ে নেওয়া যায় অলৌকিক সোনাদানা।

বইটি তখনও পড়া শুরু করিনি।ভেবেছিলুম আর পাঁচটা যাপনের গল্পের মতো মেধাবী শব্দের চাতুরী ও আগুন আগুন সংলাপ প্রয়োগের মুন্সিয়ানায় পুরনো মদে বোতল বন্দী আশ্চর্য জিনের প্রলাপে ভরা থাকবে । তবে আমি যে ভ্রান্ত তা বুঝে নিয়ে ঈশ্বর বুঝি হেসেছিলেন অলক্ষ্যে।  বহুদিন যাবৎ মায়াজম প্রকাশের সুবাদে বহু লেখকের লেখা প্রকাশ করার অভিজ্ঞতায় খটকা অবশ্যই একটা ছিলো। সেটা হলো শ্রী বিশ্বাসের বহু গল্প মায়াজম তার অনলাইন ও প্রিন্ট সংখ্যায় প্রকাশ করে এসেছে।

লেখকের বহু গ্রন্থ প্রকাশিত হলে এবং তা সর্বজনবিদিত হলে সে ক্ষেত্রে গ্রন্থ আলোচনায় বাড়তি চাপ এসে যায়। আবার ভুলভাল আলোচনা করে রসিয়ে কষিয়ে একঝুড়ি মিথ্যে প্রলোভন বকে পাঠককূলকে দিক-ভ্রষ্ট করাও যুক্তিযুক্ত নয়। একদিকে এই লেখকের কলমকে বহুদিন ধরে চিনি,কিন্তু কথা হচ্ছে যেসব লেখা মায়াজম লেখককে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে তেমন 'লেভেল' কি লেখকের বর্তমানে প্রকাশিত বইটির মধ্যে পাব! যাইহোক,যাবতীয় দোলাচল সরিয়ে রেখে লক-ডাউনের ভয়ঙ্কর খাঁড়া ঘাড়ে নিয়ে হাতে নেওয়া গেলো গ্রন্থটি। শিরোনামের কথা তো বলাই গেলো,এবার আসি প্রচ্ছদের আবিষ্কারের দিকে।অদ্ভুত এক সাদা-কালো-ধূসরের মিশেল যা মাটির গভীরতা বা মনের সাদা -কালো পরতগুলোকেই যেন তুলে ধরতে চেয়েছেন লেখক।লেখক সমরেশ মন্ডল একটি ছোট ভূমিকার মধ্যে দিয়ে বইটির সম্পর্কে যা বলার বলে দিয়েছেন।ভূমিকাটিকে বার দুয়েক না পড়ে পেরিয়ে যাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য। লেখক উত্তম বিশ্বাসের বইটিতে মোট ২০ খানি গল্প রয়েছে। আর সেই ২০ খানি গল্পের নামকরণ যে মুগ্ধ করবেই তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।চমকটা লুকিয়ে ছিলো অন্যখানে,গল্পগুলো নাড়িয়ে  দেখতে গিয়ে দেখলুম, প্রতিটি গল্পই বিভিন্ন সময়ে কোন না কোন নামী পত্রিকার প্রকাশিত হয়েছে। আমার কাজ যেন খানিকটা সহজ হয়ে গেলো। বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদকদের অভিজ্ঞ দৃষ্টি জয় করে এসব লেখারা প্রকাশ পেয়েছে , আর আমি সেইসব শ্রেষ্ঠ লেখাদেরই মেধাবীমলাটের মধ্যে একত্রিত করে পড়ছি। প্রথম গল্প "এবং দেবদাসী" -গল্পের শুরুতে ঘণ্টাধ্বনি ও ভোগারতির মধ্যে দিয়ে অদ্ভুত দর্শন ছেলের ক্ষুধা ক্ষুধা মুখ নিয়ে মন্দির চাতালে দাঁড়ানোর মধ্যে দিয়ে এক রহস্যময় বাতাবরণের অবতারণা ঘটিয়েছেন লেখক। লেখার যত গভীর তলে ডুব দেওয়া গেছে সেই আবহ আরও ঘিরে ধরেছে এবং মণিকাঞ্চন আবিষ্কারের নেশায় ঘোরপ্রাপ্ত পাঠককে আদ্যোপান্ত পড়িয়েই ছেড়েছে।আমি মনে করি প্রথম ৫লাইন পাঠককে পড়িয়ে নেওয়ার দায়িত্ব বর্তায় লেখকের উপরে,সেই আকর্ষণ যদি গ্রাস করে মননকে বাকিটুকু পাঠকই পড়ে নেবেন তরতরিয়ে। "রতিবিকার",কৃষ্ণগহ্বর ,আদি প্রত্ন কথা লেখকের অসাধারণ সব গল্প। এ প্রসঙ্গে বি এ ,এম এ ক্লাসে পড়া রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পের সংজ্ঞা মনে পড়ে গেলো। যা পড়ে মনে হবে শেষ হয়েও শেষ হল না। শ্রী বিশ্বাসের প্রতিটি গল্প পরেই মনে হচ্ছিল এক নিশ্চিত উপন্যাসের বীজ প্রথিত আছে মাটির অভ্যন্তরে।

আসলে সত্যের সামনে একজন ঋষি , একজন লেখক ও একজন ঈশ্বর সমান । সত্য যেহেতু সর্বদা সত্য এবং তার গ্রহণযোগ্যতা বাস্তবধর্মী , তাই সাধারণ মানুষ সবসময় সেই সত্যের সম্মুখীন হতে সাহস পায় না । দ্বিধাযুক্ত মানুষ মানিয়ে চলতে চলতে এক সময় থেমে যায়।লেখকের যাত্রা যেন এখান থেকেই হয়েছে শুরু।লেখক উত্তম বিশ্বাস যেন কোন তন্ময় ঋষির প্রজ্ঞা নিয়ে তুলি দিয়ে চরিত্রগুলো আঁচড় কেটেছেন একমনে।কোন দাগ ভারি মোটা হয়ে, কাটা কাটা সংলাপে পাঠককে ঠেলে নিয়ে যায় ঘাত-প্রতিঘাতের খাদে, আবার কোন দাগ সূক্ষ্ম তুলির টানে এত মনোরম হয়ে উঠেছে যে মনে হবে কোন পলকা পালক ঘুরিয়ে যাদুদন্ডের ছোঁয়ায় সোনার কাঠি-রূপোর কাঠির মায়াদেশ নেমে এসেছে শব্দের পরিণত বুনটে। পাঠক নিজের সেই চরিত্রদের রঙ্গভূমিতে আবিষ্কারে বাধ্য হবেন।আবার ক্ষণিকে মনে হবে যা দিলাম আপন বলে ছুঁয়ে সবই কি থাকলো অধরা!এই ধরা এবং অধরার মধ্যে দিয়েই জলফড়িং এর ফিনফিনে ডানায় পড়া এক চিলতে রোদ্দুরের রামধনু হয়ে ওঠার গল্প বুনেছেন লেখক।

চরিত্র সৃষ্টি করা মানে তো শুধু তাকে জন্মদান করা নয় , তার দর্শন , তার নৈতিক বিস্তারকে,তার মানসিক স্তরের ঈশ্বর-শয়তান ও মানুষ এই প্রতিটি অবস্থানের যথাযথ প্রতিকৃতি তুলে ধরা।এই গল্পগুলোর যে দিকটি পাঠকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করবে তা হলো ব্যঞ্জনাধর্মী মনতত্ত্ব ।সূক্ষ্ম কারুকার্যময়তায় কাহিনীর নানা রঙের ঢেউ পাঠককে ভাসিয়ে নিয়ে যায় না বরং গুছিয়ে তোলে। আর এখানেই সমসাময়িক লেখকদের থেকে মৌলিক শ্রী বিশ্বাস।যেন সেই থোড়-বড়ি-খাড়ার একনাগাড়ে গেয়ে চলা বন্দিশ থেকে ভিন্ন রাগিণী শোনাতে এসেছে।তিনি অবশ্য সিদ্ধহস্ত পরাবাস্তব আবহ তৈরিতে,এখানে সেটিই গল্পের রিদম হয়ে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে চলে।তার শব্দের সরোবরে দেবী সরস্বতীর নিত্য অবগাহন। একদিকে যেমন স্বর্গীয় বাগিচায় রূপগলিত অপ্সরাকে সোনার হরিণের মুখে বিচুলি ধরে আনন্দ ভারে হাসির মধ্যে চুনি-পান্না খসে পড়তে দেখা যায় তেমনি অন্যদিকে আঁশবটি হাতে নিয়ে ডাগর কালো মেছুনী রমণীর কোন্দল হুঙ্কারও বর্তমান। আমরা যদি "রেহিঙ্গা শিবির" গল্পটির মধ্যে হাটি তবে জীবনের এক পলেস্তারাহীন বাস্তবতার রাগন্মোচন দেখতে পাবো। অনবদ্য শব্দের মুন্সিয়ানা লেখককে এখানেই স্বতন্ত্রতা দান করেছে।

লেখক সজ্ঞানেই ভালোবাসার মধ্যে ঢুকেছেন , ঢুকেছেন যৌনকলার কালচক্রে।তবে এই প্রেম বা যৌনতা চক্রব্যূহ নয় ।
চরিত্রের অচলায়তন ভেঙে যৌনতাই মাঝেমধ্যে নিজেই চরিত্র হয়ে উঠেছে। এই ভালোবাসার মধ্যে প্রতিদিন পাখি জন্মায় , পাখি সভ্যতার মধ্যে দিয়ে লেখক এগিয়ে যান চিরকালীন সেই প্রেমব্যাপ্তির দিকে। 'মৎস্যগন্ধা" গল্পে তার নারী চরিত্র দিব্য বলতে পারেন নির্দ্বিধায়

"মাটিতে খামোখা এত দরদ মাখিয়ে কী লাভ শিল্পী? কাঁচা রক্ত-মাংসের শরীরে কি দিতে পার,তাই দ্যাখাও দেখি!"

এ যেন সুচারু নারীত্বের জয়জয়কার।শূল নয় ত্রিশূলে তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে যথারীতি লেখক প্রচেষ্ট হয়েছেন।এই গ্রন্থে মৎস্যগন্ধা একটি বলিষ্ঠ গল্প বলা যেতে পারে।"সানাই বাদক" গল্পে আমরা সুধন্য সাধুখা'র বাস্তবভুমি থেকে অধিবাস্তব স্তর পেরিয়ে উত্তরণের আভাস পাই।আবার "বনমোরগ" গল্পের মধ্যে দিয়ে লেখক সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে দিয়েছেন মানুষ সত্ত্বাকে।লেখকের কলম ধরে আমরা দস্যি বালিকাটির মতো জঙ্গলের ঢিলার উপরে দাঁড়িয়ে সূর্য ওঠা দেখি,আবার গ্রামবাংলার বুকে বুকে ঘুরে জেহাদি রমণীর চোখের ঝলকানিতে সনাতন গৌরবকে অস্বীকার করার গুঁড়ো গুঁড়ো স্পর্ধাও দেখি।

সাদা কাগজে চরিত্রদের ছড়িয়ে দেওয়ার পরে নিপুণ হাতে গুটিয়ে নেওয়াও এক কৌশল।সেদিকে লেখকের আরো যত্নবান হলে আকাশ ও ঘুড়ির মধ্যে হাওয়ার চলাচল পাঠকও অনুভব করতে পারবেন। আসলে দেখার চোখকেও লেখকের কলমের সমান সুশিক্ষিত হতে হয় না হলে বোধহয় বোধ আর বোধির মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য থেকেই যায়।

চিরাচরিত আকাঙ্ক্ষার বাইরে এক আকাঙ্ক্ষার জগত বিরাজ করে , তার খোঁজ পায় না সাধারণ মানুষে । আকাঙ্ক্ষা হল পাকা ও মিষ্টি ফলের মতো । যে ফলের দিকে চোখ ও ক্ষুধা হাপিত্যেশ করে বসে থাকে । আকাঙ্ক্ষাকে দমন না করতে পারলে আগাছার মতো বৃদ্ধি পেতে পেতে প্রকৃত ফসলকে নষ্ট করে দেয় ।বিশ্বাস বাবুর গল্পগুলো সেই তীক্ষ্ণ ফলাকার উপরে দাঁড়িয়ে ,সামান্য এধার ওধার হলেই রক্তারক্তি হবার মতো বিপর্যয় ঘটিয়ে ফেলতে পারে।কিন্তু শ্রী বিশ্বাস এক দক্ষ কারিগর,তিনি জানেন কতটা ক্ষয়ে গেলে,কতটা গলিত হলে ব্যথা ও পুলকের মধ্যবর্তী সীমানায় গেঁথে নেওয়া যাবে পাঠকের জহুরী চোখ।

লেখকের গল্পগুলোর সামনে দাঁড়ানো মানে ,নিজেকে ভাঙা আয়নার সামনে দাঁড় করানোর এক সুতীব্র তিতিক্ষা ।এই দাঁড়ানোর মধ্যে নগ্নতা আছে ,আছে নিজের চোখের মধ্যে অন্তরকে উজাগর করার প্রস্তাবনা।তার গল্পের চরিত্রদের মধ্যে আছে সম্পর্কের ধ্রুপদ আত্মসমর্পণ , কিন্তু সেই আত্মসমর্পণে দুঃখ নেই , সারস ঠোঁটের মতো গভীরতা আছে । এই গভীরতায় মধ্যে ডুবে যেতে পারলে কবিতা সোনার খনিতে পরিণত হয়ে ওঠে , পাঠক হয়ে ওঠে সোনার কারিগর ।

প্রাপ্তিস্থান, আদি দে বুক স্টোর, ধ্যানবিন্দু কলকাতা
উজান স্রোত প্রকাশনা। দাম 200 টাকা ----সোনালী মিত্র

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র