বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়' এর গ্রন্থ আলোচনা - মায়াজম

Breaking

২০ জুন, ২০২০

বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়' এর গ্রন্থ আলোচনা

'মনের ভেতর কত মনের খেলা/ আজ যে পুতুল কাল সে মাটির ঢেলা'
--
উপন্যাসঃ মন্ত্র
লেখকঃ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রকাশকঃ আনন্দ
প্রচ্ছদ শিল্পীঃ মহেশ্বর মন্ডল
জীবন এক বৃত্ত। সেই বৃত্তের ভেতর জড়ো হয় অভিজ্ঞতা। যে অভিজ্ঞতাই জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষক। এই শিক্ষকই মানুষকে প্রকৃত রাস্তা দেখায় এগিয়ে চলার। এটাই যদি জীবনের বেদমন্ত্র হয় তবে আমরা ভুল করি কেন? ভুল তো অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের আধার। যে ভুল থেকে সঠিক দিশা খুলে যায় জীবন পথের। হয়ত বা জীবন দর্শনের। নিজেকে না বুঝতে পারলে সে দর্শনও যে অধরা রয়ে যায় চিরকাল। পতঙ্গ কোন ঘাস জমিতে বসলেই তা যে পতঙ্গের হয়ে যায় না, এই জীবন দর্শন যে সকলের বোধগম্য নয়! তাই তো এতো অপরাধ, এত লালসা, এত আকাঙ্খা। দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভরা এই জীবন সংসারে এত বিচ্ছেদ। মায়া ছাড়া প্রেম যে অচল। সে মনুষ্য প্রেমই হোক কিংবা ঈশ্বর। সমর্পন বা আত্মোৎসর্গই ভালোবাসার আসল মন্ত্র। উপন্যাসের আধার রচিত হয়েছে যে বীজমন্ত্রকে সঙ্গে নিয়ে, তা হল এই জীবন দর্শন। সাহিত্যিক বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্ত্র উপন্যাসটি পড়তে পড়তে বারবার উপন্যাসের প্রধান চরিত্রের যে বেদনা ফুটে উঠেছে তা হল ভালোবাসার কাছে নিজেকে পুরোপুরি সমর্পন করতে না পারার বেদনা। তা এক আশ্রমিক হিসাবেই হোক কিংবা সংসারী হিসাবেই হোক। দোটানায় চলতে চলতে নিজেরই আয়না থেকে বারবার বিচ্যূত হতে হয়েছে উত্তরণকে। ঠিক ভুলের দাঁড়িপাল্লায় ক্ষতবিক্ষত এক মানুষ উপলব্ধি করেছেন বারবার, যে পথে তিনি বর্তমান, তা তার আসল মুক্তির পথ নয়, অথচ যে পথে তিনি এখনো যেতে পারেন নি, বরং জীবনের বহমানতা তাকে সেখান থেকে দূরে নিয়ে গেছে বারবার সেটিই তার অন্তরাত্মায় মিলে মিশে একাকার হয়ে আছে চিরকাল। সেই সমর্পনের পথে তবে কেন এত বাধা? নাকি তাই ভবিতব্য ছিল? কে ঠিক করে সেই ভবিতব্য? কে নিয়ন্তা, কে চালক?
জীবন মানুষকে মেনে নিতে শেখায় অনেকটা। তবেই সাময়িক শান্তি। না হলে পথ যে শেষ হওয়ার নয়! নাহলে আদি অনন্তকাল মানুষ ছুটতেই থাকবে সেই না পাওয়ার পিছু পিছু। বাড়বে যন্ত্রণা। যে যন্ত্রণা প্রতিফলিত হয় উত্তরণের স্ত্রী অনুসূয়ার ভেতর। সে তার না পাওয়াগুলোকে ছুঁতে চেয়ে পুরাতন সবকিছুকে অস্বীকার করে। নতুন মানুষের সাময়িক চাকচিক্য তার জীবনে নতুন জোয়ার নিয়ে আসে। তাকেই তখন সে তার ভবিষ্যত মনে করে। হঠাৎই তার মনে হতে থাকে, খোলা হাওয়ায় দাঁড়িয়ে পাওভাজি বা কালাখাট্টা খাওয়াতে যে নেশা লুকিয়ে আছে বা এক প্যাসিনেট কবি মানুষের ভালোবাসায় যে অ্যাডভেঞ্চার লুকিয়ে আছে তা পিএইডডি করার ভেতর বা সাদামাটা সংযমী জীবনধারণের নেই। উত্তরণের মতো ঈশ্বরের কাছে সমর্পিত মানুষ তাকে কোনদিনই সে জীবন দিতে পারবে যে জীবন, রঙমশালের চেয়েও রঙীন। নাস্তিকতা জীবনের সেইসব চাওয়াকে পরিপূর্ণ করে যার জন্য কারো কাছে মানুষের জবাবদিহি থাকে না। উচ্ছৃঙ্খলতা সেখানে এক নেশা। যার নেশায় উন্মদ হয়ে মানুষ সাময়িক ভাবে সেটিকেই সত্যি ভাবতে শুরু করে।
যে ফলস নষ্ট হয়ে গেছে তার কথা না ভেবে নতুন শস্যক্ষেতের সন্ধানে সে রঞ্জিতের সাথে ভেসে চলতে চায় এক অজানা ঠিকানায়। অথচ একদিন এই উত্তরণই ছিল তার একসময়ের ঈশ্বরতুল্য শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার মানুষ  । তবু তাকে ঘৃণা করতে শুরু করে অনুসূয়া। এর প্রধান কারণ কোথাও তার মাতৃত্বের অসম্পূর্ণতা। তার চাওয়া ও পাওয়ার ভেতর বিস্তার ফারাক রয়ে যায় বলেই হয়ত ক্ষোভের জন্ম নেয় তার ভেতর। আর তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে এমনভাবে যে যার আগুনে ঝলসে যায় একটা সাজানো সংসার।
উপন্যাসটিকে ঘিরে আছে আরো একটি বেদনা যা ব্রহ্মচারী ঠাকুর থেকে উত্তরণ ও উত্তরণ থেকে মন্ত্রতে এসে শেষ হয়। সেটি হল পিতা ও সন্তানের এক অবিচ্ছেদ্য ও সূক্ষ্ম দূরত্ব। কাছে এসেও না আসা। যে ঠাকুর বারংবার চান, উত্তরণকেই নিজের পরবর্তী কন্ঠস্বর করতে তুলতে উত্তরণ সে স্বপ্ন রাখতে পারে না। পরবর্তীতে তার মেয়ে মন্ত্র জন্মায় অগঠিত ভোকাল কড নিয়ে। কিছু অস্পষ্ট শব্দ ছাড়া কোন শব্দই সে উচ্চারণ করতে পারে না ঠিকঠাক। উত্তরণের পিতৃহৃদয় ক্ষতবিক্ষত হয়, সন্তানের গলার স্বর তার হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছায় না বলে। তার মনে হতে থাকে এ যেন পূর্ব ঘটনারই পুনরাবৃত্তি মাত্র। অভিজ্ঞতা ফিরে আসে তার ভিন্ন রূপে। ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে, যা উত্তরণকে বুঝতে শেখায় এক পিতার কাতরতা। সন্তানের মুখোচ্চারিত শব্দ কিংবা কোনদিন বাবা ডাকটুকু শুনতে না পাওয়ার যন্ত্রণা তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। সেই তাড়ণা থেকেই তার বন্ধু সোমানাথের কন্যা তনয়া যখন ফোনে তাকে অনুরোধ করে, বিশেষ অতিথি হিসাবে না যাওয়ার জন্য, তাতে প্রাথমিকভাবে সে রাজিও হয়ে যায়। এতো তার পিতৃহৃদয়ের অসম্পূর্ণতা থেকেই বিগলিত এক অপত্যস্নেহ মাত্র। সত্যাসত্য বিচার না করেই এক পিতা যেন অস্ফুটে সাড়া দিয়ে ওঠে কন্যাসম মেয়েটির অনুরোধে।   
'মন্ত্র' এক জটিল যাত্রাপথ। যে পথে চাপান উতোর আছে প্রচুর। হয়ত বড় বেশিই। যা ঘটার নয়, তাই ঘটমান। যা ভাবার উর্ধ্বে তাই ভবিতব্য। আস্তিকতা বা নাস্তিকতা সবটাই আপেক্ষিক। বেঁচে থাকার মূল মন্ত্র আসলে ভালোবাসা ও সমর্পন। তা সে যাকে উদ্দেশ্য করেই হোক। 'ঈশ্বরকে নেওয়া উচিত চরম শূন্যতাকে ভরিয়ে রাখার শক্তি হিসেবে'। এই সত্য উত্তরণ উপলব্ধি করে যেদিন মাথা কেটে রক্ত গড়িয়ে পড়লেও মন্ত্র তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় বাবার দিকে তাকিয়ে এক সরল হাসি হেসেছিল। সে যেন সত্যিই ঈশ্বর দর্শন। সকল জাগতিক বিষয়কে তুচ্ছ প্রমাণ করার জন্য ওটুকুই ছিল শেষ কথা। মানুষ যুদ্ধে নামে রক্তাক্ত হবে জেনেই। তাই লড়াইটা করে যেতে হয় আজীবন সত্যের সাথে কোন কম্প্রোমাইজ না করে।
আমেরিকায় সেই সূর্যাস্ত সন্ধ্যায় যখন উত্তরণের একদিকে নিজের দেশে ফেরার আকর্ষণ ও অন্যদিকে ফিলাডেলফিয়ার নতুন চাকরী, অর্থ, যশ, প্রতিপত্তির হাতছানি, যখন এই দ্বন্দ্বের ভেতরই অবশেষে ভারতে ফেরা ও একরাতে স্বপ্নের ভেতর এক অলৌকিক শিশুর ছায়ায় সত্যসেবী আশ্রমের প্রবেশদ্বারের দৃশ্য অনুভূত হওয়া এ সব কিছুই উত্তরণকে যেন সেই না পাওয়ার দিকেই ক্রমশ টেনে নিয়ে যাচ্ছিল যা সে ফেলে গিয়েছিল অতীতে। তার আশ্রয়দাতা পালনকর্তা ঠাকুর তাকে দেখতে চেয়েছিল ভবিষ্যৎ সন্ন্যাসীরূপে। অথচ সে সংসারী হয়। ও শুধু তাইই নয় জাগতিক সুখ ভোগের নানা স্তরে নানান বিচিত্র  অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে। কিন্তু ঘটনাক্রমে তারই ঔরসজাত মন্ত্রের হাত ধরে সেই ঠাকুরের আশ্রমেই তাকে ফিরে আসতে হল একদিন। সেখানেই সে শুনতে পেল মন্ত্রের মুখে প্রথম মন্ত্রোচ্চারণ। সেই প্রথম কোন এক অলৌকিক শক্তিতে কিংবা ঠাকুরের আর্শীবাদে ঘটে গেল এমনই এক মিরাক্যাল। বীজমন্ত্র শব্দ হয়ে ফিরে এল মন্ত্রের কন্ঠস্বরে। যাকে একসময় জাগতিক নখরাঘাতে হারিয়ে ফেলেছিল উত্তরণ। এ যেন আবার সন্তানের মধ্যে দিয়েই পিতার জন্মলাভ বা ফিরে আসা। খুলে গেল উত্তরণের সামনে ভবিষ্যতের পথ। সমস্ত দ্বিধার অবসান ঘটিয়ে আত্মোৎসর্গই যে আসল নিবেদন তা উপলব্ধি করল উত্তরণ।
'মন্ত্র' লেখকের এক অভাবনীয় সৃষ্টি যা পাঠককে বেঁধে রাখে ঈশ্বরের সাথে মানবতার সাথে। আগেই বলেছি জীবন এক মহাবৃত্ত আর 'মন্ত্র' তাকে সর্বোতভাবে সমর্থন করে। কোথাও মানুষ থেকে ঈশ্বর আবার ঈশ্বর থেকে মানুষে ভালোবাসার, আত্মনিবেদনের উত্তরণ ঘটে। পাঠক সমৃদ্ধ হয় এমন বহু অকল্পনীয় দৃশ্যে। পাঠকের চোখ ভরে আসে শেষ দৃশ্যে যখন ঈশ্বর চরণে আত্মোৎসর্গের পর এক গর্বিত পিতা ও তার কন্যা আত্মতৃপ্তিতে উজ্জ্বল হয়ে বেড়িয়ে আসে আশ্রমের দরজা দিয়ে ও চারদিকে শাঁখ বেজে ওঠে। যেন সমগ্র জগতসংসার মন্ত্রের শব্দোচ্চারণের উল্লাসে উন্মত্ত হয়ে বাজিয়ে চলে সেই বিজয়শঙ্খ। আর পাঠকের সাথে সৃষ্টিকর্তার স্থাপিত হয় এক অবিচ্ছেদ্য যোগসূত্র। লিখেছেন-সবর্ণা চট্টোপাধ্যায়
Like
Comment

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র