পলাশ চৌধুরী - মায়াজম

Breaking

২০ জুন, ২০২০

পলাশ চৌধুরী

ভাঙা চেয়ার






------------------------

ঠাৎ একটি ভাঙা চেয়ারের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল রায়ান।
যখনই ইভার সাথে তার ঝগড়া হয় তখনই যেন দাঁড়িয়ে থাকার জোর হারিয়ে ফেলে সে। স্বচ্ছল বোনেদি বাড়ির ছেলে রায়ান, বয়স ছোঁয়া কৈশোরে, শারীরিক কাঠামোয় কৃষ্ণলিঙ্গের বিস্ফোরিত পৌরুষ, গাঁ ভর্তি গঙ্গাগুলিতে রজনীবন্যা ডেকে আনে।
ইভা তার পাশের বাড়িতেই থাকে, গ্রামের বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে তারা। যাপন হারা শৈশব থেকে আগত অঙ্গিরা অবধি বাতাসে রিলিজ দেওয়া ফরমে তাদের নিয়মিত আয়োজন বিছানো রয়েছে। রায়ানের বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত লেগেই থাকে ইভার, ভাল লাগে তার এখানে আসতে, রাগ, অভিমান, খুনসুটি, অভিযোগ মিশিয়ে রায়ানের সাথে ঝগড়া করতেও ভাল লাগে তার, তবে সে সবই অপ্রকাশ্য, প্রকাশের লজ্জায় তারা অন্দরমহলের সৌজন্য অন্ধকার বেছে নেয়। সেদিনও ইভা এসেছিল রায়ানের কাছে খেলা করতে।
দাবার গুটির কারচুপি নিয়ে গোল বাঁধায় রাগের মাথায় ইভা রায়ানকে বলে--- আর কোনোদিন খেলব না তোর সাথে, আড়ি! আড়ি! আড়ি! রায়ান বোঝানোর চেষ্টা করে ইভাকে --- খেলার সময় ঝামেলা হয়েই যায় -- অবুঝ ইভা আর কখনও তোর সাথে খেলব না বলে রাগে গজগজ করতে করতে বাড়ির দিকে চলে গেল, আর সাথে সাথে রায়ান দূর্বল হয়ে পড়ে আরও।
রায়ানের ঠাকুরদা যখন বেঁচে ছিলেন, তখন প্রতি সন্ধ্যায় ঠাকুরদার বৈঠকখানায় আসর বসতো দাবার, রায়ান তখন ছোট, ঠাকুরদা গত হলেন, আর ইকোনমিক গ্রোথ হরমোন থেরাপির মতো রায়ান ঠাকুমার কাছে সেসব গল্প শুনতে শুনতে বড়ো হয়েছে। সেই বৈঠকখানা এখন রায়ানের পড়ার ঘর, আসর সেখানে এখনো বসে, শৈশব পেরিয়ে কৈশোরের, ঠিক কৈশোর নয় সন্ধিক্ষণে যৌবনপড়া জ্বলাকাঠ দেহখানিতে উত্তল অবতল মাপামাপি, নদীতে সেতু বিছিয়ে দেওয়ার মানসিক প্রচেষ্টা। এসবের মাঝে শ্লীলাশ্লীলাসর এখনো জমে ওঠে রায়ান আর ইভা'র। ঝকঝকে মার্বেল বিছানো ঘরের মেঝে, ফ্রেম বসানো দেওয়াল, পালিশ করা টেবিল চেয়ার। এসবের মাঝে ওই ভাঙা চেয়ারটি একদমই পছন্দের ছিল না রায়ানের। পছন্দ হোক বা না হোক ঠাকুরদার এই আরামকেদারাধাঁচের ভাঙা চেয়ারটি স্থানচ্যুত করার সাধ্যি কারও ছিল না সে'ঘরে। ঠাকুমা এখনো নিয়ম করে সকাল সন্ধ্যা সেই চেয়ারের কাছে নত হয়ে শরীর বিছিয়ে দিয়ে আসেন।
সেদিন খেলাপড়া শেষ করে ঘরে ফেরার পর থেকেই রায়ান মন মরা হয়ে বসে আছে, আর মাঝেমধ্যে পূবের জানালা দিয়ে তাকিয়ে ইভার বাড়িটিকে পর্যবেক্ষণ করছে। আর ধৈর্য নিয়ে বসে থাকতে না পেরে উঠে গিয়ে জানালার কাছে দাঁড়াতেই দেখল সাজন্ত ঝাঁউয়ের মতো করে নিজেকে সাজিয়ে ইভাও জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। নিস্তব্ধে একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকলো শুধু কিছুক্ষণ।
রায়ান এসব কথা বলতে পারে না কারো কাছে। এমনিতে ইভার পাশে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেই মা-বৌদি-ঠাকুমা মিলে তাদের বিয়ের কথা, তাদের কেমন মানাবে, তারা যে রাজজোটক, এসব গল্প শুরু করে দেন। কতবার হয়েছে এরকম, আর তারা দুজনে লজ্জায় সেখান থেকে পালিয়ে গিয়ে বাগানে গিয়ে বসেছে। বাগানে দুটি প্রজাপতিকে একসাথে উড়ে যেতে দেখলেই রায়ান ইভাকে বলে--- আমরা দুজনেও একদিন এভাবে উড়ে যাব মুক্ত পাখি হয়ে, দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরে থাকবো তুষার যুগ পর্যন্ত। তার এরকম কথা শুনে ইভা লজ্জা পায় খুব, মুখ নামিয়ে লাজুক গলায় বলে--- তুই না-- যা তা একবারে। এই কথাতে তার অসম্মতির সুর পাওয়া যায়নি কখনো বরং উৎকণ্ঠা প্রকাশ পেয়েছে আরও গোপনের।
জয়ব্রত তৃষ্ণার মারণসম দোটানায় এসব ঝিনুক কথন ভাবতে ভাবতে দিন ঢলে গিয়ে সন্ধ্যা হয়েছে। প্রতি দিনের মতো ইভা এসেছে তাদের বাড়িতে। লুকিয়ে ইভাকে আসতে দেখে আহ্লাদে আটখানা হয়ে উঠলো রায়ানের মন, ভাবলো তাহলে ইভার রাগ কমেছে নিশ্চয়, নইলে কেনই বা সে তাদের বাড়িতে আসবে!
বাড়িতে তখন রায়ানের মা রাতের খাবার বানানোর জোগাড় করছেন, ঠাকুমা ডাল থেকে কাঁকর বেছে দিচ্ছেন, বাবা টেলিভিশনে খবর দেখছেন। ইভাকে দেখে মা বললেন, --- ইভা'মা এদিকে আয় তো একবার।
ইভা মায়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে---বলো কাকিমা, এই ময়দাটা নিয়ে গিয়ে তুই আর রায়ান দুজনে মিলে মেখে দে তো মা। মূহুর্তে ময়দা ভর্তি পাত্রটা নিয়ে রায়ানের কাছে এসে বসল ইভা, ময়দায় জল ঢালতে ঢালতে বলল--- রাগ করে আছিস এখনো? যদিও রায়ানের মনে রাগের লেশ মাত্র ছিল না তবুও অভিমানের সুরে বলল --- হ্যাঁ। ইভা তার রাগ ভাঙিয়ে দেবে এটা রায়ানের বেশ পছন্দের। তেমনটাই হল, ইভা ময়দায় জল মাখাতে মাখাতে বলল, সোনা ছেলে, রাগ করে না, আর কখনো ওরম বলবো না, এই কান ধরছি, এবার তো আই, দুজনে মিলে ময়দাটা মেখে দিই। রায়ান খুশি হয়ে বসল ময়দা মাখতে, ইভা রায়ানের হাতের উপর হাত রেখেছে, রায়ান ময়দা মাখছে আর ইভা বিভোর হয়ে এক অজানা পূর্ণতায় ডুবে যাচ্ছে, যেন তার কত শতাব্দীর অপূর্ণতায় আজ অমৃত ঢেলে দিচ্ছে রায়ান।
রায়ানের মা খাবার বানিয়ে ইভাকে বলেন--- আজ তুই এখানেই খেয়ে নে ইভা। প্রথমে একটু অসম্মতি প্রকাশ করলেও দ্বিতীয় বার বলাতে রাজি হয়ে যায়। মা দুটি প্লেটে পরোটা, তরকারি, মিষ্টি সাজিয়ে টেবিলে দিয়ে বললেন ---তোরা দুজনে খেয়ে নে। ইভা ও রায়ান একে অপরের দিকে তাকালো একবার, তারপর খাওয়া শুরু করলো। একটুকরো পরোটা ছিঁড়ে ঠোঁটে ছোঁয়াতেই দুজনের শরীরে সেই অমৃতমাখা পূর্ণতা ফিরে এল আবার, মুখে নিয়ে চিবানো শুরু করতেই অচেনা কোনো উপভোগ্য অদৃশ্য সুখে ডুবে যাচ্ছে তারা, যেন রায়ান গিলে নিচ্ছে ইভাকে আর ইভা গিলে নিচ্ছে রায়ানকে এবং ছায়া ও কায়ার ঘূর্ণাবর্তের এই ঝুলন্ত রমনে তারা পূর্ণ হচ্ছে ক্রমশ। হঠাৎ ইভার মুখ দিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর হয়ে বেরিয়ে এলো উঃ! দাঁতের ব্যথার অযুহাত দিয়ে কোনোক্রমে তারা খাওয়া শেষ করে উঠে গেল।
খুব বেশি রাত না হওয়ায় ইভা ও রায়ান দুজনে গেল বৈঠকখানার ঘরে দাবা খেলতে। হঠাৎ একটা ঝোড়ো বাতাস তাদের দাবার গুটি ওলট-পালট করে দিয়ে গেল, প্রকৃতিও আজ যেন একটা দীর্ঘ দিনের আটকে থাকা একটা শ্বাস ছাড়ল তৃপ্তি ভরে। ঝোড়ো হাওয়ায় সাথে শুরু হল বৃষ্টি, বৃষ্টির সাথে বিদ্যুৎ ও মেঘের গর্জন। মেঘের গর্জনকে ভয় পায় ইভা। সে জোরে জড়িয়ে ধরলো রায়ানকে, একটা অসমাপ্ত ইচ্ছা চেতনা পেরিয়ে ধীরে ধীরে গ্রাস করছে দুটি সত্ত্বাকে। যেভাবে কোনো প্রাচীর বাতাসকে আটকে রাখতে পারে না তেমনই সংরক্ষণের সংযম আর বেঁধে রাখতে পারল না ইভা ও রায়ানকে। কৈশোরের অযান্ত্রিক দগ্ধতা তাদের কুণ্ঠিত হওয়া প্রাচীর ভেঙে দিল। ইভা রায়ানকে জিজ্ঞাসা করলো--- দাবার বোর্ডে রাণীর চাহিদার দাম কত?সাথে সাথে আরও একটা দমকা হাওয়া, আরও একবার বজ্রপাত, আর ভাঙা চেয়ারটি যান্ত্রিকভাবে ক্রমাগত দুলতে শুরু করল। সেই মূহুর্তে রায়ান উপলব্ধি করতে পারলো ঠিক কেন তার ঠাকুমা চেয়ারটা এখান থেকে সরাতে দেন না। ঠিক কেন এখানে এসে রোজ ঠাকুমা নতজানু হয়ে তার শরীর বিছিয়ে যান।


1 টি মন্তব্য:

Featured post

সোনালী মিত্র