সোনালী মিত্র

মায়াজম
2

 সম্পাদকীয়      




ঘন আহামরি বঙ্গীয়-বর্ষায় গ্রামবাংলার ভিটেমাটিতে শুধু জল আর জলের শীর্ষমন্তাজ । চৌধুরী বাড়ির আটচালার পশ্চিমমুখো পুকুর সম্মুখের বারান্দার বাঁশের আড়ায় প্রত্নগভীর জলসীমান্ত ভিজে এসে বসলো একজোড়া বাংলাবয়সী শালিক । জানলার আড়ালে অর্ধ-জানলা খুলে দেখছি তাদের চোখে অকৃত্রিম ও শাশ্বত তারাখসা বিস্ময় । ভেজা ডানা ঝাপটানির  শব্দে দুপুরের নির্জনতা আরও ঘনিষ্ঠ হল বৃষ্টির গায়ে । পরম মমতায় একে-অপরের ডানায় লেগে থাকা নোংরা আবর্জনা ঠোঁটে দিয়ে খুঁটে দিচ্ছে , এই দৃশ্যে পূর্বরাগ হোল প্রেমের । শুনতে কি পাচ্ছি তাদের মৃদুভাষণ ...


কিছু বলছে ভেবে কান খাড়া করি । কিছুই কী আর শোনা যায় চারিদিকে যন্ত্রের আর মানুষের হাতের দ্বারা নিহত প্রকৃতির মধ্যে শ্বাস নিতে নিতে প্রকৃতির শব্দ অস্পৃশ্য হয়েছে যন্ত্র শব্দের প্রাধান্যে !
বাংলার বর্ষায় বিলে-খালে জলাশয়ে ফুটে থাকা শাপলাফুল , কচুরিপানায় , আগাছায় , আউশ ধানের ক্ষেতে পোকামাকড় আর ছোটছোট মাছ খেটে আসা সাদাবক , পানকৌড়ি , ডাহুক গলা ডুবিয়ে খেতে -খেতে কবিকে চাষিকে যে দৃশ্যর জন্ম দিয়ে যেত , সেইসব দৃশ্য হারিয়ে গেল তবে কোন গভীর ষড়যন্ত্রে !
অর্ধভেজা উঠোনে সূর্যের রঙে টুনটুনি , চড়াই , ফিঙ্গে , মায়ের সিদ্ধধান শুকোতে দেওয়া ধান ঠোঁটে -ঠোঁটে তুলে নিয়ে লিখে রাখত জীবনের বাস্তুতন্ত্র ! এখন কোনদেশে আছে তারা ? ভালা আছে ? কোন ছোট্ট মেয়ে উঠোন থেকে তাদের তারিয়ে বেড়াই সারাবেলা ?
সেই রাজঘুঘু ? বাস্তুঘুঘু ? ক্লান্ত দুপুর নিরবচ্ছিন্ন ডেকে যেত কোন সে সুখের আড়ম্বরে ? পুকুরপাড়ে ছাই আর বটি নিয়ে কাটতে বসা বধূর চ্যাঙ , সিঙ্গি , মাগুর মাছ , আর সন্ধানী শিকারির মত ছোঁ মেরে তুলে নিত যখন চিল বা দাঁড়কাক , হতভম্ব বধূ খানিক দৌড়ে গিয়ে অভিসম্পাত দিতেন , বধূটি আজ কাকে অভিসম্পাত দেবেন ?
ইষ্টিকুটুম , ইষ্টিকুটুম ... ও- লো বউ , কে আসবে আজ আত্মীয় কে জানে ! দু'মুঠো চাল বেশি নে চাপিয়ে , ... আঃ মোল ! ঘরে চাল বারন্তি ! নারায়ণ কবে যে বুঝবেন !
''বউ কথা কও , বউ কথা কও ! '' না ভাই বউ কথা , বউ আজ কথা কইবে না । চৈত্রের নির্জন দুপুরে মাটির দাওয়ায় কোলের শিশুটি নিয়ে শুয়ে আছে ফতেমা , মরদ চার মাস বাইরে , বউ কথা কইবে না , যা যা তোর মরণ নেই ! এই কথা আর বলবে না বাংলা কোন পাখিকে দেখে ।
গাঢ় সবুজ টিয়া নারকেল গাছে । সারাদিন উড়ে যায় , ফিরে আসে , বসে , কৃষ্ণকথা বলে । প্রকৃতির সবুজ যেন তাকে ঈশ্বর উপঢৌকন পাঠিয়েছিলেন ভেবে টিয়া শিশুঈশ্বরের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে এসেছিল গাছে - গাছে , হাতের নাগালে ।
দেশে , বসন্তের পরে বসন্ত আসে । নব্যকবি-রা খাতা খুলে বসে কোকিলের সুরে লিখবেন বলে বসন্তকাব্যবাহার , কাছের বাঁশগাছে উড়ে এসে বসে না পাখি , নিমগাছ ঠাই ডালপালা অধিগ্রহণ করে তাকে যতই নিমন্ত্রণ পাঠাক না কেন আজ ...

সেই বর্ষার সুর মুছতে মুছতে মেঘের ভেলায় এলি মা লাবণী! এলি, এলি মা শবক্তানী?' কে কার মধ্যে এসে মিশে  যাচ্ছে ? কেনই বা মানুষ ডাকেন ? ঘুণপোকা টাইপের ব্যাপার হল যাওয়া বা থাকা  বিষয়ক শব্দ । মনে করুন বাঁশের - মুলিবাঁশের বেড়া বেঢপ দৃষ্টিকলুষিত ভঙ্গীতে ঠাই বৃষ্টির সাথে ক্ষমতার লড়াইয়ে ব্যস্ত । আর সেই ফাঁপরে উইপোকা ভস্মজ্ঞানে বেড়া  মাটি করে দিচ্ছে , দিচ্ছে , দিচ্ছিল দেবে ও বা । ধপাস পতনের  শব্দ উঠল । ঘরের ছেলেটি ঝুপ করে টসে যাওয়া বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখল মাথালি মাথায় বাপধন দা- নিয়ে কুপিয়ে - কুপিয়ে কাটছে আস্ত বাঁশের ঝাঁর-মূল । আসলেই কি একটা যাওয়ার প্রয়োজন হয় আর একটা আগমনের জন্য ? এই এক একটি আগমনের মধ্যে দিয়েই উৎসবের সূচনা !  যারা চাষাবাদ করেন তারা  জানেন  , ফসলের নিমিত্তে একটা বীজই যথেষ্ট । একটা বীজের মধ্যেই পৃথিবীর প্রথম সমস্ত সৃষ্টির  আগমনের গল্প লুকিয়ে ছিল । আজ আর বিসর্জন গল্প নয় । আগে আগমন , আগমনকে বিশেষণে যুক্ত করতেই আনন্দের উৎপাদন । আগমন উৎপাদনশীল একটা অবস্থান । যেখানে বর্তমানের সমস্ত আকাঙ্ক্ষা গুপ্তবিদ্যার মতো অদৃশ্য থাকে । দেখা যায় না , অনুভব করা যায় না । 
#

##

আটচালায় সেজে উঠেছেন দেবী, অভয় রূপকে অস্ত্রে সজ্জিত করছে পটুয়ার সন্তান। নবা মিত্তিরের মেয়েটা কোলেকাঁখে ছেলে নিয়ে বাপের ঘরে ফিরলো।বর্ষার শেষে মায়ের মনে শরতানন্দ।আয় বুকে আয় মা রে।
 ঝড়েজলে ধুয়ে এগিয়ে চলেছি আলোর দিকে। ঠিক এই মুক্তির আলোকের বঙ্গ মুহূর্তে মায়াজম প্রকাশ হচ্ছে এবার । বিগত সংখার চেয়ে এই সংখ্য কলেবরে বৃদ্ধি পেয়েছে যেমন , তেমন এসেছে নতুন কিছু বিভাগ । এতদিন যেভাবে আপনারা সাথে থেকে মায়াজমকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছেন , তাতে সকলের কাছে কৃতজ্ঞ , এভাবেই পাশে থাকুন , সুন্দর থাকুন , মন সুস্থ থাকুক । সকলকে ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা ... 

                                                                  সোনালী মিত্র 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন