সন্মাত্রানন্দ

মায়াজম
6

              বৃষ্টি নামুক  





বিকেল হয়ে আসছে। ছায়া ঘন হচ্ছে। আকাশ দিয়ে উড়ে যাওয়া সবুজ পাখিদের টিহিটি টিহিটি ডাক। ঘরের সামনে পান্থপাদপ গাছটির দীর্ঘ ছায়া অমোঘ সঙ্কেতে নেমে আসছে ভূস্পর্শমুদ্রায়। 

টিলার উপর নির্জন এই ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কবি দেখলেন, গেট পেরিয়ে সুঁড়ি পথ বেয়ে উঠে আসছে মেয়েটি। ধূপছায়া রঙের শাড়ি পরেছে সে। তার হাঁটার ছন্দে ব্যাকুলতা আছে। আছে হয়তো বা অভিসারিণীর গোপনীয়তাও। দূর থেকে কবিকে দেখে সে হাসল বালিকার ন্যায়। 

এ পাহাড়ি এলাকায় আরণ্যক পরিবেশে কবি একাই থাকেন। জনরোল থেকে তিনি পালিয়ে এসেছিলেন বহু বছর আগে। সে সময় তিনি অতি আলোচিত একটি নাম। তাঁর লেখা প্রকাশিত হচ্ছে শীর্ষপত্রিকায়। বেশ কয়েকটি কবিতার বই তখন ঝড় তুলেছে লোকমানসে। পুরস্কার পেয়েছেন একাধিক। এমন একটা জাগতিক উজ্জ্বলতার ভিতর দাঁড়িয়ে তাঁর মনে হয়েছিল, তিনি কেবল আত্মপরিক্রমা করে চলেছেন। শব্দরা লেখার খাতায় নিভে আসছে মুমূর্ষু জোনাকির মতো। আর তখনই আলোর বলয় ছেড়ে তিনি চলে এসেছিলেন এই অজ্ঞাতবাসে। শুধু লিখবার জন্য। 

এখানে থাকতে থাকতে মেয়েটির সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। বন্ধুত্ব, স্নেহমায়া, প্রেম। মেয়েটি রোজ আসে বিকেলে। কবির মুখোমুখি চেয়ারে বসে বারান্দায়। ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে কবিকে দেয়। নিজেও পান করে। বাঁকা রোদ এসে পড়ে তার শাড়ির পাড়ে ঢাকা পায়ের উপর। কতো কথা ভ্রমরের মতো খেলা করে দুজনের ঠোঁটে। কখনও নীরবতা নামে। কবি চেয়ে থাকেন মেয়েটির কাজলপরা চোখের দিকে। ঠোঁটের দিকে। গলার খালি জায়গাটার দিকে। বুকের দিকে। কখনও কবি ও মেয়েটি আঙুল ছোঁয়াছুঁয়ির খেলা খেলে। কখনও অকারণ অশ্রু নামে। কখনও শ্বাসের গভীরে অস্ফুট ভালোবাসার উচ্চারণ আধোস্তিমিত আলোর বাগান পেরিয়ে ধূপের ধোঁয়ার মতো সাঁঝতারার দিকে উড়ে যায়। 

সন্ধ্যা হলে মেয়েটি ফিরে যায়। কবি তাকে কখনও থেকে যেতে বলেন। কিন্তু মেয়েটি এখনও কবির সঙ্গে রাত্রিবাস করেনি। 

মেয়েটি চলে গেলে ঘরে ঢুকে কবি মৃদুবিষণ্ণ আলো জ্বালেন। লেখার টেবিলে বসে মেয়েটির কথা চুপচাপ তাঁর মনে পড়ে। ঠোঁট, চিবুক, চোখ। কপালের কাছে এসে ছবিটা ঝাপসা হয়ে আসে। তার জায়গায় ফুটে উঠতে থাকে যেন অন্য একটি মেয়ের ছবি। 

এই অন্য মেয়েটিকে তিনি দেখেছিলেন স্বপ্নে। স্বপ্নটা বারবার দেখেন। ফিরে ফিরে আসে। এই স্বপ্নটিই তিনি এখন লিখে রাখছেন। 

বারোশো বছর আগের সে এক দূরধূসর কাল। মেয়েটির নাম ময়ূরাক্ষী...সে কৈশোরে মূর্তিবিদ্যা শিক্ষা করিয়াছিল। তাহার গাত্রবর্ণ উজ্জ্বল শ্যাম, নয়নদ্বয় আয়ত, ওষ্ঠাধর স্ফুরিত, ভ্রূবিলাস সে জানে না। কেশদাম বন্ধন করিলে মেঘকলাপ গগনে সম্বৃত হইয়া থাকিত, উন্মুক্ত করিলে শ্রোণীদেশের ঢাল বাহিয়া মেঘগলিত নবাম্বুধারা নামিয়া আসিত। সে নিজেই যেন ছিল মহাকাল মন্দিরের এক যক্ষিণীমূর্তি। তথাপি, সে মূর্তি গড়িত। 

পুরুষ ভাস্করগণ অনাবৃত নাারীশরীর সম্মুখে দেখিয়া মূর্তিগঠনের শিক্ষা পাইত; কিন্তু নারীর জন্য সে যুগে সে সুযোগ ছিল না। নারীগণ সর্বদা নারীমূর্তিই গড়িত। পুরুষমূর্তি গড়িত না। ময়ূরাক্ষীও এইভাবেই শিখিয়াছিল। কিন্তু পুরুষমূর্তি নির্মাণ করিবার জন্য তাহার মন সর্বদা চঞ্চল হইয়া থাকিত। সে বিবাহ করে নাই, অন্যবিধ পুরুষ-সংসর্গও হয় নাই; পুরুষের সঙ্গুপ্ত অঙ্গ-অবয়ব কেমন, তাহা সে জানিত না। 

সুমনা নাম্নী একটি মাতৃহীনা বালিকা ময়ূরাক্ষীর নিকট ভাস্কর্য শিক্ষা করিতে আসিত। ময়ূরী অনেক যত্ন করিয়া সুমনাকে শিক্ষা দিতেছিল। বালিকা সমস্ত দিনমান ময়ূরাক্ষীর গৃহেই পড়িয়া থাকিত। ময়ূরাক্ষী তাহাকে নাওয়াইয়া খাওয়াইয়া সমস্ত দিন ধরিয়া আম্রতরুতলে মূর্তি গড়িতে শিখাইত, ক্লান্ত হইলে কন্যাকে গৃহে লইয়া শয্যায় শোয়াইয়া নিজ বাহুর উপর সুমনার শিরোদেশ স্থাপন করিয়া গান গাহিয়া ঘুম পাড়াইত। 

বেলা পড়িয়া আসিত। আলো কমিয়া আসিলে গৃহাঙ্গন হইতে ডাক আসিত, সুমনে-এ-এ! 

ময়ূরী শয্যার উপর ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিত। সুমনার পিতা ধীরশ্রাবক কন্যাকে গৃহে লইবার জন্য আসিয়াছেন। 

আপনারা কেন সর্বদাই নারীমূর্তি রচনা করেন? 

ময়ূরাক্ষী বলিত,  সমাজের নিষেধাজ্ঞা আছে। 

নিষেধ ভাঙিতে ইচ্ছা হয় না? 

ভাঙিলেও জ্ঞান নাই। 

কীসের জ্ঞান? 

পুরুষ দেহের। 

ইহা আহরণ করা অসম্ভব নহে। 

ধীরশ্রাবক কথা দিয়াছিল। ভাস্কর ময়ূরাক্ষীর সম্মুখে অনাবৃত হইতে তাহার দ্বিধা হয় নাই। ময়ূরাক্ষী শিল্পের নিমিত্ত পুরুষদেহের সকলই জানিয়াছিল। অতি যত্নে সে ধীরশ্রাবকের মূর্তি গড়িয়াছিল। 

তাহার পর জীবনের নিমিত্ত পুরুষশরীরও সে প্রথমবার জানিল। তাহার উত্তুঙ্গ স্তন ধীরশ্রাবকের প্রস্তরকঠিন বক্ষে বিমর্দিত করিয়া, উদার বাহুবন্ধনে বেপথুমান পক্ষীশাবকের ন্যায় ধরা দিয়া সে জীবনকে জানিল। বিপরীত রতিক্রীড়ায় বিজয়িনী হইয়া শিখিল, প্রাণ কাহাকে বলে। সে পুরুষ জানিল; সুকঠিন স্কন্ধ, উদার বাহু, আয়ত রোমশ বক্ষপট, জঙ্ঘা, শিশ্ন, শীৎকার, গর্জন, উচ্ছ্বাস ও এসকল কঠিনতার আড়ম্বরের ভিতর প্রেমিক পুরুষের প্রণয়কোমল সুগভীর আলোড়িত আবেগ ---- ময়ূরাক্ষী সকলই জানিল। 

কিন্তু এই জানিবার এক চূড়ান্ত মুহূর্তে ময়ূরাক্ষীর মনে এক বিচিত্র কৌতূহল উদিত হইল। মনে হইল, তাহাকে এইরূপে পাইয়া ধীরশ্রাবকের কেমন লাগিতেছে। নারীর দৃষ্টিতে পুরুষ কেমন, তাহা তো জানিলাম। কিন্তু পুরুষের দৃষ্টিতে নারী কেমন, তাহা তো জানা হইল না! 

ধীরশ্রাবককে সে এই কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছিল। কিন্তু ধীরশ্রাবক আবেগতপ্ত ভাষায় যাহা বলিল, সেসব কথা যেকোনো সংস্কৃত কাব্যেই পাওয়া যায়। সেই তিলফুল নাসা, খঞ্জননিন্দিত নয়ন, মরালগ্রীবা, কনকঘটবৎ কুচকুসুম, করিশুণ্ডবৎ জঘন--সেই এক পুনরাবৃত্তি---ইহাতে ময়ূরীর তৃপ্তি হইল না। 

রতিক্লান্ত দশায় একদিন ময়ূরাক্ষী আবিষ্ট স্বরে বলিল, প্রিয়তম! আমি যদি পুরুষ হইতাম, তুমি যদি নারী হইতে, তাহা হইলে আমার তৃপ্তি হইত। 

ধীরশ্রাবক বলিল, বেশ তাহাই হইবে। তোমাকে তৃপ্ত করিয়াই আমার সুখ, ময়ূরী। চলো রাত ভোর হল... 

এর পর ময়ূরী কী বলেছিল, কী হয়েছিল, কবি আর তা দেখতে পান না; স্বপ্নটা বারবার এখানে এসে ভেঙে যায়। যেন একটা অসমাপ্ত উপন্যাস। অথবা তা লিখিতই হয়ে আছে কোথাও, কিন্তু কী লেখা আছে এখনও তা জানা হয়নি। 

কবির হঠাৎ মনে পড়ল, মেয়েটি আজ বিকেলে হাসতে হাসতে বলছিল, যদি কাল সন্ধেয় ঝড় ওঠে, যদি বৃষ্টি নামে,যদি মেঘে মেঘে বিদ্যুৎ চমকায়,
তবে কাল আর সে ঘরে ফিরবে না, কবির কুটিরে থেকে যাবে। 

কবি লেখার মার্জিনে বারবার লিখছিলেন:

বৃষ্টি নামুক, বৃষ্টি নামুক...

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

6মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

  1. আশ্চর্য সুন্দর ! শব্দের ভাস্কর্য যেন ! ❤️

    উত্তরমুছুন
  2. খুব সুন্দর। কিন্তু কেমন একটা অসমাপ্তির রেশ থেকে গেল।

    উত্তরমুছুন
  3. যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো, এরকম দোলাচল আছে এই লেখা জুড়ে।

    উত্তরমুছুন
  4. লেখকের কাছে অনুরোধ, লেখাটির পাশে আরেকবার বসুন। টান ছিল। কিন্তু শেষ পর্যায়ে এসে...

    উত্তরমুছুন
  5. এক অচিন আলোয় আবছা আদল স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে...প্রতীয়মান হয় দূরের সে পথ, যেপথে চলে গেছে মোহের অসম্পূর্ণ যতিচিহ্নরা, লেখাটিকে একা ফেলে রেখে...তবুও সে লেখার অন্তিমে জাগরুক উদ্ভাসে যে ঋণ রয়ে গেল, যে অফেরতযোগ্যের সঙ্গত, তাকে উপেক্ষা করার ধৃষ্টতা জাগেনি এ পাঠস্পর্শে।

    উত্তরমুছুন
  6. এই কল্পকাহিনি যদি বাস্তবে হত !! শুভ ষষ্ঠী মহারাজ 🌷

    উত্তরমুছুন
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন