উত্তম দত্ত

মায়াজম
1

 সালিম আলির চড়ুই পাখি ও আমাদের প্রণয়গাথা





বালকবয়সে গল্প-উপন্যাসের চাইতে আমাকে আকৃষ্ট করত জিম করবেট ও সালিম আলির লেখা। আহা, সেই বাইক, বন্দুক, এয়ারগান, ম্যান-ইটার আর অজস্র পাখির জগৎ আর কখনো ফিরে পাব না। সেই বিহঙ্গ-ভুবন থেকে নির্বাসিত আমি মাঝে মাঝে খুলে বসি সালিম আলির বইগুলি। প্রিয় বন্ধুদের তোলা পাখিদের বিচিত্র রূপময় ছবি দেখে মুগ্ধ হই।

সালিম আলি বিশ্ব-বিশ্রুত পক্ষীতত্ত্ববিদ। পদ্মভূষণ পেয়েছেন। সেই শৈশবেই ভারতীয় পাখিদের সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। সেই সঙ্গে মাথার ভিতরে বুনে দিয়েছিলেন সাড়ে তিনশ ও ৫০০ সি সি-র ভারী  বাইক চালানোর নেশা। 

তিন বছর বয়সে বাবা-মাকে হারিয়ে মামার বাড়িতে আশ্রয় পান তিনি। অজস্র পাখপাখালির মধ্যেই তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন এক নতুন স্বর্গের ঠিকানা। সেই বালকবয়স থেকেই নিয়মিত ডায়েরি লিখতেন তিনি। সাদা পৃষ্ঠায় লিখে রাখতেন পাখিদের বিচিত্র চরিত্রের কথা। 

সালিম আলির বয়স তখন ১০ কী ১১। সদ্য হাতে পেয়েছেন একটি এয়ারগান, যা ওই বয়সের অধিকাংশ বালকের স্বপ্ন। একদিন তিনি তাঁর ডায়েরিতে লিখেছিলেন চড়াই বা চড়ুইপাখির অদ্ভুত স্বভাবের কথা :

"১৯০৬/০৭ সাল। 
বাইরে পুরুষ চড়াইটি কাঠের গোঁজে বসে আছে। গর্তের প্রবেশপথের প্রায় মুখে। ভেতরে স্ত্রী চড়াই ডিমে তা দিতে বসেছে। আস্তাবলের কাছে একটি ঘোড়ার গাড়ির পেছনে নিজেকে আড়াল ক’রে অতর্কিতে আমি তাদের উপর আক্রমণ করলাম। পুরুষ চড়াইটা গুলি খেয়ে মরল। কিছুক্ষণ যেতে না যেতে দেখি মেয়েটি এক ফাঁকে আরেকটি পুরুষ-চড়াই জুটিয়ে এনেছে। সেও বাইরের গোঁজটাতে ভর দিয়ে ‘পাহারা’য় বসে গেছে। এই মরদটিকেও আমি ঘায়েল করলাম। চোখের পলকে দেখি মেয়েটি আবার এক মরদ এনে হুজুরে হাজির করেছে। পরের সাত দিনে ঐ একই দাঁড়ে-বসা গুটি আষ্টেক পুরুষ চড়াইকে আমি সাবাড় করি।...’

এই ঘায়েল হওয়াই প্রেমিক-পুরুষের নিয়তি। মোহগ্রস্ত প্রেমিকা নারীরও নেমেসিস। ঘটনাটি যেন প্রতীকী। 

'দ্য ফল অফ আ স্প্যারো' নামক আত্মজীবনীতে 'বার্ডম্যান অফ ইন্ডিয়া' সালিম আলি মেয়ে-চড়ুইপাখিদের যে আশ্চর্য স্বভাবের কথা লিখেছিলেন তা জেনে চমকে গিয়েছিলাম আমি। শোকশূন্য, বিরহবোধশূন্য, মমতাশূন্য এই সম্পর্ককে কিছুতেই মেনে নিতে পারতাম না। 

যৌনতার ফাঁদ পেতে ধরে আনা পুরুষপাখিটি কি নিছক এক প্রহরী? নিতান্তই এক সাময়িক যৌনসঙ্গী? তার মৃত্যু ও রক্তাক্ত শরীর নারী পাখিটিকে একটা গোটা দিনও বিচলিত করে না? আদিকবি বাল্মীকির দেখা ক্রৌঞ্চমিথুনের একটির মৃত্যুতে অন্যটির আর্তনাদের মিথ থেকে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে উঠে আসা সেই শ্লোক কি তাহলে মিথ্যা?

স্মৃতিহীন, মনোহীন এই পাশাপাশি বসে থাকা ও যৌন-সহবাস আমাকে বিষণ্ণ এক অভিজ্ঞতার জগতে পৌঁছে দিয়েছিল নবীন কৈশোরে। 

তারাশঙ্করের 'কালাপাহাড়' যাঁরা পড়েছেন তাঁরা জানেন দুটি পুরুষ পশুর অসামান্য বন্ধুত্বের কথা। কুম্ভকর্ণ নামক মহিষটি বাঘের কামড়ে মারা গেলে কালাপাহাড় শোকে দুঃখে আর বিরহে উন্মত্ত ও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। লেখকের সংবেদনশীল চোখ পশুর মধ্যে আবিষ্কার করেছে বিরল কিছু মানবিক গুণ।

অনেক পশুর মধ্যেই এই বিরহবোধ লক্ষ করেছি। কিছু কিছু পাখির মধ্যেও। প্রবাদ আছে, মাছের মায়ের পুত্রশোক নেই। নেই অনেক ইতর প্রাণী ও কীট-পতঙ্গেরও। ভাগ্যিস নেই। অসীম ও মর্মান্তিক মনোদহন থেকে মুক্তি পেয়েছে তারা। শুধু শরীর রক্ষা করতেই যন্ত্রণার শেষ নেই। সেইসঙ্গে মনের কষ্ট যোগ হলে তাদের অবস্থা কিছু কিছু সংবেদনশীল মানুষের মতোই করুণ হয়ে উঠত। 

তবে ইদানীং কিছু কিছু মানুষও মনোহীনতা এবং বিবেকশূন্যতার সাধনায় ডুবে যাচ্ছে। আগেও হয়ত ছিল এই প্রবণতা। কিন্তু বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে এখন সম্পর্ক গড়তেও সময় লাগে না, ভেঙে ফেলতেও দ্বিধা বা দহন জাগে না। সামান্যতম অজুহাতে একটা সম্পর্ককে গলা টিপে খুন করে পরদিনই অন্য একটা সম্পর্কে ঢুকে কত সহজেই জামাকাপড় খুলে ফেলছে মানুষ। 

সালিম আলি শুধু মেয়ে চড়ুইটির যৌন-ম্যাজিকের কথা উল্লেখ করেছেন। পুরুষ চড়ুইগুলির স্বাভাবিক প্রাকৃতিক যৌন অনাচারও তথৈবচ। যে আটটি চড়ুইয়ের নাটকীয় আবির্ভাবের কথা লেখা হয়েছে ওই ডায়েরিতে তারাও নিশ্চয়ই ইতোপূর্বে অন্য কোনো যুবতী চড়ুইয়ের অনুগত প্রহরী ও যৌনসঙ্গী হিসেবে কাজ করে তৃপ্ত হয়েছিল।

আমার চেনা একটি মেয়ের ছবির দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম, তার প্রথম প্রেমিক যখন তরুণ বয়সে মারা যায় তখন অর্ধেক কলকাতা শহর বিপন্ন হয়ে পড়েছিল শোকে। এর কয়েক মাস পরেই সে বিয়ে করে অন্য এক তরুণকে। বছর খানেক পরেই সেই সম্পর্ক থেকে সরে এসে এখন অন্য এক পুরুষের সঙ্গে বসবাস করছে। 

একটি মেয়ে নিজের স্বামী সংসার ও সন্তান লুকিয়ে এক সীমান্ত জেলা থেকে অন্য এক সীমান্ত জেলায় এসে একটি তরুণের সঙ্গে দু রাত্রি বসবাস করে গেল। ফিরে গিয়ে বন্ধুদের বলল, ভালোবাসি বলে কারো যৌনরোগ নিতে পারব না। 

পুরুষের বিরুদ্ধে চিরকালই যৌন অনাচারের ও লাম্পট্যের অভিযোগ রয়েছে। নারীরাও এখন বহু শতাব্দীর অবদমিত তৃষ্ণার স্বাক্ষর রাখছে নির্দ্বিধায়, নিঃসঙ্কোচে। এ যেন প্রকৃতির প্রতিশোধ।

প্রকৃতি শূন্যস্থান পছন্দ করে না। গরম বাতাস উপরে  উঠে গেলে ঠান্ডা বাতাস মুহূর্তে ছুটে এসে সেই ফাঁকা জায়গার দখল নেয়। মানুষের হৃদয়ও শূন্যস্থান পছন্দ করে না। যৌনতৃষ্ণাও নিঃসঙ্গতা পছন্দ করে না। 

আমরা যার জন্য কাব্যিক বিরহ বোধ করি তার সঙ্গে সংসার করি না। যার সঙ্গে সংসার করি তাকে আছাড়ি-পিছাড়ি করে ভালোবাসি না। আর যাকে ভালোবাসি বলে মনে করি তার প্রেমিক বা প্রেমিকা-জীবনের আয়ু নিতান্তই ক্ষীণ। 

এখন প্রেমে ও মানবিক সম্পর্কে যেন চিরন্তনতা বলে কিছু নেই। কাউকে ছেড়ে যেতে খুব বড় কিছু কারণ লাগে না, ব্যথাও লাগে না। সামান্য অজুহাতই যথেষ্ট। স্বার্থ বা ব্যবহারযোগ্যতা না থাকলে প্রেমাস্পদ হিসেবে তোমার আর কোনো মূল্য নেই।

 এখন প্রায় সকলেই বড় চতুর। স্বামী বা স্ত্রী নামক শালগ্রামশিলা অথবা প্রেমিক বা প্রেমিকা নামক মূর্খটির আড়ালে সকলেই অন্যত্র ছিপ ফেলছে। আর সোশ্যাল মিডিয়া হল সেই বিশাল দিঘি যেখানে ছিপ ফেললেই সস্তায় এবং অক্লেশে ভেজে খেয়ে ফেলার মতো গাপ্পি বা তেলাপিয়া মাছ পাওয়া যায়। 

কোনো সাধনার প্রয়োজন নেই, আত্মত্যাগের প্রয়োজন নেই, কোনো দীর্ঘস্থায়ী সংকল্প নেই, বিরহের অশ্রুপাত নেই, যন্ত্রণাক্লিষ্ট অপেক্ষা নেই। কেবল একটু চতুর কথাবার্তা বলতে পারলেই হয়। একটু ধার করা স্মার্টনেস আর সস্তা সেন্স অব হিউমার থাকলেই যথেষ্ট। 

প্রথমে বন্ধুত্বের আবেদন। তারপর সিমপ্যাথি-থেরাপি। তারপর একদিন ব্লাইন্ড ডেটিং। দুদিন আড্ডা, সেলফি, বই বিনিময়, সস্তা কবিতা লেখা, বইমেলায় পাশাপাশি হাঁটা, গান গাওয়া, চারুকলায় যাওয়া, মফসসলের মেলায় বা অরণ্যে কিংবা সমুদ্রতীরে বেড়াতে যাওয়া, রেস্তোরাঁয় কফি, খাদ্য ও মদ্যপান করা, সম্ভবস্থলে  দু একবার সঙ্গম করা। নিদেন পক্ষে কয়েকবার হাগ কিংবা কিস টিস। ব্যস, যথেষ্ট। তবু কিছু মানুষ এক মুঠো বিশুদ্ধ প্রেমের জন্য এখনও আয়ুক্ষয় করে এবং অবশেষে নিভৃতে বিলাপ করে :
'অনেক মুহূর্ত আমি করেছি ক্ষয়
করে ফেলে বুঝছি সময়
যদিও অনন্ত, তবু প্রেম সে অনন্ত নিয়ে নয়।'

তারপরেই দায়দায়িত্বহীন সম্পর্কের ছেদ ঘটানোর জন্য অজুহাত খুঁজে বেড়ানো। এবং নিজেকে বলা : ' ও মন, নতুন দেশে যাবি?'

বুদ্ধদেব বসু ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে একদা লিখেছিলেন :

" তুমি মোরে দিয়েছ কামনা অন্ধকার অমারাত্রি সম
তাহে আমি গড়িয়াছি প্রেম মিলাইয়া স্বপ্নসুধা মম।"

সে বড় দীর্ঘ পরিশ্রমের ব্যাপার। দীর্ঘ আত্মত্যাগ ও সাধনার ফল। ওসব পরিশীলনের মতো পর্যাপ্ত সময় আমাদের হাতে নেই। আমাদের এক জীবনে অনেক খুদ কুঁড়ো চাই। আমরা কুড়োতে এসেছি, দিতে নয়। 

আমরা সাবিত্রী সত্যবান মার্কা জীবন চাই না। রোমিও জুলিয়েট হয়ে বেঘোরে মরতে চাই না। আমরা সালিম আলির চড়ুই হতে চাই। আমাদের আজ একটা কাল একটা যৌন-খেলনা চাই। 

আমাদের স্বর্গ নেই, সোশ্যাল মিডিয়া আছে। আমাদের মেঘদূত নেই, চাইনিজ টয় আছে... ইউজ এণ্ড থ্রো। প্রেম ট্রেম এখন টয়লেটের টিসুপেপারের মতো। নিছক দুদিনের ফান করার জন্যেও সেক্স করা যায়। তাতে নারীর শরীরের বা মনের ভার্জিনিটি নষ্ট হয় না। পুরুষও কৌমার্য হারায় না। 

 আমাদের প্রেম নেই, ভালোবাসা নেই, ভাইরাস আছে। লোককথায় বলে, প্রেম এক শাশ্বত স্বর্গীয় অনুভূতি। আর ভাইরাস আজ আছে কাল নেই। সোয়াইন ফ্লুর মতো। স্টুপিড ডিজিজ। 

আমাদের জীবন একটা কুড়িয়ে পাওয়া আধুলি। আদর্শ ফাদর্শ কিংবা সততা ফততা মূর্খের অভিধানে লেখা থাকে। এক মোহিনী কালবেলায় আমরা দশহাতে লুটে পুটে খেতে এসেছি। একে ধাক্কা মেরে, ওকে লেঙ্গি মেরে, তাকে চিট করে আমরা সবার আগে সবাই একটা পোকায় কাটা স্বর্গে যেতে চাই। 

আমরা অনেকেই আসলে সালিম আলির দেখা সেই মনোহীন, বিবেকশূন্য, যৌন-ক্ষুৎ-কাতর চড়ুইপাখির সুসভ্য মনুষ্য-সংস্করণ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

  1. সেলিম আলি'র কোনো বই'এর নাম এবং কোথায় পাবো জানালে ভালো হয় । খুব খাঁটি কথা। বর্তমানে সম্পর্ক যে কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে তা খুব সুন্দর ভাবে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন ।

    উত্তরমুছুন
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন