সমবৃত্ত
একসময় আমি তোমাকে খুব ঈর্ষা করতাম, জানো সুপ্তিদি?
কেন রে? ঈর্ষা করার মতো আমার তো কিছু ছিল না!
ছিল, ছিল। পরে বলব কখনও।
হাতে তো সময় আছে। এখন বল। আমার আবার বেশি অপেক্ষা করতে ভালো লাগে না। মুচকি হেসে বলে সুপ্তি।
কোনও জবাব দেয় না সোহিনী। শুধু সামান্য পাশ ফেরে। বোঝা যায় সে সুপ্তিকে আড়চোখে একবার দেখে নিল। তারপর অল্প সময় অপেক্ষা করে বলল তার ঈর্ষার কারণ। সুপ্তি শুধু শুনে গেছে। কোনও জবাব দেয়নি। জবাব দেওয়ার কিছু ছিলও না। সোহিনীর কথাগুলো গাড়ির বন্ধ কাচের মধ্যে যেন ভেসে বেড়াচ্ছে।
তোমাদের ডিভোর্সের খবর শুনে খুব কেঁদেছিলাম। তখন মনে হত, সাত্যকি আমাকে বিয়ে করলে এই দিনটা ওকে দেখতে হত না! তোমার বিয়ের দিনের কথা মনে পড়ছিল। ওই জায়গাটায় তোমার বদলে আমার থাকার কথা ছিল। ঐরকম ডিপ লাল বেনারসি পরে…
গাড়ির কালো কাচ ভেদ করে সুপ্তির দৃষ্টি বাইরে। ছুটে-চলা গাড়ির বিপরীত দিকে একে একে মানুষজন, গাছপালা, গাড়ি, ঘরবাড়ি, দোকানপাট চলে যাচ্ছে। সুপ্তি সেসবের কিছুই দেখছে না। দৃষ্টি পেতে রেখেছে শুধু চলমান দৃশ্যের ওপর। একসময় জানালা থেকে চোখ সরিয়ে আনে সোহিনীর দিকে। অবাক হয়ে ভাবে, গাড়ি চালাতে চালাতেই এসব কথা কী অবলীলায় বলে গেল মেয়েটা! মাঝে দু-একবার পিছন ফিরে তাকে দেখেছিল, সুপ্তি বুঝতে পারলেও চোখ ফেরায়নি তার দিকে। বাইরে তাকিয়েই সব শুনে গেছে।
আর কতটা পথ রে? সোহিনীর ঘাড়ে এসে থমকে-থাকা চুলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে সুপ্তি। ভেতরে কেমন যেন গুমোট ভাব। গাড়ি চলার শব্দ ছাড়াও বাইরের শব্দও ভেসে আসছে। তবু কেমন যেন নিস্তব্ধ লাগছে ভেতরটা। সেই অসহ্য নিস্তব্ধতা ভাঙতেই যেন সুপ্তি প্রশ্নটা করল।
গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার পরেই প্লেয়ারে গান চালিয়ে দিয়েছিল সোহিনী। সুপ্তি দেখেছিল লাল রঙের একটা পেন ড্রাইভ গোঁজা। কিশোর কুমার গাইছিলেন ‘ভিগি ভিগি রাঁতো মে...’। গানটা কয়েক লাইন এগোনোর পরে ঈর্ষা করার প্রসঙ্গটা তুলেছিল সোহিনী। চোখ-মুখ থেকে গড়িয়ে নামছিল বিষণ্ণ হাসি। সুপ্তি তখনই শুনতে চাওয়ায় গান বন্ধ করে দিয়েছিল সে। হয়তো ভেবেছিল তার কথাগুলো বাধাবন্ধহীন ভাবে শোনাতে হবে। কোনও ব্যাঘাত যাতে না-ঘটে! ব্যাঘাত ঘটেওনি। কেননা সুপ্তি মাঝে একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি। একবার সিগন্যালে গাড়ি দাঁড়ালে সোহিনী পিছন ফিরে জিজ্ঞাসা করেছিল, তুমি কি আমার কথা শুনে রাগ করছ সুপ্তিদি?
ওপরের ঠোঁট দিয়ে নীচের ঠোঁট চেপে, দুদিকে মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিল, রাগ করেনি সে। এছাড়া আর কীই-বা প্রতিক্রিয়া দেওয়ার ছিল! চুপ করে সিগন্যাল পোস্টের সবুজ আলোর সংখ্যা গুনছিল সুপ্তি। ১৯, ১৮, ১৭, ১৬...। যেন গাড়ি চালু হলেই তার স্বস্তি আসবে। মনে মনে উচ্চারণ করেছিল, রাগ, ক্ষোভ, অভিমান এইসব অনুভূতি আমাকে আর ছুঁতে পারে না সোহিনী! জীবনটা চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছি শুধু। একা একাই। নিজেদের কাছে থাকার কথা বারবার বলেছিলেন মা-বাবা। কিন্তু ইচ্ছে করেনি। আমার যে একা থাকতেই ভালো লাগে রে!
তিন বছরের বেশি হয়ে গেল তার আর সাত্যকির ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। শুধু আইনি বিচ্ছেদ নয়, মানসিকভাবেও দুজনের অবস্থান অনেক দূরে। সাত্যকি সারাক্ষণই তার পৌরুষত্বের দাবড়ানি দিয়ে দমিয়ে রাখতে চাইত সুপ্তিকে। সেসব সহ্য করতে করতে ক্রমশ নিজেকে হারিয়ে ফেলছিল সে। সুপ্তি ভেবেছিল বুঝিয়েসুঝিয়ে সাত্যকিকে ভালোবাসার পথে টেনে আনতে পারবে। কিন্তু তার সমস্ত চেষ্টাই ব্যর্থ হয় সাত্যকির একগুঁয়েমি আর অপযুক্তির কারণে। ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। দূরত্ব ক্রমশ বেড়েই গেছে। প্রাত্যহিক জীবনে ধিকিধিকি আগুন থেকে ধোঁয়া ওঠার মতো নানা সংলাপ তাদের ঘরের বাতাসে ঘুরে ঘুরে বেড়াত। সব আলো মুছে দিয়ে তখন ভেসে বেড়াত শুধুই চাপচাপ অন্ধকার।
সেই যে আদালত থেকে দুজনে দু-পথে হেঁটে চলে গিয়েছিল, সেই পথ আর একমুখী হয়নি। কোনও ভাবেই যেন আর দেখা না-হয়, সেই চেষ্টা করেছে সুপ্তি। পাছে এক পথে চলে আসে কখনও, তাই স্কুলটাও আলাদা করে নিয়েছে।
ডিভোর্সের আগের বছরই স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় বসেছিল। সাত্যকি জানতে চেয়েছিল, ‘হঠাৎ পরীক্ষা দিচ্ছ কেন আবার?’ সুপ্তি বলেছিল, ‘যদি এমএ-র স্কেলটা পাওয়া যায়। চাকরি পাওয়ার সময় অনার্সের রেজাল্টও বেরোয়নি। তাই পাশের স্কেল পাচ্ছি।’ সরাসরি বলেনি, তবে মনে করিয়ে দিতে চেয়েছিল, এমএ আর স্কুল সার্ভিস পাশ করে তবেই বিয়ে করবে বলেছিল। কিন্তু সাত্যকি তা হতে দেয়নি। বিয়ের জন্য খুব জোরাজুরি করেছিল।
ডিভোর্সের কয়েক মাস পরেই সোহিনীকে বিয়ে করে নিয়েছিল। শুনেছে আগে সেভাবে যোগাযোগ ছিল না। সোহিনীর দাদা নাকি প্রস্তাবটা দিয়েছিল। এককথায় রাজি হয়ে গিয়েছিল সাত্যকি। সোহিনীর ইচ্ছেতেই ওর দাদা সাত্যকির কাছে গিয়েছিল বলেও জেনেছিল পরে। ওদের এক কমন ফ্রেন্ডের থেকে সাত্যকির বিয়ের খবরটা পাওয়ার পরে কেমন একটা নিঝুম অন্ধকার নেমে এসেছিল, মাত্রই ঘণ্টাখানেক অবসন্নতা ঘিরে ধরেছিল তাকে। তারপর অর্ধেক শেষ করা ঠান্ডা কফি সিঙ্কে ফেলে দেওয়ার সময়ই অবসন্ন ভাবনাটকেও ফেলে দিয়েছিল সুপ্তি, কালচে খয়েরি কফির তরলের সঙ্গেই ছিদ্রপথ দিয়ে নেমে গিয়েছিল সেই অবসন্নতা।
নানা ভাবনায় ডুবে থেকেই টের পেল গাড়িটা থেমে গেছে একটা বড় লোহার গেটের সামনে। পুরনো বাড়ি, গেটের ওপরে লেখা ‘বিনোদিনী বৃদ্ধাশ্রম’। এখানেই নিয়ে আসবে বলেছিল সোহিনী? কেন? কারা থাকে এখানে?
গাড়ি থেকে নেমে সুপ্তির দিকের দরজাটা খুলে ধরে সোহিনী। মুখে একচিলতে হাসি ঝুলিয়ে বলে, নেমে এসো। এসে গেছি আমরা।
সোহিনী বলে রেখেছিল গেট-টুগেদারে যাওয়ার আগে একটা বিশেষ জায়গায় নিয়ে যাবে। এই কি সেই বিশেষ জায়গা? ভাবতে ভাবতেই সোহনীর পেছন পেছন একটা ঘরে পৌঁছে বিস্মিত সুপ্তির মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে, ওনাকে এখানে ফেলে রেখেছিস?
হুম। এছাড়া আর কিছু করার ছিল না সুপ্তিদি! আমি আর পারছিলাম না!
পারছিলি না মানে? উনি তো হার্মফুল নন! মাথাটা বিগড়ে গেছে ঠিকই। কিন্তু খেতে দিলে খেতেন, না-দিলে চাইতেনও না। নিজের মতোই থাকতেন। শুধু আপনমনে বিড়বিড় করতেন। সেই কথা কেউ শুনতেও পেতেন না!
তুমি ঠিকই বলেছ দিদি, এখনও একইরকম আছেন। তবু আমি পারছিলাম না!
আমি কিন্তু পেরেছিলাম। সাত-সাতটা বছর পেরেছিলাম... কথাগুলো বলে সুপ্তির ভালো লাগে। ইনি একসময় তারও শাশুড়ি ছিলেন। এইরকম মানুষকে সংসারে রেখেই স্কুল করেছে, ঘর সামলেছে। কোনও অসুবিধা তো হয়নি! সোহিনী পারত না নির্বিরোধী মানুষটাকে রাখতে? নাকি ফাঁকা ঘরে উদ্দাম হওয়া আটকাত? তাতেও তো উনি বাধা হয়ে দাঁড়াতেন না!
সুপ্তির খোঁচাতেও সোহিনী নির্বিকার। জবাব দেয়, আমার সত্যিই অসুবিধা হচ্ছিল। পরে তোমাকে বলব সব। আপাতত এসো এখানে ঘুরে ঘুরে দেখি।
এই মেয়েটাকে যত দেখছে, তত অবাক হচ্ছে সুপ্তি। প্রতিটি ঘরে একবার করে ঢুকছে আর সকলের কুশল জিজ্ঞাসা করছে। সবাই সোহিনীকে চেনে! বাড়ির ভেতরে ঢোকার সময়ও দেখেছিল দারোয়ান সোহিনীর কুশল জিজ্ঞাসা করছিল। সুপ্তি বুঝতে পেরেছিল এখানে নিয়মিত আসে সে। যে তার নিজের শাশুড়িকে বৃদ্ধাশ্রমে রাখে, সে আবার অন্য আশ্রমিকদের খোঁজখবর নিচ্ছে! কোনও কোনও বৃদ্ধার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে!
পাশাপাশি দুটো দোতলা বিল্ডিং। একদিকে বৃদ্ধারা থাকেন। অন্যদিকে থাকেন বৃদ্ধরা। সুপ্তিকে সঙ্গে নিয়ে বৃদ্ধদের সঙ্গেও দেখা সারল একে একে। কারও কারও হাত ধরে জিজ্ঞাসা করল, কেমন আছেন জেঠু? একজনকে বলল, সাবধানে থেকো কাকাবাবু। বলেই তাঁর মাথার চুল ঘেঁটে দিল। সেই বৃদ্ধও সোহিনীর কাঁধে হাত রেখে বললেন, আমার এই মায়ের জন্যই ভালো থাকতে হবে রে। তুইও ভালো থাকিস মা।
এক অচেনা সোহিনীর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সুপ্তি। একসময় সোহিনী বলে ওঠে, চলো সুপ্তিদি। দেরি হয়ে যাবে।
গাড়িতে বসেই সুপ্তি উচ্চারণ করে, বললি না তো কেন তোর শাশুড়িকে বৃদ্ধাশ্রমে রাখতে হচ্ছে? 'তোর' শব্দটাতে ইচ্ছে করেই জোর দিল সুপ্তি।
বলব দিদি। একটু অপেক্ষা করো। সব বলব।
বেশ। জানাস। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে!
হালকা হাসি বাতাসে ভাসিয়ে দিয়ে স্টিয়ারিঙের সামনে বসে পড়ল সোহিনী। বলল, আর মাত্র মিনিট পাঁচ-সাত লাগবে। আশাকরি অনেকেই চলে এসেছে এর মধ্যে। জমিয়ে আড্ডা আর খাওয়াদাওয়া হবে। জানো তো, এখানকার অনেককেই ঠিক চিনি না। কাউকে কাউকে চিনতে পারলেও মুখটা ভুলে গেছি। সবাই তো আর প্রোফাইলে ছবি দেয় না। বাচ্চার বা ফুলের ছবি দেয়। চিনব কী করে বলো?
হোয়াটসঅ্যাপে একটা গ্রুপ হয়েছে ‘কুসুমপুর বালিকা বিদ্যালয় প্রাক্তনী’ নামে। সেই গ্রুপে কে যেন সুপ্তিকে অ্যাড করেছে। একবার ভেবেছিল গ্রুপ থেকে বেরিয়ে যাবে। কিন্তু একের পর এক পোস্ট পড়তে পড়তে ভালো লাগা শুরু হয়ে গেল। কেউ তার বাগান করার ছবি পোস্ট করে, কেউ বেড়াতে যাওয়ার ছবি দেয়। বাচ্চার জন্মদিনের ছবিও পোস্ট করে অনেকেই। তখন সুপ্তিও শুভেচ্ছা জানায়। এমনকি বিবাহবার্ষিকীর পোস্টেও শুভেচ্ছা জানায় সে। গ্রুপ থেকে কেউ একজন প্রস্তাব দিয়েছিল, ‘একটা গেট-টুগেদার করা যায় না?’ সকলে হইহই করে উঠেছিল। অনেক আলোচনার পরে দিনও ঠিক হল। জায়গা আর মেনুও ঠিক হয়ে গেল দ্রুত। সেখানেই সোহিনীর সঙ্গে যাচ্ছে।
সুপ্তির মায়ের সঙ্গে সোহিনীর মায়ের মোটামুটি পরিচিতি ছিল। একসময় তাদের এলাকায় একটা মহিলা সঙ্ঘ গড়ে উঠেছিল। নানা কালচারাল অনুষ্ঠান হত সেই সঙ্ঘের পরিচালনায়। সোহিনীর মায়ের সঙ্গে সুপ্তির মায়ের সেই সুবাদেই আলাপ। সেইসময় অবশ্য সোহিনী ছিল সামান্য মুখচেনা। বয়সে অনেকটাই ছোট বলে আলাপও ছিল না। তবে সোহিনীর দাদাকে চিনত। দু-একবার কথাও হয়েছিল।
আজকাল হইহুল্লোড় ভালো লাগে না সুপ্তির। তাই গেট-টুগেদারে যাবে না বলেই জানিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু পুরনো পরিচিতি মনে করিয়ে সোহিনী এমন জোর করল ফোনে যে সুপ্তি ‘না’ করতে পারেনি শেষপর্যন্ত। অচেনা জায়গা বলে সোহিনীই বলেছিল সে গাড়ি করে নিয়ে যাবে সুপ্তিকে। এখন মনে হচ্ছে নিজের কথা জানাবে বলেই এত জোরাজুরি করেছিল সেদিন!
(২)
সুপ্তি দিব্যি হইচই করে কাটিয়ে দিল সারাটা দিন। অনেককেই চিনতে পেরেছে সে। তাদের সঙ্গে নানা গল্প হল। জুনিয়রদের মধ্যে কেউ কেউ তাকে চেনে দেখা গেল। সবমিলিয়ে সুপ্তির বেশ ভালো লাগল। মনে মনে সোহিনীকে ধন্যবাদও দিল সে। জোর না করলে এইরকম একটা আলো ঝলমলে দিন তো পেত না!
নাছোড়বান্দার মতো লেগে রয়েছে মেয়েটা! নিয়ে আসাই শুধু নয়, ফেরার সময় স্টেশনে পৌঁছেও দেবে বলছে। অবশ্য স্টেশন বেশ খানিকটা দূরে। ফলে পৌঁছে দিলে সুবিধাই হবে, এটাও ঠিক। একবার টোটোয় চেপে অটো স্ট্যান্ড, তারপর অটোতে করে স্টেশন।
তুই কিন্তু আরও কিছুটা সময় থাকতেই পারতি। শুধু শুধু আমার জন্য বেরিয়ে এলি! গাড়িতে বসেই রুমালে মুখ মুছতে মুছতে বলল সুপ্তি।
না গো সুপ্তিদি। আমি আসলে তোমাকে পৌঁছে দেওয়ার নামে বেরিয়ে পড়লাম। আর থাকা যাবে না। বাড়িতে ফিরতেই হবে।
কেন? এত তাড়া কীসের? সাত্যকি রাগ করত বুঝি? আর খোঁচা মারার ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু কথাটা সুপ্তির মুখ থেকে বেরিয়ে গেল।
নাহ্, ও রাগ করবে না। তবে না গিয়েও উপায় নেই। কথাটা বলেই চুপ করে যায় সোহিনী।
উপায় নেই মানে কী? ভাবে সুপ্তি। হাওয়ায় কথাটা ভাসিয়ে দেয়, ‘তোরা দুটিতে বেশ সুখেই আছিস! কী বলিস?’ বুকের ভেতরে কীসের যে চিনচিনে ব্যথা, কে জানে!
হুম। তা বলতে পারো। সুখেই আছি। এসো না দিদি। দেখে যাও আমার সুখের সংসার!
আজ নয় রে। অন্যদিন যাব। আজ গেলে দেরি হয়ে যাবে।
ছাড়ো তো! একা মানুষ তুমি। দেরি করে ফিরলেই বা?
না রে। এ নিয়ে আর আমাকে অনুরোধ করিস না, প্লিজ! অন্যদিন যাব। ঠিক যাব। কথা দিলাম।
চুপ করে গাড়ি চালাতে থাকে সোহিনী। সুপ্তি ভাবে, এই মেয়েটা কী? নিজের বরের কাছে তার প্রাক্তন স্ত্রীকে নিয়ে যেতে চায়! ভেতরে ভেতরে কেন যেন সাত্যকির বর্তমান অবস্থান দেখার ইচ্ছেটা জেগে ওঠে। আশ্চর্য হয় সুপ্তি। ডিভোর্সের পর থেকে কোনওদিন তো এইরকম ইচ্ছে হয়নি! তাহলে আজ হচ্ছে কেন?
হ্যাঁ রে পাগলী, না ফিরে উপায় নেই বলছিলি কেন? গলাটা মোলায়েম করার চেষ্টা করে জিজ্ঞাসা করে সে। বিনা ভূমিকায় সোহিনী জানাতে থাকে তার বর্তমান অবস্থান।
প্রায় বছর দেড়েক ও বিছানায় শয্যাশায়ী! অ্যাক্সিডেন্টে পা, কোমর আর বুকের পাঁজর জখম হয়ে পড়ে আছে। আদৌ ঠিক হবে কিনা জানি না! আর কোনওদিন স্বাভাবিক হবে কিনা ঈশ্বর জানেন।
সে কী! কীভাবে হল?
অফিস থেকে ফেরার পথে। একটা ফুল পাঞ্জাব লরি ওকে ধাক্কা দিল। ও নিজেও অবশ্য ড্রাঙ্ক ছিল। তাই সামলাতে পারেনি।
ডাক্তার কী বলছেন?
খুব-একটা ভরসা দিতে পারেননি। পিছনে সুপ্তির দিকে চোখ রেখে বলে, অ্যাক্সিডেন্টের পর সাত্যকির চাকরিটা চলে গেল, জানো!
চলে গেল মানে? ও তো ভালো চাকরি করত!
তা করত। কিন্তু কোভিডের পরে কোম্পানি অনেককেই বসিয়ে দিয়েছে। অ্যাক্সিডেন্টে ঘরে পড়ে আছে। কোম্পানি তাই আর বসিয়ে বসিয়ে মাইনে দিতে চাইল না। বসিয়েই দিল।
সুপ্তি কোনও কথা বলতে পারে না। বলার মতো তেমন কিছু নেইও। তাই বাইরের দৃশ্যে দৃষ্টি পেতে রেখে শুনে যায় সোহিনীর সাম্প্রতিক অবস্থা।
আগের ফ্ল্যাটটা ছেড়ে দিয়েছে ওরা। এখন একটা অপরিসর গলির প্রান্তে অন্য ফ্ল্যাটের তিনতলায় থাকে। আগের ফ্ল্যাট বিক্রি করে এখনকারটা কেনা। যে টাকাটা বেঁচে গেছে, তা দিয়েই শাশুড়িকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখেছে। এখানে এককালীন টাকা দিতে হয়েছে।
সবই তো বুঝলাম। কিন্তু সাত্যকি রাগ করবে কিনা সেটাই ক্লিয়ার হল না যে। অনেকক্ষণ বাদে মুচকি হেসে বলে সুপ্তি। তার মনে সেই চেনা সাত্যকির পৌরুষত্ব দেখানোর অদম্য জেদ ভেসে উঠল।
না গো, রাগ করত না। এই যে আমি আজ ওখানে গেলাম, কিচ্ছুটি বলেনি। অবশ্য কোথায় গেছি জানে না। শুধু বলেছি আজ একটা গেট-টুগেদারে যাব। কোথায়, কেন ইত্যাদি কিছুই জানতে চায়নি। কোনও হেলদোল নেই যেন। খুবই শান্ত স্বভাবের ও। ওর এইদিকটা নিয়ে কোনও সমস্যাই নেই। তবু তোমাদের কেন ছাড়াছাড়ি হল, সেটাই ভাবি মাঝে মাঝে।
দ্রুতগতিতে একটা বল ধেয়ে এল যে সুপ্তির দিকে। ঠিকভাবে ব্যাটেবলে না হলেই আউটের সম্ভাবনা। একটু থমকে গিয়ে ব্যাট চালিয়ে দিল সুপ্তি। একদম ভাববি না এসব। মনে কর এই ছাড়াছাড়িটা হয়েছিল বলেই তোদের সম্পর্কটা হল। হা হা করে হাসে সে। কতদিন পরে সুপ্তি এইরকম হাসল, মনে করতে পারে না।
ইয়ার্কি কোরো না দিদি। বলো না কী এমন হল যে একসাথে থাকাই গেল না? অথচ তোমাদের তো প্রেমের বিয়ে!
আবার একটা বল এগিয়ে এল। এবার স্পিন করল পিচে। মুখ গম্ভীর হয়ে গেল সুপ্তির। তবু হাসার আপ্রাণ চেষ্টা করে বলল, সেকথা সাত্যকিকেই জিজ্ঞাসা করতে পারতিস!
করেছি না! তেমন কিছুই বলেনি। বরং এসব শুনলে রাগ করে। বলে, যে অতীত ছেড়ে এসেছি, সেসব নিয়ে প্রশ্ন কোরো না। তারপর থেকে আমিও আর জানতে চাই না।
চুপ করে বাইরের চলমান দৃশ্য দেখতে দেখতে কথা গোছায় সুপ্তি। কিন্তু বিস্তৃতভাবে কিছু বলতে চায় না। ওরা ওদের মতো থাক। কী হবে পুরনো কাসুন্দি ঘেটে! ভাবে সে। তবু বলেই ফেলে, হয়তো আগের অভিজ্ঞতা থেকে শিখেছে কতটা কী আচরণ করতে হয়। তাছাড়া ওর চাকরি নেই। তুই টানছিস পুরোটা। তোর ওপরেই তো নির্ভর করে! তাই হয়তো…
বিয়ের বছরখানেক পরে চাকরিটা গেছে। তার আগে তো ছিল! তখনও কিন্তু একইরকম ছিল। কোনও রাগ দেখিনি!
‘বিয়ের বছরখানেক মানে আবেগ-উচ্ছ্বাসের সময়। তখন কি আর রাগ দেখানোর সময়? আরও কয়েক বছর গেলে বুঝতি পুরুষ মানুষের মন!’
কথাগুলো বলা উচিত নয় বলেই বলেনি সুপ্তি। নিজের অন্দরমহলে নেড়েচেড়ে গেছে শুধু।
এসব কথা থাক। গাড়ি বিক্রি করতে চাস কেন সেটা বল? কী সুন্দর গাড়ি! রঙটাও দারুণ। আর চমৎকার চালানোর হাত তোর!
সোহিনীর দিক থেকে একটুকরো হাসি ছাড়া আর কোনও প্রতিক্রিয়া আসে না। যেন গাড়ি চালানোর প্রশংসা শুনে আরও মন দিয়ে গাড়ি চালাতেই চাইছে। সুপ্তিও আর কিছু জিজ্ঞাসা করতে ভরসা পায় না। ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে বেশি কৌতূহলও ঠিক নয়। সিদ্ধান্ত নেয় সে।
সাত্যকি নিজে থেকে কিছুই করতে পারে না এখন। গেল সপ্তাহ পর্যন্ত নিজে বাথরুমে পর্যন্ত যেতে পারত না। ইদানিং পারে। তবে লাঠি বা ওয়াকার নিয়ে।
সেকি রে! এই অবস্থা?
হ্যাঁ গো দিদি। ওর ওষুধ, ফিজিওথেরাপি, শাশুড়ির দেখাশোনা, আমার মায়ের ওষুধ আর নানা পরীক্ষা! কত আর পারি বলো? তাই এই গাড়িটাও আর রাখতে পারব না গো দিদি! পেট্রোল খরচ, মেইন্টেনেন্স, এসব করা কি সম্ভব বলো একার আয়ে? হতাশ গলায় বলে ওঠে সোহিনী।
নভেম্বর মাসের শেষদিক। বাতাসে একটু একটু হীমেল স্পর্শ। নির্মল আকাশ। মনোরম পরিবেশ। তবু চাপা আর্তনাদের মতো কী যেন একটা ভেসে বেড়াচ্ছে!
এই অবস্থায় শাশুড়িকে রাখা যায় বলো? কে করবে এত? আয়া রাখাই যেত। কিন্তু সাত্যকি কোনও মহিলা আয়া রাখতে চাইছিল না। যদি কোনওভাবে সন্দেহ করি ওকে, হয়তো সেইজন্যই। আপাতত আমার স্কুলের চাকরিই ভরসা। আর কত টানব দিদি?
নিরুত্তর সুপ্তির দিকে কথাগুলো ঠেলে দেয় সোহিনী, যেন গড়িয়ে গড়িয়ে বল চলে যাক মাঠের বাইরে। সে নিশ্চিত ফিল্ডার বল আটকাবে না। চলে যেতে দেবে।
তার মানে তুই ভালো নেই! সুপ্তি কথাটা ভাসিয়ে দেয় হাওয়ায়।
একে যদি খারাপ থাকা বলো, তাহলে খারাপ। আর যদি মনে করো সুখে আছি, তাহলেও আমার কিছু বলার নেই। সোহিনীর বিষণ্ণ হাসি ঠোঁট চুঁইয়ে থুঁতনি বেয়ে নেমে যেতে দেখে সুপ্তি। সেই হাসি ধরে রেখেই সে বলে, আজকাল আমি ওর কাছে অচেনার মতো। নিজের প্রয়োজনটুকু ছাড়া কথাও বলে না আমার সঙ্গে! তাও যতটুকু পারে ইশারায় কাজ সারে।
একটা কথা বলব সোহিনী? রাগ করবি না তো?
না দিদি। রাগ করব কেন? বলো না কী বলবে?
আমি ভেবেছিলাম তুই যে সুখে আছিস, সেটা দেখানোর জন্যই আমাকে জোর করেছিলি গেট-টুগেদারে নিয়ে যাবি বলে। এখন দেখছি তা নয়। তুই আসলে এইসব যন্ত্রণার উপশম খুঁজছিস। আমি যে ভুল ভেবেছিলাম, সেজন্য আমাকে ক্ষমা করে দিস!
কী বলছ দিদি! ছোটবোনকে এভাবে বলবে?
গাল টিপে আদর করে দেয় সুপ্তি। বলে, ভালো থাকিস বলতে পারছি না সোহিনী। অন্তত ভালো থাকার চেষ্টা করিস, মিষ্টি বোন আমার।
ভালো থাকব দিদি।
আমি মাঝে মাঝে এলে ঢুকতে দিবি তো তোর ফ্ল্যাটে?
ধুর, কী যে বলো! তোমার যখন ইচ্ছে হয় এসো।
আমরা দুজনেই আসলে একই বৃত্তে আটকে আছি। ভিন্ন ভিন্ন ভাবে। কথাটা সোহিনীর কান পর্যন্ত পৌঁছল কিনা বুঝতে পারল না সুপ্তি। কেননা ট্রেন আসার ঘোষণা শুনে বলতে বলতেই হাঁটা শুরু করে দেয় প্ল্যাটফর্মের দিকে। একবারও পিছন ফেরে না সে। এমনকি সোহিনীর ‘সাবধানে যেও’ শব্দদুটো শোনার পরেও নয়!
ট্রেনে যেতে যেতে সুপ্তি টের পায়, তার চোখ জ্বালা জ্বালা করছে। তবে এই জ্বলুনিটা অন্যরকম। একদমই অন্যরকম।
খুব ভালো লাগল। এই গল্পটা দিয়েই পড়া শুরু করলাম।
উত্তরমুছুনভালো লাগল গল্পটা
উত্তরমুছুনখুব সুন্দর রোমান্টিক ও বিরহের গল্প
উত্তরমুছুনঅসাধারণ সমাপতন। ভালো লাগল।
উত্তরমুছুনখুবই সুন্দর....Indranil
উত্তরমুছুননিখাদ ভালোবাসার গল্প। সুপ্তি-সোহিনী একই দুটি পৃথক চরিত্র, তবু একই বৃত্তে আটকে।
উত্তরমুছুনখুব ভালো লাগলো । চোখটা জ্বালা জ্বালা করছে
উত্তরমুছুনbhalo laglo... Arghya
উত্তরমুছুন