পীযূষকান্তি বিশ্বাস

মায়াজম
1

 মধুময়তায়



--
হে বঙ্গ , ভাণ্ডারে তব বিবিধ মেথি , মেদিনীপুর থেকে পেড়ে আনা সমাদ্দার । তুমি তার ইশারাটুকু বোঝো । তার মগ্নতার ইঙ্গিতে বেজে ওঠো । এতোটা পথ অতিক্রম করে এসে কেন বা জিজ্ঞাসাঃ রতন কাকে বলে ? রতনে রতন চেনে , কবি চেনে কবিতা , আর ভাল্লুক চেনে মধু ।
সেবার জঙ্গল মহলে খুব হালচাল । জঙ্গল বোলে তো অরাজকতা । ক্যাওস । এই কদিন আগেই একটি ক্যাওস নামের লিটল ম্যাগাজিন ধুম মাচালো । হারিয়েও গেলো । সামান্য তার ধূলিবসন মেদিনীমধ্যে ঈষৎ মুহ্যমান, অথচ জঙ্গল এতোটাই গভীর যে সেখানে দর্প ছাড়া কিছুই দৃশ্যমান না । জঙ্গল মানে তো শুধু শাল পিয়াল সর্বদা নয় । শালপাতা আর নির্জনতার ভিতর শ্রাব্য শুধুই বন্দুকের আওয়াজ । মানুষের ঘাস পাতা বিচুলি-জীবন এখন আর দাগ কাটে কই । নগরপ্রান্তে এতো প্রাচুর্যের ভিড়, এতো তার রোশনাই । রাতের পর রাত চাঁদ উঠে কেঁদে কেঁদে গেছে , ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে শহরসমেত অথচ সে জ্যোৎস্না দেখার মতো অবসর এখন আর অবসর কই ?


অবসর নেই, অভিমুখ আছে । আছে সমাদ্দার । সামান্য দূর্বা । সামান্য ঘাস । কবির হৃদয় আজ ঘাস । কবিতার হৃদয় ও আজ ঘাস । দক্ষিণ আর প্রদক্ষিণে পৃথিবীর তরাই জুড়ে সুদীর্ঘ-তৃণভূমি । হালুম বলে যে কোন সময় ছিটকে সামনে চলে আসে জঙ্গলরাজ । ঘাসপাতা, ঝাটিবাবলা নিয়ে যেন এক অভিমুখ তৈরি হয় । তার পরিবর্তে দাঁড়িয়ে আমাদের এই সামান্য বাডকাল । এই আমাদের সামান্য মঙ্গার ।
লিটল মানে আমারও সামান্য কিছু । ভাবলে অনেক, সুদূরপ্রসারী । লিটল মানে, শূন্য থেকে ধনাত্মক । আমাদের এই সামান্য বঙ্গমধু , প্রশাখা প্রশাখায় তার মৌমাছি গুঞ্জয়মান ।

কোথায় গেলে হে মধুসূদন , কোথায় সে মণিভাণ্ডার । আমার এই অবোধটুকু ক্ষমা করো , কবি । এই ভাল্লুক নামের পাঠক্ষুধাকে কি করে লিখিত করি । আর ব্যঘ্রনামের মামাকে কি করে চোখরাঙ্গিয়ে বলি, দূর হটো এই বন্দুকধারী, বকশো এই ভাঁটিফুলের ঝাড় । এই আমাদের ছাতিম, এই আমাদের অমলতাস । আমরা এখানে মধু সংগ্রহে এসেছি । আহা , মধু আর মননের মধু পানের পিয়াসা আমাদের ।
এভাবেই কেটে গেলো দক্ষিণ বছর, আমাদের কবিতাপত্র এখন অনেকটাই হলুদ , আমরা নিজেরাই এপ্রিল । আমি কি কথা, কারে বা কবো ? মধু লেহন করার ঈপ্সা এখন একান্ত ও গোপন । তোমার কাছেও গোপন রেখেছি, অথচ তুমিও তো আপন , ইশারা করোনি ।

এই বঙ্গমালায়, জীবনকে দীর্ঘ করে রেখেছো মধু । স্বল্পতায় তো তেমন ক্ষতি নেই । আছে নাকি ? বাবুমশাই , আনন্দ নশ্বর নহে । আনন্দ তুমি জেনেছো স্বল্পতার সেই স্বাদ, রক্ত ক্লেদ মাখা ইঁদুরের মতো ঘাড় গুঁজে বেঁচে থাকার চেয়ে অন্য এক মেন্টোস জিন্দেগী । জিন্দেগী, এই ক্যায়সে প্যাহেলি হে ।
তাই বলে, তো জঙ্গল ছেড়ে চলে যাওয়া যায় না । তার অস্তিত্ব, তার মহলকে ক্রমশ ছেয়ে যাওয়া এওতো প্রকৃতি । মানুষই প্রকৃতি, মানুষই মধু , মানুষই জঙ্গলমহল । আমি সেখানে কাঠ কাটি, ট্রেকিং এ যাই, মধু সংগ্রহ করি । মানুষই হরিণ, হরিণীর চোখের কাজলে আমার হৃদয় থমকে দাঁড়ায় । মানুষই কাঠবিড়াল, সম্মুখ চাহনিতে চকিতেই আড়ালে পলায়ন করে, আবার সামনে এসে লেজ নাড়ায় । মানুষই শেয়াল, কখন কার ইক্ষু-ক্ষেতে নিজের হাল চালিয়ে দিয়ে এসে সহাস্যে আমজনতার মাঝে দাঁড়িয়ে, বত্রিশপাটি দাঁত বের করে হা হা হি হি - আমি কিচ্ছুটি করিনি, জানিনি , ফারাক পড়ে না । আমি সাতেও আছি, পাঁচেও আছি, ধর্মেও আছি , জিরাফেও আছি । হে হে হে হে, সর্বযজ্ঞে কাঁঠালিকলা ।

ভাল্লুক সেই হিসাবে শিকারেও তত পটু নয় । নির্ভেজাল প্রতিভাশালী কুম্ভকর্ণ । খানিকটা মধু পেলে সে চুরিয়ে চুরিয়ে উপভোগ করে । ল্যাদ খাওয়া শরীরে তার মধু লেগে আছে । হে ভল্লুরাজ, যতোটা না মধু, ততোটাই মধুমেহ । যতটা না ল্যাদ, ততটাই পাহাড়তলি থেকে গড়িয়ে যাওয়া পাথর । গড়িয়ে যাবি, তো যাবি কোথায় । মধুর মিষ্টতার থেকে অধিক উপভোগ্য তার পরশ । এই শহর থেকে দূর মেদিনীপুর ডাকে, ডাকছে পৃথিবীর মধুরতম নিয়তি ।

এই মধুময় নগরে, তুমি যে চাতাল, আমিও সেই বারান্দা । এই তারকার মহাকাশে সবাই তারকা । এই উজ্জ্বলের আকাশে সবাই উজ্জ্বল , এই মধুক্ষণে সবাই আজ কেমন যেন মধু মধু ।
আমি মধু চেটে খাবো সেই অবসর কই । মধুমেহতে গা যেন জ্বলে জ্বলে যায় । বাবুমশাই , জিন্দেগী অধিকতর মিষ্ট হওয়া চায়, মধুমেহ নয় । অনন্তে সুখ আছে , তোমরা থাকো । আমি আমার স্বল্পতা নিয়ে মেদিনীপুর যাবো । শালপাতার বিশালতায় আমি ঝরে পড়া নক্ষত্র দেখবো । শালপাতার সঙ্গে শুক্লা পঞ্চমীর রাতে মিশে যাবো হেমন্তের পিয়ালে ।
--

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন