কর্ণ শীল - মায়াজম

Breaking

২৪ জুন, ২০২৩

কর্ণ শীল

   মাধ্বীশিখর



দেআ গল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জার্নির বেশ কয়েকটা পরত থাকে। ভাঁজে ভাঁজে থাক থাক অনুজ্জ্বল অথচ দীপ্তিময় ছোঁয়া থাকে।
সূর্যের আলোর মত নয় কিন্তু। অত স্পষ্ট করে হয় তো লেখক বোঝাতেও চায় না, আমি জানি।
তবুও সবাই কেমন করে যেন জেনে যায়।বুঝে যায়।
কলসপত্রীর খপ্পরে যদি একগাদা জোনাকি একসঙ্গে পড়ে,তবে তার কলসের ভেতর থেকে যে মৃদু আঁচ বেরিয়ে আসে বাইরে, সে আলো সে গল্পের।
নেই, অথচ আছে। না থেকেও আছে।
এ সব লেখা নিয়ে সরাসরি মন্তব্য যাব না। একটা জার্নির কথা বলি।
অন্নপূর্ণা রেঞ্জের পায়ের কাছে দুটো ছোট শৃঙ্গ।
সায়াঙ আর জগত।
পোখরা থেকে ২০০ কিলোমিটার ট্রেক করে জগতের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেলে ধরো, তখন বিকেল।
স্কুলবাড়িটা পার হয়ে দেখবে খান কুড়ি বাচ্চা লিভারপুলের জার্সি পরে রয়েছে। গোটা দশেক আর্সেনালের।
নেপালিজ জানতেই হবে এমন কোনও ব্যাপার নেই। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বললেই হবে 'মি অমুক...হানি...হয়্যার?'
"হুইয়ার উই খ্যান গেট হানি? "বললে কিন্তু কেস খেতে পারো।
খাঁটি উচ্চারণ বুঝবেই না ওরা।
অন্নপূর্ণার চূড়ার দিকে তাকিয়ে যদি হাঁ করে ভাবতে বসো, সোনার ধানের গুঁড়ো লক্ষ্মী কৈলাস থেকে মায়ের বারণ না শুনে এনে মাখিয়ে দিয়েছে, তবে রোসো বাপু, এখনও বাকি আছে।
বিশেষণের ভাঁড়ারে পরে যেন টান না পড়ে।
রডোডেনড্রনের কম সে কম ছাব্বিশটা প্রজাতি পাবে হিমালয়ান রেঞ্জে। অতগুলো গণিতব্য নয় এখানে।

বেগুনী রডোডেনড্রনগুলোতে বসন্তে পৌঁছে যাবে বিরাট বিরাট মৌমাছি।
উঠতি বয়সে মা খুড়িদের ছোটবেলায় দেখা তাঁদের বাপ খুড়োদের হাতে পরা সলিড আংটির মত রঙ তাদের। সাইজও।
মেগ্যাচিলি প্লুটো টাইপের কিছু একটা মহাজাগতিক নাম ওগুলোর। ভাবো একবার, নাম বামন গ্রহের নামে, ওদিকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মৌমাছি।
রডোডেনড্রনের ফুলে ফুলে পাহাড় ধোওয়া জল জমে মধু তৈরি হচ্ছে মকরন্দের পেটে আর তা শুষে নিয়ে চাকে চাকে সোনার প্লেটিং করছে মেগ্যাচিলি।
মেরে কেটে তিনশ পরিবার আছে তালো - চিপলা গ্রামে। তাও ওই "তালো ",যার মানে তুমি করতে পারো গিয়ে "নিম্ন "...সেই অঞ্চলের মধ্যেই।
'নিম্ন' থাকলে, 'উচ্চ'তো থাকতেই হয়।
সেই উচ্চ অংশ বা 'চিপলা'র তবে কি কাম, যদি কেউ সেখানে না -ই থাকে?
আছে দাদা...আছে। খবর তো সেইখানেই।
গ্রাম পার হয়ে পাইন ধূপির বন।
আকাশে অন্নপূর্ণার ঘোমটা দিতে খুব দেরী নেই। রুদ্রসন্ন্যাসীর কলকের ধোঁয়া আস্তে আস্তে ভেসে আসছে বরফের মহাশ্মশান থেকে।
বনের মধ্যে দিয়ে সরু পথ নীচের দিকে।
একশো মিটার নেমে যাও।
এবার মিটার পঞ্চাশেক ওঠো।
বুকে হাত রাখো। হার্টফেল মারলে চরম মারবে মা।
উঠেছো। দাঁড়াও। সামনে খাদ।
ওপারে তাকাও। কি হলো? চমকে উঠলে তো?
হা হা...দ্যাখো, খাদের গা বেয়ে যে লাইমস্টোনের খাড়া দেয়াল, তার গায়ে ওগুলো সোনার তাল নয়। পকেট বাইনোকুলারটা তাগ করো।
দেখেছো?
বেঞ্জিন রিংয়ের মত ষড়ভুজ খাঁজকাটা রয়েছে সোনার গায়ে।
হ্যাঁ গো পথিক, ওগুলো মৌমাছির চাক।


আর হুই ওপর থেকে কোমরে দড়ি বেঁধে নেমে এসে, ঝুলে ঝুলে যারা সন্তর্পনে চাক কেটে কেটে, নিংড়ে নিংড়ে সোনার রসের মধু নিয়ে আসছে, তারাই তালো - চিপলার বাসিন্দা।
পাইনের ছুঁচলো পাতায়, ডালে একটা ধূপ ধূপ গন্ধ পাই আমি। একটু মিন্ট মিন্ট ভাপ নাকে।
পেলে তুমি সে গন্ধ?
কাঠের চেয়ারটায় বসে পড়ো। ফায়ারপ্লেসের আগুনে যে নীল ফুলদানিটা দেখছ, ওটার আদল মিং যুগের চিনামাটির শো পীসের মত হতে পারে, তবে তা নয়। আদতে চিনামাটিরই নয় হয়তো। শস্তা ফাইবারের।
ও মধু কিন্তু দিনে এক চামচ। অ্যান্ড আই মীন ইট।
তিনশ এম.এল স্প্রাইট কি কোকের বোতলে করে দেবে ওই মধু। শ'পাঁচেক টাকা চাইবে। দিয়ে দিও। ঠকবে না।
তবে ওই যে বললাম, এক চামচ। বেশী খেলে বিপদ ঘটতে পারে।
এই বসন্ত মেগ্যাচিলিদের সঙ্গম ঋতু। ভাবো একবার সেই দৃশ্য । বসন্ত, মদন, পার্বতী...সুললিতগমনা চমকিতচপলা...শিবের বিয়ে।
রতিবিলাপের পর আবার মদনের পুনর্জন্ম। মিলন।
মৌমাছিদের মিলনের ফলে গ্রায়ানোটক্সিন সৃষ্টি হয় ওদের অজান্তেই। মধুতে মিশে যায়।
তার ফলে ওই মধুতে একটা দৃষ্টিবিভ্রম সৃষ্টি করার ক্ষমতা থাকে। একটা ঝিমঝিম নেশা। ভূত প্রেত জিন পরী, মায়ের বেলনপেটা...যা খুশী দেখতে পারো ওভারডোজ হলে।
এই হলো তেমন সব গল্পের এফেক্ট যা দিয়ে এ কথা বলতে শুরু করেছিলাম।
ভূমিকার সমতল থেকে চলতে শুরু করে ক্লাইম্যাক্সের ইউ টার্ন নিয়ে আবার আগের রাস্তায় ফিরে এলে চমক। হ্যালুসিনেশন। পাহাড়ের গায়ে খাঁজকাটা খাঁজকাটা সোনার তাল।
মানুষ দেবদূত সেজে আসছে।
তৃপ্তির নেশা ধরিয়ে দিচ্ছে।
নীল ফুলদানির মতো জীবনের সৌন্দর্য বুঝিয়ে দিচ্ছে।
অথচ বিশ্বাস হচ্ছে না...


মানবতা কি সত্যিই এত সুন্দর, না শুধুই মানুষ সাজার নকলনবিশি?
সে লেখক এক রাশি মেঘ নিয়ে চলা শুরু করেছিল । তার পেট কেটে যে শুধু জল বা অন্ধকার নামে, তা তো নয়।
আলোর বর্শা গেঁথে যায় কখনও কখনও দুখী মনের আঙিনায়।
সেখানে তালো -চিপলার মধুর মত সোনারঙের রোদ।
যদিও বা দৃষ্টিবিভ্রম হয় গো পাঠক বা পরিব্রাজক, বড় মধুর সে বিভ্রম...বড় মধুর।

1 টি মন্তব্য:

Featured post

সোনালী মিত্র