ভোঁকাট্টা
ঝকঝকে নীল আকাশের চৌখুপিতে দুটো পেটকাটি মনের সুখে উড়ে বেড়াচ্ছে।একটা লাল আর একটা সবুজ রঙের। তারা কখনও কাছাকাছি আসছে, কখনও সামান্য দূরে সরে যাচ্ছে, সবুজটা ওই একটু নীচে নেমে এলো, পরক্ষণেই লালটা তার কাছে ছুটে এলো যেন, যেন খুব যত্ন তার অভিমানের কারণ জানতে চাইছে। আবার তারা দুলে দুলে খানিকটা উপড়ে উঠে গেলো। লালটা একবার কাছে এলো সবুজের, চট করে তার গালে হালকা ঠোঁটের স্পর্শ দিয়ে সরে গেল। মিটিমিটি হাসছে কি? তারপরই আচমকা লাল ঘুড়িটা সবুজের গায়ে সজোরে আছড়ে পড়ল! আর আকাশের যে ক্যানভাসে এতক্ষণ অঙ্কিত হয়ে চলেছিল লাল-সবুজ পেটকাটির খেলা, সেই ক্যানভাস ছেড়ে – খেলার মাঠ ছেড়ে পলকা তুলোর মতো বেরিয়ে যাচ্ছে।
সবুজ ঘুড়িটা ভোঁকাট্টা হয়ে যেতেই রঙ্গনার মন খারাপ হয়ে গেল।
ক্লান্ত হয়ে জানলা থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বিছানায় নেতিয়ে পড়ল সে। সারাদিন সে বিছনায় শুয়ে বা পিঠের নীচে বালিশ নিয়ে বসে থাকে। তার জগৎ এখন ওই একফালি জানলায় এসে ঠেকেছে, বড়োজোর পাশের বারান্দাটুকু কখনও বা। এই এখান থেকে যতটুকু দেখা যায় ততটুকুকে সে জীবনের ক্ষুদ্র পাত্রে ভরে নিঃশেষে পান করে। যা দ্যাখে তা-ই বড়ো মধুময় মনে হয়। সব ভালো লাগে তার, সব সুন্দর মনে হয়।
পৃথিবীর সব রঙ প্যালেটে গুলে ছড়িয়ে দেওয়া আকাশ, সব গাছগাছালি, এমনকি দোতলার জানলা থেকে দেখা নীচের রাস্তার ধারের নাম না-জানা ঘাস, আগাছাগুলির ভেতর লুকিয়ে থাকা চোরকাঁটা গাছ বা আলাকুশির পাতা কিংবা বিছুটি পাতাগুলিকেও বড়ো সুন্দর লাগে। কোথা থেকে হঠাৎ শিস দিয়ে গান গেয়ে ওঠা আড়ালে থাকা পাখি – তাকে সে ভালোবাসে। নীচের রাস্তায় খেলে বাড়ি ফিরে যাওয়া ছেলের দলটাকে বিছানা থেকে দেখা যায় না। ওদের গলা শুনতে পায় শুধু। ওদের বড়ো দেখতে ইচ্ছে করে তার।
আবার একটা ঘুড়ির মেলার দিন এগিয়ে আসছে। সেদিনও পৃথিবীতে কত কত শিশু জন্ম নেবে, আবার কত কত মানুষ ওই কাটা ঘুড়ির মতোই খসে পড়বে জীবনের আকাশ থেকে। সে নিজেই তো - ! কে জানে ওই পরবর্তী ঘুড়ির মেলার দিনটা দেখবে কিনা! এখন প্রতিদিন সকালে সূর্য ওঠা দেখে ভাবে, যাক, আর একটা সকাল দেখলাম! আজকের দিনটাও হয়তো বা বেঁচে নিতে পারব!
যখন ও সুস্থ ছিল, ওর মনে পড়ে – ঘুড়ির মেলার দিন যখন কাটা ঘুড়ির পিছনে ছুটত ছেলের দল আর ও বাড়ির ছাদ থেকে তাদের দেখত। নিজের ছেলেবেলার দিনের মতো ওরও ইচ্ছে করত কাটা ঘুড়ির পিছনে পিছনে তাকে লক্ষ্য করে মাঠ ঘাট বন পার হয়ে এগিয়ে যেতে, ওই কাটা ঘুড়ি ধরতে! ছোটবেলায় একটা মায়ায় পেত। ওই ঘুড়ির ভেতর অনেক কষ্ট রয়ে গেছে বলে ভাবত।বাতিল ওই ঘুড়ির বুঝি কোনো দাম নেই! তাই ও কোনো নতুন ঘুড়ি কিনে দেবার বায়না করত না কখনও। বড়ো হয়ে ওর মনে হতো, কাটা ঘুড়ি একটা অসফলতা, অস্তিত্বের আকাশে নিজেকে টিকিয়ে রাখার লড়াই থেমে যাওয়া। সারাজীবন ওই দুখি ঘুড়িটাকেই ধরতে সে কেমন একটা জন্ম পার করে দিল!
সে নিজের সাদৃশ্য খুঁজে পায় ভোঁকাট্টা সবুজ ঘুড়িটার সঙ্গে।
জানলা থেকে রাস্তার ওপারে থাকা নাম না জানা ঘাসফুলগুলো দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ হাওয়ায় দুলে ওঠা ফুলগুলো দেখতে দেখতে রঙ্গনা পৃথিবীটার প্রতি - পৃথিবীর দগদগে ঘা ভর্তি গা, আর কালো কালো বড়ো দাগ সত্ত্বেও হঠাৎ খুব ভালোবাসা অনুভব করে, একে ছেড়ে যেতে হবে মনে করে, তার খুব কষ্ট হয়। সে থাকতে চায় এই পৃথিবীর বুকে, আরও অনেক দিন। ভোঁকাট্টা না হওয়া ঘুড়ির মতো আকাশের বুকে উড়তে চায়। মাটির বুকে থাকতে চায় ঘাসফুলেদের মতো। কিন্তু সে জানে এখন হাতের কর গোনা আয়ু তার। গুনতে গুনতে কবে যে আঙুলপাঁজি থেমে যাবে সে জানতে পারবে না!
সে নিজের মিল খুঁজে পায় নাম না জানা ঘাস ফুলের সঙ্গে। ওই ঘাসফুলগুলো অকারণেই খুশি, নাই বা থাকল কোনো সুগন্ধ, নাই বা পেল মানুষের সাজানো সংসারের কোণে ঠাঁই, নাই বা দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদিত হলো! কেউ হয়তো তাদের হাতে ছুঁয়ে আদর করে না, তবু তারা আপন অস্তিত্বেই খুশি। বাতাসের স্পর্শ নিয়ে, সূর্যের আলোয় হেসে উঠে আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে আনন্দে অন্তরের সুরের দোলায় মাথা নাড়ে। কোনো ঘাস ফড়িং আচমকা তাদের বুকে এসে বসলে ওরা খুশি হয়ে ওঠে।
রঙ্গনাও খুশি ছিল। অলোক তার গায়ে হাত তুলেছে, অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে নাজেহাল রঙ্গনাকে একা ফেলে রেখে দিনের পর দিন বাইরে কাটিয়েছে। কী করে তাদের চলছে, সে খোঁজ নেয়নি। রঙ্গনার ভীষণ রাগ হতো সেই দিনগুলোতে। কিন্তু অলোক ফিরে এলেই সব ভুলে যেত। অকারণে গেয়ে উঠত আনন্দে, দুপাক নেচে নিত অলোকের প্রিয় পদ রাঁধতে রাঁধতে।
তার কর্কট রোগের শেষ স্টেজে রোগ ধরা পড়ার পর অলোক নির্দ্বিধায় তার অন্য সম্পর্কের কথা সগর্বে ঘোষণা করেছে। হয়তো মনে মনে দিবারাত্র তার দ্রুত মৃত্যুকামনা করছে অলোক। এক তো টাকার শ্রাদ্ধ, তার উপর মুম্বাই-আসানসোল ছোটাছুটি, কেমো, ডাক্তার, ওষুধ, নার্সিংহোম-হাসপাতাল, পেটের জমা জল বের করা - এসবে সে যারপরনাই বিরক্ত। অথচ অলোককে নিজের টাকা খরচ করতে হচ্ছে না। রঙ্গনা একমাত্র সন্তান হিসাবে মায়ের কাছ থেকে অনেক সম্পত্তি ও নগদ টাকা পেয়েছে। সেখান থেকে খরচখরচা চলছে।
নার্গিস এসেছিল গতকাল, রঙ্গনার সহকর্মী। একমাত্র ও-ই নিয়ম করে রঙ্গনার কাছে আসে, তার খোঁজখবর নেয়। বারান্দায় গিয়ে বসেছিল রঙ্গনা। একসময় বলল, “আমার সব সম্পত্তি চলে যাক, কিন্তু আমি শেষ চেষ্টা করবই। আমি বাঁচবই, দেখো আমি ঠিক পারব! পারতে তো আমাকে হবেই! আমার মেয়েকে কে দেখবে বলো! মায়ের মতো করে কেউ দেখতে পারে?”
নার্গিস তাকে সান্ত্বনা দিয়েছিল, সেটা কি সে বোঝেনি? সে বলেছিল, “অত ভেবো না রঙ্গনাদি! সব ঠিক হয়ে যাবে”। তারপর ওর হাতটা হাতে তুলে নিয়ে কিন্তু কিন্তু ভাব নিয়ে বলেছিল, “যদি কিছু হয়েও যায় তোমার, অলোকদা তো আছেন! উনি তো বাবা, দেখবেন বইকি মেয়েকে!”
কোটরাগত চোখের মণিদুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল, ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল “আমি ঠিক হয়ে গেলে তোমাদের অলোকদাও দেখো, আবার আমাকে ভালোবাসবে। যতই হোক, পুরুষমানুষ তো, কঙ্কালসার চেহারা, কোটরে বসা চোখ, আর ঢাউস একটা পেট নিয়ে এখন আমার যে চেহারা তাকে কি ভালোবাসা যায়?” বলতে বলতে হু হু করে কেঁদেও ফেলেছিল সে।
নার্গিস তার সহকর্মী, তার সব কথাই সে জানে। সে কেবল তার গায়ে হাত বোলায়, চোখের জল মুছিয়ে দেয়। একটু পর সে না বলে পারেনি, “এক বছর আগেও তুমি খুব মিষ্টি এক মেয়ে ছিলে, রঙ্গনাদি! তখনও অলোকদা তোমার গায়ে হাত তুলত, তোমার দুধে-আলতা গায়ের রঙে কালসিটের দাগ এড়াতে পারতে না। তবুও তুমি তার জন্য বিবাহবার্ষিকিতে দামী পাঞ্জাবী কিনে নিয়ে এসেছিলে। আঘাতেও তুমি প্রত্যাঘাত না করে গায়ের ধুলো মুছে নিয়ে হেসেছ। আসলে আমাদের রঙ্গনাদি ভালোবাসাতেই মুক্তি খুঁজে পেয়েছে।” একটু থেমে আবার বলেছিল নার্গিস, “ভালোবাসাকেই তুমি ভালোবাসতে, তাই প্রত্যাশা করোনি কিছুই। কিন্তু মানুষের খুব ভালোমানুষীকে অনেকে সহ্য করতে পারে না, জানো তো?”
রঙ্গনা হঠাৎ খুব কষ্ট অনুভব করে, বুকের মধ্যে দম কমে আসে যেন। তবু হাসি হাসি মুখে জানলা দিয়ে তাকায় রঙ্গনা। লাল ঘুড়িটা এখনও আকাশে উড়ছে।
সবুজ ঘুড়িটাকে আর দেখা যাচ্ছে না। কখন সে কোথায় খসে পড়েছে, কে জানে! অথচ তার মনে হচ্ছে, এই তো মাত্র সে দেখল ঘুড়িটা আকাশের উঁচু থেকে ধীরে ধীরে নেমে আসছে! তার বুকের ভেতর এমন চাপ লাগছে কেন? আকাশ কালো হয়ে অকাল সন্ধ্যে নামল বুঝি! নাহ্! ওই তো ঘুড়িটা! এক ঝলক দেখল – কমলা আলোর ভেতর – ওই তো ঘুড়িটা নেমে আসছে - ! তারপর ঘন অন্ধকারে ঘুড়িটা ডুবে গেল।
ঘাসফুলেরা নিশ্চয় দেখেছে তার খসে পড়া, ছেলের দল হয়তো কুড়িয়ে নিয়ে গেছে সেই সবুজ ঘুড়ি! ঘাসফুলেরা হয়তো একইরকমভাবে খুশিমনে দুলে চলেছে!
রঙ্গনার শরীরটা কেমন হালকা হয়ে তার মাথা বালিশে নির্ভার নেমে আসে।
সুচিন্তিত মতামত দিন