অন্যরকম ভুজুং দিচ্ছে অন্যরকম হাওয়া
স্বর্গ, নরক, পাপ-পুণ্য ফারাক করতে না পেরে যারা ঝুলছে মিনিবাসের হাতল ধরে তাদের মাথায় মিলখা সিং কিন্তু পেটে বাতাপি রাক্ষস। প্রতিটা দৌড় অকালে হাঁসফাঁস করে। পেট ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চায়। অন্তিম ফিতে ক্রমশ ফিকে... ঝাপসা। পয়সাওলা শহুরে গেরস্থেরা ম্যারাথন ম্যারাথন খেলে। দাঁতে মেডেল কামড়ে সেলফি! পাশে লেখা থাকে কত মিনিট, কত কিমি, আরো সব কত কী! আর বাতাপি রাক্ষস পেটে নিয়ে প্রতিটা দৌড় গিলে ফেলা হরিপদ কেরানির দল এককালে বিস্ফারিত করত অক্ষিগোলক, এখন সরু চোখে বুঝে নিতে চায় কত ধানে কত চাল! কোন চালে কিস্তিমাত... অন্তত একবার। নতুন স্লোগান আউড়ে নিতে হয়- ‘আপনা টাইম আয়েগা’। ‘আমি আমি’ রোগ প্রকাণ্ড এখন ... ওই ওই বাতাপির মতোই। একটা গোটা সমান্তরাল পৃথিবী চলে ‘আমি’র চক্করে।
দিন বদলানোর আহ্বান, গান, কবিতা আর তেমন হয় না। হলেও হিট হয় না। ‘আয়রে আয় লগন বয়ে যায়’ গাইতে গাইতে যে অপেক্ষা ছিল এককালে, তা মুড়িয়ে গেছে নটে গাছের মতো। দিন পাল্টাবে ভেবেছিল যারা তাদের চোখ পাথর। ঘাটে বসে অস্পষ্ট জল দুই হাতে সরিয়ে তারা দেখতে থাকে, খুঁজতে থাকে। নষ্ট দিন আর কত নষ্ট হবে? যখন ভালো করে ঘর মোছে খুকু মাসি মনে হয় নোংরাগুলো আজকের মতো অন্তত মুছে যাক। কেমন আরাম হয়। ঘষে ঘষে তুলে ফেলছে তেলচিটে কোরাপশন, গ্রিলে, পাল্লায় যত ধুলো, বেনামি কারনামার মতো সেঁধিয়েছিল... সব সাফ হোক... ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
খাটের তলায় যেদিন গোলাপি নোট পাওয়া গেল, টিভি দেখতে দেখতে চোখগুলোয় আঠা লাগেনি খুকু মাসির, সারারাত ভেবেছে- এত টাকা! কড়কড়ে! টান টান! থাক থাক কোটি কোটি সাজানো! ট্রাক আসে, টাকা নিয়ে যাবে। হাতের মুঠোয় মাসের শেষে কতগুলো ন্যাতানো নোট, গলে যায় তেল, নুন, চালে। বাবুদের ঘরেদোরে ছত্রাকের মতো ফুটে ওঠে টাকা! সারা রাত গুনেও শেষ হবে না। আলিবাবা আর চল্লিশ চোরের আরব্যরজনী জ্যান্ত, প্রকাণ্ড। চিচিং ফাঁক। আলি আর আলির বউ মোহর গুনছে আর কুনকের তলায় আটকে যাচ্ছে একটা জীবন। একটা সময়। কালে কালে বাতাপি আরও দীর্ঘ হয়। ছিঁচকেমোপনাগুলো সয়ে যায় ক্রমশ। কেমন রাক্ষস রাক্ষস ফিলিং! গালাগাল, তোলাবাজি, মাফিয়ারাজ লার্জার দ্যান লাইফ। ট্রোল ট্রোল খেলা। ভেতরের কাঁটাঝোপ হিলহিলিয়ে ছুটে আসে। দিব্য টাইম পাশ। ছুঁড়ে দিই ইতরামি, কলতলা... ফিরে আসে বটতলা, খাপ-সভা, রাহুগ্রাস।
রাতগুলো এখন দীর্ঘ সুড়ঙ্গ। সকালগুলো বিচ্ছিরি। ঘোলা ঘোলা। অপরিচ্ছন্ন। অনন্ত পথের দিকে নজর। কিছু একটা হোক। কিছু একটা হবে। ঝড় উঠবে। বেয়াক্কেলে ঝড়। দিন দুপুর ঢেকে যাবে ধোঁয়ামেঘে। মিনারগুলো গর্জে উঠবে। তাণ্ডবের সিকোয়েন্স তো এমনই হয়। অনাচার, পাপ পুণ্যের নৌকারা ডুবতে থাকে। জল থেকে উঠে আসবে স্নিগ্ধ স্বর্গীয় লক্ষ্মীমন্ত নারী, অমৃতের কলস। খাঁ খাঁ মাঠ সিক্ত হবে। ফুটিফাটা জিভ বার করা খেত দুলে ওঠে, তেষ্টায় ছাতি-ফাটা ফেরিওয়ালারা সেদিন ছেলেমেয়ের জন্য আইসক্রীম কেনার স্বপ্ন নিয়ে বাড়ি ফেরে। এসব ঘটে এসেছে পুরাণে, ব্রতকথায়, সিনেমায়, সিরিয়ালে, এমনকি সাহিত্যেও। উৎসবেও হয়তো। উৎসবের মাপ এখন বিরাট। এখন ক্যারিশ্মা কতটা বিশাল বোঝানোর জন্য সবের সামনে ‘মহা’ যোগ হয়। মহাঅষ্টমী, মহানায়ক, মহানায়িকা মহামিছিল, মহাধামাকা, মহাপ্রসাদ, মহাসংগ্রাম ইত্যাদি। বুর্জ খলিফা মণ্ডপ ইয়া বড়ো, মা দুর্গার গায়ে হিরে বসানো আসল সোনার গয়না, বড়ো বড়ো মোবাইল ঝিলিক- চোখ ঠিকরে আসে খুকু মাসির! সবকিছুই নাগালের ওপারে... তাক লাগানো! মাথা ঝিম ঝিম করে।
“...ভেবেছিলুম, যে দিকে যাই, জ্বালতে- জ্বালতে যাব
শহর-গঞ্জ-কারখানা-কল, কিন্তু এখন প্রাণে
অন্যরকম ভুজুং দিচ্ছে অন্যরকম হাওয়া...
...শুনেই আমি চমকে উঠি, পথের শক্ত ইঁটে
লাথি কষাই, হাওয়ার মধ্যে কোড়া
ঘুরিয়ে বলি, “আয় রে আমার অশ্বমেধের ঘোড়া;
আয়, যেরকম কথা ছিল, তেমনি করে বাঁচি।
তেমনি করে কেউ বাঁচে না, নেই-কুসুমের তোড়া
কেউ বাঁধে না, কোত্থেকে জল কোথায় চলে যাচ্ছে।
নজর করলে পাবি, রক্ত শুষে খাচ্ছে
আশ্বমেধের ঘোড়ার পিঠে রাক্ষুসে এক মাছি।” (ঘোড়া- নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী)
ভনভনে মাছি। কাদাগোলা মাঠ, ভকভকে গন্ধ আর জটলা, পিঠ ঠেকিয়ে ভার্চুয়াল দেওয়ালে। মজে যাওয়া ডোবায় ব্যাঙগুলো লাফিয়ে ওঠে। তিরতিরে সাপ মুখ উঁচিয়ে দেখে নেয়, ছক মেপে ঘুঁটি সাজায়। দু চারটে পাঁকাল, ল্যাটা, চারাপোনা চৌকাঠে উঠে আসে। আর কিছুই হয় না মনে রাখার মতো। মেঘলা দিবস, ঘোলাটে দিবস, প্রলয় দিবস পালনের পর কিছুদিন বিশ্রাম নেয় গেরস্থের দল। তারপর এই তিমির থাকে সেই তিমিরেই। আর ওই তিমিরেরা ভুলে গেছে যুদ্ধ। কবি জানতেন হয়তো এরকমই হবে।
নিহত ছেলের মা
আকাশ ভরে যায় ভস্মে
দেবতাদের অভিমান এইরকম
আর আমাদের বুক থেকে চরাচরব্যাপী কালো হাওয়ার উত্থান
এ ছাড়া
আর কোনো শান্তি নেই কোনো অশান্তিও না।
(‘তিমির বিষয়ে দু-টুকরো’ - শঙ্খ ঘোষ )
সাম্প্রতিক সময়ের চমৎকার কোলাজ।
উত্তরমুছুন~ রাজদীপ ভট্টাচার্য
সমর্পিতা অনবদ্য। মানুষের নীতিবোধ, সমাজ, রাজনৈতিক অনাচার সব কিছুর প্রতিফলন ঘটেছে তোমার লেখার মাধ্যমে।
উত্তরমুছুনখুব জোরালো, স্বচ্ছ একটা অভিঘাত তৈরি হয়েছে যা কিন্তু ভাবাবে পাঠককে পড়ার পর।