বনবীথি_পাত্র - মায়াজম

Breaking

২৬ জানু, ২০২৪

বনবীথি_পাত্র

 



বহু_বসন্ত_পরে


-আপনি রঙ খেলবেন না!
পছন্দের রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনছিলেন গার্গী। কানে হেডফোন থাকায়, কথাটা শুনতে পাননি। কিন্তু পাশের চেয়ারটায় কেউ একজন এসে বসায়, স্বাভাবিক ভাবেই সেদিকে চোখ চলে যায়। মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলার সাথে মৃদুর হাসি বিনিময় হয়। ভদ্রলোক কিছু একটা বলছেন মনে হওয়ায় কান থেকে হেডফোনটা খুলতেই ভদ্রমহিলা আবারও বলেন,
-আপনি রঙ খেলবেন না?
মৃদু হেসে ঘাড় নাড়েন গার্গী।
বেশ অনেক বছরই হয়ে গেল দোলের দিনটা নিয়ম করেই বাড়ির বাইরে থাকে গার্গী। মাঝে একটা দিন ছুটি নিলেই এই বছর দোলে পরপর পাঁচটা দিনের ছুটি টা বছরের শুরুতে নতুন ক্যালেন্ডার পেয়েই দেখে নিয়েছিল। আর তখনই মনে মনে ট্যুর প্ল্যানটা করে ফেলেছিল। তেমন বড়সড় কোনও প্ল্যান নয়, শুধু ওই রিসর্টে ঘরটা বুক করে রাখা। আগে থেকে বুক করে না রাখলে বহু মানুষের ভিড়ে ছুটির অবকাশগুলোতে মনের মত ঘর পাওয়া যায় না। পাহাড় পছন্দ হলেও এই বছর সমুদ্রেই আসাটা ফাইনাল করেছিল। আর হাতের কাছে মন্দারমণির মত সুন্দর ছুটি কাটানোর জায়গা গার্গীর মতে আর কোনটাই নেই। কর্মব্যস্ত জীবন থেকে ছুটি নিয়ে শুধুই সমুদ্র দেখা, পছন্দের বই পড়া আর গান শোনা। রবীন্দ্রসঙ্গীত ভীষণ প্রিয় গার্গীর।
মন্দারমণিতে এখন আর সেই আগের নিরিবিলি পরিবেশ পাওয়া যায় না। এই তো কিছুক্ষণ আগে রিসর্টের সামনের লনটাতে একদল অল্পবয়সী ছেলেমেয়ে প্রথম নিজেদের রঙ খেলা শুরু করল। তাদের দেখে তো রিসর্টের বাচ্চা বুড়ো প্রায় সকলেই রঙের টানে মিশে গেল ওদের সাথে। ব্যালকনিতে বসে ওদের রঙ খেলা দেখতে মন্দ লাগছিল না গার্গীর।
ওদের বাড়িতে রাধামাধবের নিত্য সেবা হয় সারা বছর নানা অনুষ্ঠান লেগে থাকলেও দোল উৎসবটা যেন সম্পূর্ণ আলাদা। দারুণ হৈচৈ আর সমারোহ করে দোল পালন হয় বাড়িতে। আত্মীয়স্বজনরা অনেকেই আসেন সেই উৎসবের টানে। রাধামাধবের পুজোর পর ঠাকুরের পায়ে আবীর দেওয়ার পর মন্দিরের বিশার দালানে সবাই মিলে রঙ খেলার কথা এখনও ভীষণ মনে পড়ে গার্গীর। ওই দিনটার জন্য তো সারা বছর ধরে অপেক্ষাতে থাকত ছোটবেলায়।
অপেক্ষার রংটা পাল্টে গিয়েছিল বাপনদার সাথে পরিচয়ের পর। বাবার জ্যেঠতুতো বৌদির ভাইপো। উত্তরবঙ্গে বাড়ি। তখন কলেজে পড়ত। প্রথম যেবার দোলে ওদের বাড়ি এল, গার্গী সেই বছর উচ্চ মাধ্যমিক দেবে। তখন থেকেই দানা বাঁধতে শুরু করেছিল সম্পর্কটা। তখন মোবাইল ছিল না। ল্যাণ্ডফোনে লুকিয়ে চুরিয়ে সারা বছরে সর্বসাকুল্যে দশ দিনও কথা হত না। বছরে একবার, দোলের সময় তিন চারটে দিন ভীষণ আনন্দে কাটত। শুধু রঙ খেলার আনন্দ নয়, সে এক অন্য আনন্দ।
দোলের আগের দিন রাতে সবাই যখন ন্যাড়াপোড়াতে ব্যস্ত; বাগানের পিছন দিকটাতে গিয়েছিল ওরা দুজনে। বাপনদা তখন ব্যাঙ্কে চাকরি পেয়ে গেছে। সম্পর্কটার এবার পরিণতি দরকার। কথাটা কীভাবে বাড়িতে জানাবে সেই আলোচনাই করছিল দুজনে। সেজকাকা কখন যে পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে, বুঝতে পারেনি ওরা।
যে সম্পর্কের কথাটা বাড়িতে জানাবে বলছিল, সেটাই জানাজানি হতেই যেন আগুন জ্বলে উঠেছিল বাড়িতে। সেবার রঙ খেলাই হয়নি। বাড়ি জুড়ে কেমন থমথমে পরিবেশ। দোলের দিন দুপুরেই বাড়ি ফিরে গিয়েছিল বাপনদা। ঝুম্পিকে দিয়ে একটা চিরকুট লিখে পাঠিয়েছিল,
-তুমি চিন্তা কোরো না। শুধু একটু অপেক্ষা কোরো। আমি তোমাকে নিতে আসব।
বাড়িতে সবাই গার্গীর বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল। সবার সমস্ত ক্ষোধ, শাসন সহ্য করেও কিছুতেই বিয়েতে মত দেয়নি গার্গী। বাড়ির পরিবেশ শান্ত স্বাভাবিক হতে সময় লেগেছিল কিছুদিন।
পড়াশুনো শেষ করে চাকরি পেয়েছিল। গ্রামেরই গার্লস স্কুলে ভূগোলের দিদিমণি গার্গী। অনেক ভালো ভালো সম্বন্ধ এসেছিল। বিয়েতে রাজি হয়নি। গার্গী অপেক্ষা করেছিল।
-রঙ না খেলে এখানে বসে থাকবে নাকি?
কণ্ঠস্বরটা কেমন যেন চেনা চেনা লাগে গার্গীর। তাকিয়ে দেখে আপাদমস্তক রঙ মেখে এক ভদ্রলোক পাশে বসা ভদ্রমহিলাকে রঙ খেলতে যাওয়ার জন্য জোর করছেন। কথাবার্তা শুনেই বোঝা যায় তাঁদের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক। ভদ্রলোক হঠাৎ গার্গীকে বলেন,
-আমার গিন্নির মত আপনারও বুঝি রঙে ভয়?
বহু বছর পর বাপনদা আর গার্গী মুখোমুখি। কয়েকটা নিষ্পলক মুহূর্তের পর গার্গী বলে,
-জীবনে এত রঙের মানুষ দেখেছি যে রঙের নামেই ভয় হয়....

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র