গোপা বসু - মায়াজম

Breaking

২৬ জানু, ২০২৪

গোপা বসু




কোন সে আলোয়


ই শুরু হয়ে গেলো পাখিদের কিচির - মিচির, ওমা, আকাশের কালো সরে আলো ফুটছে তো। প্রথম দিকে এই জানলার পাশে শুয়ে ভোর হতে না হতেই কিচিরমিচিরে ঘুম ভেঙে যেতো।আসলে অভ্যাস ছিলো না একেবারেই। চিরদিনই শহরে মানুষ, তেমন করে পাখপাখালির রোজানমাচায় অভ্যস্ত ছিলনা।শহরের একটেরে এই দুশো বছরের পুরনো বাড়ি আর তার পিছনে বড়ো বড়ো গোটাকতক গাছে ভরা ভরা ফালি বাগান, সবটাই কেমন জানি অন্যরকম।শহরের সব পাখিরা বোধহয় এই বাগানেই তাদের ডেরায় ফেরে আর সকালে তাদের দিনশুরুর গেরস্থালীর আওয়াজে এমন সরগরম হয়ে ওঠে। প্রথম দিকে ঘুম ভেঙে গিয়ে আর ঘুম আসতে চাইতো না পরে তো সবই অভ্যাস হয়ে যায়, তেমনটাই হোল।এখন আর অসুবিধা হয় না, তবে আমাদের আজকের গল্পটা আলাদা- আজ ঘুমই ছিলো অনুপস্থিত। শেষ দিনের শেষ রাত শেষের এই শেষ ভোর কে সমস্ত শরীর মন দিয়ে অনুভব করা হয়তো ইচ্ছেয় না অনিচ্ছেয়।এই অভ্যাসকেও তো আবারও বদলে নিতে হবে.সেখানে পরিবেশ শান্তই হবে কিন্তু এই আবছায়া মেশা এই বাড়ি এই গাছগাছালি, এই পাখি, এদের আর দেখা পাওয়া যাবে না এ জীবনে। তাই কি? এখানে আসার পরও এটাই মনে হয়ে ছিলো, মনে হয়ে ছিলো এটাই হয়তো চিরজীবনের মতো নিজের জায়গা। কিন্তু সবটাই তো বদলে গেলো।

জন্ম থেকেই বোধহয় নির্দিষ্ট ঠিকানাটা লেখা হয়নি।প্রথমে বাবা, তারপর মায়ের মৃত্যু -বাবা গেলেন তখন বয়েস চৌদ্দ-পনেরো।দিদির বিয়ে হয়ে গেছে আগেই, মা'ও প্রায় তারপর থেকেই অসুস্থ, ক্রমে একেবারে বিছানা নিলো।লেখাপড়াতে তেমন মন বা মাথা কোনকালেই ছিলো না।এই অবস্থায় তা বন্ধ হয়ে ঘর আর ঘরের বাইরের সবটা চালিয়ে নেওয়া। মা চলে যেতেই মায়ের সাথে বাবার পেনসনও চলে গেলো। ওই তো বিদ্যের বহর আর বয়সও প্রায় চল্লিশের কোঠায়।অগত্যা বিয়ে বা কাজকর্মের সম্ভবনাহীন হয়ে দিদির সংসারে আশ্রয়, তার শ্বশুর-শাশুড়ী, ছেলে-মেয়ের চরকিপাকে ঘুরেই কাটছিলো।দিদির মেয়ের বিয়ে হলো, শ্বশুরমাশাই চলে গেলেন, ছেলেও চাকরি পেয়ে বিয়ে করবো করবো, ঠিক এমন সময়ে জামাইবাবু এক প্রস্তাব নিয়ে এলেন।ওঁদের ক্লাবের এক মেম্বার, বয়সে ওঁর থেকে কয়েক বছরের বড়,রিটায়ার্ড করেছেন, বিয়ে করেন নি এতোদিন। ভালো চাকরি করতেন, যথেষ্ট আয় করেছেন এতোদিন আর তার বলে তোফা কাটিয়েছেন ভায়ের সংসারে। এখন ভাই নেই আর বৌদিও আছেন না থাকার মতোই,তাদের বৌরাই এখন কর্তা।রিটায়ার কাকার থেকে আগের মতো পাওনাগন্ডায় টান পরতেই সব বদলে গেছে। সময় যা যাবার তা গিয়ে ঠেকেছে অসময়ে সাথে অসোন্তষের অনুপান।আরামে শরীর বিদ্রোহ করলো। কয়েক দিনের বিনাযত্নে হাসপাতালে নিয়ে ফেললো।খবর পেয়ে কিন্তু বন্ধুরাই টেনে তুললো।একজনের বাড়িতে প্রায় মাসখানেক
যত্নআত্তির সাথে সকলের পরামর্শ, আজকাল চৌষট্টি -পঁয়ষট্টি বয়সেই নয়,তার উপর শরীর স্বাস্থ্য মোটের উপর ভালোই, ভালো চাকরির সুবাদে পয়সারও তেমন অভাব নেই। তখন একজন সঙ্গিনী খুঁজতে দোষ কি!দিদিও বোঝালো তাদের অবর্তমানে ছেলের বৌয়ের আমলে এমনটাই যদি হয়।এক সন্ধ্যায় কয়েকজন বন্ধু ও ম্যারেজ রেজিস্ট্রার নিয়ে এলেন সেই অমূল্য বাবু- অমূল্য সেন।দিদির বাড়ির লোকজনের সাথে কয়েকজন পাড়াপ্রতিবেশির সামনে সুনীতি দত্ত সুনীতি সেন হলেন।আগে নাকি অমূল্য বাবুর ঘর ছিলো দোতলায়, হাসপাতাল ও বন্ধুর বাড়ি হয়ে ফেরার পর একতলার এইদিকে তার জায়গা হয়ে ছিলো। পুরনো বাড়ির অন্যদিকে ছিলো আরও কয়েক ঘর শরিক।বিয়ের পর ভাইপোদের বিরোধে পঞ্চাশ পার করে এইখানে এই আড়াইখানা ঘরেই ভালোবেসে নিজের সংসার সাজিয়েছিলেম।বেশ কাটলো বছর দশেক। এলো হঠাৎ করেই ভয়ংকর সময়। কেউ নেই তাই অমূল্য বাবুকেই প্রয়োজনে বেরোতে হতো। নিজের মতো করে যথাসাধ্য সাবধানতা নিয়েও শেষরক্ষা হলো না অতিমারীর আঘাতে। তারপর থেকেই এ বাড়িতে যুদ্ধ শুরু। স্বামীর পরিবারের বাকিদের দুর্ব্যবহার মাত্রা ছাড়ালো ধীরে ধীরে। তলে তলে কি যে তাদের মতলব! ছেলেদের নাকি বিয়ে দেবে তাই ঘর চাই।খবর পেলেম অন্যকিছুরও - নানাধরণের লোকজনের আনাগোনা।
জামাইবাবুও আর নেই। অমূল্যবাবুর বন্ধুরাও অনেক নেই।যাঁরা আছেন তাঁদের ও বয়স হয়েছে। দিদির ছেলেটাও আজকাল সপরিবারে বিদেশে। অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সুনীতি।ঘরের জিনিসপত্র কয়েকদিন বিলিব্যবস্থা করেছেন,সঙ্গী পুরনো কাজের লোক বীনা, সাথে তার বর ও ছেলে। বাকি সব ওকেই দিয়ে দিয়েছিলো।আজ সকালে দশটা নাগাদ ওরা তিনজন আসবে।নিজের জিনিসপত্র -দুটো সুটকেস আর একটা ব্যাগ দিয়ে তারা গাড়িতে তুলে দেবে। খবরেরকাগজ ও টেলিফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করে পারে বীনার ছেলেকে নিয়ে একবার দেখেও এসেছেন। পুরীর লোকালয় ছাড়িয়ে সমুদ্রের ধারে নুলিয়া বস্তির অদূরে পাঁচিলে ঘেরা নবদিগন্ত -তাঁর আগামী আশ্রয়। স্বল্পায়ু সংসার জীবনের স্বোপার্জিত প্রাপ্তি হয়তো এটাই জীবনের শেষ ঠিকানা...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র