অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায় - মায়াজম

Breaking

২৬ জানু, ২০২৪

অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়

 

হাংরি আন্দোলন এবং মলয় রায়চৌধুরীর পোস্টমর্টেম

বিভিন্ন বিষয়ে প্রবন্ধ লিখলেও সাহিত্য নিয়ে কখনও প্রবন্ধ লিখব এমন ভাবনা কোনোদিন আমার মাথায় আসেনি। ২০২৩ সালের ২৬ অক্টোবর মলয় রায়চৌধুরী আমাদের ছেড়ে পৃথিবী থেকে চলে গেলেন। মলয় রায়চৌধুরীকে বলা হয় ‘হাংরি আন্দোলনের কবি’ -- হাংরিয়ালিস্ট। ১৯৬১ সাল থেকে ২০২৩ সাল – টানা ৬২ বছরের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি লেখালেখি করে গেছেন।
কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, সাংবাদিক, গণ-বুদ্ধিজীবী এবং সর্বোপরি ১৯৬০-এর দশকের হাংরি আন্দোলন তথা হাংরিয়ালিজম তথা বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার জনক মলয় রায়চৌধুরী। হাংরিয়ালিস্ট আন্দোলন শুরুতে মলয় রায়চৌধুরীর নেতৃত্বে ছিল -- তার ভাই সমীর রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং হারাধন ধারা। পরবর্তীকালে আরও ৩০ জন কবি ও শিল্পী তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন, যাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিচিত ছিলেন রাজকমল চৌধুরী, বিনয় মজুমদার, উৎপল কুমার বসু, ফাল্গুনী রায়, সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র, রবীন্দ্র গুহ, অনিল করঞ্জাই প্রমুখ।
হাংরি আন্দোলনের ইংরেজি নাম জিওফ্রে চসার (Geoffrey Chaucer)-এর লাইন “in the sowre hungry tyme” থেকে নেওয়া হয়েছিল। বাঙালির দেশভাগোত্তর কালকে তিনি ক্ষুধিতরূপে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। এবং এর দর্শনটি অসওয়াল্ড স্পেংলার (Oswald Spengler)-এর "The Decline of the West"-এর উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল। যার মূল কথা হল একটি সংস্কৃতি যখন কেবল নিজের সৃজনক্ষমতার উপর নির্ভর করে, তখন সংস্কৃতিটি বিকশিত ও সমৃদ্ধ হয় । তার সৃজনক্ষমতা ফুরিয়ে গেলে, তা বাইরে থেকে যা পায় তাই খেতে থাকে, তার ক্ষুধা তখন তৃপ্তিহীন। হাংরি আন্দোলনকারীদের মনে হয়েছিল দেশভাগের পরে বাংলার সংস্কৃতি এই অবসাদের মুখে পড়েছে এবং উনিশ শতকের মণীষীদের পর্যায়ের বাঙালিদের আবির্ভাব আর সম্ভব নয়। সেকারণে হাংরি আন্দোলনকে তঁরা বললেন কাউন্টার কালচারাল আন্দোলন এবং নিজেদের সাহিত্যকর্মকে বলতেন ‘Counter discourse’।
বাংলা সাহিত্যের ভাঙ্গা-গড়া একবার নয়, একাধিকবার ঘটেছে। বিশ্ব সাহিত্যেও আন্দোলন হয়েছে প্রচুর। যেমন – সতেরো/আঠারো শতকের যৌন কাল্পনিক সাহিত্য (Amatory Fiction), যার উল্লেখযোগ্য লেখক হচ্ছেন এলিজা হেয়উড, ডেলিয়া ম্যানলে প্রমুখ। এরপর সময়ের স্রোত বেয়ে ঘটেছে আরও অনেক আন্দোলন। যেমন -- সতেরো শতকের Cavalier Poetry, যার উল্লেখযোগ্য লেখক যথাক্রমে রিচার্ড লাভল্যাস ও উইলিয়াম ডেভেন্যান্ট। এরপর Metaphysical poetry লিখেছেন জন ডন, জর্জ হার্বার্ট, অ্যান্ড্রু মার্ভেল প্রমুখ সাহিত্যিকেরা। আঠারো শতকে আলেকজান্ডার পোপ, জোনাথান সুইফটের চিরায়ত আদর্শ, বিদ্রুপ এবং সংশয়বাদকে আশ্রয় করে লিখেছেন Augustan Literature। উনিশ শতকে যুক্তি, বিজ্ঞান সমস্ত পরিত্যাগ করে আবেগ আর কল্পনাকে আশ্রয় করে Romanticism-এ সাহিত্যকে বেঁধে ফেললেন ভিক্টর হুগো, ক্যামিলো ক্যাস্তেলো । এরপর এলো Realism, Dark Romanticism ইত্যাদি সাহিত্যের নানা ধারা।
বাংলা সাহিত্যেও দুটি সাহিত্য আন্দোলন হয়েছিল। একটি ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ সালের মধ্যে, অপরটি ১৯৬৯ সাল নাগাদ। ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ সালের এই আন্দোলনটি বাংলা সাহিত্যের প্রথম আন্দোলন, যার নাম হাংরি আন্দোলন। প্রথা-বিরোধী আওয়াজ তুলে ইস্তেহার প্রকাশের মধ্য দিয়ে বাংলা শিল্প ও সাহিত্যের আঙিনায় যে আন্দোলন হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল, তার নাম ক্ষুধার্ত আন্দোলন (Hunry Movement)। ঔপনিবেশিকোত্তর ভারতের ঔপনিবেশিক সাহিত্যকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দিয়ে নিজেদের স্বত্ত্বার বহিঃপ্রকাশই ছিল এই আন্দোলনের আপাত অভিপ্রায়। সৃষ্টি হল হাংরি জেনারেশন (Hnry Generation) বা ক্ষুধার্ত প্রজন্ম। যাকে অনেকে বলেন ‘হাংরিয়ালিস্ট’ – ক্ষুধিত, ক্ষুৎকাতর, ক্ষুধার্ত আন্দোলন। এই ক্ষুধা অবশ্য শুধু আক্ষরিক অর্থেই ক্ষুধা ছিল না। তা ছিল সাহিত্যে মনের ভাব প্রকাশের ক্ষুধা, যথার্থ শব্দ প্রয়োগের ক্ষুধা, সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা এবং অবদমিত বাসনা পূরণের ক্ষুধা। আন্দোলনকারীদের মনে হয়েছিল যে, দেশভাগের ফলে পশ্চিমবঙ্গ ভয়ংকর অবসানের মুখে পড়েছে। তাঁদের মনে হয়েছিল কিছুটা হলেও এর বিরুদ্ধে দাঁড়ানো দরকার, আওয়াজ তোলা দরকার, আন্দোলন প্রয়োজন। অর্থাৎ দেশভাগোত্তর বাঙালির কালখণ্ডটিকে কবিরা হাংরিরূপে চিহ্ণিত করতে চাইলেন।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যে অত্যন্ত সাড়া জাগিয়েছিল হাংরি জেনারেশন আন্দোলন। বাংলা কবিতার আধুনিক ঘরানার মধ্যে হাংরি জেনারেশন আন্দোলনকারীরা প্রথম আবির্ভাবেই ‘নৈরাজ্যবাদী’ বলে আখ্যায়িত হয়েছিলেন। প্রধানত রাষ্ট্র, সমাজ, প্রেম, যৌনতা প্রভৃতির বিরুদ্ধে এঁদের ক্রোধ, ক্ষোভ ও আক্রমণ প্রকাশ পেত। কবিতায় শব্দ ব্যবহারে এঁরা নিষিদ্ধ, অপশব্দগুলোকে নির্বিচারে গ্রহণ করেছিলেন, তেমনই যৌন প্রসঙ্গকে অত্যন্ত রুক্ষভাবে তাঁদের লেখায় ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। যদিও আন্দোলনটি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গিয়েছিল, তবুও বিশ শতকের আট দশকের শেষ পর্যন্ত এই আন্দোলনের ফসল ফলেছিল। তবে এই একবিংশ শতাব্দীতেও আমরা হাংরি জেনারেশনের প্রভাব বিদ্যমান আছে।
১৯৬১ সালের নভেম্বরে পাটনা শহর থেকে একটি ইস্তেহার প্রকাশের মাধ্যমে হাংরি আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিলেন। যেসব কবিরা এই বিপ্লব ঘটাল তাঁরা নিজেদের দাবি করল ‘হাংরি জেনারেশন’ হিসেবে। পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ২১ বছরের এক তরুণ তুর্কি মলয় রায়চৌধুরী, যিনি নিজেকে পরিচয় দিলেন ‘একজন কালচারাল বাস্টার্ড’ হিসেবে। ১৯৬১ সাল। দেশভাগের পর পশ্চিমবঙ্গে একদিকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, অপরদিকে উদ্বাস্তু শরণার্থীর ভিড়। অন্যদিকে অর্থনৈতিক স্বরাজের স্বপ্নকে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে স্বার্থ আর নোংরা রাজনীতির নগ্ন খেলা। হাংরি জেনারেশনের কবি মলয় রায়চৌধুরী নিজেই লিখছেন,“স্বদেশি আন্দোলনের সময় জাতীয়তাবাদী নেতারা যে সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা টকে গিয়ে পচতে শুরু করেছে উত্তর ঔপনিবেশিক কালখণ্ডে”।
হাংরি জেনারেশনের আন্দোলনের কোনো হেড কোয়ার্টার, হাইকমান্ড, গভর্নিং কাউন্সিল ছিল না। হাংরি জেনারেশন আন্দোলন কুক্ষিগত ক্ষমতাকেন্দ্রের ধারণাকে অতিক্রম করে আন্দোলনকে সবক্ষেত্রে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিল। হাংরি জেনারেশন আন্দোলন তৎকালীন সমাজের প্রথাগত নীতিবোধ আর চেতনায় নিদারুণ আঘাত হেনেছিল। প্রতিঘাতে তাঁদেরও আক্রান্ত হতে হয়েছিল। প্রথাগত সাহিত্য-সংস্কারকে ক্রমাগত চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছিল হাংরি মুভমেন্ট। সমাজে হাংরিরা এমন ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছিলেন, যেটা ষাটের দশকের বাংলা সাহিত্যে হওয়া অন্য কোনো মুভমেন্ট করতে পারেনি, সবকিছুকে এভাবে ভেঙে চুরমার করে দিতে সক্ষম হয়নি। হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে প্রথাগত সাহিত্যের যে পার্থক্য, সেটা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে হাংরি কবি সুবিমল বসাক, হিন্দি ভাষার হাংরি কবি রাজকমল চৌধুরীর করা একটি ত্রিভাষিক (বাংলা-ইংরেজি-হিন্দি) হাংরি বুলেটিনে প্রকাশ পাওয়া একটি তালিকা থেকে, হাংরি জেনারেশন আন্দোলন সম্বন্ধে ধারণাটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। যেমন -- (১) প্রথাগত সাহিত্য > হাংরি সাহিত্য, (২) প্রাতিষ্ঠানিক > প্রতিষ্ঠান-বিরোধী, (৩) শাসক সম্প্রদায় > শাসক-বিরোধী, (৪) ভেতরের লোক > বহিরাগত, (৫) এলিটের সংস্কৃতি > জনসংস্কৃতি, (৬) তৃপ্ত > অতৃপ্ত, (৭) আসঞ্জনশীল > খাপছাড়া, (৮) লোক-দেখানো > চামড়া ছড়ানো, (৯) জ্ঞাত যৌনতা > অজ্ঞান যৌনতা, (১০) প্রেমিক > শোককারী, (১১) নিশ্চল > তোলপাড়, (১২) ঘৃণার ক্যামোফ্লোজ > খাঁটি ঘৃণা, (১৩) আর্ট > জনগণ, (১৪) শিল্প > জীবন সমগ্র, (১৫) রবীন্দ্রসঙ্গীত > যে-কোনো গান, (১৬) শিষ্ট ভাষা > গণভাষা, (১৭) দায়মুক্ত > দায়বদ্ধ, (১৮) ফ্রেমের মধ্যে > ফ্রেমহীন, (১৯) উদাসীন > এথিকস আক্রান্ত, (২০) মেইনিস্ট্রিম > ওয়াটারশেড, (২১) কৌতুহল > উদ্বেগ, (২২) ক্ষমতাকেন্দ্রিক > ক্ষমতাবিরোধী, (২৩) এন্টারটেইনার > থটপ্রোভোকার, (২৪) আত্মপক্ষ সমর্থন > আত্ম-আক্রমণ, (২৫) আমি কেমন আছি > সবাই কেমন আছে, (২৬) ছন্দের একাউন্টটেন্ট > বেহিসেবি ছন্দ খরচ, (২৭) কবিতা নিখুঁত করতে কবিতা রিভাইজ > জীবনকে প্রতিনিয়ত রিভাইজ, (২৮) কল্পনার খেলা > কল্পনার কাজ, (২৮) আনন্দ > উৎকণ্ঠা ইত্যাদি।
হাংরি জেনারেশনের আন্দোলনের সময়কাল খুব সংক্ষিপ্ত -- ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ পর্যন্ত। এই সামান্য সময়কালে শতাধিক ছাপানো ও সাইক্লোস্টাইল করা বুলেটিন প্রকাশ করা হয়েছিল। অধিকাংশই হ্যান্ডবিলের মতো ফালি কাগজে, কয়েকটা দেয়াল পোস্টারে, তিনটি এক ফর্মার মাপে এবং একটি কুষ্ঠি-ঠিকুজির মতো দীর্ঘ কাগজে, যাতে উৎপলকুমার বসুর ‘পোপের সমাধি’শিরোনামের বিখ্যাত কবিতাটি ছিল। এই যে হ্যান্ডবিলের আকারে সাহিত্যকৃতি প্রকাশ, এরও পেছনে ছিল সময়কেন্দ্রিক ভাবধারাকে চ্যালেঞ্জের স্পর্ধা। ইউরোপীয় সাহিত্যিকদের পাঠবস্তুতে তো বটেই, মাইকেল মধুসুদন দত্তর প্রজন্ম থেকে বাংলা সন্দর্ভে প্রবেশ করেছিল শিল্প-সাহিত্যের নশ্বরতা নিয়ে হাহাকার।
মলয় রায়চৌধুরী তাঁর ‘হাংরি জেনারেশন সাহিত্য আন্দোলন’ প্রবন্ধে লিখছেন – “১৯৬১ সালের প্রথম বুলেটিন থেকেই হাংরি আন্দোলন চেষ্টা করল সময়তাড়িত চিন্তাতন্দ্র থেকে সম্পূর্ণ পৃথক পরিসরলব্ধ চিন্তাতন্ত্র গড়ে তুলতে। সময়ানুক্রমী ভাবকল্পে যে বীজ লুকিয়ে থাকে, তা যৌথতাকে বিপন্ন আর বিমূর্ত করার মাধ্যমে যে মননসন্ত্রাস তৈরি করে, তার দরুন প্রজ্ঞাকে যেহেতু কৌমনিরপেক্ষ ব্যক্তিলক্ষণ হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয়া হয়, সমাজের সুফল আত্মসাৎ করার প্রবণতায় ব্যক্তিদের মাঝে ইতিহাসগত স্থানাঙ্ক নির্ণয়ের হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ব্যক্তিক তত্ত্বসৌধ নির্মাণ। ঠিক এই জন্যেই, ইউরোপীয় শিল্পসাহিত্য আন্দোলনগুলো খতিয়ে যাচাই করলে দেখা যাবে যে ব্যক্তিপ্রজ্ঞার আধিপত্যের দামামায় সমাজের কান ফেটে এমন রক্তাক্ত যে সমাজের পাত্তাই নেই কোন। কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর দিকে তাকালে দেখব যে পুঁজিবলবান প্রাতিষ্ঠানিকতার দাপটে এবং প্রতিযোগী ব্যক্তিবাদের লালনে সমসাময়িক শতভিষা গোষ্ঠী যেন অস্তিত্বহীন। এমনকি কৃত্তিবাস গোষ্ঠীও সীমিত হয়ে গেছে দুতিনজন মেধাস্বত্বাধিকারীর নামে। পক্ষান্তরে, আমরা যদি ঔপনিবেশিক নন্দনতন্ত্রের আগেকার প্রাকঔপনিবেশিক ডিসকোর্সের কথা ভাবি, তাহলে দেখব যে পদাবলী সাহিত্য নামক স্পেস বা পরিসরে সংকুলান ঘটেছে বৈষ্ণব ও শাক্ত কাজ; মঙ্গলকাব্য নামক-ম্যাক্রো-পরিসরে পাবো মনসা বা চন্ডী বা শিব বা কালিকা বা শীতলা বা ধর্মঠাকুরের মাইক্রো-পরিসর। লক্ষণীয় যে প্রাকঔপনিবেশিক কালখন্ডে এই সমস্ত মাইক্রো-পরিসরগুলো ছিল গুরুত্বপূর্ণ, তার রচয়িতারা নন। তার কারণ সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে ব্যক্তি-মালিকানার উদ্ভব ও বিকাশ ইউরোপীয় অধিবিদ্যাগত মননবিশ্বের ফসল। সাম্রাজ্যবাদীরা প্রতিটি উপনিবেশে গিয়ে এই ফসলটির চাষ করেছে।”
১৯৬৩ সালে মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা "প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার" (Stark Electric Jesus), যা হাংরিয়ালিস্টদের বিরুদ্ধে সরকারের পদক্ষেপকে প্ররোচিত করেছিল। রায় চৌধুরী বাংলা সাহিত্যে স্বীকারোক্তিমূলক কবিতার প্রবর্তন করেছিলেন। কবিতাটি প্রথাগত রূপগুলিকে, যেমন -- সনেট (sonnet) , ভিলানেল (villanelle) , মিনেসাং (minnesang) , পাস্টোরেল (pastourelle) , ক্যানজোন (canzone) ইত্যাদি। সেইসঙ্গে বাংলা মাত্রা (যেমন, মাত্রাবৃত্ত এবং অক্ষরবৃত্ত) অস্বীকার করেছে। তাঁর ‘জখম’ কবিতাটি বেশি পরিচিত এবং একাধিক ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতার কয়েকটা লাইন এখানে উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারছি না -- “ওঃ মরে যাব মরে যাব মরে যাব/আমার চামড়ার লহমা জ্বলে যাচ্ছে অকাট্য তুরুপে/আমি কী কোর্বো কোথায় যাব ওঃ কিছুই ভাল্লাগছে না/সাহিত্য-ফাহিত্য লাথি মেরে চলে যাব শুভা/শুভা আমাকে তোমার তর্মুজ-আঙরাখার ভেতরে চলে যেতে দাও/চুর্মার অন্ধকারে জাফ্রান মশারির আলুলায়িত ছায়ায়/সমস্ত নোঙর তুলে নেবার পর শেষ নোঙর আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে/আর আমি পার্ছিনা, অজস্র কাঁচ ভেঙে যাচ্ছে কর্টেক্সে/আমি জানি শুভা, যোনি মেলে ধরো, শান্তি দাও।”
মলয় রায়চৌধুরীর ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি পড়ে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন এ সময়ের কবি সোনালী মিত্র। তিনি তাঁর ‘বিস্ফোরণ ও শুভা’ কবিতায় লিখলেন, “…আমিও সেঁটে নিচ্ছি তকমা ! নারীবাদী হলে/কতটুকু লাভ চেটেপুটে নেওয়া যায় ক্যালকুলেশান বইয়ে দিচ্ছি/ফেসিয়ালে মোমতোলা লোম ত্বক !/তোমার শিরায়-প্রতিশিরায় একশ ছিনেজোঁক বাসা/ বাঁধবে বলেনি,/আমার জঙ্ঘার মধ্যবিত্ত গুহায় ঘোলা রসে তোমার নাম নিয়ে/প্যান্টি ভিজিয়ে যাবে এমনও ঘটেনি প্রিয় পুরুষ।/তবুও তোমার প্রেমে পড়া যায় !/গত এককুড়ি রমণীর মতো/বুকের ওড়না সরিয়ে বলতেই পারি আমিই-বা কম কিসে।…”
অধ্যাপক শীতল চৌধুরী তাঁর ‘মলয় রায়চৌধুরী কবিতা : প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ শিরোনামের প্রবন্ধে লিখছেন, “যৌনতায় ডুবে যাওয়া নয়, কেবল যুগযন্ত্রণার অসুস্থতায় আচ্ছন্ন থাকাই কবি মলয়ের কাম্য নয়। তিনি চান জীবন যাপনের সত্য প্রকাশের মধ্যে দিয়ে প্রেমে-অপ্রেমে-বিদ্রোহে ওলোটপালট করে মানবিক, দৈহিক ও শারীরিক ক্ষুধায় জীবনের এক পূর্ণতা, এমনটি শিল্পেরও।…কবি মলয়ের অস্তিত্বময় সংকট ও আত্মদর্পণের বিস্ময়প্রসূত আত্মজিজ্ঞাসার একটি সার্থক সত্যসুন্দরের দলিল হল ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি। একথা বলার কারণ মলয়ের আত্মধিক্কারের মধ্য দিয়ে নতুন পথ খোঁজার আত্যন্তিক ইচ্ছের ব্যাপারটি কবিতার মধ্যে বারবার ব্যক্ত হয়েছে, কখনো সরাসরি ভদ্র-প্রতিবাদীর মোড়কে, কখনো শ্লীলতার মাত্রা ছাড়ানোর অভিব্যক্তিতে।”
যাই হোক, ১৯৬৫ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার মলয় রায়চৌধুরী এবং তার ভাই সমীর রায়চৌধুরী সহ ১১ জন হাংরিয়ালিস্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলে হাংরিয়ালিজম আরও প্রকট হয়। ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসনাগাদ ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২০(বি), ২৯২ এবং ২৯৪ ধারায় যে ১১ জন কবির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল, তাঁরা হলেন -- মলয় রায়চৌধুরী, শৈলেশ্বর ঘোষ, দেবী রায়, সুভাষ ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, সমীর রায়চৌধুরী, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুবো আচার্য এবং সুবিমল বসাক। এঁদের মধ্যে প্রথম ৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল এবং কলকাতার ব্যাংকশাল কোর্টে তোলা হয়েছিল। মলয় রায়চৌধুরী হাতে হাতকড়া এবং কোমরে দড়ি পরে হেঁটেছিলেন কলকাতার রাস্তায় চোর- ডাকাতের পাশে। ফেরারি হয়ে যান সুবো আচার্য ও রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। বিশ্বভারতী থেকে বহিষ্কৃত হন প্রদীপ চৌধুরী। উৎপলকুমার বসু অধ্যাপনা থেকে বরখাস্ত হন। যাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছিলো তাদের কারো-কারো চাকরি চলে গেল, কয়েকজনকে করা হল বদলি। ফলে একপ্রকারে বন্ধ হয়ে গেল হাংরি আন্দোলন। হাংরি জেনারেশন তৎকালীন সমাজের প্রথাগত নীতিবোধ আর চেতনায় দারুণ আঘাত হেনেছিল। প্রতিঘাতে তাঁদেরও আক্রান্ত হতে হয়েছিল। কিন্তু এরপর আর হাংরি মুভমেন্ট জ্বলে উঠতে পারেনি।
📷
হাংরি আন্দোলনে মলয় রায়চৌধুরীর বয়স তখন মাত্র ২১
সুভাষ ঘোষ এবং শৈলেশ্বর ঘোষ, কলকাতার ব্যাংকশাল কোর্টে মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন। ১৯৬৬ সালে কলকাতা ব্যাংকশাল কোর্ট কর্তৃক ‘Stark Electric Jesus’ কবিতার জন্য তাঁকে এক মাসের জন্য জেলে পাঠানো হয়েছিল।
https://qph.cf2.quoracdn.net/main-qimg-61af90817384a56a61ed3d2424409e90-lq
মলয় রায়চৌধুরীর দণ্ডাদেশ
তবে ১৯৬৭ সালে কলকাতা হাইকোর্ট তাঁকে খালাস দিয়েছিলেন। ১৯৬৪ সালে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে লেখা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের চিঠিগুলি থেকে জানা যায় যে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অনুভব করেছিলেন যে হাংরি প্রজন্মের সাহিত্য আন্দোলন তাঁর ১৯৫০-এর দশকের কবিদের কৃত্তিবাস দলের জন্য হুমকিস্বরূপ। হাংরি বুলেটিনের লিডার শক্তি চট্টোপাধ্যায় সাক্ষ্য দিলেন মলয়ের বিপক্ষে, অন্যদিকে পক্ষে সাক্ষী দিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। আদালতে সুনীল বলেছিলেন, কবিতাটিতে তিনি কোনও অশ্লীলতা পাননি। ফলে নিম্ন আদালতে সাজা হওয়ার পরেও উচ্চ আদালতের দেওয়া রায়ে ১৯৬৭ সালে খালাস পেয়েছিলেন মলয় রায়চৌধুরী। আসলে সেসময়ে বামপন্থী ভাবধারার বুদ্ধিজীবীদের উপর পুলিশ নিশ্ছিদ্র নজর রাখত। দেবী রায় লক্ষ করেননি যে, পুলিশের দুজন ইনফর্মার হাংরি আন্দোলনকারীদের যাবতীয় বইপত্র, বুলেটিন ইত্যাদি সংগ্রহ করে লালবাজারের প্রেস সেকশানে জমা দিচ্ছে এবং সেখানে ঢাউস সব ফাইল খুলে ফেলা হয়েছিল।
মলয় রায়চৌধুরীর বয়ানে – “অভিযোগটি কোন্ সাংস্কৃতিক অধিপতির মস্তিস্কপ্রসূত ছিল জানি না। তবে অ্যাডভোকেট জেনারেল মতামত দিলেন যে, এরকম আজেবাজে তথ্যের উপর তৈরি এমন সিরিয়াস অভিযোগ দেখলে আদালত চটে যাবে। তখনকার দিনে টাডা-পোটা ধরনের আইন ছিল না। ফলত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে নিয়ে ১৯৬৫ সালের মে মাসে বাদবাকি সবাইকে ছেড়ে দিয়ে কেবল আমার বিরুদ্ধে মামলা রুজু হল। এই অভিযোগে যে, সাম্প্রতিকতম হাংরি বুলেটিনে প্রকাশিত আমার ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি অশ্লীল। আমার বিরুদ্ধে মামলাটা দায়ের করা সম্ভব হল শৈলেশ্বর ঘোষ এবং সুভাষ ঘোষ আমার বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হয়ে গেলেন বলে। অর্থাৎ হাংরি আন্দোলন ফুরিয়ে গেল। ওনারা দুজনে হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে মুচলেকা দিলেন, যার প্রতিলিপি চার্জশিটের সঙ্গে আদালত আমায় দিয়েছিল। প্রসিকিউশনের পক্ষে এই দুজন রাজসাক্ষীকে তেমন নির্ভরযোগ্য মনে হয়নি। তাই আমার বিরুদ্ধে সমীর বসু আর পবিত্র বল্লভ নামে দুজন ভুয়ো সাক্ষীকে উইটনেস বক্সে তোলা হয়, যাদের আমি কোনো জন্মে দেখিনি, অথচ যারা এমনভাবে সাক্ষ্য দিয়েছিল যেন আমার সঙ্গে কতই-না আলাপ-পরিচয়। এই দুজন ভুয়ো সাক্ষীর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল আমাকে অপরাধী হিসেবে উপস্থাপন করা। আমার কৌশুলিদের জেরায় এরা দুজন ভুয়ো প্রমাণ হবার সম্ভাবনা দেখা দিলে প্রসিকিউশন আমার বিরুদ্ধে উইটনেস বক্সে তোলে। বলাবাহুল্য গ্রেপ্তারের হুমকি দেয় শক্তি চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু আর সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে। ফলে আমিও আমার পক্ষ থেকে সাক্ষী হিসেবে দাঁড় করাই জ্যোতির্ময় দত্ত, তরুণ সান্যাল আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে। বহু সাহিত্যিককে অনুরোধ করেছিলুম, কিন্তু এনারা ছাড়া আর কেউ রাজি হননি। শক্তি এবং সুনীল, দুই বন্ধু, একটি মকদ্দমায় পরস্পরের বিরুদ্ধে চল্লিশ বছর পর ব্যাপারটা অবিশ্বস্য মনে হয়। সবায়ের সাক্ষ্য ছিল বেশ মজাদার, যাকে বলে কোর্টরুম-ড্রামা।”
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে -- ‘অশ্লীলতা কী ?’ সেসময়ে এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর কেউই দিতে পারেননি । অশ্লীলতার সংজ্ঞা কোথাও পাওয়া যায়নি। তাই মলয় রায়চৌধুরী কোর্টে টানা-হেঁচড়ার পর অবশেষে মুক্তি পেলেন । যাঁরা মলয় রায়চৌধুরীর মেধাকে মান্যতা দিয়ে নিজের কাব্যপথকে স্পষ্ট করেছিলেন, তাঁরা এই মানুষটির বিরুদ্ধে গিয়ে মুচলেকা দিলেন যে, ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি অশ্লীল। হাংরি কবিতায় অশ্লীলতা সম্পর্কে শঙ্খ ঘোষ বলেছেন, “অশ্লীল যাঁরা মনে করে, তাঁরা ঠিক কবিতার বা সাহিত্যের পাঠক নন, তারা সামাজিক লোকজন।” মলয় রায়চৌধুরীর ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ সম্পর্কে আদালত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, “আমি অবশ্য কোনো শব্দকে অশ্লীল মনে করি না।”
মলয় রায়চৌধুরীই সাহিত্যে প্রথম ‘অশ্লীলতা’ এনেছিলেন, তা কিন্তু নয়। তাঁর অনেক আগে বাংলা কাব্যে অনেক তথাকথিত অশ্লীল লেখা আমরা পড়েছি। সেগুলো তো কালজয়ী রচনা। যেমন -- বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’, রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র রায়ের ‘বিদ্যাসুন্দর’, বুদ্ধদেব বসু ও মোহিতলাল মজুমদারের অনেক কবিতা তথাকথিত অশ্লীলতা দোষে দুষ্ট। বিনয় মজুমদারের ভুট্টা সিরিজের কবিতা কি অশ্লীল নয় ? কিন্তু তার জন্য কেউই কিন্তু কারারুদ্ধ হননি।
সুভাষ ঘোষ তাঁর একটা লেখায় বলেছেন, প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার অর্থ সরকার বিরোধিতা নয়, সংবাদপত্র বিরোধিতা নয়, হাংরি জেনারেশনের বিরোধ প্রচলিত সাহিত্যের মৌরসি পাট্টাকে উৎখাত করে নবতম মূল্যবোধ সঞ্চারিত করা। হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, তাঁরা সাহিত্যকে পণ্য হিসাবে চিহ্নিত করতে অস্বীকার করেছিলেন। কেবল তাই নয়, তাঁরা এক পৃষ্ঠার লিফলেট প্রকাশ করতেন ও বিনামূল্যে আগ্রহীদের মাঝে বিতরণ করতেন। তাঁরাই প্রথম ফোল্ডার কবিতা, পোস্টকার্ড কবিতা ও পোস্টারে কবিতা ও কবিতার পংক্তির সূত্রপাত করেন। হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ অবদান প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা। তাঁদের আগমনের পূর্বে প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা করার কথা সাহিত্যকরা চিন্তাই করেননি। হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকরা সংস্কৃতিকে সবার জন্য অবারিত করে দিলেন। বিলোপ ঘটালেন সাংস্কৃতিক বিভাজনের। অভেদের সন্ধান করলেন। বাস্তব-অতিবাস্তব-অধিবাস্তবের বিলোপ ঘটালেন। হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের আর-একটি উল্লেখযোগ্য অবদান হল নামকরণের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। হাংরি জেনারেশনের পূর্বে পত্রিকাগুলির নামকরণ হত ‘শতভিষা’, ‘উত্তরসূরী’, ‘পূর্বাশা’, ‘কবিতা’, ‘কৃত্তিবাস’ ইত্যাদি যা ছিল মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের বহিঃপ্রকাশ। হাংরি জেনারেশন আন্দোলনকারীরা পত্রিকার নামকরণ করলেন ‘জেব্রা’, ‘জিরাফ’, ‘ধৃতরাষ্ট্র’, ‘উন্মার্গ’, ‘প্রতিদ্বন্দী’ইত্যাদি। কবিতার নামকরণের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন লক্ষণীয়। যেমন – ‘আমি আর লীনা হেঁটে চলেছি’, ‘ক্ষেপচুরিয়াস’, ‘আবার এসেছি ফিরে’, ‘মানুষের বাচ্চা’ ইত্যাদি। পরবর্তীকালেও তার ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। পত্রিকার বা গ্রন্থের শিরোনামেও সম্পূর্ণ ভিন্নপথ আবিষ্কৃত হয়েছে। হাংরি জেনারেশনের আগে কবিতা-গল্প-উপন্যাস রচিত হত ঔপনিবেশিক মূল্যবোধ অনুযায়ী একরৈখিক রীতিতে। তাঁদের ছিল লিনিয়রিটি, দিশাগ্রস্ত লেখা, একক গলার জোর, কবিরা ধ্বনির মিল দিতেন, সময়কে মনে করতেন প্রগতি। হাংরি জেনারেশনের কবি-লেখকরা একরৈখিকতা বর্জন করে বহুরৈখিক রচনার সূত্রপাত ঘটালেন।
মলয় রায়চৌধুরী লিখছেন – “এতজনের লেখালিখি থেকে সেই সময়কার প্রধান সাহিত্যিক সন্দর্ভের তুলনায় হাংরি আন্দোলন যে প্রতি-সন্দর্ভ গড়ে তুলতে চাইছিল, সে রদবদল ছিল দার্শনিক এলাকার, বৈসাদৃশ্যটা ডিসকোর্সের, পালাবদলটা ডিসকার্সিভ প্র্যাকটিসের, বৈভিন্ন্যটা কখন-ভাঁড়ারের, পার্থক্যটা উপলব্ধির স্তরায়নের, তফাতটা প্রস্বরের, তারতম্যটা কৃতি-উৎসের। তখনকার প্রধান মার্কেট-ফ্রেন্ডলি ডিসকোর্সটি ব্যবহৃত হতো কবিলেখকের ব্যক্তিগত তহবিল সমৃদ্ধির উদ্দেশ্যে। হাংরি আন্দোলনকারীরা সমৃদ্ধ করতে চাইলেন ভাষার তহবিল, বাচনের তহবিল, বাকবিকল্পের তহবিল, অন্ত্যজ শব্দের তহবিল, শব্দার্থের তহবিল, নিম্নবর্গীয় বুলির তহবিল, সীমালঙ্ঘনের তহবিল, অধঃস্তরীয় রাগবৈশিষ্ট্যের তহবিল, স্পৃষ্টধ্বনির তহবিল, ভাষিক ইর্যাশনালিটির তহবিল, শব্দোদ্ভটতার তহবিল, প্রভাষার তহবিল, ভাষিক ভারসাম্যহীনতার তহবিল, রূপধ্বনির প্রকরণের তহবিল, বিপর্যাস সংবর্তনের তহবিল, স্বরন্যাসের তহবিল, পংক্তির গতিচাঞ্চল্যের তহবিল, সন্নিধির তহবিল, পরোক্ষ উক্তির তহবিল, স্বরণ্যাসের তহবিল, পাঠবস্তুর অন্তঃস্ফোটিক্রিয়ার তহবিল, তড়িত বাঞ্জনার তহবিল, অপস্বর-উপস্বরের তহবিল, সাংস্কৃতিক সন্নিহিতির তহবিল, বাক্যের অধোগঠনের তহবিল, খন্ডবাক্যের তহবিল, বাক্যনোঙরের তহবিল, শীংকৃত ধ্বনির তহবিল, সংহিতাবদলের তহবিল, যুক্তিছেদের তহবিল, আপতিক ছবির তহবিল, সামঞ্জস্যভঙ্গের তহবিল, কাইনেটিক রূপকল্পের তহবিল ইত্যাদি।”
অতি স্বল্প কালের মধ্যেই হিন্দি ও নেপালি ভাষাতেও এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল। এমনকি বাংলাদেশের ঢাকার হাংরি আন্দোলনকারীদের মধ্যে ছিলেন বুলবুল খান মাহবুব, অশোক সৈয়দ, আসাদ চৌধুরী, শহিদুর রহমান, প্রশান্ত ঘোষাল, মুস্তফা আনোয়ার সহ আরও অনেকে। অনেকেই তখনও জানতেন না যে, মলয় রায়চৌধুরীরা প্রথম হাংরি বুলেটিনগুলো ইংরেজিতে কেন প্রকাশ করেছিলেন। ফলে বিভিন্ন অঞ্চলে আন্দোলন আরম্ভ হয়েছিল ইংরেজিতে ইস্তেহার প্রকাশের মধ্য দিয়ে। হাংরি আন্দোলনকারীরা প্রধানত এক পৃষ্ঠার বুলেটিন প্রকাশ করতেন। এক পৃষ্ঠার বুলেটিনে তাঁরা কবিতা, রাজনীতি, ধর্ম, অশ্লীলতা, জীবন, ছোটো গল্প, নাটক, উদ্দেশ্য, দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে ইস্তেহার লেখা ইত্যাদি প্রকাশ করেছিলেন। বুলেটিনগুলো হ্যান্ডবিলের মতো কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউস, পত্রিকা দপ্তর, কলেজগুলোর বাংলা বিভাগ ও লাইব্রেরি ইত্যাদিতে তাঁরা বিতরণ করতেন। কলকাতার মোড়গুলোতে দাঁড়িয়ে পাঠ করতেন নিজেদের রচনা। রচনাপাঠের জায়গাকে ঘিরে হাজারো মানুষের ভিড় জমে যেত। কিন্তু হ্যান্ডবিলের মতো প্রকাশ করায় তাঁরা ক্ষতি করেছেন নিজেদের, কারণ অধিকাংশ বুলেটিন সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি। ১৯৬২ সালে হাংরিদের প্রথম বাংলা ইশতেহার প্রকাশ হয় যার শেষ লাইন ছিল -- “কবিতা সতীর মতো চরিত্রহীনা, প্রিয়তমার মতো যোনিহীনা ও ঈশ্বরীর মতো অনুষ্মেষিণী।” কবিতার ইস্তেহারে মলয় রায়চৌধুরী লিখেছিলেন -- “শিল্পের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা কবিতা সৃষ্টির প্রথম শর্ত”, “এখন কবিতা রচিত হয় অরগ্যাজমের মতো স্বতঃস্ফূর্তিতে।” ‘জখম’ শিরোনামের কবিতায় মলয় রায়চৌধুরী লিখলেন -- “মানুষের দেয়া আইনানুগ মৃত্যুদণ্ড পেয়ে কেবল মানুষই মরে যাচ্ছে/ফ্যাক্ট্রি আর বিবাহ দুটোরই রেজিস্ট্রি হয়ে চোলেছে নিয়মমাফিক/কোল্কাতায় মদের ব্যবসা থেকে নৈতিক মাইনে পাচ্ছে ৪৫০০০ ডান হাত/১ একরে ১৩৫ জোড়া পায়ের ঠেসাঠেসি আরাম খাচ্ছে ১৯৬৫ মডেলের কোল্কাতা।”
তিনি প্রথম ইংরেজি ইস্তেহারে কবিতা সম্পর্কে লেখেন -- “Poetry is no more a civilizing manoeuvre, a replanting of the bamboozled gardens; it is a holocaust, a violent and somnambulistic jazzing of the hymning five, a sowing of the tempestual hunger. Poetry is an activity of the narcissistic spirit. Naturally, we have discarded the blankety-blank school of modern poetry, the darling of the press, where poetry does not Resurrection itself in an orgasmic flow, but words come up bubbling in an artificial muddle. In the prosed-rhyme of those born-old half-literates, you must fail to find that scream of desperation of a thing wanting to be man, the man wanting to be spirit.”
১৯৬৩ সাল নাগাদ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, বিধায়ক, সচিব, লেখক এবং সাংবাদিকরা হাংরিয়ালিস্টদের থেকে পেতে থাকলেন বিভিন্ন ধরনের মুখোশ। কোনওটা জন্তু-জানোয়ারের, কোনওটা দানবের অথবা জোকার, মিকি মাউস, দেবতা ইত্যাদি। কোনও ধরনের মুখোশই বাদ গেল না। তদুপরি প্রতিটি মুখোশের সঙ্গে লেখা থাকত -- “দয়া করে মুখোশটা খুলে ফেলুন।”। অপরদিকে বিভিন্ন কবি-সাহিত্যিকদের পাঠানো হত বিয়ের কার্ড। তাতে লেখা “Fuck the Bastards of Gungshalik School of Poetry”। মূলধারার বাণিজ্যিক পত্রিকাগুলোতে ছোটো গল্পের নামে আসতে লাগল সাদা কাগজ, আর বুক রিভিউয়ের জন্য পাঠানো হতো জুতোর বাক্স। প্রথাগত সাহিত্য আর সংস্কারের বিরুদ্ধে ক্রমে আরও জোরদার হল 'হাংরি মুভমেন্ট'। কখনও তাঁরা একটি বইয়ের দাম ধরলেন এক লক্ষ টাকা বা কয়েকটি টি বি সিল, আবার কখনও চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন করে শেষদিন পুড়িয়ে ফেললেন সমস্ত চিত্রকর্ম। হাংরি আন্দোলনের কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেনকে উদ্দেশ্য করে লিখলেন -- “কবিতা ভাতের মতো কেন লোকে নিতেই পারছে না/যুদ্ধ বন্ধ হলে নেবে? ভিখারিও কবিতা বুঝেছে/তুমি কেন বুঝবে না হে অধ্যাপক মুখ্যমন্ত্রী সেন ?”
হাংরি বুলেটিনে প্রকাশিত সুবিমল বসাকের একটা কবিতা পড়া যাক – “আমারে মাইরা ফেলনের এউগা ষড়যন্ত্র হইসে/চারো কোনা দিয়া ফুসফুস আওয়াজ কানে আহে/ছাওয়াগুলান সইরা যায় হুমকে থিক্যা/অরা আমারে এক্কেরে শ্যায করতে সায়/আমি নিজের ডাকাইতে্যা হাতেরে লইয়া সচেত্তন আসি/কেউ আইয়া চ্যারায় দিশায় চ্যাবা কথা কয় না/আমি সুপসাপ থাকি/ভালাসির গুছাইয়া আমি কথা কইতে পারি না/২ কইতে গিয়া সাত হইয়া পড়ে/১৫ সাইলে ৯ আইয়া হাজির হয়/ছ্যাব ফেলনের লাইগ্যা বিচড়াইতাসি অহন/আহ, আমার দাঁত মাজনের বুরুশ পাইতাসি না/বিশ্বাস করেন, কেউ একজনা আমার মুহের সকরা খাবার খাইসে।” অথবা অরুণেশ ঘোষের কবিতাটি – “১ পাগল এই শহরের চূড়ায় উড়িয়ে দিয়েছে তার লেঙ্গট/ ১ সিফিলিস রুগী পতাকা হাতে মিছিলের আগে/ ১ রোবট নিজেকে মনে করে আগামীকালের শাসক/ ১ মূর্খ ঘুমিয়ে থাকে শহর-শুদ্ধ জেগে ওঠার সময়… শীতের ভোর রাত্রে- মধ্যবিত্তের স্বপ্নহীনতার ভেতর/ আমাকে দেখে হো হো করে হেসে ওঠে বেশ্যাপাড়ার মেয়েরা।” কিংবা হাংরি জেনারেশনের গল্পকার বাসুদেব দাশগুপ্তের ‘বমন রহস্য’ গল্পে আশাহীন এবং আলোহীন ভোগবাদী সমাজের প্রতি ঘৃণা ঠিকরে বেরোয়। গল্পের শেষ লাইনটা এরকম -- “বমি করে যাই রক্তাক্ত পথের উপরে। সমস্ত চর্বিত মাংসের টুকরো, সমস্ত জীবন ভোর খেয়ে যাওয়া মাংসের টুকরো আমি বমি উগরে বার করতে থাকি। বমির তোড়ে আমার নিঃশ্বাস যেন আটকে আসে।”
১৯৬৩-৬৫ সালের মাঝামাঝি হাংরি আন্দোলনকারীরা কয়েকটি পত্রিকাও প্রকাশ করেছিলেন । সেগুলো হল -- সুবিমল বসাক সম্পাদিত ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’, ত্রিদিব মিত্র সম্পাদিত ‘উন্মার্গ’, মলয় রায়চৌধুরী সম্পাদিত ‘জেব্রা’, দেবী রায় সম্পাদিত ‘চিহ্ণ’, প্রদীপ চৌধুরী সম্পাদিত ‘ফুঃ’, সতীন্দ্র ভৌমিক সম্পাদিত ‘এষণা’ এবং আলো মিত্র সম্পাদিত ইংরেজি ‘দ্য ওয়েস্ট পেপার’। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন প্রধান ডঃ তরুণ মুখোপাধ্যায় হাংরি মুভমেন্টের লেখালেখির বিষয়ে লিখেছেন – “ভাষায়, ছন্দে, অলংকার, স্তবকে তুমুল ভাংচুর করেছেন তাঁরা”। হাংরি আন্দোলনকারীদের সাহিত্যের ভাষা আসলেই ভূমিকম্পের মতো। সেই ভূমিকম্প প্রচলিতের ভিতে আঘাত করেছিল, ক্ষত সৃষ্টি করেছিল। যার আফটার এফেক্টে একপ্রকার উপকার হয়েছে বাংলা সাহিত্যের।
প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা ছিল হাংরি জেনারেশন কবিদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য, তাঁরা প্রতিষ্ঠান বিরোধী প্রথম বাঙালি সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত। তাত্ত্বিক ও দর্শনগত বিষয়াদির কারণে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় সহ ইউরোপে হাংরি আন্দোলনের পক্ষে সমর্থন তৈরি হয়। বিখ্যাত ইংরেজ কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ কলকাতায় থাকাকালীন ইংরেজি হাংরি বুলেটিনগুলো সংগ্রহ করে পরবর্তীতে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করেন।
হাংরি জেনারেশনের আন্দোলনে প্রচুর কবি-লেখক থাকলেও, এই আন্দোলনে তাঁদের ভূমিকা ছিল যঃ পলায়তি সঃ জীবতি। কিন্তু হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে মলয় রায়চৌধুরীর নাম খোদিত হয়ে গেল। এমন হল যে, হাংরি জেনারেশন মানেই ঐতিহাসিকভাবে মলয় রায়চৌধুরী। সেটাই স্বীকার করে নিয়েছেন – (১) সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় -- “প্রধান ভূমিকা নিয়েছিল মলয় রায়চৌধুরী । মলয় প্রথম শুরু করার পর শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাতে যোগ দেয় এবং পরে উৎপলকুমার বসু, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ও পরিচিতদের মধ্যে অনেকে আসেন।” ( পদ্যগদ্য সংবাদ, অক্টোবর ১৯৮৬)। (২) মিহির রায়চৌধুরী -- “১৯৬১-এর শেষ দিকে প্রথম হাংরি বুলেটিনটি প্রকাশিত হয়। এই আন্দোলনের উদ্গাতা হলেন পাটনার মলয় রায়চৌধুরী।”( পদ্যগদ্য সংবাদ, অক্টোবর ১৯৮৬ ) (৩) সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় -- “হাংরি আন্দোলন শুরু করে সেই মলয় রায়চৌধুরী।”(পদ্যগদ্য সংবাদ, অক্টোবর ১৯৮৬) (৪) রবীন্দ্র গুহ -- “আমরা কয়েকজন মিলে একটা আন্দোলন গড়ে তুলেছিলাম। মলয় তার নাটের গুরু ছিল” (সম্পাদকের কথা, জখম, ১৯৬৫) (৫) অজিত রায় -- “বাংলা সাহিত্যের প্রথম আভাঁগার্দ আন্দোলন হাংরি জেনারেশন। এবং এই আন্দোলনের আদি ও পুরোধাপুরুষ তথা জন্মদাতা মলয় রায়চৌধুরী। অর্থাৎ হাঙ্গামার সর্বময় কর্তা মলয় রায়চৌধুরী, যিনি সেসময়ে অজ্ঞাত লেখক হলেও বাংলা সাহিত্যের পীঠস্হানে তুলতে পেরেছিলেন বিশাল ঝড়।”(গেরো ফাঁসগেরো) (৬) সমরজিৎ সিংহ -- “মলয় নিজে এই হাংরিদের পুরোধাপুরুষ।” (আন্দোলিত মলয়ের উহুরু) (৭) বিমলকুমার মুখোপাধ্যায় -- “এক আন্দোলন বাংলা সাহিত্যে দেখা দিয়েছিল চারদিকে মাতন লাগিয়ে। এই আন্দোলনের স্রষ্টা মলয় রায়চৌধুরী।”(বাংলা অ্যাকাডেমি পত্রিকা) (৮) উৎপল ভট্টাচার্য -- “হাংরি আন্দোলন আজ ইতিহাস প্রসিদ্ধ । সেই আন্দোলনের প্রধান রূপকার ছিলেন মলয় রায়চৌধুরী।”(৯) আলম খোরশেদ -- “ষাট দশকে কলকাতা তোলপাড় করা হাংরি আন্দোলনের কবি-পুরোহিত মলয় রায়চৌধুরী।”(আহবকাল) (১০) তরুণ মুখোপাধ্যায় -- “হাংরি আন্দোলনের অন্যতম নেতা মলয় রায়চৌধুরী” (স্বপ্ন পত্রিকা)। আমরা ঐতিহাসিক তথ্য স্বরূপ হাংরি আন্দোলনের প্রথম ইংরাজি ও বাংলা ইশতেহারে স্রষ্টা হিসাবে মলয় রায়চৌধুরীর নাম লিপিবদ্ধ দেখতে পাই। একমেব অদ্বিতীয়ম। তাই স্রষ্টা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ থাকে না ।
১৯৬৩ সালের শেষদিকে সুবিমল বসাক, দেবী রায় ও মলয় রায়চৌধুরীর কিছু কিছু কর্মকাণ্ডের কারণে হাংরি আন্দোলন বাঙালির সংস্কৃতিতে প্রথম প্রতিষ্ঠান-বিরোধী গোষ্ঠী হিসাবে পরিচিত হয়। দেশীয় পত্রিকাগুলো আন্দোলনকারীদের নিয়ে মুখরোচক সব সংবাদ লিখে চলে। তাদের প্রতিষ্ঠানবিরোধী কর্মকাণ্ড পত্রিকায় নিয়মিত ছাপতে থাকে। শিরোনামে লেখা হয় -- “হা-ঘরে সম্প্রদায়”, “কাব্যচর্চার নামে বিকৃত যৌনলালসা”, “সাহিত্যে বিটলেমি কী এবং কেন?”, “Erotic Lives & Loves of Hungry Generation” ইত্যাদি। কলকাতা, বেনারস আর নেপাল গিয়ে হিপিনিদের সঙ্গে তাঁদের অবাধ যৌনচর্চার বর্ণনা ছাপাল কিছু সংবাদপত্র। হাংরিয়ানদের বিরুদ্ধে নানারকম অপপ্রচারও শুরু হল। বলা হল তাঁরা বিটনিকদের মতো মাদকাসক্ত। হাংরি কবিদের বিকৃত যৌনতার ধারক বলেও চালানোর চেষ্টা হল। শৈলেশ্বর ঘোষ ও সুভাষ ঘোষ মেসে এক ঘরে থাকতেন বলে তাঁদের বিরুদ্ধে ছড়ানো হল তাঁরা সমকামী। এভাবে সত্যি-মিথ্যে মিশিয়ে গণমাধ্যমে নানাভাবে প্রচার চলতে লাগল। বহু আলোচক হাংরি আন্দোলনকারীদের সে সময়ের কার্যকলাপে দাদাইজম প্রভাব লক্ষ করেছেন, এইরকম খবরও উঠে আসে সামনে। এই কারণে শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, সতীন্দ্র ভৌমিক প্রমুখ হাংরি আন্দোলন ত্যাগ করেন।
১৯৬৪ সালের ১০ জুন আমেরিকা থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মলয় রায়চৌধুরীকে চিঠি লিখলেন -- “কলকাতা শহরটা আমার, ফিরে গিয়ে আমি ওখানে রাজত্ব করব। দু'একজন বন্ধুবান্ধব ওই দলে আছে বলে নিতান্ত স্নেহবশতই তোমাদের হাংরি জেনারেশন গোড়ার দিকে ভেঙে দিইনি। এখনও সে ক্ষমতা রাখি। লেখার বদলে হাঙ্গামা ও আন্দোলন করার দিকেই তোমার লক্ষ বেশি। যত খুশি আন্দোলন করো, বাংলা কবিতার এতে কিছু এসে যায় না ।"
প্রশাসনকে খেপিয়ে হাংরিয়ালিস্টদের এই আন্দোলন বেশিদিন চলতে পারল না। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ছয় কবির হাতে হাতকড়া পরানো হল অশ্লীল রচনা আর রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে। হাংরি মুভমেন্টের লেখকদের বাড়িঘর তল্লাশি করার সময় পুলিশ বহু লেখা নষ্ট করল। পাশাপাশি বই, ফাইল, টাইপরাইটার ইত্যাদিসহ সব ধরনের কাগজপত্র উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হল। লেখক-কবিদের হাতে হাতকড়া পরিয়ে, কোমরে দড়ি বেঁধে চোর-ডাকাতদের সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, করা হয়েছিল ঘন্টার পর ঘন্টা জেরা।
তবে ১৯৯৫ সালে মলয় রায়চৌধুরীর লেখা কবিতা এবং কথাসাহিত্য উভয়ই নাটকীয় মোড় নেয়। ভাষাবিদ প্রবাল দাশগুপ্ত এটিকে ‘অধুনান্তিক পর্যায়’ নামে অভিহিত করেছেন। এই পর্বে রায়চৌধুরী বেশ কিছু কাব্যিক নাটক রচনা করেন, যেগুলো ছিল উত্তর-আধুনিকতাবাদ এবং ট্রান্সহিউম্যানিজমের একটি সংমিশ্রণ। রায়চৌধুরী কলকাতা থেকে মুম্বাইতে স্থানান্তরিত হওয়ার পর তিনি ম্যাজিক রিয়ালিজমের দিকে ঝুঁকে পড়েন। ২০১৪ সালে রায়চৌধুরী ‘রাহুকেতু’ শিরোনামে তার স্বতন্ত্র শৈলীতে তাঁর আত্মজীবনী লিখেছিলেন।
২০১৪ সালে রায় চৌধুরীর ‘Stark Electric Jesus’ কবিতার উপর ভিত্তি করে নির্মিত একটি চলচ্চিত্র মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলি এবং হায়াশ তন্ময় দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল। চলচ্চিত্রটি ১৫টি দেশে ২০টি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে একটি আনুষ্ঠানিক নির্বাচন ছিল। চলচ্চিত্রটি পোল্যান্ডে ‘সেরা ভিডিও আর্ট’, ​​স্পেনের ‘মোস্ট প্রমিজিং ভিডিও আর্টিস্ট’ এবং সার্বিয়াতে ‘সেরা ফ্যান্টাসি ফিল্ম’ জিতে নিয়েছে। সৃজিত মুখার্জি ২০১১ সালে ‘বাইশে শ্রাবণ’ নামে একটি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছিলেন, যেখানে মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা বহুবার ব্যবহৃত হয়েছে।
মলয় রায়চৌধুরী ও তাঁর হাংরি আন্দোলন প্রসঙ্গে ডক্টর বিষ্ণুচন্দ্র দে লিখেছেন – “মলয় রায়চৌধুরী একজন দ্রোহপুরুষ, তার কারণ – (১) তিনি প্রতিষ্ঠানবিরোধী ও আধিপত্যবিরোধী। (২) তিনি প্রথানুগ মতবাদের তোয়াক্কা করেন না। (৩) তিনি নিজের পপতিস্বকে আত্মনির্ভর করে তুলেছেন। (৪) তিনি চলিত রীতি-নীতিকে অবজ্ঞা করেন। (৫ ) তিনি সাহিত্য-সংস্কৃতিতে অভ্যুথ্থান ঘটান এবং এ-ব্যাপারে কর্তৃত্ব অস্বীকার করেন। (৬) তিনি বাম ও ডান উভয় অন্যায়ের সঘোষ বিরোধিতা করেন। (৭) তিনি চাপ বরদাস্ত করেন না, ইত্যাদি।” ডক্টর বিষ্ণুচন্দ্র দে আরও লেখেন যে, “মলয় রায়চৌধুরীর ক্ষেত্রে দ্রোহপুরুষ কথাটা প্রয়োগ করার অনেক যুক্তি বর্তমান। কারণ তিনি স্বতন্ত্র, ব্যতিক্রমী, আলাদা। তিনি সমস্ত শাসনকে ভাঙার শক্তি প্রদর্শন করেছেন। বাংলা সাহিত্যে ইশতাহার-ভিত্তিক আন্দোলন যে করা যায়, তা প্রত্যক্ষত দেখিয়ে দিয়েছেন। সেই সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের ভিত কাঁপিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। বাংলা কাব্যে পালা বদলের মন্ত্রগুরু মলয় রায়চৌধুরী। প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার মাধ্যমে গোষ্ঠীবদ্ধ সাহিত্যচর্চার বীজ বপন করে বাংলা কাব্যসাহিত্যে নতুন মাত্রা সংযোজন করেছেন মলয় রায়চৌধুরী। শুধু নাই নয়, নান্দনিকতার গণ্ডি ছাড়িয়ে, জীবন উপলব্ধির কাব্য-বয়ন করেছেন তিনি । অশ্লীল শব্দ, যৌন শব্দ ইত্যাদির অবাধ প্রচলন দ্বারা বাংলা কাব্য সাহিত্যকে দিগন্তবিস্তারী চিন্তা জগতে ঠেলে দিয়েছেন।”
হাংরি জেনারেশনের পুরোধা কবি ও প্রাবন্ধিক মলয় রায়চৌধুরী আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু তাঁর সাহিত্য সৃষ্টির নতুন ধারণাকে আমরা ভুলি কীভাবে ? উনিশ শতকের ষাটের দশকের আগে এবং ষাটের দশকের পরে সাহিত্য পর্যালোচনা করলে আমাদের চোখ এড়ায় না আমূল পরিবর্তন। আজকের যে সাহিত্য সৃষ্টির যে ধরন পাই, তা হাংরি জেনারেশনের ফসল। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের পর এতগুলো দশক অতীত হয়ে গেলেও এহেন সাহিত্য আন্দোলন নিয়ে যথার্থ মূল্যায়ন হল না। শুধু ‘নৈরাজ্যবাদী’ ও ‘অশ্লীল’ বলে হাংরি জেনারেশন আন্দোলনকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা হয়েছে। সব সাহিত্য আন্দোলনই সাধারণভাবে একটা সময়ে এসে প্রতিষ্ঠানের কাছে আত্মসমর্পণ করে, কিন্তু হাংরি জেনারেশনের কবি-লেখকরা একজনও সচেতনভাবেই আত্মসমর্পণ করেনি। সেই কারণেই হাংরি জেনারেশনের আন্দোলন নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন আছে।
তথ্যসূত্র : (১) হাংরি জেনারেশন আন্দোলন -- মলয় রায়চৌধুরী, (২) হাংরি আন্দোলন : ক্ষুধার্ত প্রজন্মের সাহিত্যসাধনা -- গৌতম শুভ, (৩) বাংলা সাহিত্যে হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের প্রভাব -- অভিজিৎ পাল, (৪) হাংরি কিংবদন্তি -- মলয় রায়চৌধুরী, (৫) ক্ষুধার্ত সংকলন -- সম্পাদনাঃ শৈলেশ্বর ঘোষ, সাহিত্য অকাদেমি, (৬) মলয় রায়চৌধুরীর ‘জখম’ ও অন্যান্য রক্তক্ষরণ -- বৈদ্যনাথ মিশ্র, (৭) মলয় রায়চৌধুরী ও হাংরি আন্দোলন -- উত্তম দাশ, (৮) হাংরি আন্দোলনের কাব্যদর্শন -- দেবী রায়, (৯) Hungryalist Interviews edited by Ajit Ray, (১০) কামুর দর্শন ও হাংরি জেনারেশন -- ড. সোমা বীরা ( অণিমা পত্রিকা), (১১) হাংরি শ্রুতি ও শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলন -- ড.উত্তম দাশ, (১২) ক্ষুধিত প্রজন্ম ও অন্যান্য প্রবন্ধ -- ড. উত্তম দাশ, (১৩) হাংরি আন্দোলন ও দ্রোহপুরুষ-কথা -- ড. বিষ্ণুচন্দ্র দে।
============================

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র