মৌ দাশগুপ্তা - মায়াজম

Breaking

১৮ মার্চ, ২০১৬

মৌ দাশগুপ্তা

                        পুতুলনাচের কথকতা






লাজে রাঙা হল কনে বউ গো, মালাবদল হবে এ রাতে”… গানটি শোনেননি, এমন বাঙালী বিরল, অথবা ছোটবেলায় পুতুল নিয়ে খেলেনি এমন শিশুকন্যাই বা কেউ আছে কি? আমাদের ছোটবেলায় খেলাঘরের রান্নাবাটি পুতুলের সাথে দ্বিগুণ মজার আকর্ষণটি ছিল পুতুলনাচ।পুতুল কি নাচতে পারে? পারে না। পারে যে না, তা জানে সবাই। তা সত্ত্বেও পুতুলের লোকপ্রিয়তা নিয়ে কোন প্রশ্নই ওঠেনা। পুতুলে অনুরাগ মানুষের কম-বেশি আশৈশব। কারো আনন্দ পুতুল নাচিয়ে, কারো মন খুশি হয় পুতুলের নাচ দেখে। পুতুল নাচের ইতিকথা, অবশ্য মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালজয়ী উপন্যাস। পুতুল নাচিয়েরা পুতুল নাচিয়ে আনন্দ খোঁজেন, অন্যদের আনন্দিত করেন। তাদের অন্ন সংস্থানও হয় এই করে। কাজেই পুতুল নাচানো একটি পেশাও বটে।পুতুলনাচ লোকনাট্যের একটি প্রাচীন মাধ্যম। বলা হয় পুতুলনাচের ইতিহাস প্রায় মানবসভ্যতার ইতিহাসের সমান। প্রত্নতাত্ত্বিক খননে মহেঞ্জোদারোসহ ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যান্য স্থানেও পুতুল পাওয়া গেছে। মিশরীয় পিরামিডেও পুতুলের উপস্থিতি লক্ষণীয়। পরবর্তীকালে সাভার, ময়নামতি, মহাস্থানগড় ও দিনাজপুরের প্রত্নতাত্ত্বিক খননেও পাওয়া গেছে হরেক রকম পুতুল। এসব জায়গায় প্রধানত দেব-দেবীর মূর্তি, সিংহ, মহিষ,ময়ূর হাঁস জাতীয় পশুপাখি, মাছ ও সাপ পাওয়া গেছে। মনে করা হয় খেলনার উদ্দেশ্যেই শুরুতে পুতুল বানানো হতো। পুতুলনাচ লোকজশল্প হলেও পুতুল তৈরী শিল্পের পাশে বয়সে নবীন।
মধ্যযুগে ইটালিতে পুলসিনেলোনামে আবির্ভাব ঘটে সূতা পাপেটের, ফ্রান্সে যার নাম হয় পেলসিনেল। দসত্দানা পাপেটের জনপ্রিয় চরিত্র হিসেবে জন্ম দেয়পাঞ্চ। এই পাঞ্চপ্রতিরূপ দৃষ্ট হয় রাশিয়া, জাপান ও ব্রাজিলে, জার্মানি ও সুইডেনে পাঞ্চের নাম কাসপারহল্যান্ড ইয়ান ক্লাসেনএবং হাঙ্গেরি ও রোমানিয়ায় ভাসিলচে। এছাড়াও মিশর, চীন, কোরিয়া, ফিলিপাইন, মায়ানমার, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং শ্রীলংকার পুরানো ও আধুনিক ধারার পুতুলনাচের অস্তিত্ব বিদ্যমান। যা বলছিলাম,বিদেশে এই পুতুল নাচকে বলে পাপেট শো। টেলিভিশনে পাপেট শো-এর অনুষ্ঠানগুলোর টিআরপি তো সোপ সিরিয়ালের যুগেও রীতিমত ঈর্ষনীয়। সাধারণ নাটকে স্থানের সীমাবদ্ধতা থাকলেও পুতুলনাচে তার প্রয়োগ অনেক বিস্তৃত। জলের প্রাণী, আকাশের পাখি, ডাঙ্গার মানুষ, বনের পশু সবই কাহিনীর প্রয়োজনে একসঙ্গে এক মঞ্চে অভিনয় করে। নির্বাক পুতুলসহ সকল প্রাণীই নিজস্ব আচার-আচরণের পাশাপাশি মানুষের ভাষায় কথা বলে। এর ফলে পুতুল নাচ হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত ও আনন্দময়, এবং সকল বয়স ও শ্রেণীর দর্শকরা তা সানন্দে উপভোগ করে। ২১শে মার্চ তো ওয়ার্ল্ড পাপেট ডেহিসাবে উদযাপিতও হয়। সারা পৃথিবীতে ছোটবড় সবার কাছেই পুতুল নাচ এক জনপ্রিয় বিনোদন ।
আমার ছোটবেলা কেটেছে উত্তর ২৪ পরগণার বেলঘরিয়াতে।পূজোর সময়, কিংবা কখনোসখনো শীতের ছুটিতে, বিবেকানন্দ বিদ্যাপীঠ আর উন্নয়নী ক্লাবের কমন খেলার মাঠে পুতুল খেলার আসর বসতো। সাগ্রহে অপেক্ষা করতাম সেই দিনগুলোর জন্য। চার আনা, আট আনার টিকিটের সেই পুতুলনাচের আনন্দ আজও মুখে হাসি ফোটায়।
খোলা মাঠে বসতো রঙিন তাঁবু, তিনদিকে ঢেউখেলানো টিনের ঘের, তাতেই থাকত টিকিট কাউন্টার এবং প্রবেশ-বাহির পথ, সামনের দিকটা বিচিত্রবর্ণ কাপড়ে ঢাকা, ওপরের দিকটায় বাঁশের আড়ার সঙ্গে ছোট ছোট চৌকোণা টিনের ক্যানভাসে আঁকা থাকত পুতুলনাচের বিভিন্ন পালার নাম। অনেকদিনের আগের কথা যদিও তাও একটু আধটু মনে আছে দু একটি পালার নাম, যেগুলোর গল্প এত ভালো লেগেছিল যে আজও মনে রয়ে গেছে। সোনাই দীঘি, রূপবান কন্যা, মর্জিনা আবদুল্লা। প্যান্ডেলের ওপর দোচালা ঘরের মতো রঙিন কাপড়ের সামিয়ানা টানানো। মাইকটি বাঁধা থাকতো প্যান্ডেলের ঠিক মাথায়। সন্ধ্যায় আলোর মেলায় সেজে উঠত তাঁবু। গান বাজত, উচ্চস্বরে ঘোষণা হত আজ কোন পালা দেখানো হবে।
বাইরের দর্শক ভাইবোনদের বলছি, যারা পরবর্তী শো দেখবেন, টিকেট নিন, মাত্র চারআনা, আটআনা, বারোআনা, ও একটাকা, আস্তে আস্তে টিকেট হাতে নিয়ে লাইন বেঁধে আসুন। বাচ্চাদের হাত ধরে রাখুন ।আমাদের আজকের পালা- রূপবান কন্যা
তাঁবুতে ঢোকার মুখে মোটা রঙিন কাপড় ঘেরা জায়গাটায় থাকত একটা অস্থায়ী ধাতব গেট, পাশে ছোট্ট জানলা দেওয়া টিকিটঘর। ছোট গেটে গেটম্যান দাঁড়িয়ে টিকিট নিয়ে এক একজন করে ঢোকাত ভেতরে। আলো আঁধারি তাঁবুর ভেতরে বানানো হত কাঠের পাটাতনের নীচু চওড়া স্টেজ। স্টেজের উপর কুচি দেওয়া কালোকাপড় দিয়ে বানানো থাকত ছোট চৌকো একটি ঘর। বাদ্যযন্ত্রীরা বসত স্টেজের পাশে, উঁচুমত বেঞ্চে, আড়বাঁশি, বেহালা, হারমোনিয়াম, ডুগি তবলা,খঞ্জনি আর মাদল টাইপের বাদ্যযন্ত্র নিয়ে। স্টেজের সামনে ভাঁজ করা চেয়ার, প্রথম শ্রেণীর দর্শকদের আসন। টিকিটের মূল্যও বেশি। তারপর নীচু বেঞ্চ আর শেষে মাটিতে ছেঁড়া মোটা শতরঞ্চি বিছানো কম পয়সার টিকিটের সাধারণের জন্য। ধীরলয়ে বাজনা বাজত গানের সুরে, ধীরে ধীরে বাজনা জোরদার হত। পুতুল নাচের মূল মঞ্চের পর্দা খুলে যেত। সাদা ধুতি আর লালপাড় সাদা শাড়ী পড়া দুটি পুতুল নড়েচড়ে বেরিয়ে আসত মূল মঞ্চে। একটি পুতুল আরেকটি পুতুলকে বলত-বলি ও খুকির মা,আসরে যখন এসেই পড়লে ,কি হবে জানো কি”?অন্য পুতুল জবাবে বলল, ‘ জানি, জানি, জানি গো, জব্বর নাচগান হবে,পুতুল নাচ হবে।উত্তরে আগের পুতুলটি বলত,’কি পালা হবে শুনি’? সঙ্গী পুতুলের এই কথা শুনে পুতুলটি নেচে নেচে গাইতে শুরু করল, “রূপবান কন্যের কথা হবে গো,রূপবান কন্যের কথা” ,একটি পুতুলের নাচ-গান দেখে অন্য পুতুলটিও নেচে গেয়ে বিদায় নিত। এরপর জগঝম্প বাজনার সাথে শুরু হত আসল পালা।কথক-মাস্টার পালার নাম ও পটভূমিকা বলে যেত,পরিচয় করাতো পালার সমস্ত পাত্রপাত্রীদের সাথে , চৌকোনা পর্দার আড়াল থেকে পুতুল নাচিয়ে বা পুতুল মাস্টারদের অদৃশ্য অঙ্গুলি হেলনে সুতোয় বাঁধা পুতুলগুলি দরকার মত আসতো যেত, হাত পা নাড়াত, ঝগড়া করত, যুদ্ধ করত, সোহাগ সম্প্রীতি দেখাত,নাচত, আর কয়েকজন সামনে বসে সবগুলো চরিত্রের কন্ঠদান করতো। থাকত দোহাররাও। যারা গানের ধুয়ো ও বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে অনেক বেশী রঙিন করে তুলতো পরিবেশনাকে। ফলে পুতুলগুলো তখন আমাদের কাছে হয়ে উঠত এক একটি জীবন্ত চরিত্র।
একটু বড় হয়ে বইয়ে পড়েছি, সারা পৃথিবীতে সাধারণত চার ধরনের পুতুল ব্যবহার করা হয় পুতুল নাচের জন্য। তারের পুতুল, লাঠিপুতুল, বেণিপুতুল ও ছায়াপুতুল। সূক্ষ্ম তার বা সুতার সাহায্যে বানানো হয় তারের পুতুল। লম্বা সরু লাঠির সাহায্যে নাচানো হয় লাঠি-পুতুল। দুই কিংবা তার চেয়ে বেশি পুতুল একসঙ্গে আঙুল দিয়ে নাচানো হলে তাকে বলা হয় বেণিপুতুল। আমাদের এখানে এই তিন ধরনের পুতুলের চলই বেশি।তবে ট্র্যাডিশনাল পুতুল নাচের জন্য সবচেয়ে বেশী ব্যবহৃত হয় সুতা পুতুল। গবেষকদের ধারনা মতে প্রায় তিন হাজার বছর আগে থেকেই ভারতবর্ষে সুতা পুতুলের প্রচলন শুরু হয়েছে। এই পুতুলগুলির উচ্চতা স্থানভেদে ১ থেকে ৩ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। প্রতিমা শিল্পীদের দিয়ে বানানো হয় বলে এদের চেহারা হয় দেব-দেবীদের মত। পূর্নাঙ্গভাবে গড়া হয়না সুতা পুতুলগুলি। মাথা হাতসহ কোমর পর্যন্ত হয়। কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় নিম্নাংশ। সাধারণত খড়, সোলা, পাটকাঠি, কাপড় ও মাটি ব্যবহার করা হয় এগুলো বানাতে। তুলি দিয়ে এঁকে নেওয়া হয় মুখমণ্ডল। পাটের আঁশে বিভিন্ন রঙ দিয়ে তৈরী হয় চুল। বাংলায় ছায়াপুতুলের চল একেবারেই কম।
বাংলায় পুতুল বানানোর ইতিহাস বেশ পুরনো। দেব-দেবীর প্রতিকৃতি ও খেলনা হিসেবে পুতুল এ দেশের ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। নাচের পুতুল তৈরিতে একসময় প্রসিদ্ধ ছিল অধুনা বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কান্দিপাড়া গ্রাম। পুতুল নাচের উল্লেখ আছে কৃত্তিবাসী রামায়ণে, কাশীরামদাসী মহাভারতে, কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্য চরিতামৃতে এমনকি গীতগোবিন্দ শ্রীকৃষ্ণকীর্তনকেও প্রাজ্ঞ পণ্ডিত সুকুমার সেন তাঁর নট নাট্য নাটক গ্রন্থে পুতুল নাচের পালা(!) বলে উল্লেখ করেছেন।
বাংলায় তারের পুতুলনাচের জন্য ত্রিমাত্রিক, বাক্স আকৃতির, একদিক খোলা মঞ্চ তৈরি হত, পশ্চাৎপটে ব্যবহৃত হত কালো পর্দা। যাতে যেসব সুতার সাহায্যে পুতুলগুলোকে নাচানো হচ্ছে, সেগুলো চোখে পড়ত না। সামনে একটি ৬০ বা ১০০ ওয়াটের বৈদ্যুতিক বাতি ঝুলিয়ে দেওয়া হত, সাধারনতঃ একাধিক ছেলে বা মেয়েপুতুল, সাথে কিছু পশুপাখীর পুতুল, যেমন বাঘ, ঘোড়া, মাছ, কুমির, সাপ ইত্যাদির ১২ থেকে ২০টি নিয়ে একটি 'সেট' বানিয়ে নেওয়া হত। পরে এগুলোকেই পালার চাহিদামত বিভিন্ন ধরনের পোশাক পরিয়ে নানা রকম চরিত্রের রূপ দেওয়া হত। যেমন_রাম, রাজা, শিকারি ইত্যাদি চরিত্রগুলোতে একটি পুরুষ পুতুল, অন্যদিকে সীতা, রূপবান, রাজকন্যা, ভানুমতী ইত্যাদি চরিত্রে একটি মেয়েপুতুল ব্যবহার করা হত। পুতুলগুলোকে রং করা হত সস্তা হলুদ, সাদা, গোলাপি, কালো, নীল ইত্যাদি এনামেল পেইন্ট দিয়ে। ফলে বেশি দিন ব্যবহারে চাকচিক্যও নষ্ট হয়ে যেত।
বাংলায় পুতুল নাচের সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে সঠিক কিছু জানা না গেলেও বলা হয় গ্রামবাংলায় পুতুল নাচ এসে পৌঁছেছিল সুদূর রাজস্থান থেকে। অধুনা বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নবী নগর উপজেলার তিতাস নদীর ধারে কৃষ্ণনগর পল্লীর বিপিন পাল প্রথম পুতুল নাচের প্রচলন করেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। বিপিন পাল সেইসময়ে পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে পুতুল নাচ করাতেন বলে জানা যায়। প্রথমদিকে পুতুল নাচের বিষয়বস্তু ছিলো নিতান্তই পৌরাণিক। রামায়ণ, মহাভারত, চণ্ডীমঙ্গল কিংবা রাধা-কৃষ্ণের প্রেম উপাখ্যান পুতুলনাচের নিজস্ব রীতিতে পরিবেশিত হত। পরবর্তীতে মুসলমানদের আধিক্যের কারণে রূপবান কন্যা, ভাবনা কাজি, ইউসুফ-জুলেখা, সোহরাব-রুস্তমের মত গল্পগুলি যুক্ত করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে পুতুল নাচ নিয়ে গবেষণা করেছেন অধুনা বাংলাদেশের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যবিভাগের অধ্যাপক ড.রশিদ হারুণ। তার মতে স্বাধীনতাপূর্ব সময়ে এদেশে যারা পুতুলনাচ দেখাতো তাদের বেশীর ভাগই হিন্দু ধর্ম্বালম্বী হওয়ায় দেশভাগের সময় তারা ভারতে চলে আসেন, পেটের দায়ে দল ভেঙে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েন এদিক ওদিক। তারা আর মূল পুতুল নাচিয়েদের স্রোতে ফেরত আসেননি। ফলে গল্পের মূল ধারা পাল্টে যায়, আঙ্গিক পাল্টায়। পাল্টে যায় উপস্থাপনা ও কাহিনী বিন্যাস। বর্তমানে দুই সখীর নাচ, মাছধরার গল্প, শিকারি ও বাঘের গল্পের মত প্রচলিত লোকগল্পগুলি বেশী পরিবেশিত হয়।
এক সময় গ্রাম-গঞ্জে ঢেউ তুললেও আজ আর পুতুলনাচের কোন চাহিদা নেই। মাঝে-মধ্যে মেলা-উৎসবে ডাক পেলেও লোকজন হয় না মোটে। বিশ্বায়নের যুগে চরম দুর্দশায় পড়েছে বাংলার শতাব্দী-প্রাচীন পুতুল নাচ শিল্প।আমাদের ছোটবেলায় এত টিভি সিনেমা নাটক থিয়েটারের চল ছিল না। ছিলনা শপিংমল, আইনক্সের রমরমা। বছরে নির্দিষ্ট সময়ে বসতো মেলা, পৌষমেলা, চড়কের মেলা, বাসন্তী পূজোর, দুর্গা পূজোর মেলা,বৈশাখী মেলা,রথের মেলা। সেখানে বিকিকিনি আর অন্যান্য বিনোদনের সাথে দশ-পনেরো দিন তো বটেই, কোথাও কোথাও টানা এক মাস ধরে পুতুল নাচের আসর বসত। আর তাই দেখতে প্রতিদিন শয়ে-শয়ে মানুষ ভিড় করতেন। একই পালা দিনে দু-তিন বার হয়েছে, এমনও দিন গিয়েছে। কিন্তু আজ পুতুল নাচের চিহ্নমাত্র দেখতে পাইনা। টিভিতে মাঝে মধ্যে পাপেট শো দেখেছি কিন্তু সে পুতুল নাচ নয়।আয়ারল্যান্ডে রূপকথা কাহিনী ভিত্তিক পাপেট শো দেখেছি,ইন্দোনেশিয়ার বিখ্যাত পুতুলনাচ রামায়ণদেখেছি, বিখ্যাত আলজেরিয়ান নাচিয়ে সিদি লার্বি চের্কাওয়ি-এর পুতুলনাচের শোও দেখেছি,মেয়েদের সাথে বসে টিভিতে বারবি শোও দেখেছি। কিন্তু ছোটবেলার দেখা সেই পুতুলনাচ আর খুঁজে পাইনি। আমি আপাতত কলিঙ্গ প্রবাসী। এখানেই বছর দুয়েক আগে রাউরকেলা থেকে সম্বলপুর ফেরার পথে দেখি সেই পুতুলনাচের তাঁবু। অপেরা শো। সেই ঝকমকে তাঁবু, সেই ছোট ছোট চৌকো টিনের ক্যানভাসে আঁকা পুতুলনাচের বিভিন্ন পালার নাম। জিজ্ঞাসা করে জানলাম এ পুতুল নাচে পুতুল নাচে না। পুতুল সেজে মানুষ নাচে, হাতে পায়ে সুতো আটকে পুতুলের স্টাইলে উত্তেজক ভঙ্গিতে ছোটখাটো পোশাকে বিড়ি জ্বলাইলেকিজিলাবি বাইয়ের সুরে অভাবী ঘরের বিভিন্ন বয়সের কিছু শিল্পী মানুষের মনোরঞ্জনের উপায় করেন।মঞ্চে টাকা পয়সা পড়ে, হুল্লোড়ের বান ডাকে। নাহ এ সেই পুতুল নাচ নয়।
বাংলা লোকনাট্যের হাজারো বছরের ঐতিহ্যমন্ডিত পুতুল নাচ আজ বিলুপ্তির পথে। শহুরে সভ্যতার কাছে হার মেনেছে বাংলার এই ঐতিহ্য। শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা বিশ্বেই পুতুল নাচ লোকনাট্যের একটি প্রাচীন মাধ্যম। পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে দেশে লোকসংস্কৃতির অন্যতম ধারক এই পুতুল নাচ এখন চোখেই পড়ে না। অথচ একসময় এই পুতুল নাচই ছিলো দেশের বিভিন্ন গ্রামীণ মেলার প্রধান আকর্ষণ।পুতুল নাচের বর্তমান চিত্র তা হলে কী? যেকোনো শিল্পরীতিই ক্রমপরিবর্তনের ধারায় এক সময় নতুনরূপ ধারণ করতে পারে।তা বলে শতাব্দী প্রাচীন এক লোকশিল্পের ধারা বিলুপ্ত হবে তা হয় নাকি?প্রথমে এক ঝলক দেখে নেওয়া যাক এর সমস্যা কোথায়?
1. টিভি ভিডিও সিনেমা জাতীয় মিডিয়ার কল্যাণে যেখানে যাত্রা শিল্প মার খাচ্ছে সেখানে পুতুলনাচের জনপ্রিয়তার পারদ যে নিম্নমুখী হবে সেটাই স্বাভাবিক।নিয়মিত বায়না হয় না। পেট চালানোর জন্য তাই শিল্পীদের অন্য পেশার সঙ্গে যুক্ত থাকতে হয়। দেখা গেছে, পুতুলনাচের সঙ্গে জড়িতরা বেশির ভাগই শ্রমিক, কাঠমিস্ত্রি, বাসের হেলপার বা কন্ডাকটর, দিনমজুর, মাছ বিক্রেতা, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, ওয়ার্কশপের শ্রমিক ইত্যাদি। মূলত পারিশ্রমিকের কারণে ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে এ দেশের পুতুলনাচ।
কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকসংস্কৃতি বিভাগের প্রধান তপন কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘‘ভবিষ্যৎ না থাকায় কেউই নতুন করে এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হতে চাইছেন না। এমনকি শিল্পীদের পরিবারের লোকেরাও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। ভালবেসে কিছু মানুষ এখনও পুতুল নাচ এখানে-ওখানে দেখান। কিন্তু যা উপার্জন হয়, তাতে পেট ভরে না।
2. এছাড়াও আছে মানুষের রুচিভেদ। রাম-সীতার বদলে রূপবান, রাধা-কৃষ্ণের বদলে আলোমতি বা ভানুমতী, বেহুলা-লখিন্দরের বদলে বেদে-বেদেনীর গল্প চালিয়ে দর্শক ধরে রাখতে পারেনি পুতুলনাচ। সেই একঘেয়ে পুরনো গল্প আর গতানুগতিক পরিবেশনা দিয়ে এটিকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয় , তাছাড়াও কথক-মাস্টার বা কণ্ঠাভিনেতা, গায়কের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকায় উচ্চারণের সমস্যাও দর্শক ধরে রাখতে না পারার আরেকটি কারণ।
3. এর পরের কারণটি মূলত অর্থনৈতিক।পুতুল নাচের দল টিকিয়ে রাখার জন্য খরচ হয় প্রচুর। একটা দলে কমপক্ষে ৭০-৮০টা পুতুল রাখতে হয়। শোলা দিয়ে পুতুলগুলি তৈরি করতে খরচ হয় দেড় থেকে দুহাজার টাকা। তিন-চার বছর অন্তর সেগুলি রং করতে হয় নিয়মিত। এছাড়াও রয়েছে গাইয়ে, নাচিয়ে, যন্ত্রবাদকদের পারিশ্রমিক। রয়েছে মঞ্চসজ্জা, আলোকসজ্জার খরচ। এত কিছু সামলাতে না পারায় ভেঙে যাচ্ছে এক একটি পুতুলনাচের দল।
4. পরবর্তী কারণটি সামাজিক। কোথাও কোথাও পুতুল নাচ দেখাতে গিয়ে মৌলবাদীদের আক্রমণের স্বীকার হয়েছেন পুতুল নাচিয়েদের দল। মঞ্চ ভেঙ্গে দেওয়া থেকে শুরু করে শারীরিক লাঞ্ছনাও জুটেছে কপালে। আবার অনেক সময় আয়োজকদের আবদার থাকে পুতুলের পাশাপাশি মেয়েদের দিয়ে অশ্লীল নাচ নাচানোর। পরবর্তীতে এই অশ্লীলতার দায়ভার বহন করতে হয় দলগুলোকে।
এককথায় পৃষ্ঠপোষকতার অভাব তো বটেই, সেই সাথে অনাধুনিকতা ও ভিনদেশী সংস্কৃতির আগ্রাসন,মানুষের রুচি পরিবর্তন, সামাজিক পট পরিবর্তন ,ধর্মান্ধতা, এতগুলো সমস্যার যাঁতাকলে পড়ে আমাদের শতাব্দী প্রাচীন এই শিল্পটি বর্তমানে রীতিমত নিশ্চিহ্ন হতে বসেছে।
ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পটিকে যদি রক্ষা করতে হয়, তাহলে ব্যক্তি সংগঠন থেকে নয় বরং আরো বৃহত্তরভাবে এর পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন। আমাদের প্রতিবেশী বাংলাদেশে ইতিমধ্যে এই লোকশিল্পের ধারাটি সংরক্ষণের একাধিক সরকারী ও বেসরকারি উদ্যোগ চলছে যা আমাদের দেশে এখনও সেভাবে শুরু হয়নি। বাংলাদেশ শিল্পকলার একাডেমীর সার্বিক তত্ত্বাবধানে গেলো বছর ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় ওয়েওয়াং ওয়ার্ল্ড পাপেট কার্নিভাল-২০১৩তে প্রথমবারের মত ড. রশীদ হারুনের নেতৃত্বে অংশগ্রহন করে বাংলাদেশ। ৪৬টি দেশের ৬৩টি দলের মধ্য থেকে বেস্ট ফোক পাপেট মিউজিক্যাল এ্যাওয়ার্ডটি জিতে নেয় বাংলাদেশ। পাশাপাশি বেস্ট সিনারি নমিনেশনের জন্য মনোনীত হয়।
এই প্রসঙ্গে মনে পড়লো, ২০১২ সালে ঈদের সময় বাংলাদেশের কক্সবাজারে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখেছি শিল্পী মোস্তফা আজিজ ও মুস্তাফা মনোয়ারের ছোট্ট বাচচাদের জন্য বানানো 'বহুরুপী', 'লিচু চোর', 'প্রজাপতি' এবং 'কাজের বিচার' শীর্ষক চারটি গল্প নিয়ে পাপেট শো।গল্প আধুনিক, উপস্থাপনা আধুনিক তবু পুতুলনাচ বলে চিনতে অসুবিধা হয়নি।
আধুনিক পাপেট্রিকে বাংলাদেশে জনপ্রিয় করার পেছনে যে মানুষটির অবদান সবচেয়ে বেশী সেই মোস্তফা মনোয়ার মনে করেন, যে মানুষগুলোর এই শিল্পের প্রতি আছে মমতা ও দায়বদ্ধতা সেইসব উৎসাহী ও শিল্পী মনোভাবসম্পন্ন মানুষদেরকে খুঁজে বের করে দায়িত্ব দিতে হবে। তবে লোকজ এই শিল্পকে একেবারে আদিরূপে সংরক্ষন সম্ভব নয় বলেই মনে করেন তিনি। এর ঐতিহ্যকে ঠিক রেখে এটিকে আরো সময়োপযোগী করতে হবে।এই পুতুল শিল্পের রয়েছে ব্যাপক সম্ভাবনাও। সারা পৃথিবীতে শিশু শিক্ষার অন্যতম উপাদান এই পাপেট বা পুতুল। উন্নত অনেক দেশেই স্কুলের সিলেবাসের অংশ পাপেট্রি,পুতুলনাচ বা পুতুল শিল্প। বিনোদনের পাশাপাশি সামাজিক প্রচার থেকে শুরু করে বিজ্ঞাপন, সবক্ষেত্রেই পুতুলশিল্পের ব্যাপক ব্যবহার নজরে আসছে। মানসিক প্রতিবন্ধী কিংবা অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের শিক্ষাদানে খুবই কার্যকরি ভুমিকা রাখছে পাপেট্রি। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠান ছাড়াও সামাজিক সচেতনতায় পুতুলনাচ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। অতি সম্প্রতি আমাদের দেশেও পুতুল নাচের মাধ্যমে জনসচেতনামূলক কর্মকান্ড চলানোর প্রচেষ্টা করছেন রাজস্থান সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের মানব উন্নয়ন দপ্তর। যেমন, এইডস, মাদক, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ, পণপ্রথা রোধ, জন্মমৃত্যু রেজিস্ট্রিকরন, এসিড প্রতিরোধ সম্পর্কে পুতুল নাচের মাধ্যমে জনসচেতনতা সৃষ্টির কার্যক্রম চলছে। ভারতের ডলস-থিয়েটার এবং বর্তমান পাপেট থিয়েটার আধুনিক ধারায় পুতুলনাচের চর্চা চালিয়ে যাচ্ছে।
অবশেষে একটিই বক্তব্য, কালের আবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে লোকজ পুতুল নাচশিল্প ,শুভবুদ্ধিসম্পন্ন কোন মানুষ সেটা মানতে পারবেন না, সেটাই স্বাভাবিক। তাই কোন অবস্থায় যেন এই ঐতিহ্যবাহী পুতুল নাচ হারিয়ে না যায় সেই দিকটি আমাদের সবাইকে লক্ষ্য রাখতে হবে।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র