দূর্বা মুখার্জী - মায়াজম

Breaking

১৮ মার্চ, ২০১৬

দূর্বা মুখার্জী

                                            হাত









 


বিকাশ বিয়ে করেছিল বছর তিন আগে । ঝুমার বাবার মেলা টাকা । কিন্তু ঝুমার হ্যান্ডিক্যাপ সার্টিফিকেট আছে । ওর পোলিও-লিকলিকে সরু ডান হাতটাকে মনে মনে ঘেন্নাই করে বিকাশ।বাম হাতটাকে মনের সুখে শাঁখা - পলা , সোনার চুড়ি , আংটি দিয়ে সাজিয়ে রাখে ঝুমা । রাত্রিবেলা আদর করার সময় হাতটা একপাশে পড়ে থাকে মনের দুঃখে - চেয়ে দেখে বিকাশকে , গলার কাছে ঘড়ঘড় আওয়াজ - উফ ! জড়িয়ে ধর আমায় , ঝুমা পারে না । ওর বাম হাত দিয়ে শুধু অর্ধেক বিকাশকেই জড়িয়ে ধরতে পারে ও ।
কিছুদিন আগে ঝুমা জানতে পেরেছে বিকাশের এক নতুন বান্ধবীর কথা । শিউলির বিউটি পার্লার আছে বাজারে । ভালই চলে , ঝুমা নিজেও গেছে বার দুয়েক ভুরু প্লাক করাতে । তাকিয়ে দেখেছে শিউলির উন্নত বুক , সুঠাম শরীর আর পেলব সুন্দর ওয়াক্সিং করা হাতদুটোর দিকে । আর ওড়নাটা আরও জড়িয়ে নিয়েছে ডান হাতটাকে আড়াল করতে ।
সেদিন আদর করতে করতে বিকাশ গলার কাছে নাক ঘষছিল , আর ঝুমা শুনতে পেল - উমম ! শিউলি , সুইটি সোনা , জড়িয়ে ধর আমায় । ওর আর কিছু বুঝতে বাকি থাকল না । কদিন ধরেই বিকাশ বাজার করতে গেলেও একটু বেশি সাজগোজ করছিল আর ডিও'র গন্ধে নাক ঝাঁ ঝাঁ করছিল ঝুমার ।
তারপরেই কান্নাকাটি , ঝগড়াঝাঁটি - বিকাশ কিছুতেই স্বীকার করল না সত্যিটা । শুধু বলে গেল , ভুল শুনেছ তুমি । রোজকার মত সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফিরে দেখল সারা বাড়ি অন্ধকার । শোয়ার ঘরের ভিতর থেকে ছিটকিনি দেওয়া দরজা ভেঙে ঝুমার ঝুলন্ত দেহটা যখন আবিষ্কার করল , একটা গভীর শ্বাস ফেলল ও । সেটা স্বস্তির না দুঃখের তা বিকাশই জানে ।
শ্রাদ্ধের কাজ মেটার আগে অবধি ও আর বাজারের দিকে যায়নি । ইচ্ছেও হয়নি । ডিমের অমলেট আর পাউরুটি দিয়ে চালিয়ে দিল তিন দিন । কাজ মিটে যাওয়ার পর ক্ষিদে  পেল খুব - শরীর মন সব খাইখাই করতে লাগল তার । পা দুটো বাজারের দিকে নিজে থেকেই হাঁটা দিল বিকাশের । শিউলিকে দেখার পর থেকে ঝুমা-টুমা উড়ে গেল মন থেকে । পার্লারের পিছনে ঘরে ডেকে নিয়ে গেল ওকে আর ও বুভুক্ষুর মত সঁপে দিল নিজেকে শিউলির বুকে । শিউলির দুটো হাত দুই দিক থেকে জড়িয়ে ধরল ওকে সাপের মত আর ও ডুবে যেতে থাকল তিরতিরে চোরাস্রোতে । অনেকদিন পর শিউলির চুলের মধ্যে থেকে ভেসে আসা বুনো গন্ধে শীত করতে থাকল হঠাৎই ।
আজকাল মাঝে মাঝেই শিউলি বিকাশের বাড়ি চলে আসে । কখনও দুপুরে পার্লার বন্ধ করে , যেদিন বিকাশ বাড়িতে থাকে দুপুরবেলা । আজই প্রথম রাতে থাকবে কথা আছে । বিকাশ ফেরার আগেই ও বাড়িতে ঢুকে যাবে কারণ সন্ধ্যের মুখে ঢুকলে পাড়াপড়শির সন্দেহ হবে । সেইমত ও এসে বসেছিল । ঝুমার একটা ছবি দেওয়ালে । গায়ে আঁচল টেনে রেখেছে ঝুমা , রোগা হাতটাকে ঢাকতে । শিউলি স্লিভলেস ব্লাউজ থেকে বের হওয়া নিজের সুন্দর দুটো হাতের দিকে তাকাল , মুখে ফুটে উঠল হাল্কা হাসি । বিকাশ এলে দুজনে আজ একটু হুইস্কি নিয়ে বসবে , ফ্রিজে বরফ আছে কি না দেখতে গেল ও ।
ডিপ ফ্রিজ খুলতেই ঠাণ্ডা হাওয়া ঝাপটা দিল চোখে মুখে -- শীত করে উঠল তার । টেম্পারেচার এত কমানো আছে নাকি ফ্রিজের ? বরফের ট্রেতে হাত দিতেই হাতটা কিসে যেন আটকে গেল ওর । ছাড়াতেই পারেনা আর , টানতে টানতে ঘেমে উঠল শিউলি । ঠাণ্ডা হাওয়া যেন পাগল হয়ে গেছে - মুখে ঠাণ্ডা ঝাপটে অস্থির হয়ে উঠল সে । ক্রমশ অবশ হয়ে যেতে থাকল হাতটা ।
বিকাশ এসে দেখল শিউলি সব সাজিয়ে নিয়ে বসে আছে । ওকে ঢুকতে দেখে উঠে দাঁড়াল , একটু হেসে । কিছু যেন বিষণ্ণ , নাকি চাপা টেনশন - বিকাশ বুঝতে পারল না শিউলির মুড । তুমি চেঞ্জ করে নাও , আমি গরম গরম ফিশ ফ্রাই নিয়ে আসছি , বলল সে । বিকাশ ঘাঁটাল না ওকে । বিছানায় শুয়ে শুয়ে শুনলেই হবে কি হয়েছে ।
"আজ জান এক অদ্ভুত কাণ্ড হল ফ্রিজ থেকে বরফ বের করতে গিয়ে - " শিউলি হুইস্কিতে প্রথম চুমুক দিয়েই কথাটা তুলল । বিকাশ থমকে গেছে , কেন , কি হল আবার ? আর বল কেন , হাতটা আটকে গিয়েছিল কোথাও ভিতরে , আমিতো ভয়েই আধমরা । " কি যে বল তার ঠিক নেই ! " বিকাশ অবাক । টানতে চাইল ওকে কাছে কিন্তু শিউলি উল্টো দিকের সোফাতেই বসে থাকল । " হ্যাঁ গো , সত্যি বলছি । তুমি একবার দেখবে ? " বিকাশ ইচ্ছে না থাকলেও গেল ফ্রিজের কাছে , একবার মাথায় ঢুকেছে যখন শিউলির মুড ঠিক হবে না ও না দেখা অবধি । ডিপ ফ্রিজ খুলতেই ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝলক , শিউলি ওর পিছনে দাঁড়িয়ে , ঘাড়ের কাছে গরম নিঃশ্বাস টের পাচ্ছে ও । হাত ঢোকানোর আগে একবার ভয় ভয় করে উঠল ওর । শিউলি কি ভাববে ভেবে শেষমেশ হাত ঢুকিয়েই দিল ।
আর সাথে সাথেই কেউ যেন চেপে ধরল ওর হাত শক্ত করে । সাঁড়াশির মত আঙুলগুলো চেপে বসল ওর কব্জিতে । ও বাম হাত দিয়ে ছাড়ানোর চেষ্টা করল ডান হাতটা , প্রাণপণ শক্তিতে কিন্তু ওই জোরের কাছে কিছুই না । হায়নার দাঁতের মত আঙুলগুলো চেপে বসতে লাগল শুধু আর চাপের চোটে সারা শরীরের সমস্ত হাড় ঝনঝন করতে লাগল তার । " শিউলি ---- ছাড়াও আমাকে , বাঁচাও --" কিন্তু শিউলি কই ? সারা ঘরে হা হা করে ঘুরপাক খেতে লাগলো একটা ঠাণ্ডা হাওয়া ।
চারদিন পর পাড়ার লোকের সন্দেহ হওয়াতে তারা দরজা ভেঙে ঢুকে খুব অবাক হয়ে গেল । ঠাণ্ডা হয়ে আছে ঘর মর্গের মত । ফ্রিজের দরজা খোলা আর তার সামনেই বিকাশের নিথর দেহ পড়ে আছে । খোলা দুটো চোখ সিলিঙের দিকে চেয়ে আছে এখনও । কব্জির নীচ থেকে হাতটা নেই , রক্ত শুকিয়ে আছে চারপাশে । ফ্রিজটা তখনও চলছে , পাখা ঘুরছে । একজন কৌতূহলী হয়ে উঁকি দিল ফ্রিজের ভিতর আর চিৎকার করে বেরিয়ে এল ঘর থেকে ।
বরফের ট্রেতে লাল লাল বরফ জমে আছে , কেউ যেন রক্ত জমিয়ে রেখেছে যত্ন করে । আর একটা কালো , শুকনো লম্বা মত কিছু পড়ে আছে যার গায়ে শাঁখা - পলা আর সোনার চুড়ি পরা থাকলেও তাকে হাত বলে চিনে নিতে কষ্ট হয় !
শিউলিকে আর খুঁজে পেল না কেউ !

২টি মন্তব্য:

Featured post

সোনালী মিত্র