বলাকা দত্ত - মায়াজম

Breaking

১৮ মার্চ, ২০১৬

বলাকা দত্ত

                                                লাল জবা











লাল মেঝের বারান্দা থেকে তিনটে সিঁড়ি নেমেই জয়তীর হাতে লাগান জবাগাছ অনেকটা জায়গা জুড়ে ডালপালা মেলে রেখেছে। বারোমাস গাছটা লাল হয়ে থাকে। রোদ যত চড়তে থাকে তিনটে ঘরেই লালের আভা এসে পড়ে। শুভময় ইজিচেয়ারটা নিয়ে সরে সরে যায়। এই করতে করতে পশ্চিমের রোদও যখন ঢলে পড়ে নিরুপায় শুভময় গাছটার পাশে এসে বসে, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত বাড়তে থাকে, শুভময়ের ওঠার নাম নেই, শংকর যতবার ডাকতে যায় দাদাবাবুর কাছে মৃদু বকুনি খেয়ে ফিরে আসে। শেষমেশ আর না পেরে জোর করেই দাদাবাবুকে ঘরে নিয়ে যায়, ফুল ভলিয়ুমে চালিয়ে দেয় খবরের চ্যানেল। চা আর মুড়ি খেতে খেতে শুভময় প্রতিদিনের মত একই রকম উৎসাহ নিয়ে জয়তীর কথা বলতে শুরু করে, শংকরও হাঁ করে দাদাবাবুর মুখের দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে থাকে
যেন আজই প্রথম বৌদিমনির গল্প শুনছে। জানিস শংকর, আটাত্তরে যেবার সাংঘাতিক বন্যা হয়েছিল, তোর বৌদিমনি সেবার রথের মেলা থেকে ওই জবার চারাটা নিজে হাতে কিনে এনে লাগিয়েছিল। তারপর মার ছেলে মিলে সে কি যত্ন- জল দেয়, গোঁড়ার মাটি আলগা করে আবার কোথা থেকে যেন কীটনাশকও কিনে এনেছিল। যেদিন প্রথম কুঁড়ি এল সেদিন তোর বৌদিমনির কি আনন্দ আর সঙ্গে মা ন্যাওটা সঞ্জুটাও বাড়ি মাথায় করে তুললো। আমি অফিস থেকে ফেরার পর ওই রাত্রি নটার সময় টর্চ নিয়ে কুঁড়ি দেখিয়ে তবে ছাড়লো। এতো গেল কুঁড়ির কথা, যেদিন লাল টুকটুকে ফুলটা ফুটলো সেদিন জয়তী মাকালীর পায়ে ফুলটা দিয়ে মালপোয়া ভোগ দিয়েছিল। আর দিনটাও ছিল রোববার, সারা বাড়িতে কেমন যেন আনন্দ আনন্দ গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল। হ্যাঁ রে শংকর সঞ্জুর কি আর জবাগাছটার কথা মনে পড়ে। হ্যাঁ গো দাদাবাবু, সঞ্জু খোকাবাবু গতবার শীতে যখন অআমেরিকা থেকে এলো তখন আমায় বলেছিল, শংকর কাকু ওই জবাগাছটায় প্রতিদিন মনে করে জল দিও-ওটা আমার মার প্রাণ ছিল। তাই নাকি রে শংকর! কই আমাকে আগে বলিস নি তো! আমার সঞ্জুও ওই জবাগাছটায় মায়ের স্পর্শ পায়। তাহলে তো ঠিকই আছে, কোথাও তো কোন ভুল নেই। জানিস শংকর তোর বৌদিমনি ভোরবেলা লালপাড় গরদের শাড়ী, সিঁদুরের টিপ পরে সাজিঁ থেকে জবা সাজিয়ে দিত সিংহাসনে তখন ধূপ অগুড়ু সলতে পোড়া তেল কর্পূর মিশে সারাবাড়িটা কেমন শুদ্ধ হয়ে উঠতো, আমি আজও ওই পুজোর গন্ধটা পাই ভোরের জবাগাছে- মনেহয় জয়তী লালটিপ আর লালপলায় খোলা চুলে হাসছে। দাদাবাবু আর নয় অনেক রাত হল এবার তুমি রুটি তরকারিটুকু খেয়ে শুয়ে পড়ো। শুভময় রুটি চিবোতে চিবোতে হাসছে, শোন তাহলে শংকর- একবার অষ্টমীর দিন ভোরবেলা উঠে জয়তী দেখে সব ফুল এমনকি কুঁড়িগুলোও নেই। ওর তো চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়াচ্ছে, যত বোঝাই আরে ওটা পাড়ার ছেলেদের কাজ আর ওরা তো ঠাকুরের পায়েই ফুল দেবে কিন্তু সেই এককথা- আমার মনেহয় কোথাও কোন ত্রুটি হয়েছে। আর একবার সঞ্জুর অ্যানুয়াল ইংলিশ পরীক্ষার দিন একটাও জবা ফোটেনি ব্যস জয়তীর মন খারাপ। তবে সেবার জয়তীকে খুব বকেছিলাম তুমি এভাবে ছেলেটার মনটা দুর্বল করে দিও না। দাদাবাবু, রাত তো প্রায় ফুরিয়ে এল, তুমি আর কখন ঘুমোবে? না রে শংকর, আজ আমায় বলতে দে, আমার জয়তীকে খুব মনে পড়ছে, ওর কাছে যেতে ইচ্ছে করছে। এত হাঁপাচ্ছো কেন দাদাবাবু, কষ্ট হচ্ছে তোমার? ডাক্তারবাবুকে আসতে বলি? না রে অামি ভালো আছি, ওই বাঁদিকের বুকটায় একটু...,ওও কিছু না, তোকে ব্যস্ত হতে হবে না। ওই শোন, পাখি ডাকতে শুরু করেছে, মনেহয় ভোর হয়ে এলো। হ্যাঁ গো দাদাবাবু আকাশ আবছা হয়ে এসেছে। তুই জবা গাছটার তলায় একটা মাদুর পেতে দে, আমি জয়তীর কোলে মাথা রেখে একটু শোবো।
শংকর দেখছে ঝিরঝিরে ঠান্ডা হাওয়ায় শুভময়ের চুল উড়ছে, মুখে স্মিত হাসি অথচ শ্বাস নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। এমন অসময়ে বারান্দার মোড়াটার ওপর রাখা মোবাইলটা বেজে উঠল। ওহহো খোকাবাবু তুমি! ধরো ধরো দাদাবাবুকে দিচ্ছি। না রে শংকর, তুই লাউড স্পীকারে দে। বাবা- আজ আমি একটা খারাপ স্বপ্ন দেখলাম, তুমি আর ওখানে একা থেকো না, আমি যত তাড়াতাড়ি পারি তোমাকে নিয়ে আসবো। তুমি জিনিসপত্র গোছাতে শুরু করো আর আসার সময় আমরা একটা জবাগাছের চারা নিয়ে আসবো বাবা, তোমার কোন চিন্তা নেই। শুভময়ের চোখমুখ লাল হয়ে উঠেছে, কোনরকমে বললো, তুই ভুলে গেলি তোর মা প্লেনে চড়তে ভয় পায়! সে কিছুতেই যাবে না তোর ওখানে। তুই এতো ভাবিস না বাবা, আমি তোর মাকে নিয়ে চললুম।
শংকর দেখল বোঁটা থেকে একটা একটা করে জবা খসে পড়ছে দাদাবাবুর গায়ে, লাল হয়ে উঠেছে ধুতি পাঞ্জাবী। শংকর বারবার চোখ কচলে কচলে দেখছে কখনও মনেহচ্ছে দাদাবাবু আবার কখনও যেন মনেহচ্ছে বৌদিমনি শুয়ে আছে। বারান্দার এককোণে ছিটকে পড়ে আছে মোবাইল তখনও সঞ্জুর গলা ভেসে আসছে, বাবা- আমরা অআবার একসাথে থাকবো, তুমি তাড়াতাড়ি জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র