সম্পাদকীয়
মাটির বুকে কান পেতে দ্যাখো।শুনতে পাও তুমি কিছু?সেই ছেলেটি শুনতে পায়।তার অমল চোখে নারকেল পাতার চশমা,গাছের ডালের ছড়ি হাতে মূহূর্তের রাজা সে।স্কুলের জানলা থেকে দেখা যায় গঙ্গার ছোট-বড় ঢেউ,ফেরিঘাট,মানুষের কলোরব,জলে ভেসে যাওয়া মৃত শরীরের উপরে ডানা মেলে ঘুরতে থাকা কাকেদের লাস্য হুল্লোড়।ছেলেটির চোখ ব্ল্যাকবোর্ড ছুঁয়ে গড়িয়ে যায় দুপুরের প্রান্তে। জনলার ওপারের ভাঙা মন্দির তট ছুঁয়ে; কারা যেন ফিসফাস করে বলে যায়- রক্তের স্বাদ নোনতা।কারা যেন বলে, মাটির নীচে লুকানো আছে গুপ্তধনের পাখি।যাকে শিকারি চোখে ধারণ করতে পারলেই ঝন ঝন মোহর বৃষ্টি।অথবা এসব কিছুই না কেবল একটা অদম্য নেশা;নেশাকে জয় করার।প্রাচীন টেরাকোটার গায়ে বোবা আর্তনাদ হয়ে পৃথিবী খুলে বসে থাকে তার গর্বিত পাঁজরের রক্তরস,খঞ্জরের সুরৎ সুরঙ্গ।এর নীচেই বুঝি গুমঘর! হুম আর একটু কান পাতলেই শোনা যাবে নুপুরের কাঙখিত নিক্কন । হ্যাঁ গো দেবদাসী এলে নাকি?গর্ভগৃহের দ্বার মর্মর ধ্বনি তুলে বন্ধ হবার আগে দৃষ্টিতে ধারণ করতে হবে অগোচর যা কিছু আছে ভাঙা দেবতার পায়ে খদিত।স্কুল পালানো ছেলেটির শার্টের বোতামে পুরনো তুনট গন্ধ আছে লেগে।ছেলেটি জানে,হলদেটে এই গন্ধবুকে নাক ডোবাতে পারলেই পৃথিবী মেলে ধরবে তার প্রাচীনগন্ধী শরীর।
যারা বুকে বালুঘড়ি বেঁধে ঘোরেন , তারা বুঝতেই পারেন না কখন সময় শেষ হয়ে এল! যারা উন্মুক্ত হাওয়ার সঙ্গে , ফসিল মেঘের সঙ্গে ,সোনা সোনা ফসলের সঙ্গে ,ছলছল নদীর সঙ্গে ঘোরেন , তাঁদের কাছে সময়ের ধারনাটাই ভুল প্রমাণিত হয় । সময়কে ব্যবহার করতে গিয়ে বেশিরভাগ মানুষ সময়ের দ্বারা ব্যবহৃত হয়ে যায় । সময়কে বদলাতে গিয়ে নিজেই সময়ের ফাঁপরে পড়ে নিঃস্ব হয়ে যায় । সময় সেই জাদুকর , যার শেষ ম্যাজিকটা কোনোদিন দেখানো হয়ে ওঠে না । আমরা সবাই ম্যাজিকটা দেখতে চাই , প্রতীক্ষা করি , আর প্রতীক্ষা করতে করতে মাটির অন্দরে পৌঁছে যাই । পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে সময়কে বদলাতে চেয়ে বদলে যাওয়া মানুষে গিয়েছে ভরে । সময় হল জলস্তম্ভের মতো ।প্রতি মুহূর্তের ঢেউয়ে ভেঙে গিয়ে নতুন নতুন রূপে আবির্ভাব ঘটে ।
কিন্তু , মানুষ তো এমন নিঃস্ব ছিল না ! মানুষের পাঁজরে নেই কি প্রাগৈতিহাসিক অস্তিত্বের বিশ্বাস ? নেই কি পূর্বপুরুষের রক্ত ? অথচ ভুলে যাওয়া যেন মানুষের স্বভাব । সমস্ত কিছু ভুলতে ভুলতে আজকে নিজেকেই ভুলে গিয়েছে মানুষ । বয়ে যাওয়া সময়ের মাহেন্দ্রক্ষণে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারা যায় , মানুষের ভাষা মানুষ আর বুঝতে পারছে না ।তবে সেই কোন প্রাচীন কাল থেকেই মানুষের রক্ত মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে লড়াইয়ের জন্য তৈরি । ভাইয়ের বুকের রক্তে স্নান করছে অন্য আর এক ভাই । সমস্ত সম্পর্কগুলো মানুষকে বেঁধে রাখার জন্য যথেষ্ট নয় বোধহয় । ইতিহাস সাক্ষী মানুষের সঙ্গে মানুষের এই ভেদাভেদ মানুষকে নিয়ে যাচ্ছে সভ্যতার শেষ প্রান্তে ।
অথচ মানুষ তো থাকতেই এসেছিল মানুষের কাছে । প্রকৃতি এসেছিল পুরুষের পাশে । হাতে হাত ধরে পাথর ভেঙেছিল , লড়াই করেছিল পশুদের বিপক্ষে । ধীরে ধীরে সেই প্রিয় পুরুষ থেকে দূরে সরে গেল প্রকৃতি । শুধু বিপরীত লিঙ্গের কারণেই কি দূরত্বের অবস্থান ? নারীর শরীর কি তাহলে নারীর মনের প্রতিবন্ধক ? পুরুষেরা নারীকে ভালোবাসতে গিয়ে ভালো বেসে ফেলল শরীরকে ।তবে কি ট্রয়ের যুদ্ধের যাবতীয় দায় ভার আমরা হেলেনের মাথায় চড়িয়ে দিয়ে স্বস্তির শ্বাস নিয়ে ঝেড়ে ফেলি দায় ভার?নাকি দৌপদীর শাড়ির আঁচল ধরে কুরুক্ষেত্র ভূমিতে পৌঁছে উল্লাস করি অথবা আক্ষেপ, একটা নারী শরীরই যথেষ্ট গোটা সভ্যতাকে ধ্বংস করবার!মানুষ শরীরকে যত ভালোবাসতে শিখল তত বাড়ল লোভ । সেই লোভ টেনে নিয়ে গেল নরকের কিনারে । অধঃপতন থেকে মুক্তি নেই , কিংবা মুক্তি চাই না বলেই পতন ডাকে আয় ।
আসলে,মানুষের ইতিহাসে শেষ নামের কোন শব্দ নেই । শুরু আছে । শেষ একটা ধারণার নাম । শেষের পর থেকেও শুরু হতে পারে ।মানুষের এমনই এক নিয়ম তারা বেশিদিন শোক বইতে পারেনা।এক একটা অন্ধকারের পরেই হন্যে হয়ে আকাশে উড়িয়ে দেয় আলোর রোশনাই।
যে জাতির অতীত নেই , সেই জাতির বর্তমান ও ভবিষ্যৎও নেই । যে প্রাণীর জীবাশ্ম আছে , তারা যে এককালে পৃথিবীতে ছিল , বলাইবাহুল্য । প্রাণীর এই থাকা বা না-থাকাটা হল ইতিহাস । দলিল । পৃথিবী নামক মঞ্চে এসে যারা অভিনয় কিছু-না কিছু করে গিয়েছেন ,তাদেরকেই আমরা খুঁজে পেয়েছি বর্তমানে ।সভ্যতার শিকড় প্রাচীনকালের মধ্যে ঢুকে রয়েছে ! নদীমাতৃক দেশ , তার সবুজে-ভরা ক্ষেতখামার , গোলাভরা ধান , যে সভ্যতাকে বিকশিত করেছিল তা আজও বর্তমান । স্তিমিত হয়ে আসা অতীতগুলি হয়তো এখনকার চেয়ে প্রাণবন্ত ছিল , হয়তো পাখির সঙ্গে শিস দিতে দিতে প্রভাতে ফসলের মধ্যে ঢুকে যেতেন তখনকার মানুষেরা ! আজকে সেই মানুষগুলি হয়তো নেই , হয়তো হারিয়ে গিয়েছে তাদের হাসিকান্নার দিনগুলি !
বর্তমানকে ভবিষ্যতের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখতে গেলে অতীতগুলো জন্ম পরম্পরায় ছড়িয়ে দিতে হয় ! অতীতের বীজ থেকে আসে বর্তমানের সন্তান । বর্তমানের সামনে অতীতের দরজা খুলে না দিলে বুঝবে কী করে অতীত কেমন ছিল ! মায়াজম এবার আমাদের অতীতকে নিয়ে,আমাদের ইতিহাসকে নিয়ে ফিরে এসেছে । ফেলে আসা যুদ্ধক্ষেত্র , মানুষের জীবনযাত্রা,ষড়যন্ত্রের তীক্ষ্ণ গন্ধ,তরবারির ঝনক নিয়ে হাজির হয়েছে পাঠকের সামনে । দেবতা থেকে মানুষ, এই দীর্ঘ পথ ভাঙতে আমরা স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালে উড়িয়েছি জয়ধ্বব্জা।ইতিহাসের ছলছল ঢেউয়ে মণিমাণিক্য খুঁজেতে মায়াজম যথারীতি প্রত্নতাত্ত্বিকের ভূমিকায় হাজির হয়েছে আপনাদের দরবারে।
এবারের মায়াজম সংখ্যা অন্য আঙ্গিকে ভরা ।পরিচিত মিথ গুলোয় নতুন দৃষ্টিকোণ, নতুন অনুভব আর রোমন্থনে পরিপূর্ণ । এবারের সংখ্যাটি পড়লেই বুঝতে পারবেন,প্রতিটি লেখার মধ্যে লেখকদের কী নিদারুণ পরিশ্রম রয়েছে।ভালবাসলে তো পাথরের বুকে ফোটানো যায় প্রেমফুল।এই মায়াজমের লেখক এবং পাঠকদের মধ্যে রয়েছে সেই ভালবাসা সম্পর্কই তো এত বছর ধরে এত মানুষের সঙ্গে পথ হেঁটে চলছি আমি,মায়াজম। যারা এবারে লেখা দিয়ে সমৃদ্ধ করেছে মায়াজমকে তাদের আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই ,জানাই অমলিন ভালবাসা। শুভেচ্ছা জানাই মায়াজমের অগণিত পাঠক বন্ধুদের ।আর একটি আনন্দের কথা জানাই,বন্ধু দূর্বা চট্টোপাধ্যায় মায়াজমকে ভালোবেসে এই প্রচ্ছদটি এঁকে দিয়েছেন।
মায়াজম পড়ুন। ভালো থাকুন।ভালোবাসুন।
ধন্যবাদন্তে-সোনালী মিত্র
মায়াজম পড়ুন। ভালো থাকুন।ভালোবাসুন।
ধন্যবাদন্তে-সোনালী মিত্র
খুব ভালো লাগলো দিদি।ভালোবাসা নিও।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুনভালো লিখেছ সোনালী। বলিষ্ঠ সম্পাদকীয়।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ দাদা
মুছুনধন্যবাদ দাদা
মুছুন