রিয়া চক্রবর্তী - মায়াজম

Breaking

১৫ মার্চ, ২০১৫

রিয়া চক্রবর্তী



জীবনের রঙ



বাড়ির সামনের গলি দিয়ে একটু হেঁটে গেলেই বড় রাস্তা। রোজ ভোরে আমি বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকি। সেখানে পাশাপাশি তিনটে দোকান। একটা ওষুধের দোকান, একটা জুতোর দোকান আরেকটা সোনার দোকান। দোকান তিনটের ভিন্ন রং আমি প্রতিদিন লক্ষ্য করি। দেখি হলুদ রঙের চকচকে ধাতুর মধ্যে লাল,নীল,সবুজ নানারঙের মূল্যবান পাথরের সাথে মিশে যাচ্ছে পাশের দোকানের চামড়ার ভেতরে লুকিয়ে থাকা রক্তে, আর তাকে জীবানু মুক্ত করছে ডেটল। এইসবের ফাঁকে সেই মিঠে গোলাপি ক্যান্ডি ফ্লসের মতন আবছা স্বাদমাখা বাসের আগমন, আমার প্রতীক্ষার অবসান।

মনে পড়ে যাচ্ছে সেই ছোট্ট বেলায় দাদুর হাতধরে ঘুরে বেড়াতাম সারা কোলকাতা। পুরনো একটা দোকানে দাঁড়াতাম। দাদু গ্রামফোন রেকর্ডের পছন্দের গান কিনতেন। ভিক্টোরিয়াকে পেছনে ফেলে , নিউ মার্কেটের নাহুমের কেকের দোকানে আমার লাফালাফি সেরে , বিশাল গড়ের মাঠটাকে টা টা করে ,কালীঘাটের মন্দিরকে নমো নমো করে রসগোল্লায় মাখামাখি করে দাদু নাতনীর বাড়ি ফেরা। আবার কখনও কোন এক গরমের বিকেলে দাদুর সাথে উড়ে যাওয়া প্রিয় গড়িয়াহাটে। পছন্দের পুতুল, একটু দরকষাকষি, ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। জবজবে ভিজতে ভিজতে বেদুইনের রোল। রাতে বাড়ি ফিরে হ্যাচ্ছো হ্যাচ্ছো করতে করতে লুচি কাশ্মীরি আলুর দম আর কাজু কিশমিশে ভরা জন্মদিনের পায়েস। চমকে উঠলাম কন্ডাক্টারের চিৎকারে, “এল্গিন এসেগেছে কারা নামবেন নেমে যান”।

অগত্যা ফিরে এলাম আমার শৈশবের সবুজ রং গুলোকে হাত ছাড়িয়ে আমার বর্তমানের সদা ব্যাস্ত জীবনে। এখন দাদু নেই তাই স্বপ্নজুড়ে দাদুর হাত ধরে ঘুরে বেড়াই। স্বপ্নের উপত্যকায় পাহাড়চেরা ঝর্না,মেঘ,ছোট্ট আমি ,দুষ্টুমিতে ছোটাছুটি এ পাড়া ও পাড়া। একটুকরো ছোটবেলার একফালি সোনালি রোদ ছড়িয়ে আছে এ শহরের পথে পথে, আরেক টুকরো আড়ি করে পাড়ি দেবে কোন অজানা পথে,হয়ত শহর থেকে দূরে।

এখন দিনগুলো বড় বেশি ধীর স্থির শান্ত। যেন কোন তাড়া নেই। এখন সূর্য ওঠার আগে উঠে পড়ি। আকাশের কোলঘেঁষে লাল, কমলা রঙের নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকি। আবার কখনও কখনও এমন রাত আসে, যেসব রাতে, একলা চাঁদের পাশে লক্ষ কোটি চাঁদ জ্বলে ওঠে।রূপকথার গল্পেরা ঘুমের -পাশ কাটিয়ে চলে আসে আমার চোখের পাতায়, মনের রুপোলী খাতায়। গতকাল রাতেও এসেছে।অনেকটা ধুয়ে গেছে অবুঝ মন। ভুলে যেতে চেয়েছে গভীর কালো অন্ধকার ভয়ংকর সেই রাতগুলোর কথা। বর্ষার এখনও অনেক দেরী, তবুও মন আজ স্বচ্ছ টলটলে দিঘী। স্বচ্ছ জলে বারবার আনমনা অবগাহন। পলির মতন আনন্দ গুলো জমে মনের মোহনায়।

ভালোলাগার তুলিকে সাথে নিয়ে নীল রঙা রাতে সেই পলি সেঁচে চোখ আঁকে ভালোবাসা। আর ঠিক তখনই রাতের ঘাসের ওপরে শিশিরের চাদরের মতো একটু একটু করে রোদ পেয়ে মুছে যায় দিঘী। ভাললাগা,ভালোবাসার হাতধরে মনের মাঝে আবার কচি নরম ঘাসের সবুজ আস্তরন,যদিও এখন আর আগের মতো মেঘেরা নিজেদের রূপের বাহার দেখতে আসে না জানলার শার্সীর আর্শীতে। রাতের আকাশের প্রিয় তারাগুলো অপেক্ষায়,অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। অসময়ের বৃষ্টিতে ভিজে যায় মন-চোখ। জীবনের নদী তিরতির করে বয়ে চলে। ইচ্ছেরা সব নিজের মতন এগিয়ে যায় সময়ের হাত ধরে বাঁধের পর বাঁধ ডিঙিয়ে। নরম রোদে মাঝে মাঝেই দাঁড়াই, কুশের আসন জলে ভিজিয়ে বসি, বুকভরে নিয়ে নিই বেল,গন্ধরাজ,খানিক আতর। রাঙিয়ে নিই নিজেকে শিমুল,পলাশের লাল রঙের সাথে। ভাললাগা জমে যায় মনের অসংখ্য অলিগলিতে। সন্ধ্যে বেলায় পাখিদের সাথে আমিও ফিরে আসি আমার প্রিয় ঘরে। মান অভিমানে একটা একটা করে নদী জন্ম নেয় আবার মুছে যায়। রোজ রোজ। মাঝে মাঝে। কখনও কখনও। নদী মোছে। আবার নদী আঁকি নতুন।পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়া স্বচ্ছ নীল জল। একা একা নির্জনে।

এখন একটুতেই নদী আঁকে মন।নীল রঙের সাথে মিশে হয়েছি নীল। যখনই নির্ভরতার হাত অবিশ্বাসের সাথে দূরে যেতে চেয়েছে ঠিক তখনই। তখন অনেকটা মন জুড়ে একা। পুরনো নদী সব ধুয়ে মুছে গেছে। এক আকাশ অভিমানের পরে তুলি হাতে বসি। আরেকটা আঁকা হবে নিশ্চিত। ঠিক তখনই মনের কৃষ্ণচূড়ায় ডেকে ওঠে চিরচেনা সুর। আর সাথে সাথেই নদী মুছে যায়, সাথে ধুয়ে নিয়ে যায় মনখারাপের আকাশ। একরাশ অভিমান। জলের মনে নদী আছে, নদীর জলে নীল। কথার ভেতরে শব্দ আছে,আবার শব্দের আছে মান। মান,অভিমান, চোখ ছলছল, আর্শি নগর, মনের ভেতর ঘর।

আবার কখনও গভীর রাতে চাঁদের আলোয় ঘর নিকিয়ে, ঘাস বিছানায়, লালচে রঙা আলো বেয়ে বয়ে যায় অপেক্ষার প্রহর। অপেক্ষার মন, আরেকটু রাঙিয়ে নেয়, রঙ ঝকমকে,খুশী ঠিকঠিক, একটু বেঠিক নেই। ঠিক-বেঠিকের হিসেব কষে হিংসুটে কাদাখোঁচারা। আমি তো মন পেতেছি, রোদ মেখেছি। হাতের বন্ধু মুঠি আছে, মুঠির দোসর আঙুল। সুখ মেখেছি আঙুলময়। আবার রপকথার রাস্তায় ঘুরে বেড়াই সেই ছোট্টবেলার খুব আদুরে মেয়েটাকে সঙ্গে নিয়ে , আর সাথে থাকে ভালোবাসা।

অনেক কথার দোষ। অনেক কথার দোষ আমার,তখন রোষ হয় ভালোবাসার। আবার কথাতে, কোন কথাতে আবার ব্যাথা পেয়ে যায় সে। তখন চুপকথাতে রূপকথাতে দিনজুড়বে মনজুড়বে তার।আর আমি তখন মন পুড়িয়ে চুপচাপ। আবার একটু পড়েই আলো মুখে অসীম সুখে অনেক আদর। কথার তখন জোয়ার আসে, আদর নদীতে ভাসে প্রেমের বজরা। লাল মাটিতে,চালতা রঙা মাঠের পারে মনের বজরা থেমে থাকে।
ঝুমকো লতার কান ফুসফুস মৌমাছিদের গুনগুনে,চুপচুপ বাতাসের সুরে ,লজ্জায় লাল হয় মন।  অভিমানী তারাগুলো ফেরে না আর। পায়রাদের বকমবকম ও খালি সরে সরে যায়। এক একবার কাছে টেনে। আবার পরক্ষণেই চলে যায় দূর থেকে বহুদূরে, অভিমানে? তবে আমি জানি একদিন ভালবাসাকে নিয়ে ওদের সাথেই ভাগাভাগি করে থাকবো। কোথায়? যেখানে আমার মন হবে খুশিতে পথ হারা। যেখানে আমি বাঁধা আছি প্রশ্রয়ের মূর্ছনায়, ক্রমাগত ,অবিরত।সেই ভালোবাসার সুরে। শূন্য থেকে চলা শুরু,জানি একদিন আঁকাবাঁকা পথ,চেনা অচেনা অলিগলি, ছায়াঘেরা মাঠ, আলো আঁধারির খেলা, মেঠো সুরের আল, রাঙা জলে ভেসে যাওয়া পাগল ঝোরা, আবীর রঙে ছোপা ফুটপাথ,সাবাই ঘাসের জঙ্গল, পাথরের তড়াই,আর খোলাম কুচির উৎরাই পেরিয়ে পৌঁছে যাবো আমার সেই স্বপ্নে ঘেরা ছোট্ট পাহাড়ি গ্রামে।
হাওয়া পথে উড়িয়ে দেবো আমার যাবতীয় নীলনদ, ইউফ্রেটিস-টাইগ্রিস দের। সুখের গন্ডোলায় ভেসে বেড়াবো ভেনিসের বুক চিরে। কোনএক সোনারঙা উপত্যকায় চুপ করে বসে শুনবো প্রিয় মানুষটিকে। তার চোখের পাতা ভালোলাগা মেখে নেবো শরীরের প্রতিটি কোষে। বুক ভরে গন্ধ নেবো তার শরীরের আতরের, উত্তাপে গলে যাবো একটু একটু করে।

মাঝে মাঝে স্বপ্নে ঘুরে ফিরে আসে সেই প্রাচীন মন্দির। হাজার বছরের পুরনো একটা পাথুরে বাড়ি খাঁজে খাঁজে জমে থাকে নির্বাক ইতিহাস। পুরনো ধুলোয় ভরা যার ঘুলঘুলি-চিলেকোঠা। ঘুরেফিরে আসে মিঠে জল পাতকুয়ো। তুলসি তলা,কুলুঙ্গি আর সেইসব ছায়া ছায়া আবছা মানুষেরা। জানি অজানার ভিড়ে, মাঝে মাঝে দিকশূন্য। তখন মন কোন কথা শোনে না। বড় বেশি অবাধ্য তখন সে। অবাক হয়ে মেঘ চোখে তাকিয়ে হালকা স্বপ্ন ভেঙে বেড়িয়ে আসি। মাঝে সাঝে বড় অসহায় হয়ে পড়ি। যখন ঝড় এসে আমার সব ইচ্ছেগুলোকে নিয়ে পালিয়ে যায়, আর আমি একটা একটা করে হারিয়ে যাওয়া ইচ্ছের গিঁট খুলতে থাকি।

ছোটবেলায় যখন এই গিঁটের জঙ্গলে আটকে পড়তাম, সারা বাড়িময় ঘুরে বেড়াতাম গিঁট খোলার জন্য। আর এখন রোজ রোজ একটু করে হালকা হয় বাঁধন, আর আমি কখনো আধখানা গিঁট খুলি আবার কখনো সিকি খানা খুলতে পারি-কখনোবা একটুুও খুলতে পারিনা। দেখতে পাই অনেক পুরনো ইচ্ছের গায়ে শ্যাওলা জমে গেছে।এক দমকা ঠাণ্ডা হাওয়া ছুঁয়ে গেলো আমাকে।

দূরে কোথাও বহুদূরে আমার প্রিয় বৃষ্টি ঘুরে ঘুরে উড়ে যাচ্ছে তারই কথা বলে গেলো কানে কানে ঠাণ্ডা বাতাস। জানি আবার খুব সকালে আমার খুশী মন, আবীর রাঙা মেঘ সোনালি ডানার চিলেদের ডানা থেকে সোনা রোদ মেখে নিয়ে চাতকের সুর হয়ে আকাশের বুক চিরে ফিরে আসবে আমার কাছে। পুরনো পুকুরের ঘাট ঘেঁষে কাচ জলে পা ডুবিয়ে, শালিক, চড়াই এর ডাক হয়ে মন পাড়ি দেবে লাল পাহাড়ির পথে। খুব রোদে চুপ করে পাতাদের কানে কানে বৃষ্টির ফোঁটা এঁকে,পানসি ভাসিয়ে এগিয়ে যাবে যাযাবরের সাথে।








কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র