সপ্তক পর্যটনে
তার
কালো ক্লেদের ইনার্শিয়া ভেঙে আলোর কোল ছুঁল খানিকটা রং।
আড়মোড়া ভাঙছে মোমকুয়াশা ভোরে। সে চোখের পাতা মেললে দিগন্ত থেকে উঁকি দিল এক থালা
ক্রিমসন রেড। শহরের রাস্তা ধোয়া হয়ে গেছে এর মধ্যে। ছ’তলা উঁচু বিল্ডিংয়ের ছাদের
জাফরি ফুঁড়ে দু-চার রোদকাঠি ঢুঁ মারল আগন্তুকের ঘরে। সে এসেছে জানান দিচ্ছে প্রবল
চিৎকারে ওদিকে তিতলির সারেগামাকে ছাপিয়ে। হাওয়ার দোলায় বুঝি কথার তুবড়ি ঝরে গোলাপি
ঝুমকো ফুলের সাথে সবুজ পাতাদের । দেখা হয়ে যায় এভাবেই শিশু রঙের সাথে সকালের
প্যালেটে।
উপরের সা তে গলা মেলাতে পারে না এখনো তিতলি। যেমন মেলেনা
আলোর ও দো বাঁও এই শহরেরই প্রান্তে ঘিঞ্জি বস্তিতে আসার পর। ওরা থাকতো সূর্যপুরের
বেশ ভিতরদিকে আদিবাসী এলাকা নবগ্রামে। শিশুরঙের বাবা পশু চরাতো আর সন্ধেবেলা হলে
পালাগানে জুটে যেতো। কোথায় যে হারিয়ে গেলো লোকটা। তারপর থেকে ভাতশিকারে গর্ভে রং
নিয়ে আলো এসেছিলো শহরে। রূপসা আবাসনে কত নায়িকা আসতো চলে যেতো।সকালে বাসন মাজতে
গিয়ে পড়ে থাকা যত গা ঘিনঘিনে রাসচিহ্ন সাফ করতো আর বিড়বিড় করে গালিগালাজ করতো।
শিশু রং কে সবাই চিনতো রাখাল নামে। ওকে পিঠে বেঁধে নিয়ে মা
কাজে যেতো। পরে যখন আর পারত না একবাটি চাল ভাজা ছোলা ভাজা দিয়ে দাওয়ায় বেঁধে রেখে
যেতো। কিন্তু রাখাল যে , তাকে কে কবে বাঁধতে পেরেছে! প্রথম আবিস্কার তাকে দিলো
মুক্তি ; লাল নীল হলুদের মাঝে হারাতে হারাতে দে ছুট... ছুট... খোলা মাঠ ছাড়িয়ে
নয়ানজুলির পাড় সবুজে সবুজ। কিরকম যেন মায়ের মতোই খুশির জোয়ার। হুঁশ ফিরতো মায়ের এক
ঝাঁকুনিতে। তারপর হাত পা ধুইয়ে যখন কোলের কাছে বসিয়ে খেতে দিতো , কেমন ঠাকুর ঠাকুর
মনে হত মা’কে। সব শক্তি,উৎসাহ, উচ্ছলতা, যুদ্ধজয় যেন মায়ের লাল লাল আঁচলটায় বাঁধা।
বিলাবল রাগ এখন দিব্যি খেলে বেড়ায় তিতলির গলায়। সুরে সুরে
তিতলির জন্য সে ও তো এক পরিক্রমা। কোথাও শুধু যাওয়া হয়না আলোর। কত আশা ওর সমুদ্র
দেখবে। তাতে নাকি অনেক নোনা জল, বড় বড় ঢেউ ওঠে। আবার হাতের শাঁখা তৈরি হয় যে শাঁখ
থেকে, সেই শাঁখ ও নাকি ওই জলের তলা থেকে ভেসে এসে আটকে থাকে বালির চড়ায়। ঘুমন্ত রাখালের
মুখে হাল্কা গোঁফের রেখা বুঝি আশ্বস্ত করেছিল মা’কে। ‘আগুন...ওঠ বাপ...আগুন
লেগেছে’... ঠেলা খেয়ে রাখাল বাইরে এসে বেঁচে গিয়েছিল সে রাতে কিন্তু দু’ঘর আগিয়ে
একটা ঘুমন্ত শিশুকে বাঁচিয়ে দিয়ে পুড়ে মারা গেলো রাখালের মা।
এয়োস্ত্রীরা শেষবারের মতো মায়ের ঝলসে যাওয়া কপালে মেটেসিঁদুর
পরিয়ে দিয়েছে। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রাখাল ভাবছিল, একলা রোগা চেহারার অতটুকুনি
তো মানুষ,সবার সঙ্গে হেসে খেলে পায়ে পা মিলিয়ে চলার, বিপদের মুখে ঝাঁপিয়ে পড়ার এত
সাহস, মৃত্যুকে থোড়াই কেয়ার করার এত ক্ষমতা মা বুঝি লুকিয়ে রাখতো ওই কমলা টিপের
মধ্যে ! ‘ আমার কিছু হলে বাবুদের কাছে যাস,তেনারা ঠিক একটা তোর উপায় করে দেবে
’ মায়ের একসময় বলে রাখা কথা ও মনে করিয়ে
দিয়ে যাচ্ছে ওই কমলা টিপ, যাবার বেলাতেও নিশ্চুপে তারসপ্তকে।
মধ্য
সূর্যজ্বলা সময়ে বড় স্পষ্ট দেখা যায় সবকিছু । আলো ঠিকরে পড়ে
নতুন আসবাবে। ঘামের উৎকট গন্ধ ও ঢাকতে পারেনা কোনও পারফিউম। মঞ্চে বেবি পড়ছে
রাখালের উপর, সামনে তিতলি। ওর মাজা গলা শুনতে শুনতে বড় হয়েছে রাখাল। ওর কাছেই তাই
প্রথমে এলো। তিতলি মানে প্রজাপতি । জেনেছিল ওর কাছ থেকে আগে। আর আজকে এই বেবির আলো
ওকে আরও সুন্দর একটা উজ্জ্বল হলুদ প্রজাপতি করে তুলছে। ও অনেক বোঝাল রাখালকে নিজের
মানুষদের কাছে ফিরে যেতে। তিতলির কথাই ঠিক মনে হল রাখালের। কারন হলুদ প্রজাপতি
সত্যি কথা বলে, ইংরেজি ইস্কুলে পড়েছে তাই জানেও অনেক কিছু। সেকথা বলেও দিলো
তিতলিকে। শুধু ফিরে যাওয়ার আগে খানিকটা হলুদ রং ভরে নিলো বুকের ভিতর , তিতলি হেসে
ফেললে তার ঢেউ ওঠা টপের দিকে চেয়ে। বাঁ দিক থেকে বাবার প্রবেশ। ধমক প্রদানে তিতলির
প্রস্থান। রাখালকে বিদায় করে তার ও প্রস্থান।
হলুদ প্রজাপতি বুঝি অস্থির করে তোলে নাকের ডগায় ডানা না
ঝাপটালেও। ভিতর থেকে তাড়াতে থাকে রাখালকে কিছু না কিছুর সঙ্গে জুড়ে যাওয়ার জন্য।
প্রকাশ্যে না আশা যত ইচ্ছে মিলেমিশে এক অবয়ব তৈরি করে। যার মুখ দেখা যায় না।
বাগালি করতে গিয়ে দেখলো পলাশ কুড়োচ্ছে এক শ্যামলা রঙের মেয়ে। এ তো সেই মেয়ে
স্বপ্নে যার মুখ দেখা যায় না।রাখাল আর ফিদা হুসেন এ কি তফাৎ ? কিছুটা কালো ,
কিছুটা হলুদ ওকার, স্যফ গ্রীন, সিয়েনা ব্রাউন আর সাদা টেম্পরা চাপিয়েও এ মেয়ের মুখ
আঁকতে গিয়ে বুঝি রাখালের ইচ্ছেরঙের কাছে হারতেন মাধুরী সাহেব।
তেওড়া এক বড়ই তেড়া তাল ৭ মাত্রার। যেমন দাম্পত্য হয় ৭পাকে।
যতই ধ্রুপদী দ্বিগুন চৌগুণে এগোবে। তাল কেটে চৌচির হতে চাইবে। রাখালের সঙ্গে
শ্যামলা মেয়ের সাঙ্ঘা করিয়ে দিয়েছিল ওদের যত ইষ্টিকুটুম মিলে।মহুয়ার নেশার মতো
কাটছিল দিন কিন্তু তাল কেটে গেলো। ট্রাক্টর নিয়ে এসে জমি চষে দিয়ে যায় যে ছেলেটা।
সে এলে গ্রামের মেয়ে বউরা তোয়াজ করে, খাবার দেয়। কিন্তু রাখালের তো জমি নেই , ওর
বউ কেন ছেলেটার শহর থেকে কেনা সবুজ জামার গুন গাইবে? হোক না যত দামের তাতে ওর কী?মার
খেয়ে পরেরদিন চলে গিয়েছিলো বাপের ঘরে রাগ করে ।রাখাল ও ঘরে আসে না। পড়ে থাকে বুঁদ
হয়ে খেতের ধারে নয়তো জারুল গাছটার তলায় এসে । এই ভাল।এই মধ্য যাপন , না ঘর না
বারের মধ্যসপ্তকে।
মন্দ্র
মান, মানান, মানি
এইসব শেষ গন্তব্য। আর্কিমিদিস লজ্জা মানের পরোয়া করলে ইউরেকা হতো না। এ গ্রীষ্মে
হকার ভাইদের উপর খুশি হওয়ার কথা মানি মুখ্যমন্ত্রীর। রাখাল মানানো রহস্য জানতো না।
লং শটে ধান খেত। ভয়েস ওভারে দুজনের হাসি। ট্রাক্টরের মালিক ছেলেটা আর তার ইচ্ছেরঙা
বউ! রাখলের কান অন্ধ! একটু পরেই আকাশে উঠেছিল সোনালী চাঁদ। তিতলির হলুদ ওর কাছেও ,
তবে একটু অন্য রকম।আর ওর কাছে টুকরো কালোমেঘ বুঝি বউটা? নালিশ এ বুঝি পেট ভরে!
বনবাদাড় থেকে খুঁটে ওকে ঘরে নিয়ে যেতে পারে না! ওর অন্ধ চোখ বুঝি ভুলেছে ভাতের
ঘ্রান। মুখ থুবড়ে পরে যাওয়ার পরেও কী আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলো আকাশের দিকে তাকাতে।
আকাশে রয়েছে যে অনেকটা সোনা রং আর তার পুরন না হওয়া যত ইচ্ছের কালো মেঘ।আকাশ বলে
দিচ্ছে যত মনের গভীরের সত্যি কথা। সে ভালবাসে রাখালকে, রাখাল ও ভালবাসে একমাত্র
তার ইচ্ছেরঙা মেয়ে। সমস্ত চেতনার উপর ধূসর অভিমানের পরত সরিয়ে সে তো ফিরেছিল
পলাশের মাসে। রাখাল ঘরে নেই। খুঁজতে খুঁজতে গেলো সেই জারুল গাছের নিচে। আধশোয়া
এলিয়ে আছে গাছের গায়ে হেলান দিয়ে। ওদের মুখের কথা যেন ফুরিয়ে গিয়েছিল। আকাশটাকে
রাখালের বাবার মতো লাগছিল। কৃষ্ণলীলায় নীল রং সারা গায়ে সুন্দর বাঁশী বাজাতো,
অনেকটা নীল কাছে চলে আসছে রাখালের। তৃষ্ণার রং বুঝি নীল , নাকি বুড়ো বাবার মতো
নিঃসীম শান্তির! কমলা হয়ে আসা সূর্যটা মায়ের কমলা টিপের মত। তার থেকে অনেকটা লাল ও
আসছে পাশাপাশি।আর ওই যে পাতাদের সবুজ ছন্দিত দোলনে বলেছিল তাকে ’ সবুজ তো সমৃদ্ধি
, সজীবতার প্রতীক । তুমি কেন তার নাগাল পেলেনা? ’ অনেক সবুজ ও তাই এসেছিল ছুঁয়ে
দিতে। হারাতে লাগলো এদের মাঝে রংরাখাল। ঝরে পড়েছিল বেগুনি কত জারুল ফুল। বিধতার
আশীর্বাদের মতো। সব রং মিশে সাদা চিতার ছাই অকাল বৃষ্টি ধুয়ে করে দিলো কালো।
কাঁদেনি ইচ্ছেরঙা বউ বরং একলা ঘরে পেটের কাপড় নামিয়ে পূর্ণগর্ভের ওপর সাজিয়ে
দিয়েছিল কৃষ্ণচূড়া হলুদ কল্কে আর আম পাতাদের ওম। দিন গুনছে পূর্ণব্রহ্মেরই মতো ,
আবার ধ্বনিত হবে ‘ স্ফোট... স্ফোট... স্ফোটয়...
ওঙ্কারে ওঙ্কারে মন্দ্রসপ্তকে...
খুব ভাল
উত্তরমুছুননমস্কার অনেক ধন্যবাদ অনবদ্য সৃষ্টি এই লেখাটা আমার ভীষণ ভালো লাগলো।
উত্তরমুছুন