''রকবাজ বিষয়ক'' - মায়াজম

Breaking

১৫ মার্চ, ২০১৫

''রকবাজ বিষয়ক''


তখন আমাদের ঢেউ খেলানো বুকে ওড়না চাপানো শিখিয়ে দিতে দিতে মা বলতেন--- সাবধানে যেও পাড়ার মোড়ে রকবাজ ছেলেদের আড্ডা.....
হিপি লম্বাচুল ফর্সা কালো বেটে ছেলেরদল রক থেকে চটুল হিন্দি গানের কলি ছুড়ে দিতো আমাদের দিকে আর আমরা আড়চোখে তাকিয়ে হরিণী পায়ে কেউ ছুটতাম , কোন কোন মেয়ে চোখের সামান্য ইশারায় বন্যা নামিয়ে দিয়ে রকে হেলে-দুলে রাজ্যের ছেলেদের ইতিহাস চর্চা করতে করতে স্কুলে ঢুকতে না ঢুকতে ঘণ্টা বেজে যেত , শীতের সন্ধ্যাবিকালে ফিরবার পথে দেখতাম রকের ছেলেদের চোখ প্রভাতের মত উজ্জ্বল , আর আমরা এসব দেখতে না দেখতে টিউশন মাস্টার আসবার সময় হয়ে যেত ...

**
আমরা তখন রকে বসে খুব সিগারেট খেতাম আর স্কুল যাওয়া মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বন্ধুর ঠোঁটের কাউন্টার টেনে নিতাম নির্দ্বিধায় , তখন ও এখানে সূর্য-প্রতিদ্বন্দ্বী ফ্ল্যাটবাড়ি গজিয়ে ওঠেনি তেমন ! শীতের সকালে বর্তমানে বিলুপ্তি হয়ে যাওয়া কিছু পাখির ডানা ধুলো উড়িয়ে দিত , গোয়ালা দুধের ক্যান হাতে যেই কলিংবেল টিপত আর রবিন বাবুর মেয়ে শ্যামলী দরজা খুলে দিত , তার দিকে সকলের চোখ যেতে না যেতেই চুলের গোছা বাঁপাশে লহমায় সরিয়ে দরজা বন্ধ করে দিত যেই না , আমাদের বুকে পাথর চেপে বসত ! রকের বাঁ- দিকের রাস্তা দিয়ে মিনিট খানেক হাঁটলে লম্বা সারি সারি টালির ঘর , রিকশাওয়ালা রহমত শেখ , পরিতোষ রুইদাস , চঞ্চল মণ্ডল , বাংলাদেশ থেকে আসা বিমল মিস্ত্রী ...... দেশ বিদেশের যতোসব সাধারণ মানুষের ঘর ছিল ওখানে , কারা নাকি বস্তিবাসী বলতেন তাদের ! রকের ডানদিকে উঁচু উঁচু বাড়ি সবে শুরু হচ্ছে তখন । আমরা সারাদিন রকের মাঠে পিংপং খেলা নিয়ে পড়ে থাকতাম , পাড়ায় গার্জেন পুরুষরা বক্রহাসি দিয়ে অফিস টাইমের বাস ধরতে যেতে যেতে মনে মনে বলতেন - ''বেয়াদপের দল ।'' 

তখন আমাদের কোন কাজ ছিল না বলেই কাজ ও আমাদের দিকে টাটা দিতে দিতে দূরের গ্রহের দিকে এগিয়ে ছিল , আমরাও সবভুলে প্রাণখুলে বন্ধুদের বুক থেকে পরাজিত প্রেমের ছাইভস্ম মুছতে থাকতাম দেখে প্রেম ও কোনদিন সেভাবে বাসা বাঁধেনি আমাদের বুকে । মুখে কাচা খিস্তী আর ফিল্মি গানের তালে আমাদের জীবন শাহজাদা সেলিম । সকাল গড়িয়ে বিকাল , বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যে , সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত নেমে আসতে থাকত চোখের দিকে আর হঠাৎ রাস্তায় চিৎকার , রাতেরট্যাক্সি অচেনা এক ভদ্রলোককে চাপা দিয়ে পালিয়েছে , রাস্তা রক্তে ভেসে যাচ্ছে , পাড়ার ইনকাম ট্যাক্স অফিসার কাকু বলছেন - পুলিশে খবর দাও , স্কুল শিক্ষক দত্ত বাবু বলছেন , ছুঁয়োও না পুলিশ কেস এটা , পাল বাবু বলছেন , ট্যাক্সিওয়ালাকে পেলে রামধোলাই দেওয়া যেত .........
বস্তির রিকশাওয়ালা রহমত ভিড় থেকে বেরিয়ে এসে বলেন - '' খোকাবাবুরা দেড়িয়ে দেখচ কি , আমার রিক্সায় তোল , প্রাণ আছে এখনও , এসো এসো ---- '' 
আমরা রক্তাক্ত শরীর নিয়ে রিক্সায় ছুটছি দেখছি হাসপাতালের দিকে ...
আমরা এখন অফিসের দিকে ছুটছি 


সময় চলে যাওয়াটা তেমন বড় কিছু ব্যাপার নয় , সময়কে বেঁধে রাখার চেষ্টার মধ্যেই থাকে সভ্যতার আপ্রাণ ও ঐকান্তিক অভিপ্রায় ! শীতশুরুয়াৎ জলজীয়ন্ত গোধূলিতে আধা-শহুরে রকের সামনে দিয়ে ঠ্যালা-গাড়িতে বিহারী যুবক এগিয়ে চলছে , পাকোরা'র গন্ধ ভাসছে ইলিশের মত হৃদয়ে এখনও । ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়ে ভিড় জমিয়ে দিয়েছে ঠ্যালাগাড়ির সামনে , সেন-বাড়ির ক্লাস নাইনে পড়া ছোটো মেয়ে কিনতে আসবে কি আসবে না ভাবছে , কেনকি রকে বসা প্রতাপের সামনে যেতে লজ্জা , রজঃস্রাব খুলে দিলে সৃষ্টিদ্বার নারীর হৃদয়ের কাছে সতত: এক পুরুষের আনাগোনা , কিন্তু তখন নারীর চোখের সামনে পুরুষের লজ্জিত জগত । 

ষ্ট্রীটলাইটের দিকে সূর্য দিয়ে যায় বকলম সূর্যঅধিকার , আর হ্যারিকেনের দিকে সূর্য রেখে আসে আগামীর প্রত্যয় ! স্মৃতি তো ট্রয় নগরীর বাইরে ফেলে রাখা সেই কাঠের ঘোড়া , দ্রষ্টব্য মনে করে ঢুকিয়ে নিলেই দুর্গে , ঘোড়া থেকে বেরিয়ে এসে স্মৃতিসৈনিক ভেঙে ফেলো অপরাজেয় দুর্গ-প্রাসাদ । স্মৃতিতেই মানুষ সর্বাধিক সময় বেঁচে থাকে , জীবন তো স্মৃতিকে বেঁচে খায় আর স্মৃতির দিকেই জেগে থাকে বর্তমান । 

হারিয়ে যেতে বসা সেই রকে তখন বন্ধুদের মত আমরাগুলো বসে থাকতাম , আর স্কুল - কলেজ যাওয়া আমরাগুলো ভাবতাম কখন রক বিছিয়ে দেবে নদীর মত শরীর , আমরা রক-অবগাহনে প্রশান্তি লিখে রাখব সময়ের গায়ে । এই তো এসেছে হারিয়ে যাওয়া বিস্মৃতির অপরূপ রিদম , দিকচক্রবালে পেয়েছি তার সুদীর্ঘ সংকেত সমাহার । ভেসে যেতে পারে যে নদী সেই নদীই জানে ভাসানের জলে থাকে ক -কোটি গ্যালন চোখের জল , চোখের জল মননের শান্তিশীতল ।
##

ফার্টিলাইজার বাস্তবায়নে গোত খেয়ে পড়া পাখিটার নাম রক ! টায়ার হর্ন কালো ধোঁয়া ও গিজগিজ পায়ের দিকে নগরায়নের উজ্জ্বল পতাকা পতপত উড়িতেছে দেখিয়া বিষম খাওয়া হুঁকো-খুড়ো ভাবিতেছে কোথায় তাহার দ্যাশ ! দেশে ভাঙিয়া দেশের মধ্যে নতুন দেশ গড়িয়া উঠিতেছে , অযথা রকের গল্প গিলে নিচ্ছে বহুজাতির কলসেন্টার , আর আমরা ভাবছি আরও কতখানি এগিয়ে গেলাম বটেক সভ্যতার দিকে ! হারিয়ে যাওয়া সকল অনুভূতি গুলো যেন কোনকালেই আমাদের ছিল না , কোনকালেই যেন রক ছিল না , ফাঁকা মাঠ ছিল না , ছিল না নির্ভেজাল আড্ডা । সবকিছুই তবে বিক্রি হয়ে গেল তথাকথিত সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যের কাছে ? ফিরে কি আর আসবে কোনদিন আমাদের ''রজবাজ'' মুহূর্তরা । 

এবার হারিয়ে যাওয়া চৈতন্য নিয়েই মায়াজম ব্লগজিনের দ্বিতীয় সংখ্যা সাজানো হয়েছে ''রকবিষয়ক '' হৃদ দিয়ে , তাহলে এখনও পর্যন্ত যারা মনঃস্থির করে উঠতে পারেন নি তারা লিখে ফেলুন , এবারের সংখ্যায় মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার হাজির করছি আমরা , এছাড়া থাকছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ এর দুর্দান্ত রক বিষয়ক একটা লেখা , থাকছে ইন্দ্রজিত মাঝি র মন রাঙানো অনুভব থাকছে শৌনক দত্ত এর অসাধারণ একটা ছোট গল্প এছাড়া থাকছে জয়া চৌধুরী র রক নিয়ে বিশেষ আলোচনা মূলক রচনা , সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায় এর বিশেষ রচনা থাকছে , সঙ্গে থাকছে এই প্রজন্মের আরও আরও অনেক লেখা , আপনারা যারা লেখা দিতে ইচ্ছুক তারা দেরি না করে দিয়ে দিন লেখা , শুধু দুটো ব্যাপার একটু লক্ষ্য রাখবেন ।
## 

আমরা কী কিছু হারিয়ে ফেলছি ? পকেট ভর্তি ১০ পয়সা ২০ পয়সা ...... ৫০ পয়সার কয়েন হারিয়ে এসেছি , হারিয়ে যাওয়ার বুকের ওপর গড়ে ওঠে নতুন অস্তিত্ব , আসলে অস্তিত্ব বীজের রূপক মাত্র , অস্তিত্ব ততোক্ষণ সঙ্গ দেয় যতক্ষণ নতুন কোন সম্ভাবনাময় অস্তিত্ব ঘাড়ে চেপে না বসে ! কলতলা হতে দাঁড়কাক হারিয়ে গেছে আর টি ভি শিশুকে শিখিয়ে দিচ্ছে 'রিও' , শিশু বাবাকে দেখিয়ে দিচ্ছে স্মার্টফোন আর বাবা দেখিয়ে দিচ্ছেন নিবিড় আকাশ ! অনুভব এইটুকু পথ চলে যতটুকু পথে স্বার্থের সংঘাত নেই , অনুভব তো সেই মুখ-কাটা কচি ডাব , জল - শাঁস খেয়ে ছুড়ে দেয় দূরে , আর কোন কুড়ানি সন্তান ফাঁকা ডাব ঘরে নিয়ে আসে , শুকিয়ে আঁচ জ্বালায় । ফেলে দিতে গেলে বর্তমান মুহূর্ত ছাড়া কেজো কোন অনুভবই বাস্তবিক নেই , যারা ভাবের ঘরে বাঁচেন , যারা ভাবতে ভাবতে জীবন কাটান তারা দেখেন সারাটা জীবন অন্যকে ইমপ্রেস করানোর জন্য চলে গেল , নিজের জন্য কিছুই করা হল না । এই অনুশোচনার দায় নিতে চাইছে না যখন কেউ তখন ''মায়াজম ব্লগজিন'' আপনাদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলছে , - আমি তো আছি , আমাকে দিয়ে যাও অনুভবের সঞ্চিত আকর ! মানুষের হৃদয় থেকে হারিয়ে যাওয়া এমন কিছু সময়ের উপাদানের মধ্যে অন্যতম হল ''রক'' , বাজাজ স্কুটারের মত হারিয়ে যেতে বসেছে সময় থেকে , আমরা চাইছি হারিয়ে যাওয়ার আগে হারিয়ে যেতে দেবো না , কেনকি কিছু মুহূর্তরা যে ওখানে স্বর্ণ ঝরিয়ে রেখেছিল , তিতলির বিয়ের রাতে সানাই সম্রাট খান বিসমিল্লা চুপি চুপি রকে এসে বসেছিল আর কানে কানে বলেছিল সেই ছেলেটিকে , সানাই বাজবার জন্যই এসেছে পৃথিবীতে , আজ তিতলির বাড়ি কালকে অন্যকোন খানে ।

প্রসঙ্গকে আর টেনে নিয়ে যেতে চাইছি না , এবারের মায়াজম এর ''রকবাজ'' সংখ্যায় সত্যি যারা রকবাজি করতে আসছেন তাদের সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্যই শিবের গীত গাইতে হল , আর অপেক্ষা নয় , তাদের নাম গুলোর এবার জানিয়ে দেওয়ার পালা .........

#

টারবাইনের বেগে ছুটে যাচ্ছে একরোখা সময় , আমরা এ- ওর দিকে ছুড়ে দিচ্ছি এক -একটা থিম মুহূর্ত । চক্ষুপলে লেগে থাকছে ইতিহাস সমৃদ্ধ জলজ অভিযোজন । স্রোতের প্রতিকূলে যারা সাঁতার কেটে এগিয়ে যেতে পারেন তারা অনুভবের মাইলস্টোন ফলকে লিখে রাখে মিলাঙ্কলি স্লোগান । আত্মভ্রমণের একাত্মতা , নৈমিত্তিক বিষণ্ণতা আবার কোন পরিযায়ী সুখপাখি নাম নিয়ে উড়ে যায় ... উড়ে যায় জীবনের জলসাঘরে ! 

'রক' শব্দটা ব্যক্তিগত দেরাজে ন্যাপথলিন গুলির মত পোশাকের শরীরে লটকে থাকে বছর - বছর । আর আমরা অহরহ পিঠে রুকসাক চাপিয়ে পাহাড় জঙ্গলের রকবাজিতে মেতে উঠি না না উঠি সেই অবকাশে সত্যিকারের রক হারিয়ে যাচ্ছে রঙ্গমঞ্চ থেকে । 

ফেলে আসা পল'কে স্মৃতি নাম দিয়ে মুছে ফেলতে পারিনা বলেই সময় নামক ঘোড়ার যথার্থ জকি হয়েও পেরিয়ে যেতে পেরেছি কি স্মৃতিনদী ? এইসময়ে ছেলের ভবিষ্যৎ, স্বামীর প্রোমোশন, স্ত্রী বায়না, ইনকাম ট্যাক্স ফাইল, পৌরসভা ভোট, কর্পোরেশন জলের লাইন আমাদের গ্রহ থেকে অন্যগ্রহে পাঠিয়ে দিচ্ছে মানে এই নয় রক এর হাঁস হাঁসফাঁস করে না কখনও বুকের খাঁচায় ! 

মুহূর্ত গুলোকে ধরে রাখতে হয় হৃদয়ের অনুভবে , মুহূর্তরা যে সোনা ফলিয়ে গেছে মনের বন্দরে তাকে ভোলা কি এতই সহজ ! কি করে ভুলে যাবো পাড়ার রকের সামনে ঝালমুড়ি খেতাম যখন তখন ছেলেরা আমার ঠোঁটের ঝালে সিসিয়ে উঠত , আর লালা দিয়ে ধুলো ভিজিয়ে দিত বলে এখনও পুরনো ডাইরির ভাঁজে রাহুলের দেওয়া গোলাপ অন্ধকারে গন্ধ ছড়িয়ে রাখে , বন্ধুরা ঠিকই ধরেছেন , এবার আসছি মায়াজম এ রকবাজি করতে আগামী ১৫ এ এপ্রিল , যারা আমাদের সঙ্গে রকবাজি করছেন তাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পালা ............

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র