আগাম কিছু কথা --
শিমুল মাহমুদ প্রথমত একজন মানুষ; দ্বিতীয়ত তিনি একজন লেখক । জন্ম নিয়েছেন বাংলাদেশে, ১৯৬৭ সালের ৩ মে। বাংলাদশের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে পাঠ গ্রহণ শেষে তিনি পৌরাণিক বিষয়াদির ওপর গবেষণা করে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। কবিতার সাথে তাঁর সখ্য স্বৈরশাসনের দুঃসহকাল গত শতাব্দীর আশির দশক থেকে। সমান্তরালে কথাসাহিত্যে রেখেছেন নির্মোহ ছাপ; সেইসাথে সক্ষম হয়েছেন নিজেকে একজন সিদ্ধহস্ত সমালোচক হিশেবে প্রতিষ্ঠিত করতে।
বর্তমানে তিনি রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক। দীর্ঘদিন ধরে সম্পাদনা করেছেন সাহিত্যের কাগজ ‘কারুজ’। ইতোমধ্যে তিনি ‘কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা পুরস্কার ২০০০’, ‘বগুড়া লেখকচক্র কথাসাহিত্য পুরস্কার ২০১২’ এবং পশ্চিমবঙ্গের ‘অচেনা যাত্রী ও দ্বৈপায়ন ১৪২২’ কর্তৃক সম্মাননা প্রাপ্ত হয়েছেন।
এবার-ই প্রথমবার ‘মায়াজম ব্লগজিন’ এর জন্য তাঁর অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি ‘বস্তুজৈবনিক’ আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন; আমরা আন্তরিক অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা জানাই কবিকে । বাংলা নিয়মতান্ত্রিক কবিতা-ঘরানা ছেড়ে পাঠক পেতে চলেছেন এক ‘ভিন্ন-প্রকাশ-রূপ’—এ এক্থাটা কাব্যগ্রন্থ আজ এই কথা জোর গলায় বলা যেতেই পারে। বৃহৎ কবিতার পাণ্ডুলিপি একবারে প্রকাশ করা ব্লগজিনে সম্ভব নয় বলেই আমরা তিনতে খণ্ডে ধারাবাহিক প্রকাশ করতে চলেছি শিমুল মাহমুদের ‘বস্তুজৈবনিক’--- আমাদের বিশ্বাস, পাঠকদের আমরা হতাশ করবো না; আপনাদের ভাল লাগবে ।
প্রসঙ্গক্রমে বলি, পাণ্ডুলিপি যেমন ভাবে সাজানো ছিল আমরা তার থেকে বেরিয়ে একটু অন্যরকম ভাবে উপস্থাপিত করতে চাইছি। আপনাদের তন্নিষ্ঠ পাঠ-সহযোগিতা কাম্য ।
বস্তুজৈবনিক
১
আমিও বলতে চেয়েছি সরল চোখে
আর সরলতাই যদি হয় প্রকৃত আরাধনা
তা হলে এ কথাই ঠিক
শয়তান শয়তান
শয়তানের অতিরিক্ত কিছু
দেখি না আমি
আমার ভেতর।
অবলা গর্দভের মতো শিখেছি অভিনয়
ভেতরে লোভের বলক।
বুক খুলে দাঁড়িয়েছি নারীর পায়ে।
আয়েশা
তসবিহ সরিয়ে রাখো
দৃষ্টি ফেরাও
ভিজে যাচ্ছি আমি
তোমার পুত্র
ভিজে যাচ্ছি প্রতিদিন
প্রাত্যহিক ঝড়ে।
ফিরে গেছে পিতা
নৌকা ভাসানের গান
কণ্ঠে নিয়ে।
ফিরে গেছেন তিনি
লজ্জাবতী গাঁয়ের দিকে
ফিরে গেছেন
নারীর দিকে
যে নারী কলস কাঁখে হেঁটে যেতো
ঘাসের ওপর
পায়ের আদর রেখে
সেই নারী, ফুটে আছে
সন্ধ্যার কুয়াশার গায়ে।
বৃক্ষের শাখায় পাখি
পাখিপরিবার
পাখিবউ
উড়াল উড়াল ভয়
সুখভর্তি বাসনাসহ
উড়াল দাও
সাম্পানের মাঝি।
পায়ের পাতার নীচে
পিষে যাচ্ছে নীরবতার গান।
ফিরে এসেছো
অকস্মাৎ
ডানামেলা ভয়
অনন্ত অনন্তকাল
পড়ে আছি মাঠের কিনারে
অচল তাবিজ।
ফিরে গিয়েছিলে লজ্জাবতী গাঁয়ে
রাখালের বাঁশির ইশারায়
ঘুঙুর-বিকেল।
সম্ভ্রম হারিয়েছিল যে নারী
সন্ধ্যেবেলা
নীরব উলঙ্গ মাঠে
সেই নারী, কোথায় থাকেন?
জানে না বদরগঞ্জ
অথবা
হাট থেকে ফিরে আসা পিতা
শুধু শোনা যায়
শীতের পোশাকের ভেতর
লবণাক্ত-মহামারি জেগে আছে।
মহামারির তীব্রতা নিয়ে
বদরগঞ্জের মাটিতে
হেঁটে যাচ্ছে লোভ।
এই ভাবে অনন্ত অনন্ত
তারপর কাহ্নপার গান
লালনের কণ্ঠে
ছেউড়িয়ার আকাশ
সঙ্গীতমুগ্ধ নদী
মন্ত্রস্নানে ফিরেছি আবার
কাকভোর
পাখিদের শিস-কোলাহল
ধ্যানমগ্ন পাখিদের মৌনতা পাশ কাটিয়ে
জেগে উঠেছে
পরিত্রাণবিহীন
কামযৌনতা।
আমিও সন্ধানে আছি
যে কোন নারী,
কামনার একাগ্রতায় ছিড়ে ফেলেছি
ব্যাকরণ-বিশুদ্ধ ফুল।
বদরগঞ্জবাসী রাখছে না সংবাদ
যৌনতার তাড়নায়
প্রতিদিন হারিয়ে ফেলছি আমি
স্বাভাবিক স্বভাব।
প্রার্থনায় নত, তসবি হাতে
সফেদ দাড়ি থেকে চুইয়ে নামছে
ওজুর পানি।
বাবা আজ বেঁচে নেই, এগারো বছর
বিধবা বোনের হাতে
প্রতিদিন চিনে নেই
বদরগঞ্জের মাঠ
মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে
মহাবিদ্যালয়
যেখানে শেখানো হতো
পাখিদের নামতা
মহাশূন্যতার সবুজ ধারাপাত।
বিষণ্ন মাতা, ছুঁয়ে দিয়ে আমার
চিবুক
তুমিই ধর্মের বাতি
পাঠ করো, ধর্মের ছেপারা
তিন পুরুষ ধরে
এই ঘরে কেউ
জ্বালায়নি আগুন
রসুলের দোহাই
দিলের ভেতরে রাখো
বেহেস্তি খোয়াব
কষ্ট ও সুখের সীমাহীন আদর
গর্ভের ভেতর থেকে টেনে তোলো
জন্মের ঋণ
জ্বালাও বংশের বাতি
নারীবিনা গতন্তর নেই
ইহাই নিয়ম।
নারীর ভেতর থেকে জেগে উঠে
বংশ রক্ষার পুরুষ
ফিরে যাচ্ছে নারীর দিকে।
কামে ও যৌনতায়
যৌনপরম্পরায় ফিরে যাচ্ছি আমি
বদরগঞ্জ বরাবর।
শিরা ও ধমনীতে চমকে উঠছে সময়
প্রত্নজল
সময়ের হিজাব।
রাতের নামাজ শেষে
ভেসে উঠলাম আবার
নায়রী মায়াবী মাছ
সোনাঝরা সোনালি দুপুর
জলস্রোত
তোমার দিকেই যাত্রা চিরকাল
অনির্বাণ
জন্ম জন্মান্তর
নারীর আঁচল
মায়াবী হরিণ
বকুল ফুলের ঘ্রাণ নিয়ে
জেগে উঠেছি আমি
জরায়ুশিরায়।
পিতাহীন
অপ-পরিচয়ের ভেতর
কেঁদেছিল যে শিশু
ফিরে গেছে সে
বদরগঞ্জ হয়ে তিস্তার দিকে
জন্ম জন্মান্তর
তীব্র যৌনতার হাঁস ডাকছে
রক্তে।
শিরা ও ধমনীতে আকাঙ্ক্ষা
সাধ ও সাধনা
সেও তো নারী!
তীর্থজলে ভাসছে মানবসংহিতা
কাদামাটিজল
আকাঙ্ক্ষার বীজ।
শূন্যতায় ভেসে উঠেছে
হাসানের হাহাকার
গিরিগুহা করজোড়ে নত।
দোজখের আগুন থেকে বাঁচাতে আমাকে
মেঘেরা ছড়িয়েছে ডানা। অবশেষে
নেমে এসেছিল নারী
অঞ্জলীভরাট কাম নিয়ে দেহে
ষড়যন্ত্রের দৈহিক বাহক।
কেন এত বাধা ও বন্ধন! মায়া ও রক্তের তীব্রতা!
২
কেন এত ক্ষত, চাঁদের গায়ে?
কোন রঙে মুছে দেব প্রাত্যহিক লজ্জা?
ফিরে এসেছি আবার, রঙতুলি হাতে।
শূন্য আকাশের গায়ে চাঁদ আঁকছি
ভরাট গোলাকার টলটলে আলোকোজ্জ্বল চাঁদ।
কোথাও জোছনা-ইশারা
হাঁটু ভেঙে বসে আসে একজোড়া তালগাছ।
আমোস টুটুওলা-র তাড়িখোরের মতো
জন্ম-অন্ধ
তাল গাছের পায়ের পাতায় বসে আছি
স্বপ্নঘোর রাত।
শীতসজ্জায় বন্ধক রেখেছি শরীর।
শুকনো ডানা নিয়ে ফিরে গেছে কানা বক।
রাতের অন্ধকার অগ্রাহ্য করে
এগিয়ে আসছে রাজা কনডম
এগিয়ে আসছে মেলোড্রামা। টক শো-র টেবিল।
মৃত্যুহার পিছে ফেলে এগিয়ে চলেছে জন্মহার
আমাদের গড়-আয়ু।
ফিরে যাই রঙতুলি হাতে
সাক্ষী রেখেছি তালবৃক্ষ
তালবৃক্ষ উগলে দিলে বমন
চেটে তুলি মানুষের আয়ু
ঘামগন্ধী রস।
মাটির থালায় হাঁসমাংস
কালাইয়ের রুটি দাঁতে ছিড়ে পরখ করছি
লোভ ও লালা।
ফিরতে চেয়েছি নীতি ও নৈতিকতার কাছে
ব্ল্যাক-কালার র্যাব, সেনাবাহিনী, আদালত, পুলিশ
সবার কাছে বেঁচে দিয়ে মাথা
ফিরতে চেয়েছি কাদাখোঁচা পাখির মতো মাটির কাছে।
কাফকার মতো সন্দেহ-জ্বরে ডুব দিয়ে
ইবলিস-হ্রদের গভীর থেকে ছেঁকে তুলেছি নিজেকে
ক্রমশ চাঁদের দিকে
ঊর্ধ্বমুখি আকাশ।
অনেক উঁচুতে
শূন্যতায় সুতো বেঁধে
ঝুলিয়ে দিয়েছি এক ফালি চাঁদ।
জাদুকরী চাঁদ
তোমার দিকে যেতে যেতে
পৌঁছে গিয়েছি আমি
বন-মানুষের মেলায়।
বেদেনীদের নৌকায় সাজানো সাপের বাক্স
সাপের বাক্সে যৌথ-সমাজ।
তাবিজে বেঁধেছি আয়ু
বাঁচবার তাড়না
প্রেমিকার স্তনের ডগায়
তিরতির কাঁপছে বাঁচবার আকাঙ্ক্ষা।
পৃথিবীর এই পাড়ে সূর্য উঠেছে
ওই পাড়ে রাত।
গত রাতে পুড়ে যাওয়া লাশ
পাখিরা গান গাইছে
ভুলিনি শশ্মান-সঙ্গীত
পৃথিবীর ওই পাড়ে রাত
কেউ কেউ সঙ্গম শেষে ঘুমের ভেতর হাসছে
এই পাড়ে দিনের আলো
গমশিস মাথা ঠেলে দিচ্ছে আরও উঁচুতে
অপেক্ষায় থাকো, রিপোর্ট আসেনি
কীভাবে বলবো মৃত্যুর কারণ?
আগুনে পুড়ছে ক্রোধ
হত্যা ও প্রতিশোধ
আর এভাবেই জন্ম হয়েছিল মানুষের
নারী ও পুরুষ।
পুষে রেখেছি দেহে যৌনতার বিষ
ঘৃণাহীন দেহ
আদর ও বেদনা
অবাক সার্কাস
মানুষের ব্যক্তিগত মায়া।
মাঠে মাঠে ফসল
ফসলেরা শিখে নিচ্ছে
যৌথের বর্ণমালা।
পাখি শাবকেরা উড়ছে
আর গান গাইছে। দেশগান।
এই ভাবে দেশগান গাইতে গাইতে
পাখিরা বুঝতে পারে না
দেশপ্রেমিক মানুষেরা কীভাবে
পাখির পালকের নীচে
লুকিয়ে থাকা চর্বি থেকে
চুষে তোলে তাপ।
এই পাড়ে সূর্য ডুবছে
শশ্মানে পোড়ানো হচ্ছে পাখিদের লাশ
আর তখন, ওই পাড়ে সূর্য উঠছিল
কয়েক জন যুবতী নামছিল নদীতে
ওদের শরীর থেকে ছড়িয়ে পড়ছিল
গত রাতের সঙ্গমকালীন ঘ্রাণ।
সমুদ্রজলে ফেলে দিয়ে
কোটি বছরের ধর্মের তাবিজ
উঠে দাঁড়িয়েছি কঠিন শিলায়
কাছে ডাকছে না কেউ
ভয়ার্ত চোখে বলছিল ওরা
তোমার পরিচয় কোথায়?
মঙ্গলয়েড দেহ
বিষণ্ন কঙ্কাল
প্রবীণ মেঘ
বৃক্ষের বল্কল
আমাকে হত্যা করেছিল যে নারী
আবার জেগেছে সে
আমারই সাথে পাললিক শিলায়
শুয়ে আছে দুগ্ধবতী নারী
জাদুকরী নারী
মাঠে মাঠে ফসল ফলাও
বিলের বুকে ভাসছে
ঝাঁক ঝাঁক হাঁস
গৃহপালিত পালক
পাখির পালকে ভাসিয়েছ জাদু।
অনার্য নগরের নগরযুদ্ধে
আমাকে হত্যা করেছিল যে নারী
আবার পেয়েছি তাকে
প্রাইম ব্যাংকের পেমেন্ট কাউন্টারে
বসে আছে সে।
পাখির পালকে উড়িয়েছি চুম্বন
ভালবাসার অব্যর্থ বিষ
কী আছে অবশিষ্ট
নিয়ে যাও ক্রেডিট কার্ড
স্পর্শকাতর পলিসি। স্মার্ট নাগরিক।
উড়িয়েছি প্রগতির পতাকা।
দাঁড়িয়ে রয়েছি বন্ধকী মাটির ওপর।
সুচতুর বণিক
কতখানি রেখেছ মগজে
আমার কণ্ঠ?
বুদ্ধিমতি নারী
তোমাকে স্বাধীনতা দিলাম
আমাকেই দিতে হয় অধিকার
আমি পুরুষ
সমাজের বিবেক
ধর্মের বাহন
কবিতার মন্ত্র
তোমার হৃদয়
বেদনার বিষ।
দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর ধীরগতি ট্রেনের মতো
লম্বা হয়ে ওঠে শিক্ষাবর্ষ
ভারবাহী গর্ভবেদনা!
তাকে ভালো না বাসলে সুস্থ থাকি না আমি
পাশাপাশি থাকো
প্রাত্যহিক ঘৃণা
অনিবার্য নিয়তি
ক্ষমতার পূজারি
জনকণ্ঠের বিবেক বেঁচে দিচ্ছে
বাঁশি হাতে জোছনা কুড়ানো বণিক।
সুদর্শন জলে গা ধুয়ে নিচ্ছে
নিটোল রোদের মেয়ে
আরও ঘন হয়ে এসো
মানবজীবন
রঙ ঢালো
মাটির উঠোনে জলরঙ
যৌবনকথা।
গান গায় রাতের বাতাস
বিনুদের বাগানে ধীর বিরতিতে ডাকছে
গোলচোখ-লক্ষ্মীপেঁচা।
নদীর জলে মিশে আছে
পিতামহের শরীরের স্বেদ
বেঁচে দেই ভূমি। পবিত্র মাটি।
নদীর জলে দুলে ওঠে অলৌকিক আলো
দোল খায় মর্মরধ্বনি।
জল থেকে ভেসে আসছে পিতামহের কণ্ঠ
ভূমির ওপর প্রবাহিত বাতাস
হাওয়া
প্রপিতামহের প্রথম ফুৎকার
ফুসফুসের দম
অন্তিম শ্বাস।
মাঠে মাঠে মিষ্টি বাতাস
ফসলের রেণুতে জমে আছে
বিন্দু বিন্দু মধু
মধুসন্ধানী মানুষ
পবিত্র মাটি
আমিই মাটি
আমি নই মাটির মালিক।
মাটির শিরায় বয়ে যাচ্ছে সন্তানের রক্ত
বেঁধেছি জীবন
মাটিতে ও রক্তে
সন্তানে ও ভ্রাতায়
ভগ্নিতে ও কন্যায়।
গরু ও মোষের অহঙ্কারী খামার
বুনো ঘোড়ার অভিমান। মানুষের ঘামগন্ধ।
পশ্চিমের চূড়া থেকে নেমে আসছে ঈগল-ডানা
শিকার অনুসন্ধানী উড়ন্ত নভোযান।
হিমালয়ের চূড়া থেকে নেমে আসছে শিশির
মায়াবতী বায়ু।
সময়ের কোল থেকে উড়ে আসছে
নবজাতকের চিৎকার
মায়ের হৃদকণ্ঠ
যত্ন নাও
মা ও মাটির
সন্তান ও নদীর
ভূমির আত্মা থেকে তুলে এনেছি শিশু
লাল, সাদা, কালো ও পিতাভ।
বস্তু ও জীবনের যৌথযাপনের নাম দীর্ঘকবিতা
ওয়ার্ডস্ওয়ার্থ
যেভাবে ভাবতেন, পোয়েট্রি ইজ দ্য স্পনটেনিয়াস ওভারফ্লো অব পাওয়ারফুল ফিলিংস; —এ ভাবনা
দীর্ঘকবিতার জন্য যথেষ্ট নয়। ভাবনাটি অবশ্যই লিরিকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
দীর্ঘকবিতা এই পাওয়ারফুল ফিলিংসের ভেতর রিয়েলিটি দাবি করে। সে-সাথে দাবি করে
বিস্তীর্ণ জীবনবাদী ক্যানভাস; যা থাকে
উপন্যাসের ভেতর। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, দীর্ঘকবিতায়
উপন্যাসের প্লট ও আখ্যান থাকবে। উপন্যাস দীর্ঘ আখ্যানের আলোকে যে জীবনজিজ্ঞাসার
জন্ম দেয় দীর্ঘকবিতা আখ্যানহীনতার আলোকে সেই জীবনজিজ্ঞাসাকে উন্মোচন করতে সক্ষম।
বিষয়টিকে খোলসা করতে উপন্যাস এবং
দীর্ঘকবিতার পাঠ নেয়া যেতে পারে।
জাঁ পল সার্ত-এর
উপন্যাস ‘রোডস্ টু ফ্রিডম’- এর ক্যানভাস সুবিস্তৃত। উপন্যাসটির প্রথম খণ্ড ‘দ্য এজ
অব রিজন’। যেখানে জীবন, মনন এবং ব্যক্তি
সব মিলে এক প্রচণ্ড শক্তি। সংক্ষিপ্ত তথা তাৎক্ষণিক যন্ত্রণা থেকে শুরু করে
মহাকালের যন্ত্রণা, সব কিছুর মূলে রয়েছে ব্যক্তি মানুষ। এই মানুষ সব কিছুর নিয়ন্তা। তার
কোনও পূর্বপরিকল্পনাকারী নেই। অর্থাৎ উপন্যাসপাঠে পাওয়া যাচ্ছে, মানুষ নিজেই
নিজেকে তৈরি করে। নিজের সংকটে তার একমাত্র রক্ষাকারী একমাত্র আশ্রয়স্থল মানুষ
নিজে। অথচ এর জন্য প্রয়োজন তার সত্তার স্বাধীনতা।
উপন্যাসের নায়ক
ম্যাথু দেলারু। দর্শনের অধ্যাপক। পরিচিত জগৎ, বন্ধু-বান্ধব, ব্যক্তিগত
সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা, বেদনা-যন্ত্রণা, নাইট-ক্লাব, আর্ট-গ্যালারি, ছাত্র, ক্যাফে সোসাইটি
সব কিছুর যোগফল সে নিজে এবং তার ব্যক্তিগত উদ্বেগ-ভয়। কেন-না সে সমাজ কর্তৃক
শৃঙ্খলিত। মার্সেলকে সে ভালোবাসে। মার্সেল অন্তঃসত্তা। সুতরাং সে মার্সেলকে বিয়ে
করতে বাধ্য। কিন্তু এই বাধ্যবাধকতায় ক্ষুণ্ন হচ্ছে তার স্বাধীনতা।
মার্সেলকে সে ভালোবাসে। সে তাকে প্রতারণা করতে চায় না। তারা একত্রে জীবন যাপন করছে
অথচ বিয়ে নামক একটা সামাজিক আচার তাদের এই অবাধ ভালোবাসাকে কলুষিত করছে। করছে তাদের
আত্মার স্বাধীনতাকে হরণ। তাহলে স্বাধীনতার অর্থ কী? মাই লাইফ হ্যাজ
ড্রেইনড ইট ড্রাই এবং মানুষ প্রকৃত প্রস্তাবে কিছুই নয়। সে যা, সে আসলে তা-ই।
ম্যাথুর ব্যক্তিজীবনের এমনি সংকটময় অভিজ্ঞতার অন্তরালে এগিয়ে আসতে থাকে মহাযুদ্ধ।
আতঙ্কে গর্ভবতী দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ।
উপন্যাসের
দ্বিতীয় খণ্ড ‘দ্য রিপ্রাইভ’। সমস্ত ইয়োরোপ
অধীর আগ্রহে মিউনিখ কনফারেন্সের ফলাফল জানতে অপেক্ষারত। অসংখ্য ঘটনা ও চরিত্র তথা
সামাজিক সংকটকে সাথে নিয়ে উপন্যাস এগিয়ে চলে। ঘটনার পর ঘটনা। ঘটনার ওপরে
সুপার-ইম্পোজ ঘটনা। যুদ্ধ চাই। যুদ্ধ চাই না। বসে থাকে না মানুষের কাম। ম্যাথুর
বৌদি ম্যাথুকে কামনা করে। অথচ ম্যাথুকে যুদ্ধে যেতে হচ্ছে। ব্যক্তিক স্বাধীনতার
পাশাপাশি নাগরিক স্বাধীনতা বিপর্যস্ত। প্রকৃত প্রস্তাবে দেশপ্রেমের জন্যই কি যুদ্ধ? মানুষ কেন যুদ্ধ
করে? কেনই বা সে মৃত্যুবরণ করে? যুদ্ধ, দেশপ্রেম, মূল্যবোধ
সবকিছুই সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অর্থে বেশ অর্থময় গুরুত্বপূর্ণ নীতিকথা কিন্তু সব
কিছুর ঊর্ধ্বে যে প্রশ্নটি উঠে আসে তা হল, ব্যক্তিক জীবন
বিপন্ন। নিজের জীবন বিপন্ন। অতএব শান্তি চাই। যে কোনও কিছুর বিনিময়ে শান্তি। অথচ
ব্যক্তিগত সম্পর্কে ফাটল ধরেছে। যে জার্মানদের ছিল নত শির আজ তারা উচ্চশির।
ফ্রান্সের মর্যাদা, সম্ভ্রম; আসলে ওসব কিছু নয়; শুধুই যুদ্ধের
করাল ছায়া। আতঙ্ক। পরাজয়ের আতঙ্ক। ইতিহাসে যাই ঘটুক না কেন, কারো কিছু আসে
যায় না। কেন-না ব্যক্তি বিপন্ন। অর্থাৎ যে মুহূর্তে সংকট এসে হুমড়ি খেয়ে পড়তে চায়
জীবনের ঘাড়ে, তখন একমাত্র মৌলিক জিজ্ঞাসা, অস্তিত্ব বজায়
রাখার সংগ্রাম।
তৃতীয় খণ্ড ‘আয়রন দ্য সোউল’-এ পরাজিত ফ্রান্স।
এই পরাজয় ম্যাথুকে শিখিয়েছে কী করে মানুষকে হত্যা করতে হয়। কীভাবে ঘৃণা করতে হয়।
বস্তুত ব্যক্তির ক্ষেত্রে যে সত্য সমাদৃত তা দেশের ক্ষেত্রেও প্রতিভাত। এমনকি
ইতিহাসের ক্ষেত্রেও। শুধু প্রতিভাত নয় অস্তিত্বগত স্বাধীনতার প্রশ্নে; ব্যক্তিক
স্বাধীনতার প্রশ্নে।
উপন্যাসে দেখা যায় একজন চিত্রশিল্পী, যে কিনা যুদ্ধকালীন সময়ে কর্ণেল। কিন্তু এখন জীবিকাযুদ্ধে
পর্যুদস্ত। তাহলে কি যুদ্ধকালীন সময়ই শ্রেয়? কেউ কাউকে সাহায্য করে না; নেশন অর সিটিজেন, ইটস দ্য সেইম থিঙ্ক; এভরি ম্যান ফর হিমসেলফ; অথচ যুদ্ধের দায়িত্ব কারও একার নয়। ইতিহাসের দায়ভার
ব্যক্তির একার নয়। পরাজয় এবং মৃত্যু অনিবার্য জেনেও ম্যাথু যুদ্ধ করল। হত্যা করল।
এবং জীবনের শুরু থেকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নিজের ইচ্ছার স্বাধীনতাকে বলি দিয়ে
চলেছে সে। এই হচ্ছে একটা মানব জীবন; যা আমাদেরকে ভয়ানকভাবে ভাবাতে থাকে। হাজারও প্রশ্নের
মুখোমুখিতে দাঁড় করিয়ে দেয়। আমরা ভাবতে থাকি এবং শিহরিত হই। শিহরিত হই জীবনের
প্রকৃত বাস্তবতাকে উপলব্ধি করে। যে বাস্তবতা উঠে এসেছে শিল্পের বাস্তবতা থেকে।
অ্যারিস্টটল যাকে বলেছিলেন, পোয়েটিক ট্রুথ; যে সত্যের স্থান ইতিহাস বা বিজ্ঞানের ঊর্ধ্বে অর্থাৎ দ্য
ট্রুথ অব পোয়েট্রি ইজ নট এ কপি অব
রিয়েলিটি, বাট এ হাইয়ার রিয়েলিটি, হোয়াট অট টু বি, নট হোয়াট ইজ।
ঐতিহাসিক অথবা
ভৌগোলিক সত্যের ঊর্ধ্বে শিল্পের সত্য যে প্রজ্ঞার জগতে আমাদের পৌঁছে দেয় তা-ই
শিল্পের সারাৎসার; যা আমরা উল্লিখিত উপন্যাস পাঠে পেয়েছি। ঠিক এই একই সত্যের মুখোমুখি
হই আমরা দীর্ঘকবিতা পাঠে। অথচ সেখানে উপন্যাসের ধারাবাহিক ঘটনাক্রম অনুপস্থিত।
অনুপস্থিত থাকে চরিত্রসমূহের সুবিস্তারিত বিকাশ ও পরিণতি। তারপরও উপন্যাস শেষাবধি
শিল্পের যে ফলাফল বহন করে, সেই ফলাফলকে ধারণ করতে সক্ষম দীর্ঘকবিতা। কেন-না
দীর্ঘকবিতার ভেতর থাকে অতিসত্যের জগৎ, যা কিনা লিরিকে
অনেকাংশেই সম্ভব নয়। অথবা সম্ভব হলেও তা থাকে আংশিক ও খণ্ডিত অর্থে। কিন্তু
দীর্ঘকবিতায় যে অতিসত্যের ছায়াপাত ঘটে তাকে হাডসনের ভাষায় বলা সম্ভব, বাই পোয়েটিক
ট্রুথ ইউ মিন ফাইডালিটি টু আওয়ার ইমোশনাল এপ্রিহেনশন অব ফ্র্যাক্ট... আওয়ার
ফার্স্ট টেস্ট অব ট্রুথ ইন পোয়েট্রি, দেয়ারফোর, ইজ ইটস অ্যাকিউরেসি ইন
এক্সপ্রেসিং, নট হোয়াট থিংস আর ইন দেমসেলভস, বাট দেয়ার বিউটি অ্যান্ড মিস্ট্রি,
দেয়ার ইনটারেস্ট অ্যান্ড মিনিং ফর আস।
উপন্যাসের মত
দীর্ঘকবিতার ভেতর এই অতিসত্যের জগৎ কীভাবে ক্রিয়াশীল তা খতিয়ে দেখতে আমরা কাহলিল
জিবরান-এর দীর্ঘকবিতা ‘দ্য লোনলি পোয়েট’-কে উদাহরণ
হিসেবে গ্রহণ করতে পারি। কবিতাপাঠে পাওয়া যায়, এই মর্ত্যলোকে
কবি একা অচেনা একজন আগন্তুক। যিনি বান্ধবহীন; যিনি মানুষের
মাঝে বসবাস করা সত্ত্বেও রয়েছেন নির্বাসনে। এখানে লক্ষযোগ্য একটি চরিত্র, যিনি সমাজের
মাঝেই নির্বাসিত। এই রূপকল্প আমাদেরকে একটি চেতনাগত অতিসত্যের জগতে নিয়ে যাবার
সিড়ি নির্মাণ করে দেয়। কবিতার নিঃসঙ্গ মানুষটি নিজের সাথে প্রশ্নবানে জর্জরিত।
তিনি কেন এই মর্ত্যলোকে? আরও একটি
চরিত্রের উদ্দেশ্যে এই নিঃসঙ্গ চরিত্রটি প্রশ্ন ছুড়ে দেন, ‘সে কে এবং কেনই বা এখানে? কী করে জানবো কে
সে? আর সখ্যতার কোন সূত্রই বা আমাদের সম্পর্কের বন্ধন?’
একাকি নিঃসঙ্গ
চরিত্রের ওপর একে একে ভর করে জীবন জগৎ ইহোকাল পরকালসহ যাবতীয় রহস্যময় কাক্ষিত
প্রশ্নমালার পাহাড়। সুতরাং তার জীবন দুর্বিসহ। চরিত্রটি ডুবে থাকে একাকিত্বে। সে
একা এই কারণে যে, ট্রাডিশনাল সমাজ তাকে কমিউনিকেট করতে অক্ষম। সুতরাং যন্ত্রণা
অনিবার্য। অনিবার্য সমাজ বাস্তবতা। অনিবার্য ধ্যান। সুতরাং মগ্নতা। মগ্নতায়
মুগ্ধতা। পার্থিব চক্ষুদ্বয় দিয়ে আপাতসত্যের ঊর্ধ্বে যে অতিরিক্ত সত্যের জগৎ রয়েছে
তাকে অবলোকন সম্ভব নয়। সুতরাং এই পার্থিব চক্ষুদ্বয়কে অস্বীকার করে চরিত্রটি
অতিসত্যের জগতে পরিভ্রমণ করতে শুরু করলো তার অন্তর্চোখ দিয়ে। পাশাপাশি পাঠকের
মধ্যেও উন্মোচিত হতে থাকে সেই অলীক চোখ যার সাহায্যে সে অতিসত্যের মুখোমুখি হবার
এক রহস্যময় অনুভূতি লাভ করতে থাকে। সুতরাং পাঠক এই দীর্ঘকবিতার চরিত্রটির সাথে
ক্রমশ অমৃতলোকে আত্মগত হন; লীন হন মহামগ্নতায়।
চারিদিকে হাসি
এবং কান্না। ক্রমশ সাহসের হট্টগোল। সুতরাং ভয়। মানুষের আত্মা সংকুচিত হয়। হৃদয়ের
কাছে ফিরে আসে মানুষ। ফিরে আসে অস্তিত্বের কাছে; স্বকীয় চেতনার
কাছে। অথচ তারপরও ব্যক্তি অস্তিত্বের স্বাধীনতার টানাপোড়েনে চরিত্রগুলো নৈঃশব্দে
কাঁপতে থাকে। ক্রমশ অচেনা। অচেনা শরীর ও চিন্তা। চিন্তা ও শরীর। এবং আমরা আমাদের
এই দুই সত্তার কাছেই আগন্তুক। আমরা দাঁড়িয়ে আছি এক অমোঘ আয়নার সম্মুখে। যে আয়না
আমাদের দেখিয়ে দেবে আমাদের অন্তর্গত সত্যের জগৎ। যা কেউ খুঁজে পায় না; যা শুধু দেখতে
সক্ষম আমাদের আত্মা। অথচ আমার আত্মার মাথা নোয়াবার মত পৃথিবীতে নেই কোনও নিশ্চিন্ত
স্থান। মানুষেরা অনুসন্ধানরত। তন্ন তন্ন করে পৃথিবীকে ছিড়ে খুঁড়ে খুঁজে পেতে চায়
তার প্রকৃত আবাসভূমি। অথচ আমার মুখোমুখিতে দাঁড়াবার মত কোনও মানুষ পাই না আমি। না
পাই অন্তত এমন একজন মনোযোগী শ্রোতা, যে পারে খুলতে
আমার মননের দ্বার।
প্রকৃত
প্রস্তাবে মানুষ মানুষের কাছে শৃঙ্খলিত। তার সত্তার সমস্ত গোপন অনুভূতি আদৌ ভাষা
পায় না; অথবা ভাষা পায় না এমন কোনও সত্যভাষ্য যা দিয়ে সে নিজের অহমকে
শৃঙ্খলমুক্ত করতে পারে; বরং সবকিছুই শৃঙ্খলিত। সুতরাং মানুষেরা অন্ধ।
অন্ধ মানুষটি হেঁটে যায় শহরের কোলাহলে। পিছে লাগে বালক-বালিকার দল। চিৎকার।
হট্টগোল। নাগরিক মানুষের সন্তানেরা বলতে থাকে, ‘দেখো এক অন্ধ মানুষ। চলো তার হাতে
তুলে দেই একখানা সাদাছড়ি যাতে সে খুঁজে পায় পথ।’ আর শহরের সব সুন্দরী কুমারীদের বলতে শোনা যায়, ‘ইস্! লোকটা
পাথরের মত বধির! এসো আমরা ওর কর্ণকুহরে ঢেলে দেই ভালবাসার গান।’
এ পর্যন্ত পাঠ
করে পাঠক পৌঁছে যান এক অতিসত্যের সত্যভাষ্যে। যে সত্যভাষ্য নান্দনিক সৌন্দর্যের
আধারে প্রতীকী পবিত্রতার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে। মানুষ পালাতে চায় সমাজ থেকে। অনাকাঙ্ক্ষিত সমাজ, রাষ্ট্র ও
ইতিহাসের বলি হতে বাধ্য যে মানুষ সেই সার্তের উপন্যাসের ম্যাথুর মত এই দীর্ঘকবিতার
চরিত্রগুলোও ক্রমাগত অনুসন্ধান করে ফেরে ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রকৃত তাৎপর্য। আর এই
তাৎপর্য অনুসন্ধান তাদেরকে পৌঁছে দেয় নিদ্রাহীন চোখের দেশে। যেখানে ঝুলে থাকে
অসংখ্য প্রতীক। কিলবিলে বিষধর সাপ জ্বীন ভূত আর গিজগিজে কীট। অর্থাৎ আমরা মানুষেরা
বাস করি যুগপৎ স্বর্গ এবং নরকের ভেতর। মানুষ এক নিঃসঙ্গ চরিত্র। সে মরুপ্রায়
তৃণভূমিতে হাঁটতে হাঁটতে দেখতে পায় দ্রুততম এক ক্ষুদ্র নদী। পাহাড়ের সুউচ্চ চূড়া
থেকে যে নদী নিরন্তর ছুটে চলেছে উপত্যকার গভীরতম প্রদেশে। এই পৃথিবী ভ্রমণরত একাকি
নিঃসঙ্গ মানুষগুলো সহসা দেখতে পায় ঊষর বৃক্ষগুলো মুহূর্তে পূর্ণ হয়ে গেল পাতায়
পাতায়। অতঃপর কুঁড়ি ফুটে উঠলো ডালে ডালে। আর মুহূর্তেই কুঁড়ি থেকে ফুল। ফুল থেকে ফলে
ফলে ভরে গেল ডাল। অথচ তখনই ডালগুলো ভেঙে
গিয়ে রূপান্তর হল চকড়াবকড়া দীর্ঘ দীর্ঘ সাপে। অর্থাৎ উৎপাদনের সাথে সংশ্লিষ্ট
মানুষ যখন উৎপাদনে সফলতা অর্জন করে তখন ওই উৎপাদিত ফসলের সুফল তাদের কাছে
মুহূর্তেই বিষধর সাপে পাল্টে গিয়ে তাদেরই স্রষ্টা, মানুষকেই ছোবল
হানে। ফসল হয়ে যায় পণ্য। পণ্যের সুফল ভোগ করে উৎপাদনের সাথে সংশ্লিষ্ট
শ্রমিকশ্রেণি নয়; বরং ভোগ করে বেনিয়া শ্রেণি; চাঁদ সওদাগর
অথবা লখিন্দরের বিলাস। সুতরাং ভ্রমণরত কর্ষণরত বঞ্চিত নিঃসঙ্গ মানবগোষ্ঠী শুনতে
পায় বিষণ্ন সঙ্গীতে বিলাপরত পাখিগুলো শূন্যে উড্ডীন।
টানটান ডানায় পাখিগুলো উড়ে যায়। অতঃপর প্রতীকাশ্রয়ী জাদুবাস্তবতা। পাখিরা
দীর্ঘকেশী বিবস্ত্রে অপরূপ নারীতে রূপান্তরিত হয়। ওরা সুরমা আঁকা মুগ্ধ গদগদ চোখে
তাকায় সেই নিঃসঙ্গ চরিত্রটির দিকে। মধু জড়ানো সকৌতুক ঠোঁটে পরিহাচ্ছলে ওদের
সুগন্ধীমাখা হাত নিঃসঙ্গ মানুষটির দিকে প্রসারিত হয়। ওদের তীব্র মোহময় কটাক্ষ আর কৌতুকপ্রদ লাস্যময় পরিহাসের
ব্যঞ্জনা আকাশে আকাশে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। অতঃপর ওরা অলীক অশরীরীর মতো
মুছে যায় দৃশ্যপট থেকে।
এভাবেই
স্বর্গদৃশ্যের মোহে মানুষ ভ্রমণে ভ্রমণে একদিন মুছে ফেলে নিজেদের। মুছে যায় জীবন।
অতঃপর তারপরও এই সংকীর্ণ অন্ধকারাচ্ছন্ন পৃথিবী থেকে পরিত্রাণের উদ্দেশ্যে মানুষ
প্রজ্ঞা অনুসন্ধান করে; শান্তি অনুসন্ধান করে। এখানেই মানুষের প্রকৃত
যুদ্ধ এবং অতঃপর আবারও মানুষের জন্ম হয় তার পুত্রের মাঝে। যদিও মানুষ জানে সে
জাতিস্মর নয়। তবুও তো তৃপ্তি। যতটুকু জীবন ততটুকু জীবনভর এক মানবীয় তৃপ্তির খোঁজে
মানুষ ক্রমাগত হাঁটতেই থাকে। এ পর্যায়ে এসে এই ভাবময় ঐক্যসূত্রের দ্যোতনায়
প্রস্ফূটিত হয়ে ওঠে ইন্টারপ্রিটেশান অব লাইফ। দীর্ঘকবিতায় ছোটগল্পের মতো জীবনের
ক্ষণমুহূর্তের পূর্ণরূপ উদ্ভাসনের ফলে পাওয়া যাচ্ছে জীবন বিশ্লেষণ বা
জীবনব্যাখ্যা। ফলশ্রুতিতে পাঠক অনিবার্য এক জীবনজিজ্ঞাসার সম্মুখিন হন। এই
জীবনসত্য উন্মোচনে পাওয়া সম্ভব কবির ব্যক্তিক বৈশিষ্ট্য। কবির শ্রেণিগত অবস্থান।
মতাদর্শগত বৈশিষ্ট্য। শিক্ষা ও মানসিক গঠন। সর্বোপরি দেশ-কাল ও
আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অনুষঙ্গ কবির দীর্ঘকবিতায় প্রভাব বিস্তার করে। লিরিকে যা
সার্বিক অর্থে সীমিত। বলা চলে অনেকটা অসম্ভব। কেন-না লিরিক হচ্ছে, কবির একান্ত
ব্যক্তিগত বাসনা কামনা ও আনন্দ বেদনার ছন্দায়িত প্রকাশ। প্রকৃত প্রস্তাবে কবির
হৃদয়জাত অনুভূতি যখন পাঠকের অনুভূতিলোকে সংবেদনশীলতার আলোকে সিম্ফনী জাগাতে সক্ষম
হয়, তখন তা গীতিকবিতার পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। শুধুমাত্র কবির নিজ
অন্তরের বোধটুকু পাঠকের হৃদয়ে সঞ্চারিত করাই এই কবিতার উদ্দেশ্য। শুদ্ধসত্ত্ব বসু
যেভাবে বলতে চেয়েছেন, ‘গীতি-কবিতায় কবি তাঁর মানসিক অনুভবের একটা
দ্যুতির বিচ্ছুরণ ঘটান মাত্র, তাঁর আবেগে যে অনুরণন ধ্বনিত— তাতে পূর্ণতার
আস্বাদ যে থাকবে— এমন কথা নেই, একটুখানি ইঙ্গিত, ব্যঞ্জনার একটি
অভিভাবের বাঙ্ময় রূপায়নই যথেষ্ট।’ সুতরাং দীর্ঘকবিতা আর গীতিকবিতার মধ্যে অবশ্যই
রয়েছে একটি পরিষ্কার দূরত্ব।
পলগ্রেভ তাঁর
গোল্ডেন ট্রেজারি অব সঙস্ এন্ড লিরিকস-এর ভূমিকায় লিখেছেন, এ লিরিক পোয়েম শ্যাল
টার্ন অন সাম সিঙ্গল থট, ফিলিং অর সিচিউশন; একইভাবে সমালোচক হেনলি বলেছেন, এ লিরিক
ইজ এ সিঙ্গল ইমোশন ট্যাম্পারামেন্টলি এক্সপ্রেসজড্ ইন টার্মস অব পোয়েট্রি; অথচ লিরিকের মতো দীর্ঘকবিতার ক্যানভাস সিঙ্গল
ইমোশান অথবা সিঙ্গল থট দিয়ে নির্মাণ অসম্ভব। দীর্ঘকবিতা ব্যক্তিগত প্রলাপন মাত্র
নয়। দীর্ঘকবিতার সাথে সম্পর্কযুক্ত থাকে পাঠক, পাঠকের সময় ও
সমাজ তথা ব্যাখ্যাতীত রহস্যের ইঙ্গিতভাষ্য; ছায়া-প্রতিচ্ছায়া, অনুভূতি ও
অসংখ্য চরিত্রঘেঁষা অনুষঙ্গ তথা তীব্র লক্ষভেদি মেসেজ; যে মেসেজগুলো
অনেক সময় কোনও নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছে না দিলেও অন্তত দেখিয়ে দেবার চেষ্টা
করবে আপাত সত্যের ওপিঠে কী সেই অতিসত্যের স্বরূপ-তাৎপর্য। যা লিরিকে সম্ভব নয়।
সম্ভব নয় মন্ময় কবিতা, তন্ময় কবিতা অথবা বৈষ্ণব কবিতা, রূপক কবিতা, গাথা কবিতা অথবা
প্যাস্টোরাল কবিতা অথবা মহাকাব্য, যাই বলি না কেন।
এক্ষেত্রে প্রতিটি
ফর্মের মধ্য দিয়েই আসলে খণ্ড খণ্ড ভাবে আর্টের স্বরূপকে ধারণ করা হয় মাত্র। কিন্তু
দীর্ঘকবিতা এই সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রমের প্রচেষ্টায় লিপ্ত। দীর্ঘকবিতা সার্বিক জীবন
জীজ্ঞাসাকে সমন্বিত করার কাজে ক্রিয়াশীল। যা করে থাকে উপন্যাস। কিন্তু মনে রাখতে
হবে উপন্যাসের প্রকরণে নয় বরং কবিতার প্রকরণে উপন্যাসের নান্দনিক রেজাল্ট
উপস্থাপনের চেষ্টা দীর্ঘকবিতায় লক্ষণীয়। এক্ষেত্রে ছোটগল্পের সাথে গীতি কবিতা এবং
উপন্যাসের সাথে দীর্ঘকবিতাকে তুলনা করা সম্ভব।
দীর্ঘকবিতা
গীতিকবিতার বিষয়গত ও পরিমাণগত সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে ইচ্ছুক। দীর্ঘকবিতা
অনুসন্ধান করে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমাজ পরিবেশে, সমকালীন
পারিপার্শ্বিকতা, নিসর্গপ্রকৃতি তথা মহাবিশ্বলোকের উদার ক্যানভাসে ব্যক্তিচৈতন্যের
মুক্তি। এই মুক্তির প্রশ্নে উঠে আসতে পারে অনিবার্য জিজ্ঞাসা। যেমন, শিল্প কি
শুধুমাত্র নান্দনিক স্ফূর্তি? নাকি এর রয়েছে
কোনও বৃহত্তর সামাজিক রাজনৈতিক উদ্দেশ্য? শিল্প কি শুধুই
দর্পণ, যাতে প্রতিফলিত হয় মানবজীবন? নাকি এরও
অতিরিক্ত কিছু? শিল্প কি শুধুই ক্রিটিসিজম অব লাইফ? নাকি এর
বাইরেও সে কাজ করে থাকে? শিল্প কি একই
সাথে শিল্প নির্মিতি ও তত্ত্ব প্রচার, প্রকরণ ও
প্রতিপাদ্যের এক সুষ্ঠু ভারসাম্য? নীতি-নৈতিকতা
তথা সামাজিক মূল্যবোধের সাথে শিল্পের সম্পর্কটি কোথায় কীভাবে ক্রিয়াশীল? শিল্পকর্মের
মূল্যায়ন কি শুধুমাত্র তার নান্দনিক তথা প্রকরণগত উৎকর্ষের মাপকাঠিতে বিবেচ্য, নাকি এর সাথে বিবেচনায়
রাখতে হবে সমাজ ও মানুষকে? শিল্পের চূড়ান্ত
গন্তব্য কি শুধুই সত্য অন্বেষণ নাকি শুধুই আনন্দ আহরণ?
শিল্পকে আশ্রয়
করে চিরকালীন এই অমীমাংসিত জিজ্ঞাসার মুখোমুখি হতে ইচ্ছুক দীর্ঘকবিতা। যার বিশাল
পটভূমিতে ক্রমাগত চিত্রিত হতে থাকে মানুষের জীবন, প্রবহমান জীবন ও
গতিরেখা তথা জীবনের অনিবার্য প্রশ্নসমূহ। যা কিনা শেষাবধি এক জন্মে অমীমাংসিতই
থেকে যায়। অথচ বিশাল মানব প্রজন্মের অসংখ্য জিজ্ঞাসাকে উষ্কে দিতে দীর্ঘকবিতা
নিজেকে আর লিরিকে আটকে রাখতে চায় না; প্রবেশ করতে চায়
নদী থেকে সমুদ্রে। সমুদ্রের রহস্যঘন বিস্ময়ে ভরপুর অনিবার্য এক সম্ভবনাময়ী
ঐশ্বর্যপূর্ণ জগতের কাছে। কেন-না প্রসঙ্গত এ কথা বলে রাখা সমীচীন যে, আধুনিক সভ্যতায়
জটিল মানব প্রজন্মের জটিল সমাজ ব্যবস্থায় গীতিকবিতা এখন আর কবির সার্বিক প্রজ্ঞার
জগৎকে ধারণ করতে বা প্রকাশ করতে সক্ষম নয়। সুতরাং সময়ের প্রেক্ষাপটে গীতিকবিতার
যাত্রা এখন দীর্ঘকবিতার দিকে। যা কিনা শুধুমাত্র আয়তনেই দীর্ঘ নয় বরং বিষয়
বৈচিত্র্যে, অর্থব্যঞ্জনায় তথা ভাব বক্তব্যেও বিশাল। সুতরাং দীর্ঘকবিতা স্বাভাবিক
ভাবেই একই সাথে উপন্যাস ও কবিতার স্বাদ দিয়ে থাকে। যা কিনা লিরিকে অসম্ভব।
তবে স্বীকার্য, যে কবিতাকে আমরা
লিরিক হিসেবে জানি অথচ তার ভেতর রয়েছে উপন্যাসসুলভ ভাবব্যঞ্জনার বিশালতা তথা
কবিতার ঐন্দ্রজাল, তা অবশ্যই দীর্ঘকবিতার দাবিদার। তা আয়তনে ছোট হলেও দীর্ঘকবিতা। তার
বিষয়বক্তব্যের গভীরতা ও বিশালতার কারণে তা আর লিরিক নয়। কিন্তু আয়তনে বিশাল হয়েও
বিষয় ও ভাববক্তব্যের সীমাবদ্ধতার কারণে এবং কবির একান্ত ‘ব্যক্তি-আমি’র উচ্ছ্বাসে
উচ্ছ্বসিত হওয়ার কারণে তা দীর্ঘকবিতা না হয়ে হতে পারে বড়ো-কবিতা। অবশ্যই তা
দীর্ঘকবিতা নয়।
দীর্ঘকবিতার
চরিত্রকে আরও কিছুটা পরিষ্কার করার লক্ষ্যে ওক্টাভিও পাজ-এর দীর্ঘকবিতাকে উদাহরণ
হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। এতে দীর্ঘকবিতার গুরুত্বপূর্ণ বেশকিছু লক্ষণ আবিষ্কার
করা সম্ভব। এ কথা স্বীকার্য যে, বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকের দিক দিয়ে পাজের কবিতা
অগভীর জটিলতাকে পরিহার করে ক্রমশ গভীর ঘনত্ব অর্জনের দিকে অগ্রসর হয়েছে। যা কিনা
শেষ পর্যন্ত দীর্ঘকবিতার স্বাক্ষরবাহী। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা উচিত, দীর্ঘকবিতা
শুধুমাত্র বিশাল প্রেক্ষাপটে সমাজ বাস্তবতার বহুবিধ অনুষঙ্গকেই চিত্রিত করে না বরং
এই চিত্রণের জন্য প্রয়োজন আরেকটি অপরিহার্য শর্ত, সেটি হল
নান্দনিক পরিশুদ্ধতা। এড্গার এলেন পো, স্তেফান
মালার্মে, র্যাঁবো, অস্কার ওয়াইল্ড প্রমুখ শিল্পী জীবনবাস্তবতার
সাথে শিল্পের সম্পর্ককে পৃথক করে, এমনকি শিল্পের ব্যবহারিক উপযোগিতার যাবতীয়
প্রত্যাশাকে অস্বীকার করে এমন এক শিল্পের কথা বলতে চেয়েছিলেন যেখানে থাকবে শুধুই
বিশুদ্ধ নান্দনিকতা। অথচ বাস্তবে শিল্প শুধুই নান্দনিক কলা কিনা এ জিজ্ঞাসারও
সমাধান সম্ভব নয়। দীর্ঘকবিতা এ প্রশ্নের উত্তর প্রদান করে না বরং বিষয়গুলোকে
বিবেচনায় রেখে শিল্পের ব্যবহারিক প্রতিক্রিয়াকে যাচাই করে দেখতে ইচ্ছুক। ফলে
দীর্ঘকবিতা নিছক কবির আবেগ-সৌন্দর্যমাত্র নয় বরং দীর্ঘকবিতা সমাজ প্রণোদিত
সত্যভাষ্যের প্রতিরূপও বটে। যা পাঠককে একই সাথে উপন্যাস এবং কবিতা পাঠের আনন্দ
দিতে সক্ষম।
দীর্ঘকবিতার
প্রধান ও প্রথম শর্ত হচ্ছে, এর প্রেক্ষাপট ও বিষয়বক্তব্যকে হতে হবে বিশাল।
যা কখনও-ই গুটিকয়েক অনুষঙ্গের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না বরং বিস্তৃর্ণ ক্যানভাসের
মধ্যে চিত্রিত হয়ে থাকে সহস্র চিত্রকল্প, অনুষঙ্গ, ঘটনা ও ঘটনার
পুনঃসংস্থাপন। দীর্ঘকবিতার ভেতর এমন একটি বিশাল প্রেক্ষাপট নির্মাণ করতে গিয়ে
সেখানে উপস্থিত হয় অজস্র চরিত্র, উপচরিত্র। কখনও বা কেন্দ্রীয় চরিত্র, পরোক্ষ অথবা
প্রত্যক্ষ চরিত্রসমূহ। যে চরিত্রগুলোকে আপাতভাবে মনে হতে পারে বিচ্ছিন্ন অথবা ঘটনা
পরিবেশের সাথে যোগসূত্রবিহীন; অথচ গভীর পাঠে চরিত্রগুলো ক্রমাগত প্রাসঙ্গিক
হয়ে ওঠে। প্রকৃত প্রস্তাবে দীর্ঘকবিতাতে প্রতিটি চরিত্রের সাথে প্রতিটি চরিত্রের
রয়েছে একটি অদৃশ্য যোগসূত্র। এরপরও মনে রাখতে হবে ছোটগল্পের মত অথবা উপন্যাসের মত
চরিত্রগুলো কবিতার ভেতর প্রতিষ্ঠিত হতে বাধ্য নয় বরং পরোক্ষভাবে চরিত্রগুলো পরিবেশ
নিয়ন্ত্রণ করে মাত্র; অনেকটা ছায়া-উপচ্ছায়ার মতো। এক্ষেত্রে চরিত্র প্রতিষ্ঠার জন্য ঘটনাক্রমের বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করতে
দীর্ঘকবিতা বাধ্য নয়। কেন-না কবি উপন্যাস বা গল্প লিখছেন না।
একই ভাবে অজস্র
চরিত্রের আশ্রয়ে ইঙ্গিত দেওয়া হয় অসংখ্য আপাত বিচ্ছিন্ন গল্প, গল্পের অনুষঙ্গ, কূটাভাষ, ঘটনার অনুষঙ্গ, অনুষঙ্গাশ্রয়ী
চিত্রকল্প। যাকে কিনা পৃথক পৃথক উপস্থাপনা বলে হোঁচট খাওয়া বিচিত্র কিছু নয়। কিন্তু দীর্ঘকবিতা পাঠে
পাঠক শেষাবধি বুঝতে পারেন, প্রতিটি চিত্রকল্প, ঘটনা বা
কাহিনি-ইঙ্গিতের মধ্যে রয়েছে একটি অদৃশ্য যোগসূত্র; যা শেষ পর্যন্ত
দীর্ঘকবিতার বক্তব্যকে গুরুত্বপূর্ণ ধাপে উপনীত করে। ফলে অনিবার্যতই সৃষ্টি হয়
অতিবাস্তব প্রজ্ঞার জগৎ। ঠিক একই ফলাফল ট্রাজেডি অথবা মহাকাব্যের ক্ষেত্রেও পাওয়া
যায়। কিন্তু এক্ষেত্রে দীর্ঘকবিতার সাথে মহাকাব্যের অথবা ট্রাজেডির মৌলিক পার্থক্য
রয়েছে; মহাকাব্য অথবা ট্রাজেডির জন্য অবশ্যই প্রয়োজন হয় একটি নির্দিষ্ট
আখ্যানের কিন্তু দীর্ঘকবিতার ক্ষেত্রে তার দরকার হয় না। দীর্ঘকবিতা সচেতনভাবে
ছোটগল্প-উপন্যাস-মহাকাব্য-আখ্যানকাব্য-গাথাকবিতা অথবা নাটকের মতো একটি সুনির্ধারিত
কাহিনিকে পরিত্যাগ করে অগ্রসর হয়। অথচ তারপরও আখ্যানধর্মী সাহিত্যের ভেতর যে
শিল্পরস বা যে ফলাফল পাওয়া সম্ভব তা সৃষ্টি করতে দীর্ঘকবিতা সক্ষম। বিষয়টি
পরিষ্কার করার জন্য ওক্টাভিও পাজ-এর দীর্ঘকবিতা ‘সৌরপ্রস্তর’-এর সুবিশাল
ক্যানভাসে আমরা আমাদের প্রজ্ঞানির্ভর বোধকে কার্যকর করতে পারি।
*** ক্রমশ চলবে ------
*** ক্রমশ চলবে ------
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন