পিয়ালি রায় - মায়াজম

Breaking

১৫ মার্চ, ২০১৫

পিয়ালি রায়




"কোথায় পাব তারে"


 ভোরের রঙও যেন তখন অন্য। কচি পাতার মতো আলো চারিদিকে। উন্মুক্ত পূবের আকাশ থেকে ক-খানা সোনালী জরির ফিতের মতো রোদ নিকানো উঠানে এসে পড়েছে। একটুও সময় নষ্ট করবো না বলে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতাম। গাছিরা খেজুর রসের হাঁড়ি উঠানের এক পাশে সার বেঁধে রাখতো। ছোটমামী কাঁচের গ্লাসে ঢেলে দিতো সেই রস। কি সুন্দর রঙ তাতে। আমি অবাক হয়ে দেখতাম। আজ খুব মনে পড়ে শীতের ছুটির কটাদিন মামাদের গ্রামের বাড়িতে কাটানোর কথা। সেই পুরনো ডায়রীর পাতা ওল্টালে এখনো কত যে হারিয়ে যাওয়া রঙ এর আভা লেগে আছে। যে রঙ শিমুলে নেই, পলাশে নেই, রাঙা মাটির পথে নেই, ঝা চকচকে শপিংমলে নেই। মনের গভীরে একটা স্তর সেই রঙে জারানো রয়েছে আজও। হুটোপাটি শুরু হতো সেই সকাল থেকেই। উঠানের পেয়ারা গাছটার সব থেকে নীচের শোয়ানো ডালটায় শুয়ে শাহেনশাদের আঙ্গুর খাওয়ার ভঙ্গিতে পেয়ারা খেতাম। ঐ গাছটায় সারা বছর পেয়ারা হতো। প্রতি কামড়েই আশ্চর্য হতাম। ছোট ছোট পেয়ারাগুলোর ভিতরটা লালচে গোলাপী রঙের। ওই রঙ আর কোথাও কখনো দেখিনি তারপর। ন-দিদিমার কাছে থাকতো কালো রঙের একটা টিনের কৌটো ভর্তি শুকনো কুল। এক মুঠো কুল নিয়ে ছুটতাম পুকুর ধারে। পুকুরপাড়ের সার সার বাবলাগাছ থেকে হলুদ ফুল জলে এসে পড়তো। মনে হতো কে যেন হলুদ চাদর বিছিয়ে রেখেছে। কুলগুলো একটা একটা করে খেয়ে দানাটাকে পুকুরের জলে ছুঁড়ে ফেলতাম। দানাটার চারপাশ থেকে হলদে রঙ গোল হয়ে দূরে চলে যেত। একটু পর আবার পুকুর হলুদ বরন। বড় রাস্তার পাশে ছোট ছোট ডোবাতে পাট গাছ ভেজানো থাকতো। অবাক চোখে দেখতাম সবুজ সবুজ ভিজে পাটগাছের গা থেকে পাট ছাড়ানোর পর ভিতর থেকে বেরিয়ে আসতো আমার চির পরিচিত সেই মাখন রঙের পাটকাঠি। ভিজে পাট শুকোনোর পর সোনালী রঙ ধরতে দেখেও আশ্চর্য হতাম খুব। মামাদের প্রতিবেশী প্রনব মামার ছেলে জড়-বুদ্ধিসম্পন্ন প্রতাপ ছিলো আমার খেলার সাথী।খুব সকালে ওর মা একখানা চাদর ওর গায়ে জড়িয়ে দিত। একটু বেলা বাড়লেই ও আর জামা কাপড়ের ধার ধারতো না।প্রতাপ কারণে অকারণে হেসে উঠতো মাঝেমাঝেই। তখন ওর ঠোঁটের কোন দিয়ে ঝরঝর করে লালা ঝড়তো। মামাবাড়ির পরে আর মাত্র একটা বাড়ি ছিলো। তারপর ফসলের ক্ষেত।দূরে দেখা যেত রেললাইন। প্রতাপ ট্রেনের আওয়াজ পেলেই সেই দিকে ছুটতো। যতক্ষণ না ট্রেনের দেখা পেতো ও ছুটতেই থাকতো। ট্রেন এলে দাঁড়িয়ে হাত নাড়াতো। আমি একদিন খাতার পাতা ছিঁড়ে রঙ দিয়ে ভারতের পতাকা বানিয়ে পাটকাঠির মাথায় লাগিয়ে ওর হাতে দিলাম। ও খিলখিল করে হেসে উঠলো। ট্রেনের আওয়াজ আসতেই ছুট লাগালো। হলুদ সরষে ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে পতাকা হাতে ছুটে চলেছে উলঙ্গ এক বালক ।আমিও ছুটছি ওর পিছনে।আমার পরনের লাল ফ্রক প্রজাপতির মতো হাওয়ায় উড়ছে। আমি যেন স্পষ্ট দেখছি ঈশ্বর দু হাতে রঙ ছড়াচ্ছে ওর উপর।ঐ রঙে রঙিন হয়ে উঠছে প্রতাপ । সব রঙ রামধনূ হয়ে জড়িয়ে ধরছে ওকে। ট্রেনের আওয়াজ বাড়ছে, বাড়ছে ওর গতিও। আমিও মন্ত্রমুগ্ধের মতো ছুটছি ওর দিকে।কিন্তু রামধনূ জড়ানো প্রতাপকে ছুঁতে পারিনি কখনো। হেরে গেছি ওর কাছে বারবার। আমার মননের সেই রঙটুকু নিয়ে প্রতাপ সত্যিই যে ঈশ্বর হয়ে গেলো একদিন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র