চন্দ্রা সোনালী - মায়াজম

Breaking

১৫ মার্চ, ২০১৫

চন্দ্রা সোনালী



সোনালী রোদ্দুর উপাখ্যান 


প্রিয় রং যেভাবে রাঙিয়ে দিয়েছে জীবন তাই না বললেও ফিরে ফিরে আসে নীল এর কথা । নীলের প্রাচুর্যে ভেসে গেছে জীবনের ইতিহাস । রূপ -রস - গন্ধের ধারক ও বাহক সেজে নীল জাপটে ধরেছে ক্ষুদ্র জীবনের সমস্ত স্মৃতিসরণী । নীলরঙ বিভিন্ন অনুভবে শব্দের ঘরে বাঁধা পড়েছে বারংবার। অথচ না চাইতেও লালের বিড়ম্বনা ফিরে ফিরে এসেছে জীবনের গতিপথে । এই যেমন ধরো , নীল পাটেরশাড়ি ,অপরাজিতা প্রেম আর নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজ -এ তো চিরন্তনী সত্য ! আর যতবার এই সত্যের সামনে দাঁড়িয়েছি প্রিয় রং গুলো সরে গেছে অন্ধকারের দিকে। দূরের সাঁঝবাতিটিকে যখন ধ্রুব মেনে এগিয়ে চলেছি তখনি -উৎসবের দিনে প্রিয় আমাকে সাজিয়ে নিতে চেয়েছে তার চোখের অভিসারে সেই যৌবনবতী লাল বেনারসির অকৃপণ রঙে ।

আসলে এই লালের মহিমা ছেড়েও ছাড়ে না । যত পিছিয়ে যেতে চেয়েছি অন্ধকারকে দূরে রেখে , যত ভুলে যেতে চেয়েছি লালের প্রাদুর্ভাব , কিন্তু অনিবার্য ভাবে লাল-কালোর কম্বিনেশন যেন এক দুরন্ত মায়াবী চাকা , এগিয়ে এসেছে সমস্ত নীলের উপত্যকা তছনছ করে দিয়ে , এগিয়ে এসেছে সময় ও বর্তমান ব্যতিরেকে আর পিষে দিয়েছে শৈশব ,অতীত,যৌবন,ভবিষ্যৎ এর তাবৎ নীলের ঐতিহ্য ।

কোনএক ঋতুমতী ভোরে ঘুম ভেঙ্গেছিল , আর সেদিনই প্রথম অনুভব করলাম কৈশোরী প্রভাত লালে লাল । মা ,কাকিরা আড়াল টানল যৌবনবতী আমিটাকে । জোরে হাসতে নেই লোকে বাঁচাল বলবে , বেশি লাফিও না উদ্ধত মেয়ে অপআখ্যা দেবে । সবই রঙ এর প্রভাবধন্য সুসময় । 

প্রথমবার যখন নিজেকে নারী ভাবতে শিখলাম আমার হৃদয়প্রদেশ জুড়ে অসংখ্য রং এর রাজত্ব শুরু হোল । শালের গাঁটরি কাঁধে ফেলে কাশ্মীরি আপেল বাগানের লাল টুকটুকে আপেল পেছনে ফেলে যে ছেলেটি বাড়িতে - বাড়িতে শাল ফেরি করে যেত , শীতে ও তার ঘামে ভিজে থাকা উন্নতবাহু প্রথম পুরুষ চিনিয়েছিল । কল্পনার গ্রন্থিতে মিশিয়ে নিতাম বরফ ভেজা উত্তরের পাহাড় ,প্রথম সূর্যের ছটায় সাত রং এর সুর-প্রপাতে আমি তখন ভেসে যাচ্ছে সেই যুবকের সঙ্গে , কোথায় যেন ভেসে যাচ্ছি সম্মানের সমাজের রঙ পেছনে ফেলে । 
সারা-হপ্তা হাপিত্যেশ করে বসে থাকা ছিল রুটিন সেই পাঠানী মুসলিম যুবকের শাল ফেরির অপেক্ষায়। তার মুখের আধাভাঙ্গা বাংলায় টিউলিপ ফুলে প্রজাপতি উড়ে যেত আর সেই রঙ্গিন ডানা পেয়ে আমিও আপেল খাওয়া আদিমতম নারী। যেখানে আমার কাশফুলের বাগান ,ছুটতে- ছুটতে আমি ছুঁয়ে ফেলেছি হলুদ সর্ষেফুলের খেত।আবার,গরিষ্ঠ বিকেলের স্নেহ রং ,ভাই এর হাত ধরে শীতের দুপুরে যখন সোনারোদে পিঠ রেখে কুলের আচার খেতে খেতে ভুলে যেতাম স্কুল ফাইনালের রেজাল্ট ,অংক সারের বেত ,তখন চোখের সামনে থাকত অরুণ - বরুণ -কিরণমালার করুণ সুর-কেলি ,ডুবে যেতে যেতে উপকথায় ঠাকুমার বুকে, আবিষ্কৃত হতো আমি এক অভিন্ন রং , ডালিম ঠোঁটের মেয়েটি যে আগুন বুকে নিয়ে সফল হয়েছিল ,ভাবতে থাকতাম সেই আগুন কি আমার মত অসফল ফ্যাকাসে রূপের কাছে তার দাহ্যতা হারিয়ে ফেলে!

আবার ,এই যেমন ধরো কালো রং এর কথাই বলি.........চোখে কাজল সাজাতে বেশ লাগে ,চোখটা যেন মায়াবী রূপের অমাবস্যা সৌন্দর্যের দিকে খেলে যেতে থাকে । বুকে যখন ওড়না চাপিয়ে দিতে হয় এই শব্দ শিখলাম নিজেকে ঐশ্বরিয়া মনে হত। ঢেউ তোলা চুলের ছেলেদের চোখে তোলপাড় প্রেম..........নিজেকে ভীষণভাবে মেয়ে ভাবতে ইচ্ছে হত। কিন্তু, "কপাল টা যায় রে সংগে".....কয়েকটা প্রেমপত্র হাতবদলে ছোট কাকার হাতে পড়ায় , কাজলনয়না হরিণী হওয়া হল না। অপাঠিত প্রেমপত্র নৌকা বানিয়ে ভাসিয়ে দিলাম বর্ষার থৈথৈ জলে। সেদিন বাড়ি থেকে কাজলের ডিবেটাই উধাও। সে যাত্রায় প্রেম প্রেম খেলায় পর্দানশীন হতে হল বুকে একরাশ চিনচিনে ব্যথা সঙ্গী করে। যদিও আমের আঁটি চুষতে চুষতে বন্ধুদের লাল টুকটুকে গ্লসিভ ঠোঁটে লুকিয়ে চুমু খাওয়া দেখতে বেশ লাগত......

ভালবাসা কে কখনোই কোন রং এ বাঁধতে দেখিনি ,পৃথিবীর তাবৎ সমস্ত সুন্দর রঙ মিশে গেছে ওই চারটি শব্দের শরীরে এসে।
কালোকে যতবারই প্রিয় ভেবেছি ততবারই প্রবল গোলযোগ দেখেছি আত্মার সঙ্গে বাস্তবের ।তবুও কোনএক শিউলী ফোটা যৌবনে নতুন করে প্রেমের সিঁড়িতে চড়লাম। প্রথমবার দেখা তার সাথে , যাকে এতদিন কল্পপুরুষ ধরে নিয়ে নানা রঙের দ্রবনে ভিজিয়ে রেখেছিলাম , ভাবের ঘরে সেই দেবতাকে হাতের ছোঁয়াতে পাবো এই স্মরণে উহু রোমকূপে আশ্চর্য শিহরণ .। দোষ ওই শিহরণের নয় , ২৭তম আগুন খেলায় বসন্ত সমাগমের, এই ঋতুকে উপেক্ষা করব সেই শক্তি কই ? 
যথারীতি নির্ধারিত দিনে সাজুগুজু রং লাগিয়ে শরীরের রন্ধে রন্ধে কয়েকটি শাড়ী নামালাম। শেষমেশ কপাল.........কালো রঙ বেশ সুইটেবেল , আমার ফর্সা ত্বকের সঙ্গে কালোর আঁচর খুব মানানসই হোল ।
দেখা হল, কথাও হল......জানালো আমায় রঙিন ডানায় চড়ে তার উড়বার নাকি বেশ সখ , আমিও একগাল হেসে কৃতার্থ হয়ে গেলাম ।
কিন্তু,বেশ কিছুদিন পরে কথায় কথায় এক অভাবনীয় তথ্য পেলাম যা আমায় নির্মম ভাবে ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট বিদ্বেষী করে তোলার পক্ষে যথেষ্ট। বলি তবে কারণটা ......

প্রিয় বললেন তুমি সুন্দর তবে যথার্থ সুন্দরী নও বটে। এই পর্যন্ত শুনে আপ্লুত হলাম নিদারুণ ,কারণ নিজের সম্পর্কে বেশ ওয়াকিবহাল ছিলাম ব্রিটনি স্পিয়ার্স নই হয়ত বাপু , তাই বলে কি খেঁদির মা ? কিন্তু দড়াম করে পিছলে গেলাম অন্যখানে----তিনি যখন বললেন তুমি বেশ সেক্সি। শরীর তোমার সেক্স রঙে দূর্বার মত মোহ দিয়েছে , বুকের পাহাড়রঙ আমাকে নেশা লাগিয়ে দিয়েছে ... জাস্ট ইমাজিন করি সহস্র জল প্রপাত তোমার গিরিখাতে,ঝিম লাগানো মহুয়া ফুলের গন্ধে...........
উফ এই কেলো করেছে । আমি!!!!!আবার সেক্সি!!!!!!!!ওরে , নাআআ । শুনেই ক্ষেপে গেলাম। কি আমি সুন্দরী নই সেক্সি????? সুন্দরী আর সেক্সি কাকে বলে এই ব্যাখ্যা শুনতে চাইলুম যখন ...
-আহা রেগে যাচ্ছ কেন!দেখ তুমি ভুল ব্যাখ্যা করছ।
-কি রকম ভুল?
-আরে ঐশ্বরিয়া ,ক্যাটরিনা এরা সুন্দরী। আবার ধরো রানী মুখার্জী কিন্তু তথাকথিত সুন্দরী নয় তবে সেক্সি , সেক্স একটা মনের মোহ , মনের আপেল খেত নয় , যেখানে সন্তানের জন্ম হয়না আকর্ষণ অফুরান, শুধু ভালবাসায় থাকে, সেখানে থাকে সেক্স , আর এই সেক্স থেকেই আপাতত তুমি সেক্সি । 
এইরে আমার তো মাথা ৩৬০ডিগ্রী ঘুরছে। মহান কবি বলে কি রে!!!!
এবার শুরু হোল হাইপার টেনশন। দু দিন টাইম লাগল বুঝতে আসলে উনি আমায় খারাপ বললেন না প্রশংসা করলেন!!
বুঝলাম শেষ পর্যন্ত ...
দোষ সেই কালো শাড়ীর ঘাড়েই। কেন যে ওই কালোয় নেবে এলাম!!!সেই অন্ধকার এখনো গদের আঠার মতই পিছু পিছু যদিও আমি ওই কালোর আগেই থাকি।

ঝর্ণায় রঙ চুইয়ে পড়তে থাকে । কখনো হলদে পাতা থেকে ঝরতে থাকা রঙের বর্ণহীনতা বড়ই বেদনাতুর করে তোলে । বিবর্ণ হলুদের মধ্যে মাঝেমধ্যে নিজেকে ফিরে দেখতে গেলেই রঙ যে কীভাবে চোখের জল হয়ে নেমে আসে , আর অনির্বাণ ঝরতে থাকে , ঝরতে থাকে অনন্তের পথে ...
আমার জন্মের পরে বাবার কাজের বিশেষ উন্নতি হয়ার সুবাদে পয়মন্ত মেয়ে হিসাবে খ্যাতিটা পরিচিত জগত পর্যন্ত বেশ ছড়িয়ে গিয়েছিল । তবুও খ্যাতির বিড়ম্বনার মধ্যেই সুপ্ত থাকে পিছলে পড়ার আর একটা বাস্তব জগত , সময় নামক রঙের সামনে দাঁড়ালে আসলেই রঙ মানেই একটা ধাঁধা । যাই হোক এক বছরের মধ্যেই আমার সাদা দুধের বাটিতে ভাগ বসানোর ভাগীদার হিসেবে আমার বোন এসেছিল কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার সন্ধ্যায় দুধ সাদা জ্যোৎস্না ঠোঁটে মেখে । মেয়ের পিঠে মেয়ের জন্ম হওয়াতে বাবা বিশেষ খুশী হননি বলাইবাহুল্য , আর তার উপেক্ষা ভোগ করতে হয়েছিল মাকে ,মা এর সাথে ছোট্ট সোনারঙের বোন কেও । বছর দুয়েকের আমি যখন তখন বোনের মাত্র মাস দশেক । বিশেষ মনেও নেই ঘটনাবলি , কিন্তু এতবার এই রঙহীন উপাখ্যান শুনেছি যে ছবিটা স্পষ্ট সাজিয়ে নিতে কোন অসুবিধা হয়না এখনও , স্পষ্টত দ্বিধাখণ্ডিত আকাশ নিয়ে বাঁচতে বাঁচতে গল্পের সময়ে নেমে যাচ্ছে সময় ।

মধ্যবিত্ত ঘরের দুটি শিশু প্রাণীর দুধের যোগান বেশ কষ্টদায়ক ছিল , সেখানে মা থাকলেও মায়ের পর্যাপ্ত দুধের যথেষ্ট অভাব থাকায় কারণে পেটের খিদেটা তখন নাকি আমাদের দুই বোনকে রাক্ষসগণে পরিণত করেছিল। বোনের জন্য গুলে রাখা দুধের বোতল আমি দরজার আড়ালে লুকিয়ে খেয়ে নেয়েছি এই গল্প বহু বার শোনা। দুই বোন , দামাল দুই মেয়েকে নিয়ে মায়ের তখন দিশেহারা অবস্থা । বাড়িতে প্রথম সন্তানের পড়ে দ্বিতীয় সন্তান তাড়াতাড়ি চলে এলে বাড়তি কিছু দায়িত্ব এসেই যায় প্রথম সন্তানের উপর , যতই আমার বয়স হোক বছর দুই তবুও বারবার মা স্মরণ করিয়ে দিতেন বোনের দিকে লক্ষ্য রাখবে , সময়মত দুধের বোতল মুখে ধরবে , খাট থেকে পড়ে না যায় দেখবে , তার সঙ্গে খেলবে , একটুও মারবে না , মায়ের সংসারে অনেক কাজ ছিল , সেসব কাজ মিটিয়ে আমাদের সঙ্গে লেগে থাকার ফুরসৎ ছিল খুব কম । 

এমনই এক দিনে মা স্নান করতে গেলে সতর্ক করে দিল- "বোন কে দেখে রাখিস ,যেন কিছু মুখে না দেয় । '' আমি বড় মেয়ে বলে কথা ! বাবা আমাদের আদর করে ডাকেন জ্বালানী আর পোড়ানী । আমি দিব্যি মাথা হেলিয়ে সম্মতি দিলে মা চলে গেল স্নান করতে ।বোন এক পা দু পা চলে টলমল পা এ , আমি কখনও খেয়েল করি , কখনও আপন খেলার তালে ...এই ক্ষেত্রে ও সেই চির শত্রু লালেই আঘাত হানল অপূর্ব , আঘাত হানল ঈশ্বরের ঘরে । 

লালকেন্ন ! দেশগাঁয়ে এই নামেই তো ডাকে মৃত্যুর দ্বিতীয় যমকে । সেই লালমৃত্যুর বীরদর্পে যাওয়া দেখে বোন হাত লাগাতেই গুটিয়ে চারআনা পয়সা আর বোন ও লজেন্স পেয়ে মুখে তুলেছে ,সদ্য ওঠা চারটে দাত দিয়ে জব্বর কামড় আর তার সাথে চিল চিৎকার , মা ছুটে এলো বাথরুমে থেকে , .মুখে তিন টুকরো সেই কেন্ন র ধ্বংসাবশেষ । বোনের মুখ ধোয়ানো হল কিন্তু কান্না কমল না। আমার পিঠে হাজার ভাদ্র মাসের তাল নেমে এলো । 

শুরু হল আন্ত্রিক ,সেই আবার কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার দিনেই বোন ফিরে গেল যেখান থেকে এসেছিল। শুধু আমার মাথায় রেখে গেল ওর হত্যার দায়। আর অন্ধকারে সামিয়ানায় মিটমিট জ্বলতে থাকা অজস্র কালো রঙের তারারা । 
সবার মুখে শুনি সে নাকি ভারি সুন্দরী ছিল ঠিক লক্ষ্মী মায়ের মত । মনে মনে ভাবি আমিও যদি ওর মত চলে যেতাম হয়ত আজ সবাই আমায় লক্ষ্মী নামেই ডাকত ,খানিক পয়মন্ত হতাম বাবার কাছে মায়ের কাছে । 
আজ সাতাশ বসন্তে এসে দু বছরের চিত্রনাট্যের কাটাছেঁড়া করে রঙের কোন বৈচিত্র্য পেলাম যা বাঁচিয়ে রাখবে আগামী জীবন । 
জীবনে রঙের অপচয় ঘোচাতে পারিনা আমরা , আমরা রঙের উদ্ভাবক বা ব্যবহারকারী কোনকিছুই নই , আমরা শুধু দেখতে পারি রঙের জগত , সেখানে পৌঁছতে পারি না ......

1 টি মন্তব্য:

Featured post

সোনালী মিত্র