অরিণ দেব - মায়াজম

Breaking

১৫ মার্চ, ২০১৫

অরিণ দেব




রঙ বিষয়ক অথবা চৈত্র ভাবনা 


হারিয়ে যাচ্ছিলাম ! সকালে গোময় নিকানো উঠোন জুড়ে মা দু-সিদ্ধ ধান বিছিয়ে দিয়েছে নরম রোদে , পৌষের গন্ধ ভালবেসে সালিক চড়ুই নবীন সূর্যরোদের দিকে পালক মেলে দিয়েছে উঠোনে বিছিয়ে দেওয়া ধানের ওপর ! কচিসূর্যরঙ ধানে প্রতিফলিত হয়ে পাখিদের ডানায় রামধনু এঁকে ছড়িয়ে পরছে উঠোনে ধানপাহারা দেওয়া ছোট্ট ছোট্ট বইপত্রের এর ওপর ! তখন যেন কত বছর আমি ? ভাবতে ভাবতে দেখছি সুরেন দা দ্বিতীয় কাটের নীলাভ খেজুররস এর ভাঁড় নিয়ে নামছে গাছ থেকে , ছাকনি দিয়ে গ্লাসে - গ্লাসে হিমরস ঢালছি , ঢালার শব্দে জিভ চুকচুক পান করে নিচ্ছি রসরাজ এর উত্তাপ , পাশে বোন কীর্তনের মুগ্ধ শ্রোতার মত অপলক চেয়ে আছে গ্লাসের দিকে ...... 
দেখছি , বোনের মুখ হিমশীতে ঘেমে-নেয়ে উঠছে , প্রিয় রঙের কাছে এলে রঙই ভাসিয়ে দেয় মুখচ্ছবি , রঙ তখন জীবনের প্রতিচ্ছবি । কাঁপছি , হিমঠাণ্ডা গ্লাসদু'ই রসরাজ পানের পরে শরীরের লোম ৯০ ডিগ্রি এঙ্গেলে দাঁড়িয়ে যেন বলছে -- সুসময়ের কাছে এলে শরীর ও সজাগ হয়ে যায় । সুসময়ের কাছে এলে ইন্দ্রিয়গাহ্যতা বেড়ে যায় ! 
হাঁস -মুরগি ঘর এইমাত্র খুলে দিয়েছে মা , তীব্র ডানা ঝাপটায়ে ছোট্ট দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসবার সে কি আপ্রাণ প্রচেষ্টা ! সকলের আগে বেরুতে হয় বাইরে , সকলের সামনে না থাকতে পারলে যেন পর্যাপ্ত ভোগ কর যায় না খাদ্যভান্ডার । 
প্রায় ১০ মাস মায়ের পেটে ছিলাম , মা একবার গল্পে বলেছিল , পেটের মধ্যে থেকে নাকি মাঝে মাঝে কষিয়ে লাথি মারতাম মাকে , আমার লাথি খেয়ে আনন্দে মায়ের দু'চোখ থেকে যে জলের ধারা প্রবাহিত হয়েছিল তার থেকেই নাকি উৎপত্তি হয়েছিল সমস্ত জলপূর্ণ নদীর ! 
আমি সেই নদীতে এখন আর সাঁতার কাটতে পারি না , দিনের শেষ সূর্যের রক্তিম লাভা বিছিয়ে দেয় নদীর জলে ঐশ্বরিক রঙ , মা সেই রশ্মির দিয়ে চেয়ে থাকে , চেয়ে থাকে ... 
অথচ আমাকে দেখতে পায় না , আমার শরীর দেখতে পায় না , আমার অফিস দেখতে পায় না , আমার এখনকার ব্যবহারের বড়জামা দেখতে পায় না , অথচ রঙ চটে যাওয়া বছর খানেক বয়সের আমার জামাটা মা চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পায় , তার রঙ , কোথায় নীল ছাপ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে স্পষ্ট দেখতে পায় , মাকে চিরান্ধ ভাবি ? মাকে কি অন্ধ ভাবা যায় ? মা আজও সারাদুপুর মাঠেঘাটে বকনা চড়িয়ে ফেরে , আঁচলে বেঁধে নিয়ে আসে নতুন ধানের শীষ , আর লক্ষ্মী পূজার দিন পাকা ধানের গুচ্ছ দরজায় বেঁধে রাখে , এভাবেই বন্দী করে রাখতে চায় গৃহলক্ষ্মী দেবী ... এভাবেই কি বর্তমানকে ধরে রাখতে চাওয়া স্মৃতির জন্য ......
ত্রিমূর্তি সোসাইটির ফ্ল্যাটবাড়ি থেকে স্পষ্ট দেখতে পাই না এসব দৃশ্য , বাসের উদাস ধোঁয়া , অফিস টাইমের ঘড়ি , মামনির স্কুল ফ্রকের রঙ কেমন ভাবতে ভাবতে ড্রাইভার হর্ন বাজিয়ে দেয় , হর্নের কোন রঙ হয় না , বর্ণ হয়না , কোন গন্ধ হয়না -- এমনকি অতীত হয়না , বর্তমান হয়না , পেছনের কোন গল্প হয়না , মায়ের চোখের ছানি হয় কি না হয় ভাবতে ভাবতে বেলা গড়িয়ে যায় পশ্চিমে ......... 

বাড়ি থেকে স্কুল পাক্কা ৬ কিলোমিটার । মেঠো পথ , বরং মেঠো পথ নয় শর্টকাট গেলে বুনিয়াদী ফসলের আল দিয়ে পাক্কা ১০ মিনিট সেভ করে স্কুলে পৌঁছে যাওয়া যায় । আমরা সেটাই করতাম । 
ক্লাস ফাইভ থেকে হাঁটছি আমি কমল বিক্রম নির্মল সঞ্জয় পাপিয়া ইসমাইল ...
ধানিআল , তিলআল , পটলআল , বেগুন- ঝিঙে -মুসুরি -খ্যাসারি -ছোলার আল দিয়ে হাঁটছি সূর্যযন্ত্রণা মাথায় নিয়ে । সঞ্জয়ের পায়ের ধুলো মাখছে আমার মাথা , আমার মুখের শসা ইসমাইলের দাঁতে লেগে রয়েছে , তখন থেকেই ... এখনও দেখছি ইসমাইল শসা খেয়ে শেষ করে উঠতে পারেনি  মেঠো আলের পাশে ছোট্ট ছোট্ট জল সংগ্রহের কুয়ো , দাঁড়াশের মুখে ব্যাঙের পা , গিলছে , যেমন সভ্যতা গিলে নিচ্ছে ধানের গোলাময় এঁদো পুকুর পর্যন্ত , ব্যাঙের বাঁচবার গ্যাও গ্যাও একঘেয়ে চিৎকার পেছনে ফেলে ছুটছি আমরা , আমাদের স্কুল ডাকছে , আমাদের পিরিয়ড ডাকছে , ডাকছে রাগী হেডমাস্টার মহাশয় , ডাকছে নীল ফ্রকের সেই অনামি মেয়েটি ! 

নিয়ত বায়ুপ্রবাহের ঝটকা লাগছে আমাদের চোখে- মুখে , কাছেই দেখতে পাচ্ছি সব শূন্য করে দিয়ে বাবলা গাছটি দাঁড়িয়ে আছে , স্থির । বাবলা গাছটি রোদের রুক্ষতা ধারণ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে স্বচ্ছ , এখনও এক পা এ দাঁড়িয়ে ডাকছে এসো নিষ্ঠুর তীব্রদাহ ! বাবলাকে ডানপাশে রেখে আমরা ক'জন গড়াই নদীর পাড় ধরতাম ( নদী ঠিক নয় , শাখা নদী ইছামতীর ) সকালে উন্মাদ সূর্যের তেজে পাড়ের বালি সোনার মত চকচক করত , বুকে জমে থাকা স্মৃতিরা এমনই বালি আর সূর্যপ্রভার মত চকচকে । নদীর পাশেই ছিল বেশকিছু ডেও গাছ , ফল গুলো লালচে উজ্জ্বল , গাছের নীচে অনাদরে পড়ে থাকত , আর সেগুলো কে আগে মুখে তুলবে তাই নিয়েই শুরু হত আমাদের রণক্ষেত্র ।
চোখ ধারণ করে থাকে উৎসব ও বিসর্জনের জল , সময় ধারণ করে থাকে স্মৃতি ও বিস্মৃতির পর্দা । দেখছি ক্লাসে প্রবহমান ছাত্ররা বসে রয়েছে , কালো ব্ল্যাকবোর্ডে সাদা চকের বিবর্তন লিখছেন স্যার , আমরা পরিযায়ীর মত উড়ে যাচ্ছি অঙ্কের দেশে , পিথাগোরাসের দেশে , বিজ্ঞানের দেশে , যুদ্ধ আর শোকের দেশে ----
স্যার পড়িয়েই যাচ্ছেন , মুখ চাঁদের থেকেও উজ্জ্বল হয়ে উঠছে , কখনও কৃষ্ণশোক মুখে বাসা বেঁধেছে আমাদের । কখনও ক্লাসরুমেই যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে দিয়েছেন ইতিহাসের হাজারী স্যার , শিবাজি উঠে আসছে , ঘোড়া উঠে আসছে , মোগল সম্রাট খোলা তলোয়ার নিয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছেন শিবাজিকে , ইকবাল কে এই তো যেন প্রশ্ন করলেন মোগল সম্রাট -- ও হে ছোকরা পর্বতমূষিক কে দেখেছিস ? 
আমরা যেন আজও শিবাজিকে খুঁজছি , রূপাই মিয়াঁর বাঁশি খুঁজছি , উপপাদ্য বিষয়ক প্রমাণের উপকরণ খুঁজতে খুঁজতে হাঁপিয়ে উঠছি
কলকাতা গলি তস্য গলি থেকে চিৎকার করছি - গড়াই তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না , সাপ - ব্যাঙ তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না , স্কুল তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না ......
আর রাতের কলকাতা লালে লাল হয়ে উঠছে , স্ট্রীট হ্যালজিনের কলকাতার তিলোত্তমা প্রেমিকার মত ছড়িয়ে দিচ্ছে ফ্লাইওভার । মেট্রো সুড়ঙ্গ থেকে উঠে আসছে ঝাঁকে ঝাঁকে পরিণত জীবন , সমগ্র কংক্রিটের রাস্তায় ধুলোর মিছিল , পায়ের চপ্পলের মতই ক্ষয়ে যাচ্ছে রঙের জগত , যেন আমর জন্ম হয়নি কোনদিন নদীর কূলে , যেমন জীবনে কোন ফসলের মাঠ ছিল না কারুর , যেন হাওয়া দেয়নি আমাদের বাউলের সুর ...
ক্রমশ ডুবে যাচ্ছি , পাক্কা কর্দমে কে যেন পা টেনে নিচ্ছে , আমি প্রাণপণ চিৎকার করছি ইসমাইল দেবাশিস বিক্রম তোরা কোথায় ???? বাঁচা বাঁচা --- আমি মরতে চাইনা 

ঝর্ণা কে তেমনটি মনে পড়ে না আর এখন । সাইকেলের প্যাডেলে পা , জোরে আরও জোরে পা প্যাডেলে পা ... ১০টা ৪৫ এর ইকোনমিক্স ক্লাস ডাকছে সাইকেলের টায়ারকে , ছুটছি ছুটছি ... পাশকেটে তীব্র ছুটে যাচ্ছে ঢাউস পৃথিবী , ছুটে যাচ্ছে পৃথিবী নামক রঙের যাদুকর ।
একুরিয়াম , জল ও অক্সিজেন বলয়ের মধ্যে অযুত - নিযুত রঙ এর জাদুবাস্তব ধারণ করে সমস্ত সময়কে নিয়ে খেলছে মাছেরা , আসলে কি একুরিয়ামের মাছের কোন রঙ আছে জলের মিডিয়া ছাড়া ? মিডিয়া ছাড়া সমস্ত রঙই শাদা , মৃত মাছের মত ফ্যাকাসে কিংবা ! বিষাক্ত কিছু সাপের রঙ এমন উজ্জ্বল ও মনোহারিণী , তবুও তারা সচারচর বুকে উঠে আসে না , বুকে উঠে আসেনা কারণ সেই রঙে হত্যা লেগে থাকে , কোন মিডিয়া তাকে গ্রহণ করে না । রঙ আসলে একটাই , রঙ একটাই , শাদা ! একবার ছাদে সখে ধান চাষ করে দেখেছিলাম , বেশ ফলেছিল , সবুজ সবুজ পাতায় যখন বাসন্তীহাওয়া খেলে যেত , তখন রূপমহল মাঠের ধানের শোভাকে ধরতে চেয়েছিলাম ছাদে , কই সে হাওয়ার দিকে পাতা ঝুঁকে পড়ার আবেগ , কই সে পাতা কাঁপানো সুরে হাওয়ার গান ? কই সেই রঙের বেসাতি ? কই সেই গন্ধ , কই সেই রঙের প্রাচুর্য ? ছাদের ধান যেন নিঃস্ব , নিঃস্বঅন্ধকারে একা একা নিজেকে নিজেই দেখিয়ে নিচ্ছে তার মুগ্ধতা , আমি হাতরে হাতরে ও ধরতে পারছিনা সেই রূপমহল ধানের ক্ষেত । 

বিক্রম স্কুলে থাকতেই কালো মেয়ে নীলিমাকে ভালবেসে ফেলেছিল , যথেষ্টই রাজপুত্র দেখতে ছিল বিক্রম , আমরা পেছনে হাসতাম বিক্রমের রুচি দেখে , সেই বিক্রম একদিন নীলিমাকে বিয়ে ও করে ফেলল । রঙকে কি চোখে দেখা যায় ? ফুলফোটা কি চোখে দেখা যায় ? সকলের বুকের বা পাশে চমৎকার এক প্রান্তিক-শিল্পী বাস করেন । সেই শিল্পী রঙের প্রাচুর্য ঘোচাবেন না বলে প্রতিনিয়ত যা দেখে তার মেধাবী অন্তর তার থেকেই সৃষ্টি করেন তার ক্যানভাস , নিজস্ব ঢঙে আঁকতে থাকেন , চুপচাপ ... 
এক ঢাকি ভাই ঢাক বাঁজাতে আসতেন দুর্গা পূজায় । হাতে কাঠি পড়লে ঢাক বেজে উঠল ঈশ্বরী-লব্ধ মৈনাক সুরে , সুরের মূর্ছনায় মগ্ন হয়ে যেতেন বাচ্চা ঢাকি । প্রান্তিক গাঁয়ে তার ঘর , গায়ে গোমাংস বিদ্যা , মুখের কথায় অজ্ঞতা ঝরে পড়ে যখন-তখন । তার বাজনার দিকে অপলক চেয়ে থাকতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নামী গৃহিণী শিক্ষিকা । ঢাক ভাইয়া যখন সন্ধ্যারতির সুর তুলতেন প্রতিমার সামনে তখন পৃথিবীর সমস্ত আনন্দমুখর রঙ নেমে আসত তার ঢাকের বাজনায় , শিক্ষিকা নিজের আত্মাকে সমর্পণ করে দিতেন ঢাকির কাছে , তার স্বত্বা , তার অস্তিত্ব , তার ক্রিয়াচল ঢাকির রঙের সঙ্গে কীভাবে হারিয়ে যেত নিজে ও বুঝতে পারতেন না , ভুলে যেতেন সমাজ সংস্কার তার বৈবাহিক পরিচয় স্ট্যাটাস । একদিন অন্তরের সব রঙ ঢাকির পায়ের কাছে দিয়ে বলেছিলেন--- ঢাকি আমায় নিয়ে চলো তোমার সাথে ...
রঙের এই বৈভব আমরা খালি চোখে দেখতে পায় না বলেই চারিদিকে রঙের এত অপচয় ঠেকাতে পারিনা , এইসব রঙ দৃশ্যগত নয় বলেই মন যাকে ভালবাসে সে যে সবসময় সময়ের উপযুক্ত হবে পাত্র \ পাত্রী হবেন হলফ করে বলা যায় না ।

রঙ সর্বদা থেকেই যায় সূর্যের অভ্যন্তরে , রঙ থেকেই যায় হাজার রঙের ভিড়ে । রঙ আবিষ্কার করে নিতে হয় , রঙ আসলে একটা গোলকধাঁধা , রঙ আসলে হাজারদুয়ারি । ঝর্ণার রঙ ছিল সেকথা স্কুল লাইফের ছেলেটি বুঝেছিল । কদম ফুল দিয়ে যেদিন বলেছিল-- -'' ঝর্ণা ভালবাসি তোমায় '' , সেদিন রঙ খুলে দিয়েছিল তার সমস্ত পাপড়ি । অথচ এই ঝর্ণা একদিন আবিষ্কার করলো যে ছেলেটি ঠিকঠাক তার মিডিয়া হতে হতে পারছে না , তার রঙ ঠিকমত খেলছে না ছিলেটির কাছে , একদিন ঝর্ণা অন্য মিডিয়ার রঙে স্নান করতে গেল দেখে ছেলেটি ঝর্ণা রঙের অপ্রাচুর্য ঘোচাতে হাতে কলম ও খাতা নিয়ে যেই না বসলো শব্দেরা পেয়ে গেল মিডিয়া । 

শব্দে - শব্দে খাতায় খেলে গেল একসমুদ্র রঙ । রঙের মহিমায় ছেলেটি বুঝতে পারল একটা রঙ হারানো জীবনে বড় কিছু নয় , একটা রঙ হারিয়ে যাওয়া মানে হাজার রঙের খুলে যাওয়া চিচিংফাঁক যেখানে মণি মুক্তোর অজস্র রঙের সাম্রাজ্যে রয়েছে উপেক্ষায় । 
ঠাঠা রোদে রিকশা চালক ভাইটি , ঠাঠা রোদে কুলিমজুর রাজমিস্ত্রির জোগাড়ে ভাইটি রোদের উপত্যকায় যে সভ্যতার রঙটি বপন করেন , কিন্তু সভ্যতার রঙটি তার বুক ধারণ করে না । তার বুকে তখন লেগে থাকে ছোট্ট একটা ঘর , কালো বউ , শিকনি বেরনো সন্তান আধো দাঁতে যেন তাঁকে ডাকছে -- ''বাবা পুতুল নিয়ে আব্বি তুই '' , ---- আর বাবা ইট মাথায় নিয়ে বাড়িতে ফেলে আসা রঙের কথা ভেবে যেই ফিক করে হেসে উঠলেন , সেই মুহূর্তে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ রঙশিল্পী হয়ে উঠলেন তিনি , যেহেতু এই সংবাদ আমার আত্মা পর্যন্ত সঙ্গ দেবে না , সেহেতু আমি দেখব ভ্যান চালকের পা প্যাডেলে আর গা থেকে দরদর ঘাম ঝরছে ---

পাথর করে রেখেছি চোখ । যুদ্ধ শুরু হয়েছে , কুরুক্ষেত্র প্রস্তুত ভাইয়ের রক্তরঙে রাঙিয়ে নিতে ভাই । অর্জুনের সামনে ছোটবেলার স্মৃতিমেদুর রঙ নিয়ে দুর্যোধন , পিতৃতুল্য স্নেহরঙ নিয়ে প্রপিতামহ ভীষ্ম , অস্ত্রশিক্ষা রঙ নিয়ে দ্রোণাচার্য , আরও আরও স্মৃতিভস্ম রঙ মেখে গাণ্ডীবের সামনে দাঁড়িয়েছে সম্পর্কের রঙ , অর্জুনের হাত কাঁপছে , চোখ বর্ণান্ধ হয়ে উঠছে , এসমস্ত রঙ খুন করে কোন রঙ অর্জন করব পার্থ ? 
পার্থ , আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না কেন ? চারিদিকে এত অন্ধরঙ , বল প্রিয় , গাণ্ডীব চালাবো কোথায় ? 
পার্থ ঠোঁটের কোণে মৃদু হেসে বললেন - কোন রঙ নিয়ে এসেছিলে তুমি অর্জুন ? কোন রঙ এর শোভা দেখাচ্ছ আমায় ? পৃথিবীতে কোন রঙ নেই যা তোমার অন্তরের চেয়ে উজ্জল তৃতীয় পাণ্ডব , চোখের সামনে যে রঙ দেখছ সব মিথ্যা , যে রঙ বাস্তবে নেই তাকে দেখবে কি করে ? রঙ যে তোমার বুকে , নিয়ত সেখানে তৈরি হয় একটা রঙ ভেঙ্গে আর একটা রঙ , আজ যে স্ত্রীরঙ ভাসিয়ে দিচ্ছে তোমার হৃদয় , কালকে তার অবর্তমানে কি গাছে ফুটবে না রঙিন কোন ফুল ? তুমি কি দেখবে না ফুলের রঙ ? অস্ত্র ধরো , একটা রঙের অপচয় ঘুচিয়ে নিয়ে এসো আর একটা রঙের জগত ।

আমাদের মন স্মরণাতীত থেকে কিছু নিয়ে আসেনি , যা অর্জন করেছি , যা উপভোগ করেছি তার অস্তিত্ববাদী অভিভাবক আমরা নিজেই । সময় ও রঙের বহুমুখীতার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটা থেকে আর একটা মুহূর্তের মধ্যে পদার্পণ ও স্থিতিশীল অবস্থান বাঁচিয়ে রাখতে গিয়ে ভুলে গিয়েছিলাম আমার গায়ের রঙ ঠিকটি তোমার মতই । বরফের দেশের কোন চামড়া আর নিরক্ষীয় চামড়ায় যখন কোন প্রেয়সী হামলে পড়ে চুমু খায় , বুঝি রঙ আসলে একটা কল্পগত মনের অবস্থান , স্থান কাল পাত্র ভেদে রূপক পৃথিবীর মতই রঙের এই যে বিবর্তন তাকে নাম দিই আমি লায়লা ও মজনু । রঙে থেকে সরে থাকা যায় না , যেমন নিজের আত্মা নিজের ভস্ম বয়ে নিয়ে চলে আমৃত্যু । রঙের নিদিষ্ট কোন উৎপাদন মাত্রা নেই তাইতো রঙের বিনাশ নেই ।
দেবদেবীগণ অনন্তকাল ধরে রেখেছেন অপার বিস্ময়ের এক অপূর্ব রঙের জগত , সেখানে কান্না নদীরঙ হয়ে যায় , আনন্দ হাসনুহানারঙ নিয়ে ফুটে থাকে মন্দিরে মন্দিরে বুকের উপাসনা গৃহে । এই নিষাদ পুরুষকে রঙের বিস্মিত জগত বাউল করে তোলে সর্ষের খেতে মৌমাছির অবগাহনে , আমের মুকুল আর নদীর চরে বেড়ে চলা পরগাছার সবুজ পাতা মোহযুক্ত গ্রামবাংলা সাজিয়ে রাখে যখন চরাচরে , তখন ভুলে যায় সকালে বাজারের থলি হাতে গণিত পৃথিবীবক্ষে নামতে হবে খুচরো নিয়ে , উপার্জন আর সংগ্রামের বশীকরণ আমাকে খাদের কিনারে দাড় করিয়ে দিলে বুঝি-

দুঃখ কষ্ট একটা সীমা পর্যন্ত সঙ্গ দিতে পারে , তারপরে পড়ে থাকে আদর্শগত অদ্ভুত রঙের জগত

২টি মন্তব্য:

Featured post

সোনালী মিত্র