শব্দটাকে
ছুঁতেও ভয় করছিলো! কী অর্থ ওর? ‘অলৌকিকতার
কাছে সবার আকৃতি ঝরে যায়,’ লিখেছিলেন শক্তি; চতুর্দশপদী কবিতাবলী-র ৩৭ নম্বর সনেটে। সে অলৌকিকতা কী বস্তু? যার সামনে আমাদের সবার চেনা পোষাক গলে’ যায় বা খসে
পড়ে? হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় অলৌকিক বলতে যা বোঝান তাতো এ নয়?
তাঁর অভিধানে তো এর মানে— ‘১ লৌকিকভিন্ন,
লোকে অবিদিত, লোকাতীত, লোকোত্তর,
অমানুষিক [যেমন ‘ইষ্টপ্রাপ্তানিষ্টপরিহারয়োরলৌকিকমুপায়ঃ
যো গ্রন্থো ন বেদয়তি স বেদঃ’— অর্থাৎ সে গ্রন্থ ইষ্টকে পেতে
আর অনিষ্টকে পরিহার করতে অলৌকিক পথের কথা বলেনা সে গ্রন্থই বেদ]। ২ অপার্থিব,
স্বর্গীয়, দিব্য। ৩ অসামান্য, অসাধারণ, বিরল। ৪ বেদে প্রচলিত, সংস্কৃতে অপ্রচলিত; বেদনিষ্ঠিক, বৈদিক। ৫ সংস্কৃতে বিরলপ্রচার বা সমুল্লিলেখ। ৬ (বাঙলায়; অপভ্রংশ) লোক বিগর্হিত অপরাধ; গুরুতর দোষ।’ জ্ঞানেন্দ্রমোহনের অভিধানেও অলৌকিকের এমতই অর্থ। শব্দটির প্রথমার্থে
অলৌকিককে ভুরিভুরি উদাহরণে কবিত্বশক্তি, রূপলাবণ্য ইত্যাদির
বিশেষণ হিসেবে দেখেছেন হরিচরণ। দ্বিতীয়ার্থে যেমন, ‘তোমার
উপদেষ্টা অলৌকিক ব্যক্তি’, বঙ্কিম থেকে। বাকিগুলোর অর্থ
এতদূরের যে তাদের কথা আসছেই না!
আসলে
এককালে আগেকার বাংলায় যে ব্যাপারটিকে ‘অতিলৌকিক’
বলা হতো, তাই হয়তো এখন আধুনিক বাংলায় অলৌকিক।
হরিচরণে শব্দটি অন্তর্ভুক্ত হয়নি। কিন্তু জ্ঞানেন্দ্রমোহনে শব্দটি অলৌকিকের সঙ্গেই
শেষে আছে। তার অর্থ এরকম—‘যা লোকচরিত্র বা মনুষ্যচরিত্র
অতিক্রম করিয়াছে এমন; যা লোকশক্তির অতীত এবং মানববুদ্ধির
অগম্য। অলোক-সাধারণ, অলোকসামান্য, অসাধারণ
ও অসামান্য। তার থেকে অতিলৌকিকতার দুটি অর্থ — ১ লোকাতীতের
ভাব; চমৎকারজনকতা। ২ লোকব্যবহারে অনভিজ্ঞতা, লোকব্যবহারে অনাদর। পরিষ্কার বোঝা যায় অতিলৌকিকতারও প্রথমার্থই মায়াজমের
এই সংখ্যার পরমার্থ। দ্বিতীয়ার্থ থেকেই আমরা পাই লৌকিকতা, বঙ্গদেশের
বহু স্থানে যার চলিত নাম ‘নৌকতা’।
তো
অতিলৌকিকতার অর্থে যে অলৌকিকতা আমাদের আলোচনায় উপজীব্য, তাকেও আমরা বহু অর্থেই নিই! শব্দের ব্যক্ত্যর্থ ও জাত্যর্থ
বুঝে নিতে তাকে অনুবাদ করার ব্যারাম এক অতিপ্রচলিত প্রথা শিক্ষিত বাঙালিদের মধ্যে।
সংসদ Bengali English Dictionary-তে অলৌকিক-এর ইংরিজি পাঁচটি—
‘Superhuman; not possible or available in the world; extra-mundane; unworldly;
supernatural’। এর দ্বিতীয়ার্থ, ত্রিতীয়ার্থ আর
পঞ্চমার্থ আমাদের কাজে আসে। Everyman’s Dictionary English-Bengali, যেটি এ মুহূর্তে ইঙ্গবঙ্গ অভিধানগুলির মধ্যে মোটামুটি ভালো, সেখানে অন্ততঃ দুটি শব্দ আমাদের অতিলৌকিকতার অর্থে যে অলৌকিকতার সঙ্গে
যুক্ত। একটি হোলো miraculous (অভিধানে অলৌকিক; প্রকৃতির নিয়ম বহির্ভূত, অপ্রাকৃত; অবাক-করা, আশ্চর্যজনক, অত্যাশ্চর্য,
বিস্ময়কর)। আর অন্যটি হোলো supernatural (অভিধানে
স্বাভাবিকোত্তর, অতিপ্রাকৃত)।
অভিধান
নিয়ে শব্দ চালাচালি করতে করতে ইতিমধ্যে আমরা অলৌকিকের বেশ কয়েকটি বাংলা প্রতিশব্দ
পেয়ে গেলাম, তাই না? ‘অতিপ্রাকৃতের প্রকৃতির নিয়ম বহির্ভূত, অপ্রাকৃত;
অবাক-করা, আশ্চর্যজনক, অত্যাশ্চর্য,
বিস্ময়কর; স্বাভাবিকোত্তর, অতিপ্রাকৃত। এদের সব কটিই আমাদের কাজে লেগে যেতে পারে। এমনকি আমরা এর
মধ্যে এনে দিতে পারি অতিরিন্দ্রিয়বাদ, এমনকি অতিরিন্দ্রিয়ী
প্রত্যক্ষ, যা ‘extrasensory perception’ নামে এককালে বেশ বাজার গরম করেছিল। জাতিস্মর-টাতিস্মর নিয়ে। তা মিঃ টম-ডিক
থেকে এই খগেনবাবু-নগেনবাবু অনেকেই অলৌকিক বলতে বোঝেন ভূত, যা
ভূতকাল থেকে আজকাল সমান বাজার রেখেছে। ত্রৈলোক্যবাবুর ‘লুল্লু’
যার পছন্দ হয়না, সে চলে যায় সত্যজিৎ রায়ের ‘খগমে’। হুমায়ূন আহমেদ তো তাঁর ‘ভূতসমগ্র’-র ভূমিকায় ‘অতিপ্রাকৃত
বিষয়ের প্রতি আমার আগ্রহ প্রবল’, ‘জগতের রহস্যময়তা আমাকে
প্রবলভাবে আকর্ষণ করে’ ইত্যাকার অনেক কথা বলে’ ভালো গৌরচন্দ্রিকা জুড়েছেন। জুড়বেন নাই বা কেন? ইলু-বিলু-নীলুদের
উচ্চমধ্যবিত্ত প্রেমের গল্প যদি গল্পের বাজার জুড়ে নেওয়ার পর, তাদেরই কারুর কারুর (যেমন ‘নি’-র রূপা, ‘বৃহন্নলা’-র বিন্তি,
‘ভয়ঙ্কর ভুতুড়ে’-র মিলি ইত্যাদিকে অলৌকিকতায়
স্থাপনা করে’ সমান বাজার পান তবে ভূতগ্রস্ত হবেন না কেন?
যেকালে শিক্ষিত বাঙালি ও তাদের সন্তানরা ‘খগমে’
কফিনে রাখা পুতুলের বয়োবৃদ্ধি আকারবৃদ্ধি দেখে’, ‘সোনার কেল্লা’-য় জাতিস্মরতার বাড় বাড়ন্ত দেখে এত
আপ্লুত হয়েছে! ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালি আবার গিল কেনানের ‘পোল্টারগাইস্ট’
বা উইলিয়াম ফ্রিডকিনের ‘ইক্জরসিস্ট' দেখে ভূতাবেগে হাবুডুবু খেয়েছে। অতিপ্রাকৃতের প্রতি মানুষের তীব্র
আকর্ষণকে নিয়ে ভীষণ রকম করে’ খাচ্ছে বাংলা খবরের কাগজের দুনং
পাতা আর বিবিধ ফরচুন চ্যানেল। আমি বাংলার কথাই বলছি। বাঙালিই পড়ে না, কোন অবাঙালি পড়বে আমার এই পোস্ট? পড়লেও সেখানে এই
কথাগুলো হয়তো দুগুণো, তিনগুণো প্রযোজ্য হবে। কিন্তু,হয়তো সবক্ষেত্রেই, জনপ্রিয় চলচ্চিত্রনাম থেকে ধার
করে’ বলা যায় ‘ভূতের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল’।
তো নাকি
তবু! অতিপ্রাকৃতকে বা অতিলৌকিকতাকে পুরোপুরি ভূতগ্রস্ত দেবার আগে ফিরে আসি শক্তির
শুরুর কথায়—‘অলৌকিকতার কাছে সবার আকৃতি
ঝরে যায়’। কী কথা, কোন অলৌকিকতার কথা
বলছেন এখানে শক্তি? আগে কবিতাটি দেখা যাক—
মহীনের
ঘোড়াগুলি মহীনের ঘরে ফেরে নাই
উহারা
জেব্রার পার্শ্বে চরিতেছে। বাইশ জেব্রায়,
ঘোড়াগুলি
অন্ধকার উতরোল সমুদ্রে দুলিছে
কালের
কাঁটার মতো, ওই ঘোড়াগুলি জেব্রাগুলি
অনন্ত
জ্যোৎস্নার মাঝে বশবর্তী ভূতের মতন
চড়িয়া
বেড়ায় ওরা-কথা কয়-কী কথা কে জানে?
মানুষের
কাছে ফিরিবে না এ কথা মনে হয়
আরো বহু
কথা মনে হয়, শুধু বলিতে পারি না।
বাইশটি
জেব্রা কি তবে জেব্রা নয়? ময়ূরপঙ্খীও
হতে পারে
এই ভৌত সামুদ্রিক জ্যোৎস্নার ভিতরে?
বামনের
বিষন্নতা বহে নেয় ও কি নারিকেল
ও কি
চলচ্ছবিগুলি লাফায়ে লাফায়ে যাবে চলে?
ও কী
মহীনের ঘোড়া? ও কি জেব্রা নয় আমাদের?
অলৌকিকতার
কাছে সবার আকৃতি ঝরে যায়।।
জীবনানন্দের
সাতটি তারার তিমির কাব্যগ্রন্থের ‘ঘোড়া’
নামের কবিতাটি থেকে প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত এই অসাধারণ এই অসাধারণ
সনেটটি। মূলটিতে জীবনানন্দ শুরু করেছিলেন এই কথা বলে’ ‘আমরা
যাইনি ম’রে আজো -তবু কেবলি দৃশ্যের জন্ম হয়’। ‘তবু’ অব্যয় দিয়ে জোড়া এই
দুর্বোধ বাক্য-পংক্তিটিতে জীবনানন্দ কী বলছেন- যৌক্তিকতা বা অতিযৌক্তিকতার চাপে ‘আমাদের’ মানে সাহিত্যভাষার দারিদ্র্য, যা তার ফলে যৌক্তিকতাসীমার বাইরে ‘দৃশ্যের জন্ম’-কে ব্যর্থ করে’ দেয়। ‘কার্তিকের
জ্যোৎস্নার প্রান্তরে’ চরা ‘মহীনের
ঘোড়াগুলি’ কি কবিতাপ্রতীক পেগাসাস? যারা
আমাদের অমর কবিচেতনার ‘এখানে ঘাসের লোভে চরে’? যার চাপে পৃথিবীকে ‘কিমাকার ডাইনামো’ মনে হয়, ‘চায়ের পেয়ালা ক’টা’-কে হঠাৎ দেখা যায় ‘বেড়ালছানার মতো -ঘুমো-ঘেয়ো’। আমাদের যৌক্তিকতার দীন ‘পাইস্- রেস্তরাঁতে’
একবার যদি ‘সময়ের প্রশান্তির ফুঁয়ে’ যদি ‘প্যারাফিন –লন্ঠন’
নিভে যায় তবে আমরাও ‘এইসব ঘোড়াদের
নিওলিথ-স্তব্ধতার জ্যোৎস্নাকে ছুঁয়ে’ নিতে পারি। অনেক পরে
শক্তিও কি তাই এক ইন্দ্রিয়াতীত, যৌক্তিকতা-অতীত কাব্যদৃষ্টির
কথা বলছেন না, বা অধ্যাপকী বাংলায় ‘আবাহন’
করছেন না? নইলে কেন আর্তনাদ করছেন, ‘মহীনের ঘোড়াগুলি মহীনের ঘরে ফেরে নাই/উহারা জেব্রার পার্শ্বে চরিতেছে’। Shamanism- তথা পিশাচসিদ্ধ তন্ত্রে জেব্রা ভারসাম্য
ও শান্তির প্রতীক। শক্তি কি যৌক্তিকতা ও অতিপ্রাকৃতের ভারসাম্যের সন্ধানে
পেগাসাসদের ভিড়িয়ে দিতে চাচ্ছেন জেব্রাদের কাছে? কারণ কি
তাঁর মনে হচ্ছে ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ সেই
শমনীয় জেব্রাদের কাছে চলে গেছে, যারা ‘ময়ূরপঙ্খীর’
নাব্যতায় ‘নারিকেল’ হয়ে’
যৌক্তিকতার ‘বামনের বিষন্নতা’-কে বয়ে নিতে পারে। তাই তারা ‘মহীনের ঘরে ফেরে নাই’।
এই
যৌক্তিকতানির্ভর কার্পণ্যের আভাস দিয়েছিল মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হলুদপোড়া’ গল্পের র্যা্শনালিস্ট ‘ধীরেন’, যখন সে হঠাৎ নিজের বাড়ির খিড়কি দুয়ার দিয়ে
ঢুকতে গিয়ে বোনের—নাম কি সুধা, মনে নেই—
পাতা বাঁশ পেরোতে পারছিল না। অলৌকিকতা, অতিলৌকিকতা,
অতিপ্রাকৃত থাকবে। যে সামূহিক অচেতনার (collective
unconscious) কথা তা-বড় সমাজতত্ত্ববিদ, মনস্তত্ত্ববিদ
বলে গিয়েছেন তারি চাপে থাকবে সে। কারণ Ernst Haeckel বলেছিলেন
‘Ontogeny recapitulates phylogeny’ অর্থাৎ একটি জীবসত্তা (ontogeny)
তার নিজের মধ্যে তার নিজের যাবৎ পূর্বপুরুষের বিবর্তনের সব কটি
অন্তর্বর্তী স্তরকে ধারণ করে। মাতৃগর্ভের ২৭০ দিনে। হেকেলতত্ত্ব বিবর্জিত। ‘তবু মন্ত্রে ভেড়া মরে কিনা’ এই প্রশ্নের উত্তরে ‘সঙ্গে একটু সেঁকোবিষ দিতে হয়’ এই ভলটেয়ারীয় ব্যঙ্গে
অতিলৌকিকতার আকর্ষণ মরবেনা। তবে সেটা আহমেদ সাহেবের গল্পের অতিলৌকিকতায় আবদ্ধ নয়।
কিন্তু
কী কথায় কী কথা চলে এলো! এতো শ্মশানে গোরু! মাপ করবেন সোনালি!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন