সহেলী রায় - মায়াজম

Breaking

৬ মে, ২০১৬

সহেলী রায়

                          বিবাহবার্ষিকী








“সময় আর অসময়ের মাঝে
 নীলচে আকাশ , আর নিচে
 ঝুলন্ত ব্রিজ আর আমি
 বন্দী ।
 দু'পা এগোলেই টোপা হাসির ঝর্ণা
 প্রশ্রয়ে প্রশ্ন করে কেমন আছ?
অসময়ের নিরালম্ব বেজে চলে ঘণ্টাধ্বনি
 পুরনো গির্জা থেকে ...
আমি কি একা ফিরে যাব?”

চারতলার ওপরে কটন মিলের কোয়ার্টার। সামনে গঙ্গা। এত হাওয়া জানলা খুলে রাখার উপায়ই নেই। ফাঁকা বোতল, ক্যালেন্ডার সব ওলটপালট।সন্ধেবেলা গঙ্গার পাড়ে ভালই লোকজনের যাতায়াত। মাধুরী জানলা বন্ধ করতে এসে খানিক্ষন দাঁড়াল। মৌলী পড়ছে আর ঢুলছে। অবশ্য মেয়েটার দোষ নেই, সেই ভোর চারটেয় দিন শুরু হয়েছে। শ্রীরামপুর থেকে কলকাতা, রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের অপজিটে স্কুল।যাতায়াতেই অর্ধেক দিন বেড়িয়ে যায়। রাতে বেশীক্ষণ পড়তে পারে না বলে ভোরে টানে। মাধুরী জানলা বন্ধ করে টিভিটা চালাল। দূরদর্শনে এক প্রবীণা লাইনগুলো আবৃত্তি করছেন। কি সাবলীল ভঙ্গিমা , কোন বাঁধা ছাড়াই এগিয়ে চলেছে আপন গতিতে। “আমি কি একা ফিরে যাব?” মাধুরী কেমন ডুবে গেল এই প্রশ্নে। এতটাই অতলে হাতড়াতে লাগল যে পরের লাইনগুলো ঠিক মত শোনাই হল না। পাশের কোয়ার্টারের জানলা দিয়ে মেট্রো চ্যানেলের হিন্দী সমাচার শুরুর সুর ভেসে আসতেই সম্বিৎ ফিরল মাধুরীর। একটু বিরক্তও লাগল। পাশের বাড়ির পাল পরিবার সারাদিন হিন্দী চ্যানেলে মগ্ন। তবু ভাল, এখন টিভি এসেছে ও বাড়িতে। আগে তো সন্ধে হলেই গোটা পরিবারের এ বাড়িতে সমাগম ঘটত। একে মৌলির পড়াশোনার দফারফা তার ওপর অতিথিদের পছন্দের অনুষ্ঠান পরিবেশন, মাধুরী নাজেহাল হয়ে যেত। এদিকে সন্ধে হলে তো অনিমেষের টিকি পাওয়া দুষ্কর। ৮.৪০ এ হিন্দী সমাচার শুরু হলে মেয়েটাকে খেতে দিতে হবে। অনিমেষের বাড়ি ঢোকার নামগন্ধ নেই। আজ আবার কোথায় ঠেক কে জানে। প্রতিটা সন্ধেয় নেশায় ডুবতেই হবে। তিনটে মানুষ নিয়ে মাধুরীর গোছানো সংসার। অনিমেষের কটন মিলের চাকরিতে ভালই আয়। কোয়ার্টারের প্রতিটা ঘরেই লক্ষ্মীশ্রী ভাব। অবশ্য পুরো ক্রেডিটটাই মাধুরীর একার। অনিমেষ বাউন্ডুলেপনা নিয়েই ব্যস্ত। নিজের কাজ, বইপড়া, সমাজসেবা আর নেশা। টাকাপয়সা লোকজনকে সাহায্য করতেই খরচ করে ফেলে। কার সাইকেল, কার মেয়ের বিয়ে সব একা যেন অনিমেষেরই দায়িত্ব। উনি ভগবানের দূত। তার সাথে নেশার খরচ। বিয়ের কয়েক বছরে মাধুরী এসব বুঝেই সর্বস্ব মাইনেটুকু নিজের কাছেই রাখে। দরকার মত অনিমেষ চেয়ে নেয়। তাছাড়া এ লক্ষ্মীশ্রী সম্ভব নয়। মৌলীর জন্য একটা ভাল স্কুল আর সংসারে একটা স্বচ্ছলভাব, আর কি চাই?
- কি এমন সুস্বাদু জিনিস যে তুমি ছাড়তে পারছ না?
- আঃ, চীৎকার কোর না, মৌ জেগে যাবে
 জড়ানো গলায় অনিমেষ বলল। বাথরুমের সামনে টলতে টলতে পৌঁছেও প্যান্টের জিপ না খুলেই পেচ্ছাপ করে ফেলল। মাধুরী ঠেলে বাথরুমে ঢুকিয়ে অনিমেষের মাথায় জল ঢালতে লাগল।কাঁদতে কাঁদতে বলল,
- আজই মেয়ের মাথা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা কর, ছাইভস্ম ছাড়বে
- আমায় তাড়াতাড়ি ঘরে নিয়ে চল, আঃ ঘুম পাচ্ছে

মশারির নীচে অঘোরে মৌলী ঘুমচ্ছে। অনিমেষ প্রায় ভিজে গায়েই নিজের বিছানায় শুল। মাধুরী যতটা পারল মোছালো। তারপর সারারাত প্রায় জেগে মৌলীর পাশে। তার সাজানো সংসারে এক টুকরো মন্দ বাতাস। মাধুরী একা ফিরে যাবে? চোখ দুটো ভিজে আসে। শেষ কোথায় কে জানে।

দিন তিনেক আগের ঘটনা। তারপর দুদিন অনিমেষ বাড়িতেই ছিল, বলেছিল খেলে বাড়িতে বসেই খাবে। এটুকু মাধুরীকে আলাউ করতেই হবে। নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল ভেবে মাধুরী নিমরাজি হয়েছিল যদিও জানত এ ব্যবস্থা বেশিদিনের নয়। এই সতের বছরের সংসারে এটুকু চেনা হয়ে গেছে অনিমেষকে। কিন্তু আজ কি হল? রাত বাড়ছে ক্রমশ। মেয়েটাকে খাইয়ে শুইয়ে দিয়েছে। নিজেও রেগেমেগে খেয়ে ফেলল ভাত চাট্টি। কার জন্যে অপেক্ষা? আর লাভই বা কি? নেশার ঘোরে তো কিছুই মুখে তুলবে না। কোনদিন কিছু অঘটন না ঘটে। অজানা চিন্তায় মাধুরীর বুক কেঁপে উঠল। রাত সাড়ে বারোটা। অনিমেষ মোটামুটি পৌনে বারোটার মধ্যে ঢোকে। আজ একটু বেশিই রাত হচ্ছে। জানলাটা খুলে আবার দাঁড়াল মাধুরী। লোকজন আগের চেয়ে কম। ফেরিঘাট অন্ধকার। লাস্ট ফেরি তো ১১টাই। মোটর বোটগুলো সারিবদ্ধভাবে ঘাটে বাঁধা। কোন কোন নৌকায় কুপির বাতি জ্বলছে। মাঝিদের বিশ্রামের সময়। অনিমেষ ওপারে যায়নি তো? বারবার ঘরবার আর অস্থিরতায় ভোর হল।

- মৌ ওঠ, বাবা সারারাত বাড়ি ফেরেনি

ধড়মড় করে উঠে বসে মৌ হতবাক।

- নে চল, দেখি কোথায় পড়ে আছে নাকি সব শেষ, কে জানে?
হাওয়াই চটিটা পায়ে গলিয়ে মা মেয়ে ফেরিঘাটের দিকে এগোল।
- অ বাবু উটুন, আপনার পরিবার এয়েচে, মাঠাকরুন স্বামীকে সামলাও, এক গলা মদ খেয়ে গঙ্গা হেঁটে পার হচ্চে, নেহাত আমি
গঙ্গার পাড়ে কাঁচাপাকা দাড়িওয়ালা মানুষটা পড়ে আছে নিস্তেজ হয়ে। ভিজে শার্টপ্যান্টে, গঙ্গামাটি শুকিয়ে কাঠ। মাধুরীকে দেখেই মাঝি চেঁচিয়ে উঠল।
রিক্সায় উঠে আঁচলের খুটে চোখ মুছল মাধুরী
- এর চেয়ে বিধবা হলেই ভাল
- (জড়ানো গলায়) কাল আমাদের বিয়ের তারিখ ছিল, তাই তাড়াহুড়ো করতে গেলাম, আর...
প্রথম খেয়া ঘাট ছাড়ছে। মাধুরী কোলে মৌলী, আরেকটা হাত অনিমেষের হাতে। সেরা মুহুর্তের স্বাদ মাধুরীর মুখে চোখে। এভাবেও একসাথে ফেরা যায়।

৩টি মন্তব্য:

Featured post

সোনালী মিত্র