রুখসানা কাজল - মায়াজম

Breaking

৬ মে, ২০১৬

রুখসানা কাজল

                                    বিহু








বাঁ  দিকের জানালা দিয়ে ওবায়েদ সাহেবকে দেখছিল বিহু। দারুণ লাগে ওবায়েদ আঙ্কলকে। কাঁচাপাকা চুল কি অনির্দেশ্য মিষ্টি হাসি। দাঁতগুলো অসাম। টোটাল সেক্সি প্যাকেজ। বিহু ভাবতেই পারে না কারো দাঁত এত ক্রেজি করে তুলতে পারে অন্য কাউকে । ওবায়েদ আংকেলের ভয়েস শুনলেই ও তাই এই জানালার পাশে পর্দার আড়ালে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। ঘিয়ে রঙের ফতুয়ায় নীল জিন্সের আংকেল মুখ তুলে গাছগুলো দেখছে। কেমন শিরশির করে উঠে ওর শরীর। ইচ্ছা করে ঘুঙুর বেঁধে ঝাঁপতালে অনেক্ষণ নাচতে। আর নাচ শেষে ঘামমাখা ক্লান্ত শরীর থেকে একে একে সব পোশাক খুলে দেওয়াল আয়নায় নিজের মুখোমুখি হয়ে ওবায়েদ আংকেলকে ভাবতে। কেমন কেঁপে কেঁপে উঠে শরীর। একেই বোধহয় বলে, আমার অঙ্গে অঙ্গে কে বাজায়, বাজায় বাঁশী----
পাকা উঠোনের পাশে মাটির আরেকটি উঠোন । সেখানে আম কলা নারকেল পেয়ারা সজনে পেঁপে জাম গাছ। ফল হয় কিন্তু পাড়া প্রতিবেশী কাউকে কোনদিন কিছু ছোঁয়ায় না ওবায়েদ আংকেল আন্টি । অনেকেই সমালোচনা করে আড়ালে, এই জন্যেই তো ওদের কোন সন্তান হয়নি । কি কিপ্টুস বাবারে বাবা!এটা শুনলে বিহুর খুব রাগ হয়। যেন কৃপণদের কখনো সন্তান হয় না! যাচ্ছেতাই মানুষজন। মা অবশ্য মাঝে মাঝেই বলে ঢাকা শহরের অভিজাত এলাকায় এমন দৃশ্য বিরল। কিছু না দিক অন্তত চোখের আরাম তো পাচ্ছি।
 গাছগুলো একবার দেখে আংকেল গাড়িতে উঠে পড়ে। আজ তো ছুটির দিন। কানাঘুষায় এটুকু জানা যায় ছুটির দিনগুলোতে আংকল যাত্রাবাড়ি না কোথায় যেন চলে যায়। সেখানে অন্য একজন আন্টি থাকে। একটি ছেলেও নাকি আছে। দুদিন থেকে আবার পুরানো বাড়ির পুরানো আন্টির কাছে ফিরে আসে। পুরানো আন্টি এই নিয়ে কোন ঝামেলা করে না। ঝগড়া বা চেঁচামেচি কিচ্ছু করে না। মা একবার গাড়ির দরোজা খুলে গল্প করেছিল পুরানো আন্টির সাথে । আঙ্কলের বিরাট লাল গাড়ি বিহুদের ছোট্ট সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়িকে আটকে দিয়েছিল বাসার সামনের ব্লাইণ্ড গলিতে। কি যেন হয়েছিল লাল গাড়ির। আঙ্কল মিস্ত্রী আনতে গেলে মা আর পুরানো আন্টি গল্প শুরু করছিল দুনিয়ার আজেবাজে সব বিষয় নিয়ে।
 বিহুকে দেখে কেমন অবাক হয়ে গেছিল পুরানো আন্টি। বার বার দেখছিল। মা বলেছিল, ভাবি আমার মেয়ে । এবার ক্লাস নাইনে উঠল।” পুরানো আন্টির মুখ কালো বোরকায় ঢাকা। কেবল চোখ দেখা যায়। কথাও বলেন ফ্যাসফ্যাসে ভয়েসে । সেই ত । সেই ত! কত ছোট ছিল। ওকে টাওয়েলে জড়িয়ে এই পাড়ায় এসেছিলেন। বড় হয়ে গেছে আপনার মেয়ে বলে আবার বিহুকে খুঁটিয়ে দেখে। তাড়াতাড়ি সালাম দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে চলে এসেছিল বিহু। বদলে গেছে আন্টি। হাতে মোজা পায়ে মোজা । সিনেমার দস্যুরাণীর মত লাগছে। মা কি করে চেনে বক্কা জানে।
 সেদিন আন্টির সাথে কথা বলে ঘরে ফিরে মুখচোখ কাঁদো কাঁদো করে মা বলেছিল, বুঝলি তো সব পুরুষের এক স্বভাব। তোর ড্যাডাও বিয়ে করে বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে সুখে আছে নিশ্চয়।” ফ্রিজ থেকে ললি আইসক্রিম বের করে সবে কামড় দিচ্ছিল বিহু। রাগী চোখে তাকায় ও। মা ঝাঁঝিয়ে উঠেছিল, লম্পটের লম্পট ।মাতাল, অশিক্ষিত। তুই তো তার মেয়ে ।তুই কি করে বুঝবি মানুষের মন ।বদমাশের বাচ্চা বদমাশ। আমার সব শেষ করে দিয়ে চলে গেছে। শয়তান শুয়োর একটা ।” মাকে শুনিয়ে শব্দ করে নিজের রুমের দরোজা বন্ধ করে দিয়েছিল বিহু।
 সত্যি আনবিলিভিয়েল ক্যারেক্টার এই মহিলার। বড় খালামনি যে বলে তোর মা একটা শিক্ষিত বোকচোদ কথাটি মিথ্যে নয়। এখনো অই এক পুরুষ নিয়ে খাবি খাচ্ছে। ড্যাডা ছাড়া মা আর কোন পুরুষের সাথে প্রেম করতে পারেনি। বিয়ের আগেও না। পরেও না। প্রচুর প্রেমপ্রার্থী মার। এই বয়সেও হেভি মাল। স্টাইলিশ । ফার্স্টক্লাস ব্রেস্ট, ঠোঁট । তীব্র আকর্ষণ শরীরে। কিন্তু তাতে কি! বিহু বুঝে গেছে মার ফিজিক্যাল আর্জ খুব কম। বেচারী! মাকাল নারী। সব প্রেম ভালবাসা আস্থা টাকা পয়সা ড্যাডাকে দিয়ে থুয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে। কেউ শরীরের কথা বলে এগুলেই মা তাকে ব্লক মেরে দেয় । বুঝতে চায় না প্রেমের মাস্টার কী হচ্ছে শরীর । প্রেমিক তো শরীর চাইবেই। শরীর আছে তো প্রেম আছে । প্রেম মানেই প্রেমিক !
বিহু বুঝেছিল মা এখন দুদিন গুম মেরে থাকবে। কথায় কথায় বিহুর সাথে ঝগড়া করবে। আর অই বদমাশ লোকটির সাথে বিহুর নানা সাদৃশ্য বের করে চেঁচামেচি করবে। অথচ ড্যাডা চলে যাওয়ার পর ওদের চুক্তি হয়েছিল অই লোকটির কথা কেউ কখনো উচ্চারণ করবে না। আইসক্রিমের লাঠিটা চুষতে চুষতে বিহু হিসেব করে , বড়রা বিশেষ করে বাবা মার মত বড়রা অসম্ভব ফাউল । যখন তখন প্রমিজ করে যখন তখন প্রমিজ ভাঙ্গা ভাতমাছ এদের কাছে। তখন দুনিয়ার সব আর্গুমেন্ট, কজ, এনভার্মেন্ট, এবিলিটির কোয়েশ্চেন টেনে আনে । এই যেমন সাদাত আংকেলের বেলায় হল।
 ড্যাডা সত্যি মাকে ঠকিয়েছে । চলে যাওয়ার আগে চাকরিও ছেড়ে দিয়েছিল । একটু একটু করে সরিয়ে নিচ্ছিল আলমিরাতে রাখা লাখ লাখ টাকা। ব্যাংকে রাখলে এতদিন ধরা খেয়ে যেত কোম্পানির কাছে। বিহুর মনে আছে যাওয়ার আগের রাতে একটি বাজারের ব্যাগে অনেকগুলো খালি মদের বোতল মেইন রাস্তার ডাস্টবিনে ফেলতে গেছিল ড্যাডা। সেই সুযোগে গোপন চাবি দিয়ে আলমিরা খুলে বিহু দেখে টাকার বান্ডিলগুলো নাই। তবে বিএফ এর ভিডিওগুলো আছে। এখান থেকে দু একটা সরিয়ে বিহু ওর বন্ধুদের নিয়ে ইশকুলে দেখে আবার রেখে দেয় । মা এগুলো জানেও না।ড্যাডাও বুঝতে পারে না। একটি ভিডিও নিয়ে দ্রুত আলমিরা লক করে বিহু পড়তে বসে গেছিল।
 পরিকল্পনা করেই চলে গেছে ড্যাডা। মার টাকা হাতিয়ে ফ্ল্যাট, জমি গোপনে নিজের নামে করে নিয়েছিল। জানতে পেরে মা চেপে ধরতেই নির্লজ্জের মত বলেছিল, আরে নমিনি তো তুমিই। আর কে আছে আমার তুমি আর বিহু ছাড়া। ফালতু চেঁচামেচি কর না ত।” মা কিন্তু ততদিনে বুঝে গেছে ভুল করেছে । লোকটা বদলে গেছে । অসম্ভব স্বার্থপর হয়ে উঠেছে । নিজের ছাড়া অন্যের কোন কিছু বোঝে না। মদ টদ খাওয়া মেয়েমানুষ নিয়ে ঘোরাকে মা অত পাত্তা দেয়নি। সৎ হিসেবে আগে কোম্পানিতে ড্যাডার প্রচুর সুনাম ছিল। কিন্তু অফিসেও ইদানীং টাকা পয়সা ঘুষ নিচ্ছিল। দু তিনবার কোম্পানির চেয়ারম্যান সতর্ক করেছে। ফোনের কথাবার্তায় মা বুঝে গেছিল যে কোন সময় হ্যান্ডকাপ পরতে পারে । এখানেই মার লেগেছিল। মার কাছে সন্মান অনেক বড় । না খেয়ে থাকতে রাজী মা কিন্তু সন্মান হারাতে মোটেই রাজী ছিল না। মা যুক্তি দিয়েছিল, আমাদের তো সব আছে, জমি, ফ্ল্যাট, নগদ টাকা, চাকরী তাহলে কেন অসৎ হলে? ড্যাডা তখন মরিয়া। মার মুখের সামনে মদের গ্লাস দুলিয়ে বলেছিল, আমার ইচ্ছা। মা শক্ত মুখে উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিল, মনে রেখো আমাদেরও কিন্তু ইচ্ছা আছে। ড্যাডা মার এই গলাকে ভীষণ ভয় পেত। কেমন ধাতব দৈব বাণীর মত কাট পালিশ ভয়েস। ইনফ্যাক্ট বিহুও ভয় খায় তবে সব সময় নয়!
বিহু বোঝে ড্যাডা মার কাছে সন্মান হারিয়ে এখানে আর থাকতে পারছিল না। তাছাড়া ড্যাডা টাকা দিয়ে আরো অনেক ইচ্ছা পূরণ করতে ক্রেজি হয়ে গেছিল। রোজ ঘরে ফিরে দুতিন বান্ডিল টাকা আলমারীর লকারে ঢুকিয়ে বসে পড়ত বোতল গ্লাস নিয়ে। বিহুর সাথেও কথা বলত না। বিহুর কি লাগবে, পড়াশুনা কি করছে কাদের সাথে মিশছে কিছু জানতে চাইত না। চলে যাওয়ার আগে একবার আহলাদ করে ড্যাডাকে ব্যাগ কেনার কথা বলতে গেছিল বিহু । প্রায় মারতে এসেছিল ড্যাডা । ঠিক সময়ে মা ড্যাডার হাত ধরে ফেলে আবার সেই গলায় বলেছিল, বিহু তোমার রুমে যাও। তারপর ডোর লক করে সে কি তুমুল ঝগড়া। ছিটকে আসা কিছু কথা শুনে অবাক হয়ে গেছিল বিহু। ড্যাডা মাকে সাবধান করছে, কিপ অয়ে ইওর ডটার আদারওয়াইজ আই রেপড হার মে এট এনি টাইম। মা ছি ছি করে বলেছিল, ইউ আর জাস্ট আ বিন । আই সোয়াপ ইউ।থু থু-- গেট আউট ফ্রম আওয়ার লাইফ।
 সেদিন থেকেই মার সাদাসিধে চেহারা শক্ত হয়ে উঠছিল। সংসারের কাজ করতে করতে বিহুকেও জুড়ে নিচ্ছিল সাথে । বিহু মার সাথে কাজ করতে করতে অবাক হচ্ছিল। ড্যাডা এত বদলে গেছে ? এরপর আর কোনদিন মা ঝগড়া করেনি । ড্যাডা চলে গেলে বন্ধুর মত হয়ে গেছিল মা মেয়ে। তবে প্রচুর রেজাল্ট খারাপ করছিল বিহু। মা শুধু বলেছিল, ক্লাস নাইন মানে তোমার জীবন তোমার বিহু । চেষ্টা কর। আমাদের মত নষ্ট মানুষদের জন্যে নিজের জীবন নষ্ট কর না । কিন্তু কিছুতেই বিহু পড়াশুনায় মন বসাতে পারছিল না। সেই সময়ে সাদাত আংকেল এসেছিল বাসায়।
 মার ছোটবেলার বন্ধু । প্রত্যাখ্যাত প্রেমিক। একেবারেই হঠাত। মা নিজেই অবাক হয়ে গেছিল। আর কি আশ্চর্য সাদাত আংকেল সব জেনে কেমন সহজভাবে সংসারের একজন হয়ে গেছিল। মা ঘোর আপত্তি করলেও বিহু চাইত সাদাত আংকেল আসুক। উনি এলেই ঘর ভরে যেত। দূর শহর থেকে মাসে একবার আসত। আর বিহুর এটাসেটার লিস্ট বেড়ে যেত । প্রথম দিকে মা কেমন আড়ষ্ট হয়ে থাকত । আস্তে আস্তে মার মুখ নরম হতে দেখেছিল বিহু। প্রেম না হোক নির্ভরতা পেয়েছিল মা। দুজনে স্মৃতি ঘেঁটে গল্প করত । হাসত। এবং আরো কাছাকাছি চলে এসেছিল ।

 বিহুর খারাপ লাগেনি। মাকে সাদাত আংকেলের সাথেই মানায় ভাল । মাঝে মাঝে হঠাত ভার্সিটি থেকে বাসায় ফিরে দেখত সাদাত আংকেল এসেছে। ওকে দেখে মার মুখে রক্ত খেলে যেত। কিছু না বোঝার ভান করে সহজ হয়ে গল্প করতে করতে ও খুঁজে দেখত মার শরীরে কথা ফোঁটার রুমঝুম। মা কি এখন প্রেম বোঝে ? বোঝে জীবনে কেবল একবার নয় বার বার প্রেম আসে । আসতেই পারে!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র