স্বপ্ননীল - মায়াজম

Breaking

৬ মে, ২০১৬

স্বপ্ননীল

                                                

ইন্টারিভিউ



“ পথে চলে যেতে যেতে কোথা কোনখানে
 তোমার পরশ আসে কখন, কে জানে ”
ফোনের রিং টোন টা বেজে উঠতেই ধরমরিয়ে উঠল অভিমান , রোববার এর অলস দুপুরে একটা লেখা নিয়ে বসেছিল ,সুরজিত দা বলেছিলেন কি হল জানাবেন , হ্যাঁ ঠিক সুরজিত দারই ফোন , ও উত্তেজিত হয়ে বলল বলুন দাদা নিতে পারলেন অ্যাপয়েন্টমেন্ট ?
খুব ছোটবেলায় বাবা মারা যায় অভিমানের। ওর মা একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে ওকে বড় করেছেন। ডাক্তার ,ইঞ্জিনীয়র নয়, চেয়েছিলেন ছেলেকে একটা ভাল মানুষ হিসাবে গড়ে তুলতে। খুব সাধ করে ছেলের নাম রেখেছিলেন “অভিমান”। অভিমানকে স্কুল , কলেজে , পাড়াতে সবাই খুব ভালবাসে। মিশুকে সদাহাস্যময় ছেলে হিসাবে অভিমানের খুব নাম-ডাক। লেখালেখির অভ্যাসও আছে ছোট থেকেই,স্কুল কলেজের ম্যাগাজিনের সম্পাদনাতে চিরকাল অভিমানের নাম থাকত।
 তাই বাংলাতে এম এ পাশ করার পরও খুব আগ্রহ নিয়ে জার্নালিজ্ম্ পড়তে শুরু করল । ছোটবেলা থেকেই ওর খুব প্যাশান সাংবাদিকতায় ,ভালভাবে পাশও করে গেল। এবার চাকরীর চেষ্টা। মা আর কত দিন টানবেন সংসার । কত বড় বড় জায়গাতে ইন্টারভিউ দিয়ে আসে কিন্তু কিছুই হয় না। অবশেষে এক স্নেহশীল দাদার পরিচিতির সূত্রে একটি সান্ধ্য পত্রিকার জুনিয়র জার্নালিস্ট হিসাবে জয়েন করল। ওর কাজ হল ফিচার বিভাগে বিভিন্ন সেলিব্রিটির ইন্টারভিউ জোগাড় করে আনা ।

খুব খুশী হল অভিমান এইরকম একটা কাজ পেয়ে। কিন্তু একটা কথা আছে না—“Man proposes god disposes” অনেক চেষ্টা করেও নামী কোন সেলিব্রিটির অ্যাপয়েন্টপমেন্ট জোগাড় করতে পারল না ।

এক মাস যায়, দুমাস যায় ছুটকো ছাটকা লেখালেখিতে এডিটরের মন ভরে না। অবশেষে একদিন এডিটর ওকে বলেই দিলেন—দেখো অভিমান এই মাসই শেষ যদি কোনো নামী কারও ইন্টারভিউ না আনতে পারো। দিশাহারা হয়ে ঘুরতে থাকল অভিমান। অবশেষে এক সিনিয়র দাদা সুরজিতের চেষ্টায় ও বিখ্যাত অভিনেত্রী লাবণ্য সরকারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেল ৩০মিনিটের জন্য । কিছুটা আনন্দ, কিছুটা টেনশনে রাতে ঘুমোতে পারে না অভিমান। সারা রাত ধরে ভাবনাগুলোকে গুছোতে থাকে, আগামীকাল লাবণ্য সরকারকে ঠিক কি কি প্রশ্ন করা যেতে পারে যা আগে কখনও - গতানুগতিক প্রশ্নের বাইরে নতুন কিছু প্রশ্ন ভাবার প্রাণপণ চেষ্টা করে , এইভাবেই রাত ভোর হয়ে যায়। কিন্তু কি প্রশ্ন করা যেতে পারে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না। তারপর ভাবতে থাকে-- ঠিক আছে, সময় তো আসুক তখন না হয় আগে থেকে ভাবলেই বরং সব গুলিয়ে যেতে পারে ।
 ওর সবচেয়ে প্রিয় নীল শার্টটা পরে, প্রিয় বডি স্প্রে গায়ে ছড়িয়ে মাকে প্রণাম করে বেড়িয়ে পড়ে লাবণ্য সরকারের বাড়ির উদ্দেশ্যে। ঠিক সময়ের আগেই পৌঁছে যায় ওখানে , কারণ ওদের তো আবার সাঙ্ঘাতিক এক অ্যালার্জি থাকে টাইমিং নিয়ে ,সময়ের ব্যাপারে জ্ঞান খুব টনটনে। দেরী হলে আবার যদি অ্যাপয়েন্টমেন্টই ক্যান্সেল করে দেন উনি ।
 বিশাল ড্রয়িং রুমে বসে ঘামতে থাকে অভিমান , মনেমনে বেশ স্মার্ট ভাবতে থাকে নিজেকে। কিন্তু তখনও ভেবে উঠতে পারে না ঠিক কি প্রশ্ন দিয়ে শুরু করা যেতে পারে। সুরজিৎদা ওকে অনেক করে শিখিয়েও দিয়েছিল কি কি প্রশ্ন করতে হবে , কিন্তু ওর সবই কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যেতে থাকল ।
 অবশেষে সব প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে শ্রীমতী সরকার এসে বসলেন সামনে। অভিমান অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখল—এঁকেই কি আমরা টিভির পর্দায় দেখি ! ঠিক মার মত করে আটপৌরে শাড়ি পড়া , চুলটা খোলা ! কিছুতেই কিছু মেলাতে পারল না ও……
ওর এই অবস্থাটা বুঝতে দেরী হল না লাবণ্য দেবীর। ওকে একটু স্বাভাবিক করার জন্য নিজেই বললেন—তুমি অনেক ছোট, তাই তোমাকে তুমি করেই বলি। বলো, কি জানতে চাও ?
অভিমান একটু ধীরে বলল—আপনার সম্পর্কে তো কিছুই অজানা নেই আমাদের , আপনি কি খান, কি পড়েন, কার সঙ্গে কোথায় বেড়াতে যান, ছবি পিছু কত টাকা পারিশ্রমিক পান, বাংলার ঘরে ঘরে এ তথ্য সবার মুখস্ত। এমন কিছু বলুন না যা কেউ জানে না আগে কাউকে বলেন নি ।

আপনাকে সত্যি কথাই বলি—এই ইন্টারভিউর উপর আমার চাকরী নির্ভর করছে। একটা ভাল ইন্টারভিউ নিয়ে যেতে না পারলে হয়তো এমাসেই আমার চাকরী শেষ , এডিটর সেরকমই বলেছেন ।
 অভিমান আরও কিছু বলতে চলেছিল কিন্তু শ্রীমতী সরকার ওকে থামিয়ে দিলেন—তোমার হাতে সময় আছে??
অভিমান লাফিয়ে ওঠে—হ্যাঁ হ্যাঁ, আমার কোন তাড়া নেই……
তাহলে তুমি একটু বোসো, ভেতরে আমার হেয়ার ড্রেসার বসে আছেন , আমি একটু কাজ সেরে আসি। তারপর তোমাকে এমন কিছু শোনাবো যা এর আগে কোনদিন কাউকে … বুঝলে…… তুমি কি চা-কফি কিছু খাবে?
না, মানে, একটু জল.
ওকে, তুমি বোসো আমি চা জল পাঠিয়ে দিচ্ছি । এই বলে উনি ভেতরে চলে গেলেন .অভিমান বসে বসে ভাবতে লাগল এইবার বোধহয় ওর কপালে শিকে ছিঁড়ল, এতো দিনে। সকালে মাকে বলে এসেছে কাল ওর একটা লেখা বেরোবে , মা গোপাল ঠাকুরের কাছে মানত করেছে। এইসব নানা ভাবনার মাঝে ও ভাবতে লাগল, ছোট বলে কি ওর সাথে উনি মজা করলেন ! না না, দেখে তো বেশ অমায়িকই মনে হল ।

সোফার পাশে একটা টেবিলে খানকয়েক খবরের কাগজ রাখা সেখান থেকে একটা তুলতে গিয়ে চোখে পড়ল একটা খোলা ডায়েরী উল্টে রাখা । খুব কৌতূহল হল ওর ডায়েরীটা দেখার যদি কোন না জানা তথ্য পাওয়া যায়! এদিক ওদিক দেখে ডায়েরীটা তুলেই নিল। যে পাতাটা খোলা ছিল সেখান থেকেই ও পড়তে শুরু করল……

কিছুক্ষণ পড়ার পর ও রীতিমত ঘামতে শুরু করল এসব কি লেখা ডায়েরীতে…! কি লিখেছেন শ্রীমতী সরকার ,উনি লাস্ট তিন বছর ধরে ক্যান্সার পেশেন্ট , কেউ জানে না সেকথা ! অভিমান গোগ্রাসে গিলতে থাকল ডায়েরীটা। যদি আরও কিছু ইনফর্মেশন পাওয়া যায় কাল এই নিউজটা যদি ওদের পেপারই ফার্স্ট দিতে পারে তাহলে ওর চাকরীটা কনফার্ম হয়ে যাবে !একদম ব্রেকিং নিউজ - মনেমনে ও অনেককিছুই ভেবে ফেলল। কলকাতার সব বড় বড় এডিটররা অবাক হবেন ভেবে ওর মত একটা সাধারণ ছেলে কি করে এমন একটা খবর জোগাড় করল। সুরজিৎদাও খুব খুশি হবে। এরকম নানা চিন্তার মধ্যেই ও ডায়েরীটা পড়তে থাকল তবে কি শ্রীমতী সরকার এই কথাটাই ওকে শোনাবে বলেছিলেন !

ঘামতেই থাকে অভিমান কি করবে এখন ভেবে পায় না। এটাই তো একটা বিরাট খবর ! এইসময় শ্রীমতী সরকারের পায়ের আওয়াজ পেতেই ডায়েরীটা রেখে দিয়ে উঠে দাঁড়াল
 সরি, তোমাকে অনেক্ষণ বসিয়ে রাখলাম ।

অভিমান তাড়াতাড়ি কয়েকটা ফর্মাল প্রশ্ন করে বলল—আচ্ছা আমি একটা লেখা মনে মনে ভেবেছি আপনাকে নিয়ে ,সেটা লিখে এনে যদি দেখাই ,আপনি যদি আর এক দিন সময় দেন প্লিজ । লাবণ্য একটু অবাক হলেন—আমার না বলা গল্পটা শুনে যাবে না ! সেটা না হয় কাল আপনাকে আমি দেখিয়ে নিয়ে যাব ,তার মানে তুমি জান আমার না বলা গল্প !
অভিমান বলে ওঠে—মনে হয় কিছু কিছু জানি

লাবণ্য বললেন—ইন্টারেস্টিং বেশ , তুমি তবে কাল না পরশু এসে আমাকে দেখিয়ে যেও কি লিখলে , ছাপতে দেওয়ার আগে ।

থ্যাংক্স জানিয়ে অভিমান চলে গেল। সারা রাত জেগে সুন্দর একটা ফিচার লিখে ফেলল । মা কে ডেকে লেখা টা শোনাতেই মা বলল তুই কি করে জানলি এই খবর টা ?উনি নিজেই বললেন তোকে ? তখন অভিমান মা কে ডাইরির গল্প টা বলল , ওর মা একবার ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিঃ বলে উঠে চলে গেলেন । ওর মা কে ও চেনে ছোট বেলা থেকে । না বলে অন্যের ডাইরি পড়ার মত অপরাধ মা কিছুতেই সমর্থন করবে না । পরে মা কে বুঝিয়ে ম্যনেজ করে নেবে ঠিক ।আবার মনে মনে ভয় ও পেল যদি ডাইরি পড়ার অপরাধে উনি ইন্টারভিউ টাই কান্সেল করে দেন , না কাজ টা ঠিক হয় নি ।

একদিন বাদে এল আবার ও শ্রীমতী সরকারের বাড়ী । লাবণ্য দেবী খুব আগ্রহ সহকারে লেখাটা পড়লেন। তারপর কিছুক্ষণ একটু গম্ভীর হয়ে থেকেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন , হো হো করে হাসতেই থাকলেন। অভিমান কিছু বুঝতে না পেরে বড্ড অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল ।
 ওর এই অবস্থা দেখে লাবণ্য বললেন—আসলে, ঐ ডায়েরীটা আমার এক খুব প্রিয় বান্ধবীর ও আমাকে পড়তে দিয়েছিল। আর তুমি ভাবলে আমি? সাংবাদিক রা এত বোকা হয় নাকি , এই বলে উনি আবার হেসে উঠলেন……
অভিমান যেন এক মূহুর্তেই ফিউজ হয়ে গেল। একটু আমতা আমতা করে বলল—তাহলে, আপনার না বলা গল্পটা…?


লাবণ্য বললেন—বোসো, ভেতরে আমার হেয়ার ড্রেসার অপেক্ষা করে আছেন ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র