অনীক রুদ্র - মায়াজম

Breaking

২৪ জানু, ২০১৬

অনীক রুদ্র

                               সাক্ষাৎকারঃ কবি-  অনীক রুদ্র







মায়াজমঃ
      কবিতা লেখেন কেন ?  কোনদিন ভেবেছেন  কেন লিখছেন , কী কারণে লিখছেন ? আজকে কবিতার সামনে দাঁড়িয়ে মনে হয়েছে কি কবিতা আসলে নিজের জন্যই লেখা হয় ! তারপরে কবি আর দায়ী থাকে না সময়ের কাছে ? আপনার মতামত কি এ-বিষয়ে ?
অনীক রুদ্রঃ
        আকৈশোর  আমি কবিতার সঙ্গেই বেড়ে উঠেছি।বাড়িতে পিতৃসূত্রে দেশ -বিদেশের কবিতা ,শুধু কবিতাই কেন উল্লেখযোগ্য শিল্পকাণ্ডের  সাথে পরিচিত হয়েছি।ভালোলাগা -খারাপলাগা থেকেই নিজের চেতনা চিন্তন প্রণালীর মধ্যে অনুরণন জাগত ,  তাকেই ভাষায় সংহত ভাবে রূপদানের চেষ্টা করেছি বা আজো করে চলেছি।বহমান চিন্তা স্রোত ,পারিপার্শ্বিক সমাজ -রাজনৈতিক ঘটনাবলী মান অভিমান মানুষের সঙ্গে ঘটে চলা মিথক্রিয়া তাকে প্রবাহিত করে নিশ্চিত। কিন্তু কবিতা লিখে বড় বিপ্লব গোছের কিছু হবে তেমনটা কখনই ভাবিনি।এক কথায় বলতে পারি নিজের কাছে পরিষ্কার ও সৎ থাকার জন্য লিখি। আর সেগুলো আকৃতিগত বিচারে কবিতার শরীর গড়ে।সময় বা সময়োত্তর দিকে যাত্রার অভিলাষ নিশ্চয় আমারো আছে ,  কিন্তু ব্যক্তি আমি বিশ্বাস করি ইতিহাস ও ঐতিহাসিক বাদ দিয়ে বা আবিষ্কার করে কোন ধরনের সাহিত্য সৃষ্টি অসম্ভব।আরো বিশ্বাস করি কখনো বা নিজের জন্যই কবিতা লেখা হয় যদিও সেটা একশো ভাগ ঠিক নয়।

মায়াজমঃ
তথাকথিত সমজাতীয় কবিতা লেখা ছাড়া ও অন্যধারায় কবিতার ও একটা পথ আছে । আসলে পথ বোধয় তৈরি করে নিতে হয় । এতদিন ধরে  এভাবে এগিয়ে যেতে যেতে কী ভেবেছেন সত্যিই কিছু করতে পেরেছেন  কবিতা নিয়ে ? আজ সময়ের আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজের লেখাকে কোন দৃষ্টিতে দেখেন আপনি ?

অনীক রুদ্রঃ
  কবিতা নিয়ে কিছু করতে পেরেছি কিনা সেটা আমি নয় আমার পাঠক বলবেন। যদি জানতে চাইতে কবিতা লিখে কিছু ধরা যায় কিনা তাহলে বলবো ,কিছু লিখতে পারলে বা গ্রহণযোগ্যতা পেলে কবির আনন্দ হয়।কিছু করার চাইতে ব্যক্তিআমার আনন্দভাব বা দুঃখ -বেদনা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।আর কেজো অর্থে যা দিয়ে কিছু করা বোঝায় ...যেমন বিষয় সম্পত্তি ,ধনদৌলত বাড়িয়ে তোলা ,আমরা যাদের মহান কবি বলে মান্য করি তারা সে অর্থে কিছুই করে উঠতে পারেন নি।কবিতা বোধহয় সবচেয়ে দুঃখী মানুষের ,কষ্টভোগ করা মানুষের ভাষাশিল্প।কবিকে সময়ের আয়নার কাছে মাঝে মধ্যেই দাঁড়াতে হয়।কবিতার থেকে আমি পলায়নবাদী নই।

মায়াজমঃ
   অনেকে বলেন কবিতার কোনও ব্যাখ্যা হয় না । কবিতা হল মনের মধ্যে অনবরত ঘটে চলা আণবিক বিস্ফোরণ । সেই বিস্ফোরণে সৃষ্টির মাত্রা যোগ হয় । তখন সেই সৃষ্টিকে শব্দের মাধ্যমে বাইরে প্রকাশ করি । সৃষ্টি মানে স্রষ্টার একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতি , একথা ঠিক ততক্ষণ যতক্ষণ সেটা বাইরে প্রকাশ হচ্ছে না । বাইরে প্রকাশ হলে কি স্রষ্টার কিছু দায় বর্তায় না ? দায় এড়িয়ে গেলে কি সৃষ্টি পূর্ণ মর্যাদা পায় ?

 অনীক রুদ্রঃ
   কবিতার ব্যাখ্যা লেখার দায় সাহিত্যের ছাত্রছাত্রীদের ও তার মাস্টারমশাইদের।আণবিক বিস্ফোরণের কারণ ও ব্যাখ্যা আমার বিজ্ঞান পড়া থেকে জানা আছে।সে রকম বিস্ফোরণে সৃষ্টি কম ,ধ্বংসলীলাই ঘটে।তবে মনোজাগতিক সংঘাত ও চৈতন্যের বিস্ফার রচয়িতার অদম্য দায়।এসবের বহিঃপ্রকাশেও পাঠক বা কবিতার দায় থাকে।সৃষ্টি কোনভাবেই কোনদিনও তার পূর্ণ মর্যাদা পায় না ,সেটা স্বাভাবিক।

মায়াজমঃ
   সৃষ্টি ( এখানে কবিতা ধরেই এগোবো আমরা ) একটা বিশেষ মুহূর্তের ব্যক্তিগত ছায়াপথ বা অমরাবতী । এখানে কবি ঈশ্বর । ( ঈশ্বর একটা ধ্রুব অর্থে , শ্রেষ্ঠ অর্থে ) সৃষ্টি জন্মলগ্নে সহজই থাকে । সৃষ্টির ওপর শব্দের জাল ফেলে সৃষ্টিটাকে ধরা হয় । আপনার কি মনে হয় না , অযথা শব্দের দিকে বেশি মন দিতে গিয়ে কবিতাকে একটা খেলায় পরিণত করা হচ্ছে এসময়ে ? তখন কবিতায় পেশাদারী নিয়ম থাকে প্রাণ থাকে না !

 অনীক রুদ্রঃ

     শব্দই ব্রহ্ম।শব্দ নিয়ে যারা খেলাধুলা করবেন ,অমোঘ শব্দের প্রয়োগ ক্ষমতা তাদের দরকার।পেশাদারি নিয়ম বলে যদি কিছু স্থায়ীকৃত থাকে ,তবে তা হল মনোরঞ্জনের বা ব্যবসার বাজারদরের দিক।আমি সাহিত্য সাধনাকে কোনদিন সেই স্তরে নামাবার চেষ্টা করবো না।খরিদ্দার পেলেই শিল্পকর্ম সমেত নিজেকেও বেঁচে দেবেন এমন কথা,কবির কাছে সৃষ্টি একটা নিরন্তর ক্রিয়া।ফরাসীদের  আর্তু র‍্যাঁবো  আমাদের সমর সেন কবিতা ছেড়ে দিয়েছিলেন।আমি সমর বাবুকে দেখেছি ,বলতে শুনেছি কবিতা লিখছি না এখন,কবিতা আসছে না।সমর বাবু বিদগ্ধপণ্ডিত ,সুরসিক ,পরিশীলিত আধুনিক মানুষ। ...আর কত গোল্ডফ্লেকের গন্ধ ...হে শহর,হে ধূসর শহর ...সেই কবে থেকে আমার স্মৃতিতে আছে।
কবিতা , কতোটা সংহত আবেগের ঘটনা সুধীরন্দ্রনাথ দত্তের লেখা ছত্রে ছত্রে তার প্রমাণ মেলে ।


মায়াজমঃ
 - জীবনানন্দ দাশ এর সময়ে  বা পরবর্তীতে বাংলা কবিতায় টি এস এলিয়টের প্রচ্ছন্ন ছায়া অবচেতনে একটা সূক্ষ্ম বলয় তৈরি করেছিল  , সেটা খালি চোখে দেখা যায় না ।  আসলে কি নতুনত্ব বলে কিছু আছে ? নতুনত্ব বলে দাবি করার মধ্যে কি কিছু আছে ?

 অনীক রুদ্রঃ
    এলিয়টের ছায়া বা বলয় না বলে প্রভাব বললেই বোধকরি ভালো হয় । জীবনানন্দ দাশ  , বুদ্ধদেব বসুদের  চেয়েও এলিয়টের দর্শনের প্রভাব বিষ্ণু দে , সুধীরন্দ্রনাথ দত্তদের হয়তো আরো অনেকটা বেশি ছিল । এলিয়ট সর্বগ্রাসী একজন আধুনিক মানুষ ছিলেন । আর একজন ইউরোপীয় কবি স্টিফেন স্পেনডার   । তিনিও মহান চিন্তানায়ক ও দার্শনিক । তাদের সমসাময়িক বাংলার কবিরা ছিলেন অধিকাংশ দেশ-বিদেশের সাহিত্য ও দর্শন পড়া চিন্তাশীল শিক্ষিত ও পণ্ডিত মানুষ । এসব নিয়ে আলোচনার এসব জায়গা নয় । নতুনত্ব , পরাবাস্তবতা থাকা বা উত্তর আধুনিকতার দিক এখন খুব আলোকিত হচ্ছে । এগুলো সবটাই কবিতার শরীর অথবা বিষয় নিশ্চিত সময়ের দাবী মেনে । আমারও ভাবনার স্তর এরকম ।


মায়াজমঃ 
  - রবীন্দ্রনাথ উপনিষদের মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন জীবনের সারমর্ম । নিজেকে আকাশের উচ্চতায় তুলতে পেরেছিলেন বলেই তিনি শোককে আনন্দে রূপান্তরিত করতে পেরেছিলেন । দুঃখকে সুখে পরিণত করে এখন তেমন কবিতা হচ্ছে না কেন ?

 অনীক রুদ্রঃ
   মনে হয় বলতে চাইছ তোমরা ভালো কবিতার কথা । কাটজু নামের একজন বিচারপতি দেখছি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর  ব্যাখ্যায় নেমেছেন । আমার এসব শুনলে বমনেচ্ছা জাগে । ভালো কবিতা চিরকালই কম লেখা হয় । শঙ্খ ঘোষ  দা রবীন্দ্র কবিতা নিয়ে ' সূর্যাবর্ত  ' নামে একটা সঙ্কলন সম্পাদনা করেছেন । একজন সৃজনশীল মানুষের জীবন সারমর্ম খুঁজতে গিয়েই তো শেষ হবে । সেটা খুব একটা পরিবর্তনশীল বিষয় মনে করি না ।


মায়াজমঃ
 - অনুভব চিরন্তন ও শাশ্বত । ভাষা বা শব্দ হয়ত যুগের সঙ্গে সঙ্গে কিছু বৈচিত্র্য  আনে মাত্র । তাই সঠিক অনুভূতি ধরতে পারলে শব্দ, গঠন , ভাষ্য এসব কোন প্রতিবন্ধকতা নয় কবিতার কাছে ।এক্ষেত্রে আপনার মতামত কি ?

 অনীক রুদ্রঃ
   আমি তোমাদের সঙ্গে সহমত পোষণ করি । কবিতার প্রতিবন্ধকতা রচয়িতার চৈতন্যে । বিষ্ণু বাবু খণ্ড- চৈতন্যের কথা বলেছেন । তিনি মৌলনা আজাদ কলেজে আমাদের দাদাদের কাউকে কাউকে টি এস এলিয়ট পড়াতেন শুনেছি ।

মায়াজমঃ
   বর্তমানের পরিবর্তনশীল ( এই নামই বললাম )_ বাংলা কবিতা কতটা সফল হয়েছে ? পাঠকের সঙ্গে কমুনিকেট করতে পারছে কি বাংলা কবিতা ?

 অনীক রুদ্রঃ
   তিন- চারটে বিখ্যাত দর্শন ধরে পরীক্ষামূলক কিছু লেখালেখি নজরে পড়েছে । মানুষ কোনকিছু সহজে যেমন গ্রহণ করে না , বর্জন ও করে না । কবিতাকে জনপ্রিয় বা আবৃত্তিযোগ্য করে তোলার মত করে আমাদের সময়েও দু-চারজন চেষ্টা করছেন । পাঠকদের সঙ্গে যোগাযোগ বা কমিউনিকেশন ঘটানোর চেষ্টা সব কবিরাই যে করেন সচেতন ভাবে ... আমার ধারনা সেরকম নয় । এখনকার উৎকৃষ্ট কবিতার জনপ্রিয়তার দিক কম । কবিতার পাঠকও যে খুব বেশি বাড়ছে , মনে হয় না ।

মায়াজমঃ
 - শূন্য-দশকের কবিতায় তেমন কোন ঐতিহাসিক মাত্রা যোগ হয়েছে যে আগামী প্রজন্ম এই দশক নিয়ে আলোচনা করবে ? জীবনের একটা বিশেষ সময়ে এসে আপনার প্রথম দিককার কবিতার সঙ্গে শূন্য-দশকের কবিতার মিল কতখানি খুঁজে পান ? এটা স্বস্তিদায়ক ?

 অনীক রুদ্রঃ
   শূন্যদশক এর কবি বলে যারা নিজেদের তালিকা পেশ করে কবিতাচর্চা করছেন , সেখানে অধিকাংশ কবিতা কর্মীদের মধ্যে কারিগরি দিকের প্রাধান্য দেখি , শেকড়হীনতার সংকটও লক্ষণীয় । তবে আমি ওদের ব্যাপারে আশাবাদী । দশকটা ধরে কাব্য বিচার করার আমি ব্যক্তিগতভাবে পক্ষপাতী নই কোনদিন । একজন কাব্যকর্মী দশ বছরেই , আবির্ভাবের শুরুতেই খুব মননশীল , চিন্তাশীল কিছু উপস্থাপন করবেন , এভাবে ভাবাটাও সঙ্গত মনে করিনা । প্রায় ৩৫ বছর ধরে আমিও চর্চার মধ্যেই আছি । আমার সমসাময়িক কবিদের মধ্যে একজন ছিলেন অনন্য রায় । অল্প বয়সেই তিনি প্রয়াত হন । কিন্তু তার কবিতা ভাবনা , লিখন প্রক্রিয়া এখন বুঝতে পাড়ি কী চমৎকার ছিল । কবির উচিত তার নিজের সময়কে ছাড়িয়ে আরও ১০-২০ বছর একটু আগিয়ে ভাবা । শাশ্বত কবিতায় আমার বিশ্বাস নেই ।
শূন্যদশকের কবিতার সঙ্গে আমার নিজের লেখার কিছু মিল থাকলে বা না থাকলেও আমার কোন অতৃপ্তি নেই । একজন কবি তার জীবদ্দশায় কটা মনে রাখার মত কবিতা লিখতে পারলেন , সেটাই যথেষ্ট । ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য এক্ষেত্রে থাকছেই ।

মায়াজমঃ
 - আপনি কেন এবং কি করতে আছেন বা আরও স্পষ্ট করে বললে বলি নিজে কী  এই নিয়ে কি কোনদিন ভেবেছেন ? আমিত্বটুকুই কি কোন শিল্পিকে শিল্প হতে প্রভাবিত করেন ?

অনীক রুদ্রঃ
    কি করতে আছেন বা কেন আছেন এসব তো দার্শনিক প্রশ্ন । একটা মানুষের জীবনদর্শন একটা বয়সের পরে খুব বেশি আর পাল্টায় না । সামাজিকভাবে যে পালাবদল বা পাল্টানো থাকে আমি তার সাক্ষী বা শরিক হতেও চাইনা কখনো বা । তবে শিল্পীর অহংবোধ থাকাটাকে আমি সম্মান ও সমর্থন করি ।

মায়াজমঃ
 - সকলের চেয়ে অন্যভাবে লিখতে হবে , কেমন যেন ঘরের মধ্যে আরেকটি ঘর বানিয়ে তার মধ্যে রাজত্ব করা । সকলের মনের মধ্যেই থাকে অন্য সকলের থেকে বেরিয়ে এসে নিজের মত কিছু করা । তবুও কিছু প্রশ্ন এসেই যায় ,সবকিছু শুরুর একটা শুরু থাকে । আপনি কাদের কবিতা যুবক বয়সে পছন্দ করতেন । কোন কবির লেখা কি আপনাকে কবিতা লিখবার দিকে এগিয়ে দিয়েছিল ?

অনীক রুদ্রঃ
   শারীরিকভাবে না হলেও আমি মানসিকতায় এখনো যুবক । অরুণ মিত্র ছিলেন নবতিপর বর্ষেও যুবকের মত প্রাণবন্ত । আমি বিহারীলাল চক্রবর্তী , মধুসূদন দত্তর কবিতাও যেমন পড়েছি তেমনি কম বয়সে সুভাষ মুখোপাধ্যায় , সমর সেন , বিষ্ণু দে  , সুধীন্দ্রনাথ দত্ত  , বিনয় মজুমদার ও খুব মন দিয়ে পড়তাম । পড়তাম পুরনো দিনের বিস্তর লিটিল ম্যাগাজিনের কবিতা । সে সবই আমার পিতার সৌজন্যে । ইয়োরোপীয় সাহিত্য ইংরাজি বা ইংরাজি-বাংলা অনুবাদে পড়েছি । আর একটু পরে রুজেভিচ  -  হ্যারাণ্ড পিসটার  ... ( আমি তাদের কিছু লেখা অনুবাদ ও করেছি বাংলায় ) অবিভক্ত সোভিয়েতের অগ্রগণ্য কবিদের । আমার নিজের কবিতা লেখার শুরু অবশ্য আমার প্রয়াত পিতার প্রভাবেই । তার কোন কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি আজো । কিন্তু তিনি বেশকিছু সাময়িক পত্রে নিয়মিত কবিতা লিখেছিলেন একদা ।

মায়াজমঃ 
 ব্যক্তিগত কটা কথা জিজ্ঞাস করি । আপনার কবি হয়ে ওঠার পিছনের গল্প মায়াজমের পাঠক শুনতে চায় । আপনার পেছনের সেই শুরুটা যদি বলতেন ...

অনীক রুদ্রঃ
   কবি হয়ে উঠেছি কিনা বা কতটা জানি না । সময়ের চাপ আমাকে অনেকসময় লিখতেও প্ররোচিত করেছে । তখন বেশ একটা অস্বস্তি  অনুভব করি । মনে হয় আমার কিছু বলার ছিল মানে , লেখার । কিশোরবেলা থেকেই আমার ছিল একটা সাহিত্য পত্রিকা বের করার প্রবল ইচ্ছা । আমার সেইসময়কার তাগিদে তখন প্যালা দেয় শ্যামল , ডাক্তার শ্যামল চক্রবর্তী । ওর বাড়ির ঠিকানায় আমরা যুগ্মভাবে সম্পাদনা করি ' অণু আন্দোলন ' । বেশ কয়েকটি সংখ্যা বেরিয়েছিল । যার অধিকাংশ লেখাই নামে ও বেনামে আমি আর শ্যামলই লিখতাম । আমাদের পত্রিকায় লিখেছিলেন  শৈলেশ্বর ঘোষ । তিনি শ্যামলের মাস্টার মশাই , আমি দাদাই বলতাম । হাংরি পরবর্তী সময়ে ' ক্ষুধার্ত ' পত্রিকার সম্পাদনায় ছিলেন । এইভাবে শুরু বলতে পারো ...

মায়াজমঃ  
আপনার যুবক বয়সের ফিরে দেখা কিছু ঘটনা বলুন যা আপনাকে আজো অনুপ্রাণিত করে জীবনবোধ কে এগিয়ে নিয়ে যেতে ।

অনীক রুদ্রঃ

জীবনবোধকে কীভাবে এগিয়ে মিয়ে যাওয়া যায় আমার জানা নেই । তবে জীবন ঘটনাবহুল , থেমে গেলেই বা তার বোধ এগবে কি করে ! সাহিত্য আমাকে অনুপ্রাণিত করেন প্রয়াত গল্পকার ও নাট্যকার জ্যোৎস্নাময় ঘোষ । তোমরা তার লেখা পড়েছ কি ? আমার শিক্ষক মশাইদের মধ্যে প্রোফেসর অরুণকুমার শর্মা , প্রয়াত প্রোফেসর সন্তোষ ভট্টাচার্য ( যিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন ) এ রকম অনেকেই যেমন ইংরাজি অধ্যাপক জ্যোতি ভট্টাচার্য , কবি বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় , অরুণ মিত্র , মণিভূষণ ভট্টাচার্য প্রমুখ । এই তালিকা দীর্ঘায়িত করে লাভ নেই । আমি যে বিদ্যালয়ে পড়তাম সেখানের শিক্ষক মশাইরাও ছিলেন । আমাদের পণ্ডিত স্যার সত্যকিঙ্কর চট্টোপাধ্যায় মুখে মুখে সংস্কৃত ও বাংলায় পদ রচনা করতে পারতেন ।

মায়াজমঃ   -
  এই সময়ে যারা বাংলা কবিতার তথাকথিত ধারক ও বাহক তাদের সম্বন্ধে আপনার মূল্যায়নই বা কি ? এনারা কতখানি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বাংলা কবিতাকে ? এদের ওপর কি কোন ঈর্ষা বা অভিমান আছে আপনার ?

অনীক রুদ্রঃ
   বাংলা কবিতার ধারক ও বাহক বলে আমি কাউকে মনে করিনা । কবিতার কেউ ধারক , বাহক বা কর্ণধার হয় না । বরং কবিতাই কবিদের কান ধরে ওঠাবসা করায় কখনো সখনো ।

মায়াজমঃ   
   জীবনানন্দের হাত ধরে সুরিয়ালিজম  এর যে প্রাণ পেয়েছিল , আজকের দিনের সুরিয়ালিজমের  সঙ্গে কি তেমন কোন পার্থক্য আপনার চোখে পড়ে ?

অনীক রুদ্রঃ
  ' সুরবিয়ালিজম বা অধিবাস্তবতা শব্দটা ইংরেজদের থেকে আমদানি করা । অধিবাস্তবতা বা জাদু বাস্তবতা ( magic realism) বহুকাল ধরেই বাংলা সাহিত্যে আছে । জীবনানন্দ আলাদা করে মহান কাজ কিছু করেন নি । সুনীতিকুমার থাকলে হয়ত নির্দেশ দিতেন ছাত্রছাত্রীদের চর্যাপদ বা মৈথলীকবিতা পড়ার ।


মায়াজমঃ   -
 এতদিন ধরে লিখছেন , এত রকমের লিখেছেন , এত লিখে যাচ্ছেন আজো । তবুও কি কোনও সময়  মনে হয় যা লিখতে চাইছেন টা এখনও লেখা হয়ে উঠল না ? আসলে একটা অতৃপ্তিই তো লেখাকে বাঁচিয়ে রাখে আমাদের হৃদয়ে । এ ব্যাপারে আপনার মতামত কি ?

অনীক রুদ্রঃ
আমি খুব বেশি লিখি না।শাদা পৃষ্ঠার সামনে দাঁড়ালে অধিকাংশ সময় হতবুদ্ধি হয়ে পড়ি।----- ব্যাপারে তোমাদের সাথে একমত আমিও।যদিও আমার শ্রেষ্ঠ কবিতা (প্রথম খণ্ড )বেরচ্ছে শীঘ্রই।আমি কিন্তু জানি শ্রেষ্ঠ লেখা কিছু আমায় ছাড়া সম্ভব নয়।এই নামকরণের দায় আমার প্রকাশক মশাইয়ের।


মায়াজমঃ   
বাংলা সাহিত্যের আগামীদিনে কি রূপে আপনি দেখতে চান ? পাঠক কি সাহিত্য থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছেন ? তবুও কিন্তু প্রতিদিন হাজার হাজার সৃষ্টি হয়েই চলেছে । আসলে সাহিত্যে কি কোন খেলা ? যেটা না খেলতে পারলে সাহিত্যিক এর স্বস্তি নেই ?

অনীক রুদ্রঃ
দেখ মানুষের মুখ কোন বিশিষ্ট দিকে একভাবে নিবদ্ধদৃষ্টিতে থাকে না।পাঠকরাও জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে কমে না কখনো।সাহিত্য ছিল এক সময় একমাত্র রিক্রিয়েশনের জায়গা।এখন সেখানে বিনোদনের বিষয় বিস্তর ,যেন পণ্যসম্ভার।তবে সবকিছুই ঘুরেফিরে আসে।সাহিত্যের মজাটা ওখানেই।পাঠ ও পাঠদান পদ্ধতিও বদলে গেছে।এই যেমন তোমরা পড়েছ।এই 'তোমরা ' কি আণুবীক্ষণিক সংখ্যালঘু?


মায়াজমঃ
  - বাজারি সাহিত্য বা বলতে চাইছি ফরমায়েশি লেখাতে কি শিল্পী সঠিকভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারেন ? একটা সৃষ্টির জন্য যতটা সময়ের দরকার হয় , দেখা যায় নামীদামী রা সেই সময়টুকু দিতে পারছেন না । তাহলে তাদের সৃষ্টির মধ্যে কি কোন ফাঁক থেকে যাচ্ছে ?

অনীক রুদ্রঃ
ফরমায়েশ লেখা যে সব সময় নিম্ন মানের হবেই এমন কোন স্থির সিদ্ধান্তে আসা ঠিক নয়।একটা ভাল লেখার প্রেক্ষিতে অনেকগুলো  ফ্যাক্টর বিভিন্নভাবে বা একসঙ্গে কাজ করে।তবে সাধারণ দৃষ্টিতে সেখানে ফাঁক থাকার সম্ভাবনা থাকেই।

মায়াজমঃ
 - আমরা শেষের দিকে পৌঁছে গেছি । আপনাকে আর দুটো প্রশ্ন করব । আধুনিক বাংলা সাহিত্যে খুব প্রাচীন নয় । ভাল করলে লক্ষ্য করা যায় বাংলা সাহিত্যে ইংরাজি  সাহিত্যের প্রভাব সব থেকে বেশি । আপনার কি মনে হয়েছে কখনো যে  অতিরিক্ত ইংরাজি প্রভাবে র জন্য বাংলা সাহিত্যে সেই উচ্চতায় উঠতে পারল না ?

অনীক রুদ্রঃ
  আমার এমনটা মনে হয়নি।আসলে ইংরাজিটা প্রায় সর্বত্রই চলে।আমরা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা বাংলাভাষাটাকেই সাধারণ ভাবে মর্যাদা দিই না।পৃথিবীর বেশিরভাগ লোক শুনি চৈনিক ভাষায় কথা বলে?চিনেরা নাকি খুব সাহিত্য পড়ে?ওখানের প্রতি তৃতীয় ব্যক্তি তো সরকারের(পার্টির)চর।কোন বিশেষ ভাষার সাহিত্যের প্রভাব যদি বাংলাতেও পড়ে সাহিত্যের ক্ষতি হয় কিভাবে?

মায়াজমঃ
  - আপনাকে অনেক ধন্যবাদ । আমাদের কে মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য । আপনার শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা কামনা করি । আপনার কলম এগিয়ে চলুক ।

অনীক রুদ্রঃ
     thank u   বলাটা ইউরোপীয় কেতা।ধন্যবাদ জানানোর আলাদা করে কিছু নেই।তোমাদের সহযাত্রী হিসাবেই পাশে থাকবো।ভালো থেকো।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র