অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায় - মায়াজম

Breaking

২৪ জানু, ২০১৬

অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়

              

           অস্পৃশ্যনামা










প্রথম পর্ব --- 




 “লোকানান্তু বিবৃদ্ধ্যর্থং মুখবাহুরুপাদতঃ। ব্রাহ্মণং ক্ষত্রিয়ং বৈশং শূদ্রঞ্চনিরবর্তয়ৎ।।”(মনুসংহিতা ১ : ৩১) ---লোকবৃদ্ধির জন্য (স্রষ্টা) মুখ, বাহু, ঊরু ও পদ থেকে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র সৃষ্টি করলেন।এখানে পরিষ্কার। শূদ্রদের জন্মই হয়েছে পদ বা পা থেকে। নির্দেশ যাদের পা থেকে তারা মাথায় উঠবে কীভাবে ! তাই এদের স্থান তো পায়ের নিচেই হতে হবে ! অতএব জন্মও পায়ের নিচে, কর্মও পায়ের নিচে। গীতায় শ্রী ভগবানের উক্তি মতে বলা হয়েছে—‘আমি গুণ ও কর্মের বিভাগ অনুসারে চার বর্ণের (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র) সৃষ্টি করেছি। পুরুষ সুক্তের মন্ত্র ব্যাখ্যা করে নির্মল কুমার বসু যে মত ব্যক্ত করেন তা হল চারটি বিশেষ গুণসম্পন্ন এবং বিভিন্ন মাত্রার সংযাগের ফলে চার বর্ণের মধ্যে গুণের তারতম্য দেখা যায়। প্রাচীন ভারতবর্ষের বিভিন্ন জাতের গুণ ও কর্মের ভিত্তিতে সে জাতির কর্ম উল্লিখিত চার বর্ণের কর্মের সঙ্গে মিল না থাকলে সে জাতি মিশ্র গুণসম্পন্ন ধরে নেওয়া হত। তবে এক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয় তাদের বর্ণ ও সামাজিক মর্যাদা নির্ধারণের ক্ষেত্রে। মনু, যাজ্ঞবল্ক্য, গৌতম প্রভৃতি স্মৃতিকার এ নিয়ে যে মতামত দেন তা প্রণিধানযোগ্য। মনু সংহিতায় স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে প্রত্যেক জাতির নির্দিষ্ট বৃত্তি ছিল এবং স্মৃতিকাররা বৃত্তির ভিত্তিতে সে জাতির বর্ণ ও সামাজিক মর্যাদা নির্ধারণ করে দিতেন। এর থেকে প্রমাণিত হয়, প্রাচীনকালে কিছু গুণকে উত্তম এবং কিছু গুণকে অধম বলে গণ্য করা হত। একইভাবে কিছু বৃত্তিকে শুদ্ধ এবং কিছু বৃত্তিকে অশুদ্ধ বলে বিবেচনা করা হত। এভাবে গুণ ও কর্মের ভিত্তিতে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রএ চার বর্ণের সৃষ্টি হয়। ব্রাহ্মণদের প্রভূত্বকামী শাসনব্যবস্থা ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রধান অস্ত্রই হল চতুর্বর্ণ প্রথা। অর্থাৎ সমাজে চারটি বর্ণের উপস্থিতি -- ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র। এই প্রথার মাধ্যমে গোটা জনগোষ্ঠিকে এক অদ্ভুত বর্ণবৈষম্যের মধ্য দিয়ে বিভাজিত করে যে ভাগ করো, শাসন করোনীতি কায়েম করা হয়েছে, সেখানে স্বঘোষিত বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণদের আধিপত্য প্রশ্নহীন করে রাখা হয়েছে। বর্ণ-মর্যাদার দিক থেকে এর পরই রাজদণ্ডধারী ক্ষত্রিয়ের অবস্থান। তার নিচে বৈশ্য এবং সর্বনিকৃষ্ট বর্ণ শূদ্র। মানব সমাজটাই বিলুপ্ত হয়ে গেছে আগ্রাসনবাদী বৈদিক সমাজের সর্বগ্রাসী বর্ণ-বিভেদের ছায়ায়। গোটা মনুসংহিতার কোথাও কোন ভাবে মানুষ নামের কোনো স্বতন্ত্র সত্ত্বার বা মানব জাতির অস্তিত্ব প্রায় খুঁজেই পাওয়া যায় না। যা পাওয়া যায় তা হচ্ছে- চারটি বর্ণভিত্তিক ব্রাহ্মণ জাতি, ক্ষত্রিয় জাতি, বৈশ্য জাতি ও শূদ্র জাতি। মনুসংহিতায় ভগবান মনু যে চারটি বিষয়ে সবচেয়ে বেশি চিন্তিত ছিলেন, তা হল ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, নারী এবং শূদ্র। এই চারটি ক্ষেত্রেই তিনি সবচেয়ে বেশি নির্দেশ দিয়েছেন। তবে চতুর্বর্ণের বাইরে আর-একটি গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব আছে, তা হল -- অন্ত্যজ বা অস্পৃশ্য। অর্থাৎ অস্তিত্ব থাকলেও সমাজ যাকে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত বলে স্বীকার করে না। বর্ণ ব্যবস্থায় একজন ব্যক্তি যে বর্ণে জন্মগ্রহণ করেন তার বাইরে অবস্থান গ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। জন্মের দ্বারাই নির্ধারিত হয় যে, সে কোন্ বর্ণের অন্তর্ভুক্ত। অজানা সময় কাল থেকে একটি বংশধারা এই মর্যাদা ভোগ করে আসছে। অনন্তকাল পর্যন্ত বংশধারার মাধ্যমে এটা অব্যাহত থাকবে। ব্যক্তির মর্যাদা জন্ম দ্বারা নির্ধারিত। একজন ব্রাহ্মণ হিসাবে জন্মগ্রহণ করলে যে-কোনো অবস্থাতেই সে ব্রাহ্মণের জন্য নির্ধারিত মর্যাদা ও পুরস্কার ভোগ করবে। কোনো ব্যক্তি এক বর্ণে জন্মগ্রহণ করে অন্য বর্ণে বিয়ে করতে পারে না। কারণ বর্ণের বাইরে বিয়ে করলে তার বংশগত পবিত্রতা নষ্ট হয়ে যায়। শুধু যে বংশগত পবিত্রতাই মূল কথা তাই নয়, এর সঙ্গে আরও বহু আচার ব্যবস্থা জড়িত, যার মাধ্যমে বর্ণ শুদ্ধতা রক্ষিত হয়। মূল বর্ণগুলির মধ্যেও আছে হাজারও উপবর্ণ। এই উপবর্ণগুলি আবার নিজেদের গোত্রগত বিশুদ্ধতা রক্ষার রীতিনীতি মেনে চলে। এই উপগোত্রগুলি আবার নিজেদের বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য নানারূপ বিধিনিষেধ মেনে চলে যেমন সপিণ্ড, সগোত্র ইত্যাদি সংক্রান্ত আচার বিধি। এই নিয়ম কঠোরভাবে মানতে হয়, তা না হলে উঁচু জাতের পবিত্রতা বিনষ্ট হয়। বিশেষ করে ব্রাহ্মণ এবং অব্রাহ্মণের মধ্যে এটা কঠোরভাবে মেনে চলা হয়। এজন্য পণ্ডিতরা বলে থাকেন, ভারতে বর্ণপ্রথার ইমারতটি গড়ে উঠেছে ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্বের উপর।  একজন ব্রাহ্মণ একজন নিচু জাতের লোকের সঙ্গে একত্রে বা হাতের রান্না খাবে না, ছোঁয়া খাবার খাবে না। তার খাওয়া পাত্রে খাবে না, তার স্পর্শ করা খাবার খাবে না। বর্ণ পঞ্চায়েত এবং আচরণরীতি ব্যাপারটার কেন্দ্রে রয়েছে ব্রাহ্মণ সমাজ এবং তাদের কৌলীন্য ও মর্যাদার ধারণার গুণগত উৎকর্ষের কারণে সমাজে মানুষ উচ্চতর মর্যাদা এবং পুরস্কারগুলি ভোগ করবে। এটাই স্বাভাবিক নিয়ম, এটাই দস্তুর। একটি বিশেষ পুরস্কার বা সুবিধা বিশেষ গোষ্ঠীর জন্য নির্ধারিত থাকে। এর ফলে সমাজের নিম্ন শ্রেণিগুলির মধ্যে উচ্চতর অর্জন প্রেষণা কাজ করে না। সমাজ হয়ে পড়ে বদ্ধ জলাভূমি। এখানে সর্বস্তরের মানুষের মেধার সর্বোচ্চ ব্যবহার সম্ভব হয় না। মানুষের উচ্চ অর্জন প্রেরণা হচ্ছে সমাজ উন্নয়নের চাবিকাঠি। যেহেতু বর্ণ ব্যবস্থায় ব্যক্তির মর্যাদা এবং পুরস্কার শ্রম ও মেধার সাহায্যে অর্জন করা যায় না তাই সার্বিকভাবে সামাজিক সচলতার উপস্থিতি এখানে লক্ষ করা যায় না। বর্ণ ব্যবস্থায় বর্ণ দ্বারা নির্ধারিত হয় ব্যক্তির পেশা। এই বর্ণ ব্যবস্থায় ব্যক্তির মেধা অনুযায়ী পেশা নির্বাচনের কোনো অধিকার সেই ব্যক্তির বা গোষ্ঠীর থাকে না। পেশা এখানে জন্মগত এবং বংশগতভাবে নির্ধারিত হয়। সমাজ থেকে ব্যক্তির উপর এক ধরনের প্রত্যাশার বাধ্যবাধকতা চাপিয়ে দেওয়া হয়, সে তার গোত্র বা বর্ণের পেশাই গ্রহণ করবে। এই সেদিন পর্যন্ত ব্যক্তির পক্ষে উপেক্ষা করা সম্ভব হত না। এই বর্ণপ্রথায় ব্যক্তির মেধা, যোগ্যতা, শ্রমকুশলতা, আগ্রহ, সৃজনশীলতা কোনো গুরুত্ব পায় না। তাই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে যার যা জন্মগত এবং বংশগত পেশা তারা তাই করে যাচ্ছে, যে মানুষের মল বা বিষ্ঠা ফেলার কাজ করত সে তাইই করত(মেথর)। যে কাঠের কাজ করে সে তাইই করে যাচ্ছে (ছুতোর)। যে ক্ষৌরকর্মের কাজ করে তার সন্তান-পরম্পরা তাইই করে যাচ্ছে (নাপিত)। যে মাছ ধরে বংশপরম্পরায় তারা ওই পেশাই (জেলে) করে চলেছেন। যে মৃতদেহ দাহ করেন তিনি তাইই করেন (ডোম) -- পরিবর্তনের কোনো চিন্তাই করে না। বর্ণপ্রথা সমাজের অভ্যন্তরে দারুণ রকমের সামাজিক বিচ্ছিন্নতা তৈরি করেছে এবং করছে। একটা জাতি হাজার বিভাজনে বিভাজিত হয়ে আছে। যে উৎস থেকে একজন ব্রাহ্মণ জল উত্তোলন করেন, সেখান থেকে একজন দলিত জল উত্তোলন করতে পারেন না। বাবা আম্বেদকরের এ অভিজ্ঞতা হয়েছিল, যা তিনি লিপিবদ্ধ করে গেছে। কেরালাতে একজন নায়ার একজন নাম্বুদারি ব্রাহ্মণের কাছে আসতে পারে, কিন্তু তাকে স্পর্শ করতে পারে না। একজন তিয়াএকজন ব্রাহ্মণ থেকে ৩৬ পদক্ষেপ দূরে থেকে কথা বলবে এবং একজন পুলাইয়া একজন ব্রাহ্মণ থেকে ৯৬ পদক্ষেপ দূরে থেকে কথা বলবে। এর চেয়ে কম দূরত্বে আসতে পারবে না। পেশোয়া শাসন আমলে মহারাষ্ট্রে মাহার এবং মঙ সম্প্রদায়ভুক্ত নিম্নবর্গের মানুষদের শুধু সকাল ৯টার পর এবং বিকাল ৩টার আগে পুনা গেটে আসার অনুমতি ছিল, কারণ এর আগে মানুষের ছায়া অনেক দীর্ঘ থাকে এবং কোনো ব্রাহ্মণ যদি সে ছায়া অতিক্রম করে তাহলে তার জাত নষ্ট হয়। অর্থাৎ পবিত্রতা নষ্ট হয়। এখন প্রশ্ন -- এই বর্ণপ্রথার ধারণা এলো কীভাবে ? ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলা হয় আর্যরা ছিল মধ্য এশিয়ার যাযাবর জাতি। তারা ক্রমেই পূর্বদিকে অগ্রসর হতে হতে সিন্ধু নদ পার হয়ে ভারত উপমহাদেশে প্রবেশ করে। যেহেতু ভারতের তৎকালীন দ্রাবিড়, কোল, ভিল, মুণ্ডা, সাঁওতাল প্রভৃতি জাতি ছিল কৃষিজীবী এবং খাদ্য আহরক, যারা খাদ্য আহরণ অর্থনীতির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করত। তাদের প্রযুক্তি ছিল অতীব প্রাথমিক পর্যায়ের। অপরদিকে পশুপালন এবং শিকারজীবী আর্যরা ছিল যোদ্ধা জাতি। দীর্ঘকায় অশ্বচারী আর্যরা দ্রুতগতিতে ভারতে প্রবেশ করে অপেক্ষাকৃত ক্ষীণকায় নিম্ন প্রযুক্তির ভারতের আদিবাসীদের সহজে পরাভূত করে দাসে পরিণত করে। এই দাসত্বকে স্থায়িত্ব দান করার জন্য এর একটা সামাজিক ব্যাখ্যা দান করা হল। যার বহিঃপ্রকাশ বর্ণপ্রথা। এটা ইউরোপীয়দের বর্ণবাদের মতোই নিবর্তনমূলক প্রথা। কারণ সাধারণত কোনো ব্রাহ্মণ ক্ষুদ্র-কৃষ্ণকায় হয় না, আবার কোনো শূদ্র দীর্ঘ নাসিকা সংবলিত দীর্ঘদেহী শ্বেতকায় হয় না। যেহেতু আর্যরা এমন অঞ্চল থেকে এসেছিল যেখানে জীবন ছিল সংগ্রামমুখর, গতিময় আর আহার্যের স্বল্পতা। বহিঃশত্রুর আক্রমণ, চারণভূমির জন্য কিংবা পালিত পশুর নিরাপত্তার জন্য সর্বদাই তাদের যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হতে হত। সংগ্রামী জীবন তাদেরকে উচ্চ মেধা এবং কল্পনা শক্তি দিয়েছিল। সেই কারণেই হয়তো সহজ-সরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত কৃষিজীবী ভারতীয়দের তারা সহজে পরাভূত করতে পেরেছিল। আর্যরা উপলব্ধি করল এখানে খাদ্যের প্রাচুর্য আছে যার জন্য তাদের আজীবন সংগ্রাম করতে হত। তাই চতুর ও বিচক্ষণ আর্যরা বিজিত কৃষিজীবীদের তাদের স্বপেশায় নিয়োজিত রেখে উৎপাদনের চাকা সচল রাখল এবং এমন এক কর্মকৌশল উদ্ভাবন করল যাতে করে তারা কখনোই সমাজের উপরিকাঠামোর অংশীদারিত্ব দাবি না করে।  ফলে এমন এক অভিনব ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটল, যার মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদনের নিশ্চয়তা অটুট থাকল, যার জন্য আর্যদের অহর্নিশি সংগ্রাম করতে হত। আবার সামাজিক শৃঙ্খলা বিধানের দুরূহ কার্যটিও আনায়াসে সমাধান হয়ে গেল, যার জন্য পৃথিবীর প্রায় সব সমাজকে বাড়তি অর্থ এবং শ্রম নিয়োজিত করতে হত। এভাবেই আর্যরা আদিবাসী ভারতীয়দের কার্যত দাসে পরিণত করল। ঋগবেদের যুগেই যে চারটি বর্ণের উৎপত্তি হয়েছিল তার বীজ বা প্রমাণ পুরুষ সুক্ত (১০/৯০)।সেখানে দ্বাদশ ঋকে আছে পুরুষের মুখ থেকে ব্রাহ্মণ হল, দুই বাহু বা হাত থেকে রাজন্য হল, দুই ঊরু থেকে বৈশ্য হল এবং দুই চরণ বা পা থেকে শূদ্র হল। ঋগবেদের অন্যত্র দুটি মূল ভাগ পাই আর্য এবং দাস (১০/১০২/৩)। মনে হয় এটি জাতিভিত্তিক (racial) বিভাগ। পরবর্তী সময়ে যখন এই দাসজাতি সমাজের অঙ্গীভূত হয় গেল তখন তারা শূদ্র বলে বর্ণিত হল। অথর্ব বেদে দাস অর্থে শূদ্র শব্দের ব্যবহার হয়েছে (৪/২০/৪)।বৃত্তি বা পেশা অনুসারেই যে বিভাগের ব্যবস্থা হয়েছিল তা বোঝা যায়। অবশ্য তখনও বর্ণ বিভাগ পুরুষানুক্রমিক হয়নি। তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ ৯/১১২ সুক্ত। তাতে দেখা যায় একই পরিবারে বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন রকম বৃত্তি অবলম্বন করত। সেই পরিবারের একজন স্তোত্রকার, তার পুত্র চিকিৎসক এবং কন্যা যব ভাঙে। যে ঘৃণ্য জাতিভেদ প্রথার অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে আজ ভারতবর্ষ আকুল, ঋগবেদের যুগে কিন্তু এ জাতিভেদ প্রথার সৃষ্টি হয়নি। তখন জাতি বলতে মাত্র দুটি শ্রেণিই বুঝাত আর্য এবং অনার্য।পরবর্তীকালে শূদ্রদের মতো অনার্য জাতির লোকেরা তাদের ভয় করে চলত বলে অনেকে মনে করেন। আর্য বর্ণের মানুষরা ইন্দ্রের কাছে  কী প্রার্থনা করছে একবার দেখা যাক – “হে মেঘবন ! নীচ বংশীয় ধন আমাদের প্রদান করো” (৩/৫৩/১৪)।এই বাক্যে অনার্যদের প্রতি বিন্দুমাত্র সমীহ আছে বলে আমার মনে হয় না। যাই হোক, সে সময় কিন্তু বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ ছিল বলে মনে হয় না।এটা মুসলমান আকবর আর হিন্দু রাতপুতদের মধ্যে ভালোবাসার মতোও হতে পারে ! তবে লাঞ্ছনা, বঞ্চনা, ঘৃণা এসব পরবর্তীকালের সংযোজন। পরবর্তী সমাজব্যবস্থায় ভাগ করে দেওয়া হল চার বর্ণের কাজ, কর্তব্য এবং অধিকার। (১) ব্রাহ্মণ :অধ্যাপনমধ্যয়নং যজনং যাজনং তথা।/দানং প্রতিগ্রহঞ্চৈব ব্রাহ্মণানামকল্পয়ৎ।।অর্থাৎ ব্রাহ্মণদের জন্য তিনি সৃষ্টি করলেন অধ্যাপনা, অধ্যয়ন, যজন, যাজন, দান ও প্রতিগ্রহ । (২) ক্ষত্রিয় : প্রজানাং রক্ষণং দানমিজ্যাধ্যয়নমেব চ।/ বিষয়েষ্বপ্রসক্তিশ্চ ক্ষত্রিয়স্য সমাসতঃ।।অর্থাৎ ক্ষত্রিয়ের কর্ম লোকরক্ষা, দান, যজ্ঞ, অধ্যয়ন ও বিষয়ে অত্যাসক্তির অভাব। (৩) বৈশ্য : বৈশ্যের কর্ম হল পশুপালন, দান, যজ্ঞ, অধ্যয়ন, সুদে অর্থ বিনিয়োগ ও কৃষি । (৪) শূদ্র : প্রভু শূদ্রের একটিমাত্র কর্ম নির্দেশ করলেন। তা হল সকল বর্ণের অসূয়াহীন সেবা করা । আর কেনই-বা করবে না ! সমস্ত শূদ্রদের প্রশ্নহীনভাবে উপরের তিন বর্নের ফাই-ফরমাশ খাটতেই হবে। এটাই দস্তুর, নিয়তি।কারণ জাতমাত্রেই ব্রাহ্মণ পৃথিবীতে সকল লোক অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হন এবং সকল সৃষ্ট পদার্থের ধর্মসমূহ রক্ষার জন্য প্রভু হন (“ব্রাহ্মণো জায়মানো হি পৃথিব্যামধিজায়তে।/ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং ধর্মকোষস্য গুপ্তয়ে।।”)।অথবা পৃথিবীতে যা কিছু আছে সেই সব ব্রাহ্মণের সম্পত্তি। শ্রেষ্ঠত্ব ও আভিজাত্য হেতু ব্রাহ্মণ এই সবই পাওয়ার যোগ্য (সর্বং স্বং ব্রাহ্মণেস্যেদ্যং যৎকিঞ্চিজ্জগতীগতম্।/শ্রৈষ্ঠ্যেনাভিজনেনেদং সর্বং বৈ ব্রাহ্মণোঽর্হতি।।”)। কিংবা ব্রাহ্মণ নিজের অন্নই ভক্ষণ করেন, নিজের বস্ত্র পরিধান করেন এবং নিজের দ্রব্য দান করেন। অন্য লোকেরা যা ভোগ করে, তা ব্রাহ্মণের দয়া হেতু করে। অপরদিকে শাসক বা রাজা বা ক্ষত্রিয়দেরও প্রভু পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন বিচক্ষণ সমাজপতিরা।মনুসংহিতার সপ্তম অধ্যায় দেখুন -- রাজশূন্য এই জগতে চারদিকে ভয়ে(সকলে) প্রচলিত হলে এই সমগ্র (চরাচর জগতের) রক্ষার জন্য ঈশ্বর ইন্দ্র, বায়ু, সূর্য, অগ্নি, বরুণ, চন্দ্র ও কুবেরের শাশ্বত অংশ গ্রহণ করে রাজাকে সৃষ্টি করেছিলেন (অরাজকে হি লোকেঽস্মিন সর্বতো বিদ্যুতে ভয়াৎ।/রক্ষার্থমস্য সর্বস্য রাজানমসৃজৎ প্রভুঃ।।/ইন্দ্রানিলযমার্কাণামগ্নেশ্চ বরুণস্য চ।/চন্দ্রবিত্তেশয়োশ্চৈব মাত্রা নির্হৃত্য শাশ্বতীঃ।।”)যেহেতু এই শ্রেষ্ঠ দেবগণের অংশ থেকে রাজার সৃষ্টি হয়েছিল, সেইজন্য তিনি সকল জীবকে তেজে অভিভূত করেন (যস্মাদেষাং সুরেন্দ্রাণাং মাত্রাভ্যো নৃপঃ।/তস্মাদভিভবত্যেষ সর্বভূতানি তেজস্য।।”)।অথবা রাজাকে বালক হলেও মানুষ মনে করে অবজ্ঞা করা উচিত নয়। ইনি মানুষের রূপে মহান দেবতা (বলোঽপি নামমন্তব্যো মনুষ্যা ইতি ভূমিপঃ।/মহতী দেবতা হ্যেষা নররূপেণ তিষ্ঠতি।।”)। এই অধ্যায়ে এ রকম ২২৬টি শ্লোকে ভয় ধরানো বর্ণনা, বিশেষণ এবং নিদানের উল্লেখ আছে। দেখা যাচ্ছে এরা সবাই-ই দেবতা বা সুর, এরা ছাড়া বাকি সব দৈত্য বা অসুর।তাই নিয়মনীতিও আলাদা। ব্রাহ্মণঃ ক্ষত্রিয়ো বৈশ্যস্ত্রয়ো বর্ণা দ্বিজাতয়ঃ।/চতুর্থ একজাতিস্তু শূদ্রো নাস্তি তু পঞ্চমঃ।।” (১০/৪) অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য এই তিন বর্ণের পক্ষে উপনয়ন সংস্কারের বিধান থাকায় এরা দ্বিজাতিনামে অভিহিত হয়। আর চতুর্থ বর্ণ শূদ্র উপনয়নসংস্কারবিহীন হওয়ায় দ্বিজাতি নয়, তারা হল একজাতি কারণ শূদ্রের পক্ষে উপনয়ন-সংস্কারের বিধান নেই। অতএব অনিবার্যভাবে শূদ্ররা হলো নিম্নবর্ণ। ফলে এরা ব্রত যজ্ঞ অনুষ্ঠানাদি পালনের যোগ্য হতে পারে না।এছাড়া পঞ্চম কোনও বর্ণ নেই অর্থাৎ ঐ চারটি বর্ণের অতিরিক্ত যারা আছে তারা সকলেই সঙ্করজাতি।হিন্দুধর্মের চারবর্ণের সর্বশেষ ধাপে অবস্থান শূদ্রের। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য যাদের সভ্য ভাষায় বলা হচ্ছে উচ্চবর্ণ বা উঁচু জাত এবং শূদ্রদের বলা হয় নিন্মবর্ণ বা নিচুজাত বা ছোটোজাত। একজন মানুষ মৃত্যু বরণ করলে, মৃত ব্যক্তির পূত্র-কন্যা ও নিকট আত্মীয় স্বজনেরা হিন্দু সমাজের বিধান অনুযায়ী অশৌচ হয়ে যায়। এ জন্য জাতিভেদের নিয়ম অনুসারে ১০-১২-১৫-৩০ দিন অশৌচ পালন শেষে ব্রাহ্মণ দ্বারা মৃত ব্যক্তির শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান করে তারপর পবিত্র হতে হয়। শুধ্যেদ্বিপ্যো দশাহেন দ্বাদশাহেন ভূমিপঃ।/বৈশ্য পঞ্চদশাহেন শূদ্রো মাসেন শুধ্যাতি।।” -- যারা ১০দিন অশৌচ পালন শেষে ১১দিনে শ্রাদ্ধনুষ্ঠান করে তারা ব্রাহ্মণ, যারা ১২দিন অশৌচ পালন শেষে ১৩ দিনে শ্রাদ্ধনুষ্ঠান করে তারা ক্ষত্রিয়, যারা ১৫দিন অশৌচ পালন শেষে ১৬দিনে শ্রাদ্ধনুষ্ঠান করে তারা বৈশ্য, আর যারা ৩০ দিন অশৌচ পালন শেষে ৩১ দিনে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করে তারাই শূদ্র।এরকম হাজারো বৈষম্যমূলক নিয়মনীতি শূদ্রদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, ঘৃণ্য করে তুলেছে। বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, মনুসংহিতা, রামায়ণ, মহাভারত সর্বত্রই শূদ্রদের অপমানের বিবরণ। প্রতি পদে পদে শূদ্রদের প্রান্তিক করে দিয়েছে, শৃঙ্খলিত করেছে। উদাহরণ দিয়ে প্রবন্ধটি ভারাক্রান্ত করতে চাই না। স্বধর্মে নিধনং শ্রেয় পরাধর্মো ভয়াবহঃ” – সে সময় হিন্দুধর্মের মতো সন্মিলিত ধর্মের সৃষ্টি হয়নি, সে সময়ের ভারতীয় ধর্মকে সনাতন ধর্ম বললেই সঠিক হয়। গীতায় উল্লিখিত এই ধর্ম আসলে ব্রাহ্মণ ধর্ম, ক্ষত্রিয় ধর্ম, বৈশ্য ধর্ম এবং শূদ্র ধর্ম।এই ধর্ম রক্ষা করতেই ত্রেতাযুগের রাজা রামচন্দ্র শূদ্র শম্বুককে হত্যা করেছিলেন।তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি তপস্যা করে ব্রাহ্মণ হতে চেয়েছিলেন।তার অপরাধ, তিনি লুকিয়ে বেদ পাঠ করেছিলেন।ঘটনাটি এ রকম : এক কুলিন ব্রাহ্মণের বালকপুত্র অসময়ে মারা যায় । রাজপুরোহিতরা রামকে বলেন, “রাজ্যে কেউ পাপ করেছে, যার ফলে এই অঘটন ঘটছে খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, শম্বুক নামে এক শূদ্র সশরীরে দেবত্ব পাওয়ার জন্যে তপস্যা করছে এবং তা সে নিজেই সেই কথা স্বীকার করল (রামায়ণ : ৭/৬/২) । সেই শূদ্রটি কথা বলতে বলতেই উজ্জ্বল খড়্গ কোশ থেকে বের করে তার শিরোচ্ছেদ করলেন রাঘব।তখন দেবতারা রামকে সাধুবাদ দিয়ে বললেন, “রাম তুমি দেবতাদের কার্যসাধন করলে, তোমার জন্য এই শূদ্র স্বর্গভাক হতে পারল না।” [পৃ: ১৩] রাবণ, কুম্ভকর্ণ, ইন্দ্রজিৎ, শূর্পনখা হত্যা তো আসলে শূদ্র তথা অনার্য হত্যাই। শূদ্র নির্যাতনের আর-একটি কাহিনি সকলেই কিছুটা জানেন, যা মহাভারতে বর্ণিত হয়েছে। ঘটনাটি এরকম : একলব্য ছিলেন মগধের অধিবাসী নিষাধরাজ হিরণ্যধনুর পুত্র। গুরুদেব দ্রোণের কাছে একলব্য গিয়েছিলেন যুদ্ধবিদ্যা শিখতে । কিন্তু একলব্য ক্ষত্রিয় ছিল না বলে দ্রোণ তাকে শিষ্য হিসাবে গ্রহণ করতে রাজি হননি।কিন্তু বালক একলব্য দ্রোণকেই গুরু মেনে গহীন বনে একমনে যুদ্ধবিদ্যা শিখতে থাকে । একদিন দেখা যায় একলব্য দ্রোণের ক্ষত্রিয় শিষ্যদের চেয়েও বড়ো যোদ্ধা হয়ে গেছেন । বনে ঘুরতে এসে একদিন দ্রোণ একলব্যের প্রতিভার পরিচয় পেয়ে জানতে চান কে তার গুরু । একলব্য দ্রোণকেই গুরু বলে জানায় । দ্রোণ তখন পশ্চিমাকাশে কালো মেঘ দেখতে পান। দূরদর্শী দ্রোণ গুরুদক্ষিণা হিসাবে একলব্যের ডানহাতের বুড়ো আঙ্গুল দাবি করে বসলেন।ডানহাতের বুড়ো আঙ্গুল কেটে ফেলা মানে ধনুক চালানো সারাজীবনের জন্য শেষ। তা সত্ত্বেও একলব্যকে বিনাবাক্যে গুরুকে তা দিয়ে দিতে হল।এই ঘটনাটিকে অনেকে অত্যন্ত মহান হিসাবে দেখে থাকে। কিন্তু আমি সেভাবে দেখতে পারছি না। খুঁজে দেখা যাক কেন একলব্যকে তার অত্যন্ত মূল্যবান বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠটি খোয়াতে হল। কারণ -- (১) শিক্ষাগুরুর প্রত্যক্ষ উপস্থিতি ছাড়াই একলব্য যে অস্ত্রবিদ্যা অর্জন করেছিল, সেই বিদ্যা তখনও পর্যন্ত দ্রোণের খাসশিষ্য অর্জুনের পক্ষে শেখা হয়ে ওঠেনি। কেন-না ব্রাক্ষণ ও ক্ষত্রিয় তথা দ্বিজ ছাড়া অন্য কারোকেই শিক্ষালাভ ও শিক্ষাদানের অধিকার দেওয়া হয়নি। কেবলমাত্র ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যেরা উপযুক্ত দক্ষিণার বিনিময়ে নির্দিষ্ট কয়েকটি বিষয়ে শিক্ষালাভ করতে পারত। শূদ্রের বেলায় যে-কোনো শিক্ষাই নৈব নৈব চ। অপস্তম্ভ ধর্মসূত্রে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে শূদ্র যদি বেদ পাঠ করে তবে তার জিহ্বা কর্তন করা হবে এবং যদি বেদপাঠ শ্রবণ করে তার কর্ণে গরম সিসা ঢেলে দেওয়া হবে। অতএব ক্ষত্রিয় অর্জুনকে পিছনে ফেলে শূদ্র একলব্য সামনে এগিয়ে যাবে তা কী করে হয়! মাহাত্ম্য দিয়ে কী মল ঢাকা যায় ? কারণ – (২) একলব্য ছিলেন মগধ দেশের উপজাতি। এই মগধের রাজা ছিলেন জরাসন্ধ এবং সেনাপতি ছিলেন শিশুপাল। মগধ ছিল হস্তিনাপুরের শত্রুদেশ, তাই হস্তিনাপুরের অন্নজলে প্রতিপালিত দ্রোণাচার্য চাননি যে তাঁর বিদ্যা হস্তিনাপুরের বিপক্ষে প্রয়োগ হোক। একলব্য অজেয় হয়ে উঠলে দ্রোণের সমূহ বিপদ। দ্রোণের মনোবাঞ্ছা পূরণ হবে না। কী সেই মনোবাঞ্ছা ? দ্রোণের সঙ্গে দ্রুপদরাজার ভয়ানক শত্রুতা ছিল। দ্রুপদরাজাকে উচিত শিক্ষা দিতে অর্জুনকেই দ্রোণের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল। দ্রোণ কৌরব-পাণ্ডবদের অস্ত্র শিক্ষা শেষে গুরু দক্ষিণা হিসাবে দ্রুপদকে বন্দী করে আনার কথা বললে, এঁরা দ্রুপদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং অর্জুন দ্রুপদকে বন্দী করে দ্রোণের কাছে নিয়ে আসেন।যদিও দ্রুপদ রাজার পুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন খড়গ দ্বারা দ্রোণের শিরশ্ছেদ করেন, আর দ্রুপদের মৃত্যু হয় দ্রোণের শাণিত অস্ত্রেই। যদিও রামায়ণ-মহাভারত মহাকাব্য বই অন্য কিছু নয়, তা সত্ত্বেও বলব এই মহাকাব্য দুটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না।এই মহাকাব্য দুটিতে প্রচুর ইতিহাসের  উপাদান আছে, যা তৎকালীন সমাজব্যবস্থার ছবি রক্ষিত আছে। সেই সমাজব্যবস্থায় ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয়ের প্রতাপ ছিল দোর্দণ্ড। এদের নির্দেশ ছাড়া গাছের একটি পাতাও নড়তে সাহস পেত না। রামায়ণ-মহাভারতের পরতে পরতে মনুসংহিতার নির্দেশিত ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-শূদ্রের ছবি স্পষ্ট হয়েছে। সেইজন্য বোধহয় ব্রাহ্মণ্যবাদের কর্তৃত্বে এই মহাকাব্য দুটি ধর্মীয় গ্রন্থের সন্মান পায়।মহাভারতে আমরা দেখতে পাই  ক্ষত্রিয় সমাজের অস্ত্রশিক্ষাও ব্রাহ্মণগণ নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছেন। ক্ষত্রিয় নন, অথচ পরশুরাম, দ্রোণাচার্য প্রমুখ ব্রাহ্মণগণ অস্ত্রগুরু হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করে। রাজকার্য পরিচালনাতেও তারা ক্ষত্রিয়দের অভিভাবক হন। ব্রাহ্মণসেবা ও তাদের নির্দেশ পালন করাই হল ক্ষত্রিয় রাজার অবশ্য-পালনীয় কর্তব্য।তাই ব্রাহ্মণ বশিষ্ঠের নির্দেশে ক্ষত্রিয় রামচন্দ্র শূদ্রপণ্ডিত শম্বুকের ধড় থেকে মুণ্ডু আলাদা করে দেন। ভগবান (?) মনু যতভাবেই প্রত্যাখ্যাত হোন-না-কেন, বৃহত্তর সংখ্যার মানুষ কিন্তু মনুর প্রভাব থেকে কোনোভাবেই মুক্ত হতে পাচ্ছেন না।আজও নানাভাবে সমাজে এবং বর্তমানের আধুনিক সমাজে আবর্তিত হচ্ছেন। মনু তাঁর হিন্দুত্বের প্রলম্বিত ছায়া দিয়ে আধুনিক সময়ের সমাজকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রাখার চেষ্টা করে চলেছেন। সেই চেষ্টা উচ্চবর্ণেরা তো করেই, তার চেয়ে বেশি করে নিন্মবর্ণেরা।এমনকি দেখা যায়, উচ্চবর্ণদের কেউ কেউ যদিও উদারতার পরিচয় দিতে চায়, সেক্ষেত্রে নিন্মবর্ণের মানুষেরাও নিদান নিয়ে আসে, হিন্দুধর্ম শেখায়।মনুবাদে এত আনুগত্য ! যদিও ২০০০ সালের  ৩০ জানুয়ারি পাইওনিয়ারপত্রিকায় তথ্য দিয়ে ছাপা হয়েছিল জাতপাত ব্যবস্থাভিত্তিক ধর্মের অনুশাসনে ভারতে শত শত বছরে লক্ষ লক্ষ দলিত নিহত হয়েছেন শুধুমাত্র দলিত হওয়ার অপরাধে।তার মধ্যে প্রায় ত্রিশ লক্ষ দলিত নিহত হয়েছে স্বাধীনতা-উত্তর পর্বে।জ্ঞাতসারেই হোক কিংবা অজ্ঞাতসারে মনুর নির্দেশ নিরন্তর পালিত হয় সারা ভারতেই। মনু শূদ্র নিধনের জন্যে তো প্রেরণা দিয়েই রেখেছেন তাঁর মূল্যবান সংহিতায়। একাদশ অধ্যায়ের ১৩১ নম্বর শ্লোক তথা নির্দেশে বলছেন একটা শূদ্র হত্যা করলে একটা বিড়াল বা নকুল বা চাষপক্ষী বা ভেক বা কুকুর বা গাধা বা পেচক বা একটা কাক পাখি হত্যার সমান পাপ হয় এবং সেই পাপ স্খালনের জন্যে ঠিক ততটুকুই প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। মার্জারনকুলৌ হত্বা চাষং মণ্ডূকমেব চ।/শ্বগোধোলূককাকাংশ্চ শূদ্রহত্যাব্রতং চরেৎ।।একজন শূদ্রহত্যা একটি ব্যাঙ হত্যার সমান। খুবই ক্ষুদ্র বা তুচ্ছ কাজ বটে !  উচ্চবর্ণের হিন্দুত্ববাদীদের মদতে পুষ্ট বিহারের রণবীর সেনানামের সংগঠন শূদ্রহত্যার কাজে নিবেদিতপ্রাণ। ভারতে প্রতি ঘণ্টায় দুজন শূদ্র প্রহৃত হয়, প্রতিদিন ধর্ষিতা হন তিনজন দলিত নারী, প্রতিদিন খুন হচ্ছেন দুজন দলিত এবং পুড়িয়ে দেওয়া হয় দুটি দলিত-গৃহ (Report of the Ministry of Welfare of the Government of India, 1992-1993)এহেন ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং ব্রাহ্মণদের গা-জোয়ারি ফতোয়া যে সকলে মুখ বুজে মেনে নিয়েছেন,তা কিন্তু মোটেই নয়। প্রতিবাদ যেমন হয়েছে, বিদ্রোহও হয়েছে।প্রতিবাদ যে হয়েছে তার প্রমাণ চার্বাক, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, বৈষ্ণব প্রভৃতি ধর্ম বা দর্শন ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ফল।এইসব ধর্ম বা দর্শন গড়ে উঠেছিল ব্রাহ্মণ্যবাদের সৃষ্ট অস্পৃশ্যতা ও পতিতদের ঘৃণার বিরুদ্ধেই। এইসব ধর্ম বা দর্শন সমাজের প্রান্তিক/অচ্ছ্যুত/ব্রাত্য/দলিত/শূদ্র/পতিত/অন্ত্যজদের সাম্যবাদের সমাজ উপহার দিল।বিরোধিতা বা মুখ খোলার পরিণাম কী হয়েছিল তা ইতিহাসেই রক্তের অক্ষরে লিপিবদ্ধ আছে। সম্ভবত চার্বাকরাই সর্বপ্রথম ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে মুখ খোলে। শুধু ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধেই নয়, প্রতিবাদ করেছে বেদের বিরুদ্ধেও।তাই চার্বাকরা নাস্তিক তকমা পেল।পারলৌকিক নয়, ইহজাগতিক সুখ ভোগই মানুষের একমাত্র কাম্য বলে চার্বাকরা মনে করত। চার্বাক দর্শনের প্রভাব বুদ্ধের সময় ও প্রাক-বুদ্ধ যুগে উপস্থিত ছিল বলে অনেকে মনে করে থাকেন।মৈত্রায়ণীয় ও ছান্দোগ্য উপনিষদের রচনাকালেই চার্বাক মতবাদের গোড়াপত্তন হয়েছিল বলে অনুমান করা যায়। ঐতরেয় উপনিষদের কিছু অনুচ্ছেদে দেহাত্মবাদ ও বৃহদারণ্যক উপনিষদে মরণোত্তর চৈতন্যের অস্তিত্বের অস্বীকৃতির স্বপক্ষে কিছু শ্লোকের উল্লেখ পাওয়া যায়। কঠ উপনিষদের পরলোকগামী আত্মার অস্তিত্বে অবিশ্বাসী সম্প্রদায়ের উল্লেখ পাওয়া যায়।ছান্দোগ্য উপনিষদ ও বৃহদারণ্যক উপনিষদের রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে বুদ্ধদেবের আবির্ভাবের পূর্ববর্তী বলে অনুমান করা হলে চার্বাক মতের জন্ম এই কালেই হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়।চার্বাকগণ মনে করেন, ব্রাহ্মণরা হিন্দু নয়। বেদ, গীতা, মনুসংহিতা ইত্যাদি ব্রাহ্মণ্যধর্মের শাস্ত্র। চতুর্বর্ণপ্রথা, জাতপাত, অস্পৃশ্যতা এগুলি ব্রাহ্মণ্যধর্মের জিনিস। ব্রাহ্মণ্যধর্ম হিন্দুধর্ম নয় বা হিন্দুধর্মের কোনো অংশ নয়। ব্রাহ্মণ্যধর্ম হিন্দুধর্মের উপর পরগাছার মতো চেপে বসা একটি ধর্ম। আর এই ব্রাহ্মণ্যধর্মকে অবলম্বন করেই ব্রাহ্মণরা হিন্দু জাতির উপর আধিপত্য করে যাচ্ছে। হিন্দু জাতির উপর ব্রাহ্মণদের আধিপত্য কায়েম করার জন্যই ব্রাহ্মণ্যধর্মের সৃষ্টি। ব্রাহ্মণ্যধর্মকে সেভাবেই তৈরি করা হয়েছে, ব্রাহ্মণ্য ধর্মশাস্ত্রে ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিধিবিধান, নিয়মনীতি, সত্য-অসত্য বোধ বা পাপপুণ্যের ধারণাকে সেভাবেই সাজানো হয়েছে, যাতে তা নিঃসংশয়ে হিন্দুজাতির উপর ব্রাহ্মণদের প্রভুত্বকে কায়েম করে এবং হিন্দু জাতিকে ব্রাহ্মণদের বিশ্বস্ত ও অনুগত ক্রীতদাসে পরিণত করে।এইভাবেই চার্বাকগণ ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরোধিতা করতেন। কিন্তু লোকবল, বাহুবল এবং অস্ত্রবল না-থাকায় ব্রাহ্মণ্যবাদীদের রক্তচক্ষুর সামনে চার্বাকগণ পরাস্ত এবং নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল চিরতরে।পুড়িয়ে দেওয়া হল চার্বাকদের রচিত গ্রন্থসমূহ। ব্রাহ্মণবাদীরা চার্বাকদের নিশ্চিহ্ন করতে সমর্থ্য হলেও, বৌদ্ধদের সঙ্গে তেমন এঁটে উঠতে পারেনি । ব্রাহ্মণ্যবাদের চরম বিরোধিতা করে বৌদ্ধদর্শন এবং বৌদ্ধ অনুগামীরা সারাভারতে অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকল।বুদ্ধের সময়কার সমাজে ব্যাপক ক্রীতদাস প্রথা ছিল, ভয়ংকর দারিদ্র্য ছিল। অত্যন্ত চড়া সুদে ঋণ দিতেন শ্রেষ্ঠী, বণিক, ধনী সম্প্রদায়। ঋণে জামিন হিসেবে সম্পত্তি না রাখতে পারলে বউ, বোন বাঁধা রাখতে হত ঋণদাতার কাছে। এই মহিলাদের শ্রমের সঙ্গে দেহ দিতে হত। এরপর ঋণ শোঢ না হলে ঋঙরহীতাকে দাস থেকতে হত ঋণদাতার কাছে। দারিদ্র্য ও দাসত্বের এই যন্ত্রণা ও দুঃখছিল ভয়ংকর। শ্রমজীবী শূদ্রদের জীবনও ছিল বিভীষিকাময়। দিন থেকে রাত কঠোর শ্রমের বিনিময়ে এক বেলা উচ্ছিষ্ট খাবার মিলত। ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলোতে যাদের শূদ্র বলে ঘোষণা করা হয়েছিল, বৌদ্ধ গ্রন্থে তারাই চণ্ডাল, নেসাদ, পুক্কুস নামে পরিচিত। পরিচয় পাল্টালেও ধনী মহাজনদের উৎপীড়ণ একই রইল।শোষিত শূদ্ররাও বৌদ্ধ ধর্মকে গ্রহণ করে ঘৃণ্য জীবন থেকে মুক্তি পেয়েছিল। উচ্চবর্ণের ভারতীয় দার্শনিক ও ঐতিহাসিকরা বুদ্ধকে উপজাতীয় থেকে ক্ষত্রিয় বানিয়ে ছেড়েছেন। শুদ্ধোধনকে বানালেন রাজা। অথচ বুদ্ধের সময়কার ব্রাহ্মণ ও উচ্চবর্ণের মানুষদের কাছে বুদ্ধ ছিলেন নীচবংশীয় মানুষ।চরক, সুশ্রুত, নাগার্জুন, ভাস্করাচার্য, বাৎসায়ন, কৌটিল্য, পাণিনি, অশ্বঘোষ প্রমুখ মননশীল পণ্ডিতরা ছিলেন বৌদ্ধ বা বৌদ্ধভাবাশ্রয়ী। বৌদ্ধ যুগে একটা সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটে গিয়েছিল।ভারতবর্ষে তখন বৌদ্ধ ধর্ম রয়েছে। বৌদ্ধ ধর্ম হল উদার। জাত-পাত-বর্ণ নেই। সবাইকে গ্রহণ করতে হাত বাড়িয়েই আছে। এই অবস্থায় বিদেশ থেকে আগত রাজশক্তি বৌদ্ধধর্মকে গ্রহণ করাকেই সম্মানজনক মনে করেছিলেন। এই কারণেই গ্রিক, শক, কুষাণ প্রভৃতি রাজশক্তি ও তাদের সঙ্গে আসা সৈন্য-সামন্ত বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিল। ফলে স্বাভাবিক নিয়মেই বৌদ্ধধর্ম রাজশক্তির সহযোগিতায় তুঙ্গে উঠেছিল।বৌদ্ধধর্মের উত্থান ঠেকাতে কিছুটা কৌশল গ্রহণ করল। তারা গ্রিক, শক, কুষাণদের পতিত ক্ষত্রিয়বলে আখ্যা দিল। এতে দুটি ঘটনা ঘটল। (১) ব্রাহ্মণ্যবাদীদের বর্ণপ্রথা বড়ো ধরনের ধাক্কা খেল। ব্রাহ্মণ্যবাদীদের একটা বড়ো অংশই বর্ণের নতুন সমীকরণ মেনে নিল না। (২) সমাজের বহু নিচু বর্ণের মানুষ বিদেশিদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে সমাজের দু-এক ধাপ উপরে উঠতে চেষ্টা করল।এরপর একটা প্রশ্ন উঠে আসতেই পারে, অশোক তো বিদেশি ছিলেন না, তিনি কেন বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন? যুদ্ধ, হত্যা, লুণ্ঠন, রক্তপাতের মধ্য দিয়ে অশোক তাঁর রাজত্বকে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিলেন। এই বিস্তৃতির পেছনে সামরিক শক্তি প্রয়োগের প্রয়োজন হয়েছে। সেই রক্তাক্ত হাত ধুয়ে ফেলতেই ধর্ম পরিবর্তন করে নিরামিষাশী হয়ে গেলেন।সবাই বললেন বোধোদয়।তারই পরিণতিতে অশোক অহিংস বৌদ্ধধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। বৌদ্ধধর্মের নিরন্তর প্রসারে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা ভীত হয়ে পড়লেন।ব্রাহ্মণরা ফতোয়ায় অতিষ্ঠ হয়ে ওঠা শূদ্র তথা অন্ত্যজরা ব্রাহ্মণ্যধর্ম ত্যাগ করে দলে দলে বৌদ্ধধর্মে চলে যাচ্ছিলেন।সংকটে পড়ে গেল ব্রাহ্মণ্যধর্ম। অপ্রতিরোধ্য বৌদ্ধধর্মকে প্রতিরোধ করতে আদি শঙ্করাচার্যকেও আসরে নামতে হয়েছিল। তারা বোঝাতে সক্ষম বৌদ্ধধর্মে যাওয়া আর ব্রাহ্মণ্যধর্মে থাকা একই ব্যাপার। কারণ ভগবান বুদ্ধ স্বয়ং বিষ্ণুরই অবতার। বুদ্ধ ব্রাহ্মণ্যধর্মেরই অংশ।বলা হয় বৌদ্ধধর্ম সবসময়ই হিন্দুধর্মের ভিতরেই। যদি হিন্দুধর্মের মধ্যেই তবে বুদ্ধের সংস্কার হিন্দুধর্ম কেন মেনে নেয়নি তার উত্তর পাওয়া যায় না।যাই হোক, ব্রাহ্মণ্যবাদের তীব্র প্রভাবে বৌদ্ধরা ভারতে গুটিয়ে গেলেও ভারতের বাইরে বিস্তার লাভ করতে কোনো অসুবিধাই হয়নি। পরবর্তীতে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের কাছে খুব চাপ হয়ে গেল ভারতে মুসলিমদের আগমনের পর।রিচার্ড ইটনের প্রামাণিক গ্রন্থ দি রাইজ অফ ইসলাম অ্যান্ড দি বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ারসূত্র থেকে জানা যায়, মুঘল যুগে কোন্ অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটের নতুন কারণে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় কৃষকরা ইসলাম ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল এই আকৃষ্ট এতটাই ছিল যে অবিভক্ত বাংলাদেশে মুসলিমরাই সংখ্যাগুরু হয়ে গেল। কীভাবে ? সহজিয়া দর্শনের প্রথম সাংস্কৃতিক প্রকাশ ঘটেছিল নবম-দশম শতাব্দীতে বাংলাভাষার আদিস্রষ্টা সিদ্ধাচার্যের রচিত চর্যাপদে। চর্যাপদে যে সহজসাধনার প্রকাশ পরিলক্ষিত হয়েছিল তা ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রাতিষ্ঠানিকতার সব শৃঙ্খল পরিত্যাগ করতে উন্মুখ ছিল। সহজিয়া দর্শনে আত্মোপলব্ধির জন্য, বিগ্রহ ও ব্রাহ্মণের প্রয়োজন নেই। ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথম দশকে সেনবংশের রাজাদের অপসারিত করে তুর্ক-আফগান সেনানায়করা সংগঠিত সেনাবাহিনী নিয়ে বাংলার সমাজে নতুন প্রক্রিয়ার উদ্ভবের সূচনা করে।বলাই বাহুল্য, তুর্ক-আফগান সেনানায়কদের ধর্ম ছিল ইসলাম।সে সময় ব্রাহ্মণ্যধর্মের জাতপাতের জাঁতকলের নিষ্পেষণ থেকে মুক্তি পেতে নিন্মবর্গের মানুষেরা ইসলাম ধর্মে চলে আসে।জোর করে ভয় দেখিয়ে মুসলমানরা ব্রাহ্মণ ধর্মাবলম্বীদের ইসলাম ধর্মে টেনে আনা হয়েছিল, একথা সর্ব্বৈ সত্য নয়। যে ইসলামকে বাঙালি মুসলমান গ্রহণ করেছিল তা গোঁড়া মোল্লা ও মৌলভীদের ধর্মীয় আদেশ দ্বারা পরিচালিত হয়নি। সেই গ্রহণ প্রক্রিয়ায় ইসলামের সুফি মতবাদের প্রভাব সবচেয়ে বেশি অনুভূত হয়েছিল। কারণ তার মেলবন্ধন ঘটেছিল প্রাক-মুসলিমসহজিয়ামানবধর্মের সঙ্গে, বিশেষত সমন্বয়ধর্মী নির্গুণবাউল সহজিয়াদের সঙ্গে লোকায়ত স্তরে। সুফি সাধকরা বাংলার সহজিয়াদের কাছে এসেছিলেন, কারণ উভয়ই বাংলার সমাজে ব্রাহ্মণ্যধর্মের আরোপিত বর্ণভেদের বিরোধিতা করতে প্রস্তুত ছিলেন। উভয়ই গোঁড়া হিন্দু পণ্ডিত ও মুসলমান শাস্ত্রজ্ঞদের অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন।সুফি দর্শনের মেলবন্ধনের প্রক্রিয়াটি সক্রিয় ছিল বাংলার তুর্ক-আফগান ও মুঘল রাজত্বকালে। সেই মেলবন্ধনের প্রক্রিয়ার প্রেক্ষাপটেই নিন্মবর্গের মানুষরা ইসলামকে গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছিল, সক্ষম হয়েছিল লোকায়ত সমন্বয়বাদী দর্শনের আধারে।ইসলাম ধর্মকে কখনো জোরপূর্বক চাপানো হয়নি তুর্ক-আফগান ও মুঘল রাজত্বের সময়।এই ধর্মের প্রসার ঘটেছিল সুফি সাধকদের সমন্বয়বাদী তৎপরতার ফলে। ১৮৭১ সালে জনগণনা হয়। এই সময় থেকে বাঙালি জাতির উদ্ভব বিকাশ ইত্যাদি নিয়ে কথা শুরু হয়।১৮৭২ সালেই জনগণনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায় স্থানীয় মুসলমানরা বেশিরভাগই নিচুজাতের হিন্দুসমাজ থেকে উদ্ভূত। ত্রয়োদশ এবং চতুর্দশ শতাব্দীতে সারাভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ইসলাম ধর্মের প্রচার শুরু হয়। তখনকার সামাজিক অবস্থা বিরাট অংশের নিন্মবর্ণের হিন্দুরা ইসলাম ধর্মে চলে আসে। নিন্মবর্ণের হিন্দুরা ইসলাম ধর্মে গেলেন কেন ? শুধুই কি জাতপাতের ঘৃণা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য, নাকি অন্য কোনো কারণ ? ইসলাম ধর্মের তত্ত্বে কি জাতিভেদের কোনো স্থান নেই ? জাতপাত ইসলাম ধর্মেও আছে।ইসলামি সমাজকে প্রধানত দু-ভাগে ভাগ করা যায় – (১) শিয়া এবং (২) সুন্নি। শিয়াকে আবার দুই ভাগে ভাগ হয়েছে – (১) ইসনে আসারিয়া এবং (২) ইসমাইলিয়া। অপরদিকে সুন্নিদেরও দুই ভাগে ভাগ করা হয় – (১) শরিয়তি এবং (২) মারফতি। শরিয়তিও দুই ভাগে বিভক্ত – (১) হানাফি এবং (২) মোহম্মদী/আহলে হাদিস। হানিফরা চারভাগে বিভক্ত – (১) হানাফি, (২) সাফি, (৩) হাম্বলি ও (৪) মালেকি।এইভাবে ৮০টি ভাগ জানা যায়। হিন্দু সমাজে জাতবর্ণ প্রথা এক সচল প্রথা। চতুর্বর্ণের অজস্র উপবিভাগ এবং সংকর জাতগুলির উদ্ভব এক দীর্ঘ সময়ের প্রক্রিয়ার ফসল।বৃত্তি ও তৎসংক্রান্ত বৈশিষ্ট্যগুলি ধর্মান্তরিত জনগণের মধ্যে বেঁচে থাকায় কসাইরা গোষ্ঠীবদ্ধ হয়েছিল। আর প্রাচীন ভারতে যারা যত শ্রম করে তারা তত ঘৃণিত নীচুজাত। বৃত্তি বাহিত হয়ে পুরুষানুক্রমে এই বৈশিষ্ট্য ইসলামি জনগণের মধ্যেও বাহিত হয়েছে।তাই বলে ইসলামে জাতপাত নেই, একথা বলা যায় না। তবে ছোটোজাতের মানুষগুলো কতটা ঘৃণিত হয়ে থাকে তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। মুসলিম শাসনের প্রায় ৭০০ বছরে এই ভারত উপমহাদেশে জাতপাত নিয়ে বহু জলঘোলা হয়েছে। জাতপাতের ঘৃণা থেকে মুক্তি পেতে অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষগুলো বারবার অবস্থান পরিবর্তন করেছে। ধর্মান্তরিত হয়েছে। গোষ্ঠী বদল করেছে। জাতপাতের ইস্যু নিয়ে মুসলিম শাসন চলাকালীনই উত্থান হয়েছে ব্রাহ্মসমাজ, বৈষ্ণব আন্দোলন, খ্রিস্টান বা মিশনারিদের। ব্রাহ্মসমাজ বা ব্রাহ্মসভা উনিশ শতকে স্থাপিত এক সামাজিক ও ধর্মীয় আন্দোলন যা বাংলার পুনর্জাগরণের পুরোধা হিসাবে পরিচিত।কলকাতায় ১৮২৮ সালে ২০ আগস্ট হিন্দুধর্ম সংস্কারক রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩) ও তার বন্ধুবর্গ মিলে এক সার্বজনীন উপাসনার মাধ্যমে ব্রাহ্মসমাজ শুরু করেন।কিন্তু কেন এ ব্রাহ্মসমাজ ? বস্তুত ব্রাহ্মসভার মূল বক্তব্য ছিল, ঈশ্বর এক ও অভিন্ন, সকল ধর্মের মূল কথা এক । রাজা রামমোহন রায়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেশবচন্দ্র সেন, অক্ষয়কুমার দত্তের মতো প্রসিদ্ধ মানুষেরা এই আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন। একেশ্বরবাদ, ধর্মের গোঁড়ামি, শাস্ত্রীয় আচারপালন, কুসংস্কার এবং অবশ্যই জাতিভেদ প্রথা পুরোপুরি বিলোপ করার পক্ষে মত প্রকাশ করেন তাঁরা। ব্রাহ্মসমাজের উদ্দেশ্য হিন্দু সমাজে প্রচলিত বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, কৌলিন্য প্রথা, জাতিভেদ, অস্পৃশ্যতা, গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন প্রভৃতি কুপ্রথার অবসান ঘটানো । সেই সঙ্গে নারীদের মধ্যে উচ্চশিক্ষার প্রচলন করে ভারতীয় নারীদের সামাজিক অবস্থার উন্নতি সাধন করা । তবে ব্রাহ্ম আন্দোলন আর বেশি দূর অগ্রসর হতে পারে নি, বরং দিনে দিনে শক্তি হারাতে থাকে। অর্থাৎ ব্রাহ্মসমাজের মানুষরা ব্রাহ্মণ্যধর্মের তীব্র বিরোধিতা করলেও, ব্রাহ্মণ্যধর্মের দাপটে ব্রাহ্মসমাজ বৃহত্তর মনুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেনি। তাই এই সমাজ সমাজে প্রান্তিক হয়েই রইল। শ্রীচৈতন্য মধ্যযুগে (বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার নবদ্বীপে) আর্যাবর্তেও বৈদিকধর্মের চতুর্বর্ণ প্রথার (Caste System) নিষ্পেষণ এবং বিদেশি শাসকদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে এক অহিংস আধ্যাত্মিক আন্দোলনের সঞ্চার করেন, যার নাম গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম। ধর্মগুরু আর রাজ-শাসনের অত্যাচারে জর্জরিত বাংলার দিশেহারা অন্ত্যবর্ণ সাধারণ জনগণকে তিনি মুক্তির পথ দেখিয়েছেন, ঐক্যবদ্ধ করেছেন এবং নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহস জুগিয়েছেন এই আন্দোলনের মাধ্যমে। তাঁর আবির্ভাবে এবং কর্মতৎপরতায় গণমানুষের উদ্যোগে তৎকালীন সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আসে। মানুষ হিসেবে জন্মলাভ করে স্বাভাবিক মনুষ্য জীবনযাপন করা সম্ভব হয়। ধর্মের জন্য মানুষ না-হয়ে মানুষের জন্য ধর্ম -- এই বোধ সৃষ্টি হয়। বাংলা ভাষায় বৈষ্ণব সাহিত্যের নতুন ধারা সৃষ্টি হয়, যা গণমানুষকে জাগাতে সাহায্য করে। বাংলার সংস্কৃতিতে উদারনৈতিকতা, সহনশীলতা ও সাহসিকতার রূপান্তর ঘটে। গৌড়ীয় বৈষ্ণব আন্দোলন বাঙালি সভ্যতাকেও ভারতীয় হিন্দু সভ্যতা থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে। তাই, বাঙালির গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মকে আর্যাবর্তের বৈদিক ধর্ম থেকে পুরোপুরি আলাদা মনে করাই সংগত। ধর্মতত্ত্বের ইতিহাসে দেখা যায়, কোনো ধর্ম ভৌগোলিক সীমায় আবদ্ধ না-থাকলেও প্রতিটি ধর্মের আবির্ভাব ঘটেছে একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকায়, সেখানকার সামাজিকসাংস্কৃতিক সংকট সমস্যাকে কেন্দ্র করে। যেমন ইসলামের উদ্ভব হয়েছে আরবের মক্কায় হজরত মোহাম্মদের  মাধ্যমে সেকালের আইয়ামে জাহেলিয়াতথেকে মুক্তিকে কেন্দ্র করে। ঠিক তেমনই গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মও এসেছে প্রাচীন বাংলার বাঙালি শ্রীচৈতন্যের মাধ্যমে তৎকালীন হিন্দুধর্মের চতুর্বর্ণ প্রথা, বিদেশি শাসকদের নিপীড়ন এবং হিন্দুমুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের এলিটদের জোরজবরদস্তি থেকে ব্রাত্যজনের মুক্তির বার্তা নিয়ে। বাংলায় চৈতনদেবের আন্দোলনে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা কেঁপে ওঠে। কেঁপে ওঠাই স্বাভাবিক। একদিকে হুসেন শাহর আমলে ব্রাহ্মণ্যধর্মী অন্ত্যজদের ইসলামপ্রীতি, অপরদিকে চৈতন্যদেবের কৃষ্ণপ্রেমে আকৃষ্ট হয়ে ছোটোজাতের মানুষগুলো বৈষ্ণবধর্মে ভিড়তে থাকল। চেতন্যদেবের শোভাযাত্রা ক্রমশ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকল। ব্রাহ্মণ্যধর্ম প্রত্যাখ্যান করে  জাতপাতমুক্ত বৈষ্ণবধর্মে অন্ত্যজদের আত্মসমর্পণ। ব্রাহ্মণ্যবাদীরা ক্ষেপে উঠলেন। কিছুটা দিশাহারাও। হয়ে উঠলেন প্রতিহিংসাপরায়ণ। মাহাত্ম্যের খর্বতায় ভীত-সন্ত্রস্ত। একদিকে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের দিকে ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মে সাঁড়াশি আন্দোলন, অন্যদিকে বৈষ্ণব ধর্মের দিকে ইসলাম তথা রাজরোষ এবং ব্রাহ্মণ্যবাদীদের প্রতিরোধ। উভয় সংকটের ধর্ম সংকট। চৈতন্যদেবের অন্তিম পর্ব সম্পর্কে যৌক্তিক বিদ্যায়তনিক সংশয় অপেক্ষা, অযৌক্তিক অপপ্রচারই বড়ো হয়ে উঠেছে বলে মনে হয়৷ সন্দেহ কেনদুটি স্পষ্ট কারণ -- (১) চৈতন্যদেবের মৃত্যু ঠিক কীভাবে হল সেই প্রশ্নের সঠিক উত্তর জানা নেই৷ এবং (২)  শ্রীচৈতন্য জগন্নাথে মানে নীলাচলে লীন হয়ে গেলেন, এই প্রচার অনেকেই তাঁকে হত্যারই করার সন্দেহ করছেন৷  জয়ানন্দের পায়ে ইট লেগে মৃত্যু”-র তত্ত্ব বাস্তবে এক্কেবারেই অসম্ভব নয়৷ কিন্তু অন্যান্য কাব্যগুলি এই ভাবনাকে সমর্থন করে না বলে এ নিয়ে মানুষের সন্দেহ আছে৷ চৈতন্যদেবের জগন্নাথে লীনহয়ে যাওয়ার বর্ণনা এই সন্দেহকে আরও জোরদার করেছে৷ অনেকের ধারণা পাণ্ডারা তাকে হত্যা করে এই প্রচার করেছে মহাপ্রভু জগন্নাথে লীন হয়ে গেছেন! নিরঞ্জন ধর তাঁর অবতার শ্রীচৈতন্য ও মানুষ নিমাইশিরোনামে একটি প্রবন্ধে যেকথা লিখেছেন, সেটি সংক্ষেপে উল্লেখ করা যাক: রাজরোষ”-এ পড়ে চৈতন্য নীলাচলবাসী হন এবং প্রতাপরুদ্রের সভাপণ্ডিত নিযুক্ত হন। রাজরোষথেকে নিজেকে রক্ষা করতেই নিমাই গৃহত্যাগী হন। মহানিষ্ক্রমণের রাতে নিমাই দুই বলবান মায় বিশ্বস্ত সহচর গদাধর ও হরিদাসকে নিজের দু-পাশে নিয়ে শুয়েছিলেন। এ ঘটনায় বোঝা যায়, নিমাই ওই রাতের অন্ধকারে সুলতানের লোকেরা তাঁকে ধরতে আসতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা করেছিলেন। ইতিমধ্যেই যে সুলতান তাঁর বিশ্বস্ত হিন্দু কর্মচারী কেশবছত্রীর উপর চৈতন্যকে ধরে আনার ভার দিয়েছেন। একথা শোনামাত্র সেদিনই রাতের অন্ধকারে তিনি ওই স্থান ত্যাগ করেন। রাজশক্তির সঙ্গে প্রকাশ্যে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছিলেন নিমাই। নিমাই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন।সঙ্গে দণ্ড রাখতে শুরু করেন তিনি। চরম নিরাপত্তাহীনতার কারণে নিমাই নবদ্বীপ ছেড়ে পুরীতে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করতে মনস্থ করেন। কারণ একাধিক। প্রথমত ওড়িশা তখন পূর্ব ভারতের সবচেয়ে শক্তিশালী হিন্দুরাজ্য, তদুপরি বৈষ্ণব-প্রভাবিত ছিল।দ্বিতীয়ত পুরী বৈষ্ণবদের এক সর্বভারতীয় প্রধান তীর্থক্ষেত্র বটে এবং পুরীর রাজা প্রতাপরুদ্ররা স্বয়ং ছিলেন বৈষ্ণবভাবাপন্ন। সর্বোপরি, নবদ্বীপবাসী যাঁরা মুসলিম শাসকদের অত্যাচারে ও নানা ফতোয়ায় অতিষ্ঠ হয়ে দেশত্যাগ করেছিলেন, তাঁরা প্রায় সকলেই পুরীতে এসে জমায়েত হয়েছিল। বাংলা-ওড়িশার সীমান্তের পরিস্থিতি কিছুটা অনুকূল থাকলেও চৈতন্য কোনো ঝুঁকি নেননি।তাঁর বিশ্বস্ত অনুচর রামচন্দ্র খাঁনের সঙ্গে তিনি আগে থেকেই আগাম বন্দোবস্ত করেছিলেন, যাতে তিনি নির্বিঘ্নে বাংলা-ওড়িশা সীমান্ত অতিক্রম করতে পারেন। তিনি বাংলার রাজরোষ অতিক্রম করে সীমান্ত পেরিয়ে ওড়িশায় প্রবেশ করলে এতটাই নিরাপদ বোধ করছিলেন যে, সর্বক্ষণের সঙ্গী তাঁর হস্তস্থিত দণ্ড সপাটে ভেঙে ফেলেন।কিন্তু শেষরক্ষা হল কোথায় ! ওড়িশায় গিয়েও তিনি নোংরা রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। হ্যাঁ, চৈতন্য ওড়িশার অভ্যন্তরীণ রাজনীতির শিকার হয়েছিলেন।বস্তুত ওড়িশার সেদিনকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতি পরিষ্কার দু-ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। একদিকে প্রতাপরুদ্র ও চৈতন্যসম্প্রদায়, অপরদিকে বিদ্যাধর ও মন্দিরের পুরোহিতকুল। উৎকলবাসীরা শ্রীচৈতন্যকে যখন সচল জগন্নাথভাবতে শুরু করে দিয়েছেন, ঠিক সেই সময়কালে ঈর্ষান্বিত হয়ে ক্ষমতা দখলের চরম পর্যায়ের প্রস্তুতি হিসাবে গোবিন্দ বিদ্যাধর চৈতন্যশিবিরকে ছত্রখান করতে অগ্রসর হয়েছিলেন এবং জগন্নাথ মন্দিরের পুরোহিতকুলের সাহায্যপ্রার্থী হলেন। তাঁদের চৈতন্যবিরোধিতা তো ছিলই, উপরন্তু তাঁদেরকে আর্থিক টোপ দেওয়া হল। বলা হল তীর্থযাত্রী, ভক্তদের কাছ থেকে পূজা-দান-প্রণামী ইত্যাদি বাবদ মন্দিরের যে বিরাট আয় হত তার সবটুকুই পুরোহিতদের প্রাপ্য। চৈতন্য যে এইসব ষড়যন্ত্র বুঝতে পারেননি তা নয়। তা বুঝেই কাশীশ্বর নামে এক ভীমদেহী ব্যক্তি অঙ্গরক্ষক রূপে সর্বদা সঙ্গে সঙ্গে থাকতেন, যখন চৈতন্য মন্দির প্রদর্শনে আসতেন। যে দণ্ড তিনি সীমান্তে ভেঙে ফেলেছিলেন, তা আবার ধারণ করতে শুরু করলেন। তবুও শেষ রক্ষা হয়নি। সেদিন ছিল জগন্নাথের চন্দন উৎসব। চন্দন সরোবরের চারপাশে দর্শনার্থীদের ভিড় উপচে পড়ছে।মন্দির প্রায় পরিত্যক্ত বলা যায়। কয়েকজন প্রহরী ও দু-একজন পুরোহিত মন্দির-প্রাঙ্গনে টুকটাক কাজে ব্যস্ত। এমন সময় সতর্ক পাহারা এড়িয়ে চৈতন্য একাকী মন্দিরে এসে উপস্থিত।তিনি মন্দিরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে প্রবেশপথগুলি বন্ধ করে দেওয়া হল। চৈতন্য অনুচরেরা দরজা খোলার জন্য দরজার বাইরে হইচই করতে থাকলেন, ভিতর থেকে কোনো সাড়া এলো না। বেশ কয়েক ঘণ্টা পরে দরজা খুলে মন্দিরের প্রহরী জানিয়ে দিল যে  -- চৈতন্য জগন্নাথের অংশ, জগন্নাথের দেহে মিশে গেছেন এবং তাঁর মৃতদেহ জগন্নাথের আদেশে ক্ষেত্রপাল আকাশ দিয়ে বয়ে নিয়ে গিয়ে গঙ্গায় বিসর্জন দিয়েছেন। জগন্নাথ মন্দিরের পুরোহিতদের এহেন দুর্বল চিত্রনাট্য সরল ও শান্তিপ্রিয় বৈষ্ণবরা মাথা পেতে মেনে নিল বিনাবাক্যব্যয়ে। বৈষ্ণব তথা চৈতন্যভক্তগণরাও মনে করেন, ব্রাহ্মণ পাণ্ডারা চৈতন্যদেবের উপর সন্তুষ্ট ছিলেন না৷ তদুপরি চৈতন্যদেবকে একা একা মন্দিরে যেতে নিষেধ করা হয়েছিল৷ রাজা প্রতাপরুদ্র চৈতন্যদেবকে লিখিতভাবেই কড়া নিরাপত্তা দিয়েছিলেন৷ তাঁর মৃত্যু কীভাবে হয়েছিল, তাঁর মরদেহ কোথায় গেল এসব প্রশ্নের উত্তর আজ আর নেই৷ তবে অনেকেই মনে করেন মহাপ্রভু চৈতন্য অন্ত্যজদের উদ্ধার করার জন্য হরিনামে নগরকীর্তন করতেন না। মহাপ্রভু চৈতন্যদেব আসলে ব্রাহ্মণ্যবাদ রক্ষার্থেই অন্ত্যজদের নিয়ে এই সংগঠন করেছিলেন। কারণ তখন বাংলায় ছিল হুসেন শাহর আমল এবং সুফিবাদের প্লাবন। এ সময়ে প্রচুর অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষরা হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছিলেন। এই ধর্মান্তর স্রোতকে ঠেকাতেই ঘুর পথে অন্ত্যজদেরঅস্পৃশ্যবলে ঘৃণা -- এই অপবাদ এবং অপমানের অভিমানকে কাজে লাগিয়ে হিন্দুধর্মে ধরে রাখতে পারলেন তিনি, হিন্দুধর্মের শাখাধর্ম বৈষ্ণব ধর্মের আবরণে। ভারতীয় উপমহাদেশে সর্বশেষ ধর্মীয় আগ্রাসন এলো খ্রিস্টান মিশনারিদের হাত ধরে। টারগেট আবার সেই অশিক্ষিত দলিত শ্রেণি। ব্রিটিশ আগমনের সঙ্গে সঙ্গে প্রেম ছড়াতে ছড়াতে খ্রিস্টান মিশনারিরাও ঢুকে পড়ল ভারতের মাটিতে। খ্রিস্টান মিশনারি  খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারের কাজে নিয়োজিত সংগঠন। প্রধানত প্রোটেস্ট্যান্ট সম্প্রদায়ভুক্ত খ্রিস্টান মিশনারি উপনিবেশিক আমলে বাংলায় সক্রিয় থাকলেও তাঁদের সংযোগ স্থাপন শুরু হয় ষোলো শতকে। প্রারম্ভে জেসুইট ও রোমান ক্যাথলিকবৃন্দ একত্রে কাজ করেছেন এবং ১৫৯৯ সালে একটি গির্জা ও একটি মঠ স্থাপন করেন। ধর্মশিক্ষার জন্য একটি কনভেন্ট স্কুল ও সেন্ট পলের জেসুইট কলেজও প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৬২২ সালে সেইন্ট পল কলেজের রেক্টর হিসেবে ফাদার পিটার গোমেজের নিয়োগের মধ্য দিয়ে ধর্মসংক্রান্ত শিক্ষা কার্যক্রম পূর্ণোদ্যমে শুরু হয়। বি. রড্রিকস্, জেমস গোমেজ, সাইমন দি ফিগুরেডো ও আন্দ্রে ম্যাশাডো এটিকে শিক্ষাদান ও খ্রিস্টান ধর্মের সুসমাচার পৌঁছানোর একটি মহতী কেন্দ্রে পরিণত করেন। এক দশকের মধ্যে দশ হাজারের মতো ব্যক্তিকে ধর্মান্তরিত করা হয় বলে দাবি করা হয়।আঠারো শতকের শেষ দশকে ব্রিটিশ প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মপ্রচারকদের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলায় তথা গোটা ভারতবর্ষে খ্রিস্টান ধর্মপ্রচার কাজ একটি সংগঠিত আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে। সমসাময়িক ইংল্যান্ডে প্রোটেস্ট্যান্ট সম্প্রদায়ের পুনরুজ্জীবনের ফলে সকল দেশে খ্রিস্টের বাণী প্রচারের জন্য বেশ কয়েকটি ধর্মপ্রচারক সমিতি গঠিত হয়। এগুলির মধ্যে প্রধান কয়েকটি হল ১৭৯২, ১৭৯৫ ও ১৭৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত যথাক্রমে ব্যাপ্টিস্ট মিশনারি সোসাইটি, লন্ডন মিশনারি সোসাইটি ও চার্চ মিশনারি সোসাইটি।কয়েক দশক পর ১৮৩০ সালে আলেকজান্ডার  ডাফ (১৮০৮-১৮৭৮)-এর অধীনে স্কটল্যান্ডের গির্জা বাংলায় ধর্মপ্রচার কাজ শুরু করে। কিন্তু এ সকল গির্জা বাংলায় ধর্মপ্রচার কাজ চালানোর ক্ষেত্রে প্রোটেস্ট্যান্ট সম্প্রদায়ভুক্ত মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ হয়।স্কটিশ ধর্মপ্রচারকগণ ও আইরিশদের গির্জার যাজকীয় শাসনতন্ত্রের সমর্থকবৃন্দও এ কার্যক্রম অনুসরণ করেছিলেন। তাঁদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা উনিশ শতককে খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারের বিশিষ্টতম শতকে রূপান্তরিত করে। খ্রিস্টান ধর্ম ও উপমহাদেশের ধর্মসমূহের মধ্যকার সাংস্কৃতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকগণ ইসলামের অনুসারীদের প্রভাবিত করতে ব্যর্থ হন, সম্ভবত। একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী মুসলিমগণ খ্রিস্টান ধর্মের ত্রিত্ববাদীমতবাদকে গ্রহণ করতে পারেনি।সাধারণভাবে মুসলিম সমাজ খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকদের প্রচেষ্টার আওতার বাইরে থেকে যায় এবং মুসলিম অধ্যুষিত গ্রামীণ পূর্ববঙ্গে খুব অল্প কয়েকটি ধর্মপ্রচার কেন্দ্র গড়ে ওঠেছিল।শ্রীরামপুর ত্রয়ী কিছু হিন্দু সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও আচারানুষ্ঠান, যেমন  জাতিভেদ প্রথা, সতীদাহ, সন্তানকে গঙ্গায় বিসর্জন, অন্তর্জলি  ইত্যাদি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে জনমত গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। ১৮০৪ সাল থেকে ১৮২৯ সালের এই মাঝের সময়টুকুতে এ রকম কিছু আচারকে নিষিদ্ধ করতে আইন পাসে তাঁরা সহায়ক ছিলেন।সাঁওতাল মিশনে জর্জ ক্যাম্বেলের গভীর আগ্রহ এবং সাঁওতালদের শিক্ষার প্রতি তাঁর বিশেষ অনুদান ধর্মপ্রচারকদের অনুপ্রাণিত করে। উনিশ শতকের শেষ নাগাদ সাঁওতালদের শিক্ষিত করে তোলার কাজ একচেটিয়াভাবে ধর্মপ্রচারক সমিতিগুলির ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়।খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকদের প্রধান উদ্দেশ্য, যা ছিল খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করার মাধ্যমে বাংলার মানবগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তন সাধন করা, কখনও পূরণ হয়নি।  তাঁদের ভবিষ্যৎ অনেকটা নির্ভর করত জাতিচ্যুত ও উপজাতিদের ধর্মান্তরকরণের মধ্য দিয়েই। চার্চ ও ব্যাপ্টিস্ট মিশনসমূহের সর্বাধিক সংখ্যক ধর্মান্তরিতগণ আসত কর্তাভজাদের (ঈশ্বরের পূজারী) মধ্য থেকে, যারা ছিল নিম্নবর্গপদমর্যাদার হিন্দু, যেমন চণ্ডাল ও   নমঃশূদ্রদের মধ্যে গড়ে ওঠতে থাকা একটি হিন্দু সমতাবাদী ধর্মীয় সম্প্রদায়।সমাজের দরিদ্র মানুষের সেবা করার ছলে তারা গরিব হিন্দু-মুসলমানদের খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত করে আসছে, আজও যা অব্যাহত। খ্রিস্টান মিশনারিরা এমনসব জায়গায় যায় যেখানকার মানুষগুলো খুবই দরিদ্র, অশিক্ষিত এবং অবশ্যই দলিত শ্রেণির।খ্রিস্টান মিশনারির কর্মচারীরা এমন লোক খুঁজে বেড়ায় যারা ঋণ নিয়ে পরিশোধ করতে পারছে না, অসুস্থ টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছে না, টাকার অভাবে না খেয়ে মরে যাওয়ার অবস্থা-- এককথায় অভাবী এবং সমাজে ঘৃণিত মানুষদের খুঁজে বেড়ায়। খ্রিস্টান মিশনারিরা এই সুযোগে তাদের টাকা দিয়ে তাদের সাহায্য করে, আর সাহায্য করার ছলে ধর্মের প্রচার এবং ধর্মান্তর করতে থাকে। এদের টারগেট দলিত, দরিদ্র এবং অনাথ। বিভিন্ন দেশের দরিদ্র এবং অশিক্ষিত জনগোষ্ঠী খুব সহজেই তাদের ছলনায় চিন্তা করে হিন্দু অথবা মুসলমান হয়ে তো কোনো লাভ নেই। তারা মনে করেন খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করলে তাদের অনেক সুবিধা, তাদের সমস্ত অভাব দূর হয়ে যাবে। ২০০৫ সালে ভারত ছিল পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম খ্রিস্টধর্মী দেশ। ২০২৫ সালে তা পঞ্চমে উন্নীত হবে (সূত্র : www.worldchristiandatabase.org)২০০৫ সালে ভারত ছিল পৃথিবী দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ। যা ২০২৫ সালে তৃতীয়তে চলে যাবে (সূত্র : www.worldchristiandatabase.org)মজার বিষয় হল বৌদ্ধ, ইসলাম, গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা যতটা অসহিষ্ণু ছিলেন, খ্রিস্টান মিশনারিদের ক্ষেত্রে ঠিক ততটাই সহিষ্ণু কেন ! দলিতদের খ্রিস্টধর্মে চলে যাওয়ার ঘটনায় ব্রাহ্মণ্যবাদীরা এত উদাসীন ছিলেন কেন ! ইংরেজপ্রীতি, নাকি অন্য কোনো মতলব ! ইংরেজপ্রীতি যে ছিলই সেটা ব্রিটিশ-ভারত ইতিহাসের পরতে পরতে চিহ্ন রাখা আছে। মানবসেবা, সমাজসেবার নামে দিনের পর দিন অতীতে মাদার টেরিজা, বর্তমানে স্টিভ ও সহ অনেকেই ধর্মান্তরের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন ওপেনে-গোপনে! এই ধর্মান্তরযজ্ঞের জন্য কোটি কোটি ডলার আসছে বিদেশ থেকে। কেউ কেউ বলেন জাতপাতের এই বিড়ম্বনা নাকি হিন্দুধর্মের নয়। হিন্দুধর্মে নাকি জাত-বিভাজনের বালাই নেই এসব নাকি ব্রাহ্মণ্যধর্মের হিন্দুদের ঘাড়ের চাপিয়ে দেওয়া নিষ্পেষণ-চাক্কি। তাহলে কি ব্রাহ্মণ্যধর্ম আর হিন্দুধর্ম সমার্থক নয় ! এ ভাবনার যুক্তি কী ? তাঁরা বলছেন – (১) তাঁদের প্রত্যেকের ধর্মপালনের নীতি-নিয়ম একই হবে।(২) তারা একই পদ্ধতিতে ধর্মাচরণ বা উপাসনা করবে।(৩) তাদের মধ্যে অবাধ বিবাহ সম্পর্ক চালু থাকবে।(৪) ধর্মের দৃষ্টিতে তারা সবাই অভিন্ন বলে বিবেচিত হবে।(৫) তাদের মধ্যে কোন উঁচু-নীচু ভেদ থাকবে না।(৬) তারা সবাই সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ থাকবে।(৭) একই ধর্মের অনুগামী বলে তারা পরস্পরের প্রতি একাত্মবোধ করবে। এই বৈশিষ্ট্যগুলি ব্রাহ্মণ ও হিন্দুর ক্ষেত্রে এক নয়, আলাদা। এ পরিপ্রেক্ষিত বিচার করে বোঝা যায় ব্রাহ্মণ ও হিন্দু এক ধর্মভুক্ত নয়, তাদের ধর্ম  আলাদা।তা ছাড়া দুটি আলাদা ধর্মের মানবগোষ্ঠীর মধ্যে যে বৈসাদৃশ্যগুলি থাকে ব্রাহ্মণ ও হিন্দুর মধ্যেও তা লক্ষ করা যায়।বৈসাদৃশ্যগুলি মিলিয়ে নেওয়া যেতে পারে, যেমন -- (১) ব্রাহ্মণ ও হিন্দুর মধ্যে বিবাহ সম্পর্ক হয় না।যদিও কিছু ব্যতিক্রম দেখতে পাওয়া যায়,তবে ব্যতিক্রম ব্যতিক্রমই।(২) ব্রাহ্মণ ও হিন্দুর মধ্যে সৌভ্রাতৃত্বের ভাব দেখা যায় না,বরং ঘৃণার সম্পর্ক দেখা যায়।(৩) একজন ব্রাহ্মণ ধর্মাচরণের হ্মেত্রে যে অধিকার পায়,একজন হিন্দু তা পায় না।(৪) ব্রাহ্মণ ও হিন্দু পরস্পরের সাথে একাত্ম  মনে করে না।(৫) ব্রাহ্মণ হিন্দুকে তার সাথে সমমর্যাদার ভাবে না,তার থেকে নীচু ভাবে। (৬) ব্রাহ্মণদের ধর্মপালনের উদ্দেশ্য শূদ্রদের সম্পদ হাতানো।হিন্দুদের ধর্মপালনের উদ্দেশ্য সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।(৭) ব্রাহ্মণ্যধর্মে অব্রাহ্মণ আছে এবং ব্রাহ্মণ্যধর্মের এই অব্রাহ্মণরা হল পথভ্রান্ত, নিজের অজান্তে বিপথে চালিত ধর্মচ্যূত হিন্দু, ব্রাহ্মণরা যাদের উপর অপমানজনক, ঘৃণ্য শূদ্রনামের ছাপ্পা মেরে দিয়েছে।কিন্তু হিন্দুধর্মে কোনো অহিন্দু নেই। (৮) ব্রাহ্মণ্যধর্ম অনুযায়ী ব্রাক্ষ্মণ সবার শ্রেষ্ঠ, সবার প্রভু।আর ব্রাহ্মণ্যধর্ম অনুগামী অব্রাহ্মণরা ব্রাহ্মণ অপেক্ষা নিকৃষ্ট, এমনকি কেউ কেউ আবার  ব্রাহ্মণদের নিকট ঘৃণার বস্তু,অস্পৃশ্য। কিন্তু হিন্দু ধর্মে কোন উচ্চনীচ ভেদাভেদ নেই,সবাই সমান।(৯) বর্ণভেদ, জাতপাত, অস্পৃশ্যতা, সতীদাহপ্রথা, গুরুপ্রসাদী প্রথা ইত্যাদি অমানবিক, অশালীন প্রথাগুলি ব্রাহ্মণ্যধর্মেরই অবদান।কিন্তু অপরদিকে  হিন্দুধর্ম একটি সুসভ্য, যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদী ধর্ম। (১০) ব্রাহ্মণ্যধর্মের অনুগামীরা সবাই ব্রাহ্মণ নয়, কেউ ব্রাহ্মণ, কেউ শূদ্র ইত্যাদি ইত্যাদি।কিন্তু হিন্দুধর্মের অনুগামী মাত্রেই সবাই হিন্দু এবং কেবলমাত্র হিন্দু। হিন্দুদের একমাত্র পরিচয় -- তারা হিন্দু।(১১) ব্রাহ্মণদের উপনয়ন হয়, হিন্দুদের হয় না। (১২) ব্রাহ্মণ্যধর্মে জাতপাত, বর্ণভেদ, অস্পৃশ্যতা আছে, কিন্তু হিন্দুধর্মে ওইসব কদর্য জিনিস নেই।ওগুলো সম্পুর্ণতই ব্রাহ্মণ্যধর্মের ব্যাপার, হিন্দুধর্মের নয়।(১৩) ব্রাহ্মণরা পৈতে পরে, কিন্তু হিন্দুরা তা পরে না। তাই পৈতে পরা দেখে ব্রাহ্মণকে সহজেই স্বতন্ত্র ধর্মের অনুগামী হিসাবে সনাক্ত করা যায় -- যেমন টুপি (ফেজ) পরা দেখে মুসলমানদের সনাক্ত করা যায়, বুকে ক্রুশ দেখে খ্রিস্টান সনাক্ত। এইসব তথ্য বিচার ও বিশ্লেষণ  করলে সহজেই অনুমিত হয় যে, ব্রাহ্মণ্য ও হিন্দু দুটি স্বতন্ত্র ধর্ম, কখনোই এক ধর্ম নয়।অতএব ব্রাহ্মণ্যবাদের সব রকম অন্যায়-অবিচার হিন্দুধর্মের উপর চাপিয়ে দেওয়াটা সুবিচার হয় না।এ ব্যাপারে শিবরাম চক্রবর্তীর বক্তব্য অনুধাবনযোগ্য -- এই হিন্দু সভ্যতায় ব্রাহ্মণের দান অতি সামান্যই, বলতে গেলে ব্রাহ্মণের থেকে যতটা এ নিয়েছে তাই এর কলঙ্ক“……ব্রাহ্মণের দ্বারা প্রভাবিত না হলে এ সভ্যতা আরও প্রাণবান, আরও বেগবান, আরও বীর্যবান হতে পারত“…… ব্রাহ্মণ্য সভ্যতার চেয়ে ঢের বড়ো এই হিন্দু সভ্যতা। ব্রাহ্মণ না জন্মালেও এ হত এবং ব্রাহ্মণ লোপ পেলেও হিন্দু সভ্যতা থাকবে“…… ব্রাহ্মণরা সমাজের মাথা নয়, বরং টিকি। সমাজের মাথা থেকে ওটাকে কেটে বাদ দিলে সমাজটার কোনো ক্ষতি হবে না, বরং তাকে আরও বেশি আধুনিক দেখাবে। সেই কারণেই বোধহয় অন্ত্যজ বা দলিতদের সন্মানের জন্য যাঁরা লড়াই করেছেন এবং করছেন, তাঁরা সকলেই প্রায় উচ্চবর্ণের হিন্দু।রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর, কেশবচন্দ্র সেন, রবীন্দ্রনাথ, স্বামী বিবেকানন্দ, মহাত্মা গান্ধি প্রমুখ উচ্চবর্ণীয় ব্যক্তিগণ দলিতদের পক্ষে জোরদার আন্দোলন করেছেন। অবশ্য ড: ভীমরাও রামজি আম্বেদকরের আন্দোলনও দলিত সমাজে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যদিও বাবা আহম্মেদকর উচ্চবংশীয় ছিলেন না, বরং দলিত শ্রেণির।স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর বর্তমান ভারতগ্রন্থে লিখেছেন – “ভারতবাসীর কেবল ভারবাহী পশুত্ব, কেবল শূদ্রত্ব।বিবেকানন্দের সমকালীন ভারতে ব্রাহ্মণত্ব, ক্ষত্রিয়ত্ব, বৈশ্যত্বের অধিকারী হলেন ইংরেজ এবং তাদের শাসন-শোষণের ভার পশুর মতো বহন করে চলেছে শূদ্ররূপ ভারতবাসী।বিবেকানন্দ মনে করতেন, “শূদ্রজাতি মাত্রেই এজন্য নৈসর্গিক নিয়মে পরাধীন।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র