-“কিছুতেই
রাজি হচ্ছে না দাদা!” অরূপের
গলা বেশ হতাশ শোনায়। বাঁ হাতে উন্নয়ন ভবন পার করে সল্টলেক করুণাময়ীর দিকে যেতে
যেতে মোবাইলে কথা বলছে অরূপ। যে কাজের জন্য আজ দুপুর থেকে সল্টলেকে হত্যে দিয়ে
পড়েছিল, তারই হতাশাজনক ফলের
রিপোর্ট দিচ্ছে বসকে। কলকাতার বুকে সন্ধ্যে নামছে।
-“রাজি
না হলে ত আমার চলবে না রে অরূপ! যে করেই হোক, ম্যানেজ করতেই হবে তোকে!”
-“অনেক
চেষ্টা করলাম দাদা। মাল বহুত ঘুঘু। সেই কোন দুপুরে এসেছি। এতক্ষণ বসিয়ে রেখে
ডাকলো। ভাবলাম পজিটিভ কিছু বলবে। কোথায় কি!” চেষ্টার যে কোনও ত্রুটি করেনি সেটা বসকে বোঝানোর মরিয়া চেষ্টায়
অরূপ।
-“এসব
নেগেটিভ কথা শোনার জন্য আমি পয়সা দিয়ে তোকে রাখিনি অরূপ। আশার কথা কিছু থাকলে বল”
ওপ্রান্তে শীতল কঠিন গলা।
-“দাদা,
ভাবগতিক যা দেখলাম, তুমি কথা বললে ম্যানেজ হয়ে যেতে পারে
মনে হল।” এসব কথা শুনলে যেকোনো
বসই যে কাত হয়, অল্প কদিনের
অভিজ্ঞতায় অরূপ জেনে গেছে।
-“কবে
আসবে এদিকে? শুনলি কিছু?” যথারীতি সুর নরম কিছুটা।
-“দিওয়ালির
সময় যায় প্রত্যেক বছর। দিন পনেরো থেকে জগদ্ধাত্রী পুজো কাটিয়ে ফিরে আসে!”
-“পরশুই
ত কালী পূজা।“
-“হ্যাঁ,
পরশু সকালের ট্রেনেই উনি পৌঁছচ্ছেন।“
বসকে আপ টু ডেট খবরটা দিতে পেরে অরূপ
যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
১
ট্রেন
রাণাঘাট থেকে ছাড়তে অরুনাংশু হাত ঘড়িতে সময় দেখলেন, সকাল নটা বাজতে দশ। কৃষ্ণনগর পৌঁছতে আর মিনিট চল্লিশ লাগবে
হয়ত! ট্রেনের জানালায় লম্বা চাষের ক্ষেতের পেছনের দিকে চলে যাওয়া দেখতে দেখতে
অরুনাংশুর মনটাও যেন বেশ কয়েক বছর পিছিয়ে গেল। আজ থেকে তিরিশ বছর আগে কৃষ্ণনগরের
শক্তিনগরের বাসিন্দা ছিলেন অরুনাংশু। কৃষ্ণনগর স্টেশনে নেমে সদর হসপিটাল ছেড়ে
শক্তিনগর পাঁচ মাথার মোড়ের থেকে ডানদিকে গিয়ে রাস্তার ওপরেই অরুনাংশুর পৈতৃক বিশাল
বাড়ি। মা মারা যাওয়ার বছর দুয়েকের মাথায় পঁচাশির ডিসেম্বরে বাবার সাথে কৃষ্ণনগরের
পাট চুকিয়ে কসবায় ছোট এক ফ্ল্যাটে চলে এসেছিলেন অরুনাংশু। তাঁর বয়স তখন এগারো।
এরপরে বাবার বদলির চাকরির জন্য ভারতবর্ষের নানা প্রান্তে ঘুরে ঘুরে স্কুল, কলেজের পড়া কমপ্লিট করেছেন। কিন্তু
কৃষ্ণনগরের স্মৃতি মন থেকে কখনো মুছে যায়নি। যেভাবে জন্মের পরে মায়ের সাথে
সন্তানের নাড়ীর বাঁধন কেটে দেওয়া হয়, শক্তিনগর
থেকে আসার সময় কত সম্পর্কের সাথে অরুনাংশুর নাড়ীর সংযোগ যেন হ্যাঁচকা টানে ছিঁড়ে
দেওয়া হয়েছিল। স্কুলের এক বন্ধুর কথা এতদিন বাদেও মনে পড়ে। স্কুলে ওদের দুইভাই বলত
বাকি সহপাঠীরা।
-“অরুণ,
তোর টিফিন কই?”
-“আজ
আনতে ভুলে গিয়েছি রে” ত্রিদিবের
কাছে ধরা পড়ে আসল কথাটা চেপে গেল অরুণ। স্কুলের টিফিনে ক্লাসের সবাই যখন ব্যাগ
থেকে টিফিন বের করছে, অরুণ
চুপিসারে ক্লাস ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে চলে যাবে ঠিক করেছিল।
-“আমায়
বলিসনি কেন সেটা?” অভিমানে ত্রিদিবের
ফর্সা মুখটা লাল হয়ে গেছে।
-“টিফিনের
কথা ত মনেই ছিল না! এক্ষুনি তোদের দেখে মনে পড়ল।” অরুণ বুঝতে পারছে না কিভাবে ত্রিদিবকে বোঝাবে। ও যে ইচ্ছে করেই
জানায়নি সেটা শুনলে ত্রিদিব খুব রেগে যাবে।
-“তা
ত বুঝলাম। কিন্তু কিছু না বলে কোথায় কেটে পড়ার তাল করছিলি রে?” ত্রিদিব একটু যেন স্বাভাবিক হচ্ছে। অরুণ
মনে মনে নিশ্চিন্ত হল।
-“ভাবছিলাম
ছোটন-দার থেকে আলুকাবলি কিনে খাবো। বাবার কাছে থেকে কিছু টাকা পেয়েছিলাম। সেটা
আছে।” পরিস্থিতি সামাল দিতে
আবার একটা মিথ্যের আশ্রয় নিল অরুণ। ওদের স্কুলের বাইরে ছোটন-দার ঠেলায় আলুকাবলি,
ঘুগনি, পাপড়ি চাট এসব জিভে জল আনা খাবার পাওয়া যায় বটে, কিন্তু টিফিন টাইমে অরুণদের বাইরে
যাওয়ার ক্ষেত্রে বেশ কিছুদিন ধরে নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে।
-“এক
চড় খাবি হতভাগা। বাইরে যেতে পারবি তুই, যে
এসব বলছিস? আয় আমার সাথে বোস।”
ত্রিদিবের ডাকে কিছু একটা ছিল, অরুণ আর টালবাহানা করতে পারলো না। খিদেও
পেয়েছিল জব্বর। স্কুলে আসার আগে ত সেভাবে কিছু খায়নি সকালে। মা যতদিন ছিল, অত সকালে উঠেও কত কি বানিয়ে দিত। কিন্তু
মা চলে যাওয়ার পর থেকে অরুণকে দেখার আর সেরকম কেউ নেই। কাকীমারা নিজেদের মেয়েদের
নিয়েই ব্যস্ত। অরুণ সকালে খেল কিনা, টিফিন
নিয়ে গেল কিনা সেসব দেখার তাদের ফুরসৎ কোথায়!
ত্রিদিবের
টিফিন থেকে রুটি ছিঁড়ে খেতে গিয়ে অরুণের চোখে জল চলে এসেছিল প্রথমদিন। অরুণ জানত,
ত্রিদিবের বাড়ীর অর্থনৈতিক পরিস্থিতি
মোটেও সুবিধাজনক নয়। ত্রিদিবের বাবা টিটাগরে একটা মিলে কাজ করতেন। কৃষ্ণনগরের চাষা
পাড়ায় ওদের বাড়ী থেকেই রোজ যাতায়াত করেন। মাঝেমাঝেই মিল বন্ধ থাকে, খুব টানাটানি যায় সেসময়।
-“রোজ
আমরা এভাবেই টিফিন ভাগ করে খাবো, বুঝলি!”
অরুণের পায়ে আলতো চাপড় মেরে বলল
ত্রিদিব। এই ভয়টাই পাচ্ছিল অরুণ। ত্রিদিব ঠিক বুঝতে পেরে গেছে।
-“তা
কেন? কাল আমি ঠিক টিফিন
আনবো, দেখে নিস।” অরুণ ত্রিদিবের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ার
মরিয়া চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অরুণ বিলক্ষণ জানে, দুজনের উপযুক্ত টিফিন বানিয়ে দিতে ত্রিদিবদের সংসারে একটা
অতিরিক্ত চাপ এসে যাবে।
-“শোন
অরুণ। আমাকে বোকা পেয়েছিস নাকি? আমি
কি জানিনা যে তোর বাড়ীতে তোকে দেখার এখন কেউ নেই। ও কি! কাঁদছিস কেন রে পাগল?”
ছোট ছোট হাতে অরুণের চোখ মুছিয়ে দিতে
দিতে বলেছিল ত্রিদিব।
সেই
শুরু। টানা দুবছর এইভাবেই টিফিন শেয়ার করেছিল অরুণ আর ত্রিদিব। কৃষ্ণনগর থেকে চলে
আসার পর ত্রিদিবের সাথে চিঠিতে বেশ কিছুদিন যোগাযোগ ছিল। তারপরে যা হয়! যোগাযোগ
বিচ্ছিন্ন! মাঝের এই তিরিশ বছরে বেশ কয়েকবার কৃষ্ণনগরে এলেও ত্রিদিবের সাথে কখনো
দেখা হয়নি অরুনাংশুর। স্কুলে পরিচয় বলে অরুনাংশুর কাছে ত্রিদিবের বাড়ির ঠিকানা ছিল
না! ঠিকানা থাকলেও এক দেড় দিনের কৃষ্ণনগরের ঝটিকা সফরে এসে ওর বাড়ির ঠিকানায় গিয়ে
দেখা করা যেত কি! তবে খবর নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন অরুনাংশু! এটুকুই জেনেছিলেন,
ত্রিদিব কৃষ্ণনগর ছেড়ে কোথাও যায়নি।
স্কুলের পরে কোন কলেজে পড়ল, কি
নিয়ে পড়ল, বিয়ে শাদির কথা,
কিছুই জানা নেই। কাজের চাপে, চেনা পরিচিতর সংখ্যা বাড়তে বাড়তে
বাল্যবন্ধুর কথা ভুলেই গিয়েছিলেন।
২
দশটা
পাঁচটার সরকারী চাকরী করতে করতে বছর আটেক আগে এক বন্ধুর উৎসাহে লেখালেখির ভুতটা
মাথায় চেপেছিল অরুনাংশুর। ছোটখাটো পত্রিকা দিয়ে শুরু করে আজ তিনি মোটামুটি
প্রতিষ্ঠিতই বলা যায়। বাংলার স্বনামধন্য প্রকাশক সংস্থার সাথে যুক্ত হয়ে গেছেন।
পূজার সময় প্রথম সারির ম্যাগাজিনের পূজাবার্ষিকীতে উপন্যাস, গল্প বেরোয়। এছাড়া বইমেলাতে একটা গল্পের
সংকলনও বেরিয়েছে গতবছর। কলকাতায় মেয়েদের বিয়ে দিয়ে যখন দুইকাকাই মেয়েদের ফ্ল্যাটের
আশেপাশের ফ্ল্যাটে সেটল করলেন, অরুনাংশু
কাকাদের পরশন কিনে নিয়েছিলেন। বছর তিনেক হল, ছ কাঠার ওপর মায়ের স্মৃতি বিজড়িত একতলা বাড়িটা পুরোটাই এখন
নিজের। এই কাজের জন্য বৌ আর মেয়েকে যুক্তি দেখিয়েছিলেন, নিরিবিলিতে মাঝে মাঝে সাহিত্যসেবার জন্য একটা পাকাপাকি আস্তানা
চাই। যদিও নিজের কাছে অরুনাংশু স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে কৃষ্ণনগরের সাথে একটা
নাড়ীর টান তিনি আজো অনুভব করেন।
বাড়ি
কেনা পরবর্তী সময়ে গত দুবছরে জগদ্ধাত্রী পূজার সময় টানা ১০/১২ দিন ছিলেন, কিন্তু পুরনো সম্পর্কের হাত ধরে কারো
সাথেই সেভাবে হৃদ্যতা গড়ে ওঠেনি। আসলে অরুনাংশু তিরিশ বছর আগে কৃষ্ণনগরে যে সময়টা
ছেড়ে গিয়েছিলেন, বর্তমান সময় তার থেকে
অনেক পাল্টে গিয়েছে। সবাই এখন খুব ব্যস্ত। আগে যে পাড়ায় পাড়ায় গল্পগুজব আড্ডা হত,
তা আর দেখতে পেলেন না অরুনাংশু গত
দুবছরে। অরুনাংশুদের পাশের বাড়ীর রাজুকাকার সাথে ছোটবেলায় অরুনাংশুর খুব দোস্তি
ছিল। অরুনাংশু বাড়ীতে এসে থাকতে শুরু করলে রাজুকাকা এসে দেখা করেছিলেন। পুরনোদিনের
অনেক গল্পও করেছিলেন। অরুনাংশুর মনে হয়েছিল, রাজুকাকার সাথে ছোটবেলার টিউনিংটা যেন গড়ে উঠছে। রাজুকাকার
মেয়ে সুদীপ্তা গত বছর ভাইফোঁটাতে অরুনাংশুকে ফোঁটাও দিয়েছিল। অরুনাংশু বুনু ডাকতেন
সুদীপ্তাকে। এবছর কৃষ্ণনগরে আসার আগে বিজয়া দশমীতে রাজুকাকাকে ফোন করেছিলেন
অরুনাংশু।
-“বুনু
কোথায়? ফোনটা দাও ওকে”
রাজুকাকার সাথে ফোনে প্রণাম পর্ব সেরে
সুদীপ্তাকে চেয়েই ভুলটা বুঝতে পারেন অরুনাংশু।
-“বুনু
ত নেই রে অরুণ। এবছর অগাস্টে বুনুর বিয়ে দিয়ে দিলাম।” রাজুকাকার অপরাধী গলা। “আমার খুবই ভুল হয়ে গেছে রে! তোকে একদম জানাতেই পারিনি।”
রীতিমত ধাক্কা খেয়েছিলেন অরুনাংশু এই
ঘটনায়। তবে এখানেই বোধয় শেষ নয়। পাস্ট টেন্সের সাথে প্রেজেন্ট টেন্সের ঠোকাঠুকিতে
আরো কিছু আঘাত হয়ত অপেক্ষা করেছিল ওর জন্য।
সবশেষে
কৃষ্ণনগর
স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে অরুনাংশু স্টেশনের গেটে টিকিট বের করার সময় পার্সে
পোদ্দার কন্সট্রাকশনের কার্ডটা উঁকি মারল। ওদের পৈতৃক বাড়ীটা নেওয়ার জন্য স্থানীয়
প্রোমটারের সাকরেদ কলকাতায় অরুনাংশুর অফিসে অব্ধি ধাওয়া করেছে। কৃষ্ণনগরের বাড়িতে
আজ প্রোমোটার নিজে কথা বলতে আসছেন। কার্ডে প্রোমোটারের নামটা আরো একবার দেখে
অরুনাংশু হেসে ফেললেন। ত্রিদিব পোদ্দার! ভাগ্যের কি অদ্ভুত পরিহাস!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন