যুগান্তর মিত্র - মায়াজম

Breaking

২৪ জানু, ২০১৬

যুগান্তর মিত্র

                                               অসুখ













নীলাদ্রি বুঝতে পারে ভেতরে ভেতরে পাল্টে যাচ্ছে সে। কিন্তু সঠিক সময়ে কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না নিজেকে। যতক্ষণ বাড়িতে থাকে নিজের চারপাশে একটা অদৃশ্য ঘেরাটোপ তৈরি করে রাখে। মাঝে মাঝে বোনের সঙ্গে হাসিমস্করাও করে। কিন্তু কোনো কোনো সময় নিজেকে এসবের মধ্যে মেলে ধরতে পারে না। এমনকি মার সঙ্গেও রুক্ষভাবে কথা বলে। সেইসময় নিজের গালেই কষিয়ে চড় মারতে ইচ্ছে করে তার।
অফিসেও ওকে এড়িয়ে চলে সবাই। কখন কোন মুডে থাকে, কী বলতে কী বলবে ঠিক নেই ! একমাত্র মৌড়ির কাছে গেলে নীলাদ্রির সারা শরীরজুড়ে বৃষ্টি নামে। কোনো রাগ, ক্ষোভ, যন্ত্রণা অনুভব করে না ও। মৌড়িকেই তাই সবচেয়ে কাছের মনে হয়।
চাকরিটা নেহাত খারাপ করে না। বেসরকারি, কিন্তু ভালো মাইনে পায়। বাড়িতে মায়ের হাতে বেশ মোটা টাকাই তুলে দেয় সংসার খরচের জন্য। মা অবশ্য নিজেই ভালো পেনশন পান। তাই ছেলের আয়টা বেশ যত্ন করে খরচ করেন। মাঝে মাঝে ছেলের পছন্দের শার্ট বা টি-শার্ট কিনে দেন। সবকিছু ঠিকঠাকই আছে। শুধু এই মেজাজটা নিয়েই নীলাদ্রির যত দুঃশ্চিন্তা। মৌড়ি অনেকবার বলেছে, তুমি বরং কোথাও ঘুরে এসো সৌম্য। নীলাদ্রি রাজি হয় না কিছুতেই। বলে, সব ঠিক হয়ে যাবে দেখো।

তাহলে তুমি সাইক্রিয়াটিস্ট দেখাও। মনের মধ্যে কোথাও একটা কাঁটা বিধে আছে তোমার। সেই কাঁটাটা তুলে দিলেই তুমি সত্যিকারের সৌম্য হয়ে উঠবে।
নীলাদ্রি হাসে। পাগলের ডাক্তারের কথা বলছ ? আমার কি সত্যিই মাথা খারাপ হয়ে গেছে ?
বোকার মতো কথা বোলো না। সাইক্রিয়াটিস্ট মানেই পাগলের ডাক্তার নয় সৌম্য। মানসিক অবসাদের জন্যও মনোবিদের কাছে যায় অনেকেই। তুমিও যদি অবুঝের মতো কথা বলো ...
নিলাদ্রি দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ে। আচ্ছা দেখা যাবে। খানিকটা আশ্বাস দেয় মৌড়িকে। কিন্তু বাস্তবে কোনোদিনই ডাক্তারের কাছে যেতে পারে না সে। যেতে ইচ্ছেই করে না।

অফিস থেকে বাড়ি ফিরে নিজের ঘরেই একরকম বন্দি হয়ে থাকে নীলাদ্রি। কোনো কোনো দিন মাথায় কী যেন ভর করে। উঠে গিয়ে মাকে ধমক দেয়। কী সারাক্ষণ টিভি সিরিয়াল গিলছ ? তোমার কি কোনো কাজ নেই নাকি ? আগে তো তাও আসন সেলাই করতে, উল বুনতে। এখন সেসব কিছুই করো না। যত্তসব বস্তাপচা সিরিয়াল গেলো !
মা এখন আর কিছু বলেন না। জানেন এসব বলবে, একটু বাদেই আবার স্বাভাবিক আচরণ করবে। বোন অবশ্য দাদার কথার পৃষ্ঠে উত্তর দেয়।
সারাক্ষণ কানে হেডফোন গুঁজে থাকিস কেন ? এভাবে পড়া হয় ?
হ্যাঁ হয়, আমার হয়।
কচু হয়। আমারও কেমিস্ট্রি অনার্স ছিল। আমি জানি না কতটা পড়তে হয় ! আমাকে বোঝাস না। কানে হেডফোন গুঁজে উনি পড়ছেন !
দেখ দাদা, ওরকম টিকটিক করিস না। আমারটা আমাকে বুঝতে দে। পড়া হয় কি হয় না রেজাল্টে দেখে নিস।
শিল্পিকা বরাবরই ভালো রেজাল্ট করে, নীলাদ্রি সেটা জানে। ঠিক আছে, দেখব রেজাল্ট। কথাগুলি ছুঁড়ে দিয়েই বেরিয়ে যায় তাই।

(২)

মাত্র সাড়ে চার মাস অ্যাসাইলামে থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেছে নীলাদ্রি। ডাক্তার মুন্সি বলেছেন, এত দ্রুত রেসপন্স করতে খুব-একটা দেখা যায় না।
অনেক কথা হল ডাক্তারের সঙ্গে নিরুপমার।
ছোটোবেলায় ওর কি খুব অবহেলা হয়েছে ?
একটু থমকে যান নিরুপমা। ও যাকে অবহেলা ভাবছে সেটা আসলে ছিল আমাদের অক্ষমতা। ওর বাবার ছিল ছোটো চাকরি। আমি একটা সরকারি চাকরি জুটিয়ে নেওয়ার পর অনেকটাই স্বচ্ছল হত্যে পেরেছিলাম পরে।
আরও কিছু কথা হল, যার মূল কথা ওর ভালো সাহচর্য চাই, সহমর্মিতা চাই।

একসময় নীলাদ্রির আচরণ বেশ অসহ্য হয়ে উঠেছিল। নিরুপমা বা শিল্পিকা আর সহ্য করতে পারছিল না। এমনকি মাঝে মাঝে মৌড়িও বিরক্ত হয়ে পড়ত। সেইসময়ই শিল্পিকা যোগাযোগ করে মৌড়ির সঙ্গে। দাদার অফিস থেকে এক কলিগ এসে জানিয়ে গেছে নীলাদ্রির ভয়ঙ্কর আচরণ সম্পর্কে। তার থেকেই জানা গেছে মৌড়ির কথা। মৌড়িদের পাড়ার ছেলে নিবারণ দাস দাদার কলিগ। সেই-ই শিল্পিকার সঙ্গে মৌড়ির পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। শিল্পিকার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলে অ্যাসাইলামে দেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়েছে।
মা কি রাজি হবেন অ্যাসাইলামে দিতে তাঁর ছেলেকে ? সংশয় নিয়ে জানতে চায় মৌড়ি।
সে দায়িত্ব আমার। মাকে আমি ঠিক রাজি করাব। মা দাদার জন্য সব করতে পারে জানো। বলেছে শিল্পিকা।একরকম জোর করেই ছেলেকে নিয়ে গেছেন নিরুপমা। মৌড়িও সঙ্গে ছিল। এই মেয়েটা যেভাবে নানা সময় সঙ্গ দিয়েছে, তাতে মুগ্ধ তিনি।

প্রায় বছর দেড়েক হল মৌড়ির সঙ্গে ছেলের বিয়ে দিয়েছেন তিনি। ওরা যে ভালো আছে এটা ভেবেই পরম নিশ্চিন্ত লাগে তাঁর। শিল্পিকাও বৌমণিকে চোখে হারায় যেন। নিরুপমা পরম তৃপ্তিতে এসব কথা গল্প করে বলছেন তাঁর ছোড়দির ছেলে পলাশকে। অনেকদিন বাদে পলাশ এসেছে পাটনা থেকে, সেখানেই থাকেন তাঁর ছোড়দি।
ছোটোবেলায় এই পলাশদা ছিল নীলুর প্রাণের দাদা। বছরে এক-দুবার পাটনায় যেতেই হত। ওরাও আসত। আসলে এই যাতায়াতটা ছিল বাধ্যতামূলক। এ ছাড়া উপায় ছিল না। ওদিকে পলু, এদিকে নীলু কিছুদিন যোগাযোগ না-হলেই চিৎকার চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় করত। সেই পলাশদাকে পেয়ে নীলু উচ্ছ্বসিত আজ।
তোকে আজ আমি নিজের হাতে চিকেন রান্না করে খাওয়াব পলুদা। দারুণ প্রিপারেশন ! আমি চিকেন, টক দই আর যা যা লাগে কিনে আনি। তুই ততক্ষণ ওদের সঙ্গে গল্প কর।
গল্পের ফাঁকে পলাশ হাসি মুখে জিজ্ঞাসা করে, এখন আর নীলুর কোনো সমস্যা নেই তো মৌড়ি ?
নতুন এক অসুখ ধরেছে ওকে। হাসি মুখেই বলে মৌড়ি।
পলাশ চোখ সরু করে তাকায়। নিরুপমার চোয়াল ঝুলে পড়ে। কী অসুখ ? অস্ফুটে জানতে চান তিনি।
ওকে এখন কবিতার অসুখে ধরেছে। কবিতা লেখে। প্রতিদিনই। আর দারুণ দারুণ কবিতা !
স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়েন নিরুপমা। পলাশ হো হো করে হেসে ওঠে।
তাহলে কি আবার ডাক্তার দেখাতে হবে নাকি ? হাসতে হাসতে জানতে চায় পলাশ।
না দাদামণি, এ অসুখটা থাকুক। আমি ওর এই অসুখটাকে লালন করতে চাই। আজীবন। ওর কবিতার বইও প্রকাশ হোক আমি চাই।

নিরুপমা মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখেন মৌড়িকে। পলাশও। অসুখ শব্দটাও যে এত রমণীয় হতে পারে জানা ছিল না নিরুপমার।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র