সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী - মায়াজম

Breaking

২৪ জানু, ২০১৬

সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী

                                                    ছেলেমানুষ













আগামী সোমবারই তো অ্যাডমিশন টেস্ট।বাবুই পারবে তো গো? ‘
মশারি টাঙ্গিয়ে তাতে বিছানার চাদর গুঁজে পরিপাটি করতে করতে বলে ইমন। রাতের খাওয়া শেষ। ঘুমিয়ে পড়েছে বাবুই আগেই। ল্যাপটপ থেকে চোখ না সরিয়ে জবাব দেয় তন্ময় – ‘ কেন পারবেনা? এতদিন ধরে prepared হচ্ছে। চারজন টিউটর, তুমিও দেখাচ্ছ, নিশ্চয় পারবে
একটু থেমে আবার ইমন বলে – ‘হু। আসলে আমাদের ছেড়ে তো থাকেনি কখনো। তাই ভাবছি, অসুবিধায় পড়বে না তো ছেলেটা?এখনও তো যথেষ্ট ছেলেমানুষ। যতই হোক। ওরা ঠিক মতই কেয়ার নেয় তো বল?’
এবার ল্যাপটপটা মুড়ে বন্ধ করে সোজা ইমনের চোখের দিকে বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে তন্ময় বলল- এই কথাগুলো এখন বলার কি কোন মানে হয় ইমন? এভাবে সবকিছু planning করা, বহুবার আলোচনা করেই তো এটা ভাবা হয়েছে, অফিসের মৃগাঙ্কদার কথা ভুলে গেলে? মিশনের এই ব্রাঞ্চটাই বেস্ট। বাবুইয়ের ভবিষ্যৎ আগে না তোমার ঐ প্যানপ্যানে ভাবনার ঝুড়ি? Disgusting!’
ইমন একটু লজ্জিতই হয়। ঠিকই তো। ক্লাস সিক্সে ভর্তির জন্য প্রবেশিকা পরীক্ষায় বসতে হবে বাবুইকে আগামী সপ্তাহেই। ওখানে ভর্তি করাতে পারলে যে কোন মা বাবাই গর্ব বোধ করেন। আর সে কিনা । শুধু শুধু মায়া বাড়িয়ে লাভ কি?

বেলা সাড়ে বারোটা বাজে। টিউশন থেকে বাবুইয়ের আসার সময় হয়ে এল। ছাদের উপর লাগানো চন্দ্রমল্লিকার টবগুলোতে জল দিতে দিতে ইমন খেয়াল করল পিঠে ব্যাগ নিয়ে হেলেদুলে আসছে তার ছেলে।

হঠাৎ একটা দুষ্টুবুদ্ধি খেলে গেল তার মাথায়। একটু চমকে দিলে কেমন হয় ওকে? যেমন ভাবা তেমন কাজ। গেট খুলে ঢুকল বাবুই নিচে। মা!বলে জুতো খুলতে খুলতে স্বভাববশতঃ ডাক দিল। ইমন নিশ্চুপ। ছাদে জলের বড় ট্যাঙ্কটার পিছনে আড়ালে চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইল সে।
দেখি কি করে, সাড়া দেব না এখুনি
আবার ডাকে একটু জোরে বাবুই, ‘মা! ও মা! আমি এসেছি। কোথায় তুমি?’ ধুপ করে পিঠের বইয়ের ভারী ব্যাগটা রাখার শব্দ পায় ইমন সোফার উপর।দু এক মুহূর্ত চুপ। এবার গলার আওয়াজটা ঘুরে বেড়াতে থাকে বসার ঘর, শোবার ঘর দুটো, রান্নাঘরের দিকেও। আর আস্তে আস্তে সেই ডাকের ধরণ বদলাতে থাকে। প্রথমে যেটা সাধারণ নিশ্চিন্ত একটা ডাক ছিল, ক্রমে সেটা অস্থিরতা হয়ে উৎকণ্ঠার দিকে এগোয়।মা! মা গো! তুমি কোথায় গেলে? আমি খুঁজে পাচ্ছিনা কেন তোমায়?’ কাঁদো কাঁদো শোনায় বাবুইয়ের গলা। কষ্ট হয় এবার ইমনের। সাড়া দেব? নাহ থাক। আরেকটু দেখি ছেলের কাণ্ডটা। দুদিন পরেই তো মিশনের হোস্টেলে থাকতে হবে মা বাবাকে ছেড়ে। দেখাই যাক সামলাতে পারবে কিনা। একটা পরীক্ষা হয়ে যাক তার। বাথরুমের দরজা খোলার আওয়াজ পায় এবার ইমন। ইমন ছাদ থেকে দেখে,বাবুই একবার গেট খুলে বাইরে এসেও উঁকি মারে,গেট বন্ধ করে সিঁড়ি দিয়ে ধুপধাপ পা ফেলে উঠে আসতে থাকে ছাদে। সতর্ক হয় ইমন। আরেকটু সরে যায় কালো ট্যাঙ্কটার আড়ালে। বাবুই ছাদের মুখে দাঁড়ায় ,প্রায় আর্তনাদের মত গলায় চেঁচিয়ে ওঠে মা বলে,এদিক ওদিক তাকায় উদ্ভ্রান্তের মত। ভাবতে পারেনা, মা সব শুনেও ইচ্ছে করে চুপ করে থাকতে পারে দুষ্টুমি করে। আর রিস্ক নিল না সে। হাতে করে মোবাইলটা নিয়েই এসেছিল মায়ের। তড়িঘড়ি বাবার অফিসের নাম্বারটা ডায়াল করে বলতে থাকে হ্যালো! হ্যালো বাবা! আমি বাবুই বলছি! জানো তো মাকে খুঁজে পাচ্ছিনা কোথাও। হ্যাঁ সব দেখেছি। হু বাথরুম ও। কোত্থাও নেই। কি হবে বাবা? না ঘর খোলাই ছিল। ময়না মাসিও তো নেই,ছুটি নিয়েছে আজ কাজে। আমি তো পড়তে গেছিলাম। ফিরে এসে আর পাচ্ছিনা মাকে...
ইমন দেখল এটা বেগতিক। তন্ময় এমনিতেই নানান ঝামেলায় থাকে অফিসে,তার মধ্যে এসব শুনলে টেনশন করবে। অনেক হয়েছে, আর নয়। ওরে পাগল ছেলে আমি এই তো! কোথাও যাইনি সোনা। ছুটে বেরিয়ে আসে বাবুইয়ের বিস্ফারিত চোখের সামনে ইমন। তার দুই গাল বেয়ে গড়ানো অশ্রুবন্যা আর কান্নার আওয়াজ দুটোই দ্বিগুণ হারে বেড়ে যায় মায়ের দুই হাতের বাঁধনের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ার পর। ফোনটা হাতে নিয়ে ইমন দেখল কেটে গেছে আগেই। কি জানি, হয়তো চিন্তা করছে বেচারা অফিসে। এবার লজ্জা পায় নিজের আচরণে সে। বেশ একটা অপরাধী অপরাধী বোধ হতে থাকে নিজেকে। ছি ছি! সামান্য খেয়ালের বশে ছেলে বাবা দুজনকেই অহেতুক চিন্তায় জড়াল! ওদিকে ছেলেটা সমানে বলেই চলেছে – ‘কেন তুমি সাড়া দিচ্ছিলেনা? কেন মা? আমার ভয় করছিল একা একা খুব!বাবুইয়ের পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বলে – ‘ভুল হয়ে গেছে বাবা। আর কক্ষনো এমন হবেনা। -সত্যি তো? আর কখনো যাবেনা তো আমাকে একা ফেলে? প্রমিস মি?’
প্রমিস বলতে গিয়েও থমকায় ইমন। কি করে বলি? তাহলে কি মিশনে ওকে ভর্তি করতে চেয়ে পাপ করছি আমরা?


ডিনার হয়ে গেছে। শুতে যাবার তোড়জোড় রোজকার মত। তন্ময় ল্যাপটপে মগ্ন। বাবুই সকালের কান্না ভুলে আবার আগের মত, সুখে নিদ্রামগ্ন। শুধু ইমনের মনে কি একটা মেঘ জমাট বেঁধে। খচখচ করছে একটা কথা। তন্ময় তো একটা কথাও বলল না আজ দুপুরের ঘটনাটা নিয়ে। একদম সহজ স্বাভাবিক। অথচ ইমন ভাবছিল সে কতনা চিন্তায় রয়েছে অফিসে, কিন্তু না। ফোনও করেনি একটাও ফেরার আগে, যেন ধরেই নিয়েছে ইমন যেতে পারেনা কোথাও, কখনও। এত নির্লিপ্ত, এত নিশ্চিন্ত? বাবুই না হয় ছেলেমানুষ, অত কান্নাকাটি, টেনশন বা attention কোনটাই চাইনা ইমনের, তাও... একবার তো বলতে পারত! আলো নিভল।ঘুমন্ত বাবুইকে নিয়ে ইমন পাশ ফিরে শুয়ে, টের পেল তন্ময় শুল পাশে। হঠাৎ কাঁধে একটা আলতো ছোঁয়া পেল, ‘জানি ঘুমাও নি।নিশ্চয়ই ভাবছ আর কিছু জানতে চাইলাম না কেন আজ? তবে শোন,বাবুইয়ের ফোনটা কেটে দেবার আগে আমি তোমার গলার আওয়াজটা শুনতে পেয়েছিলাম ও প্রান্ত থেকে। ছেলেমানুষিটা আছে জানতাম। এখন দেখছি অভিমানও ষোল আনা। বাবুই মিশনে ভর্তি হয়ে যাক, তারপর এই বাচ্চাটাকে আমি পড়াব, কেমন?’ ইমন আর থাকতে পারেনা। পাশ ফিরে তন্ময়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পরে ফুঁপিয়ে। ছেলেমানুষ! তাই তো!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র