জেলের উঁচু
দেওয়ালের বাইরে ঠাঠা রোদে দাঁড়িয়ে থাকার মধ্যে পাশ দিয়ে অল্পবয়েসি ছেলেছোকরাদের
বারবার ঘুরে তাকানো, এপাশ ওপাশের বাড়ির মধ্যে বাটি চালাচালির মাঝে, “এ মেয়েটার বাড়ি
কোথায় গো?” ক ঘণ্টা হলো মাঝে মাঝে মোবাইলে চোখ রেখে বুঝে নেওয়া। এখান থেকে
শ্যেনদৃষ্টিতে দেখতে থাকা তার বৈধ সম্পর্কেরা ফিরে গেল কি না। তারা ফিরলে, তবেই তার একঝলক
দেখা হবার সুযোগ, দোষী নির্দোষ চেনে না সে, শুধু জানে গরাদের ওপারে তার ভোর কয়েক
মিনিটের... তারপর আবার সপ্তাহব্যাপী রাত। টানা পনেরো দিন হলো তার চোখ বিনিদ্র;
হিংসে
করে সে আকাশকে। কেমন একটানা মেঘের অজুহাতে কেঁদে চলেছে! চোখ রাঙাবার, গায়ে কালি দেবার
কেউ নেই। তার গোঙানোও অপরাধ। তার বৈধ সবের প্রতি সমস্ত কর্তব্য সেরে এই যে ভোর না
হতেই ছুটে আসা, এ জানলে ছি ছি করবে না বুঝি কেউ? ছি ছি করুক
পরোয়া নেই, কিন্তু পুড়তে থাকা সেই ছোটবেলার সজনে গাছটা আর দেখতে চায় না সে। যখন
ককিয়ে উঠেছিলো, গাছটাকে মেরো না তোমরা, জ্যেঠিমা গাল টিপে বলেছিলো, শুঁয়ো পোকা ছেয়ে
ফেলেছে, ওর পুড়ে যাওয়াই মঙ্গল...
না পুড়ে গেলে যে
পাপ উড়ে উড়ে আশেপাশের সবার ঘরদোর ছেয়ে ফেলবে! পাপ, বৈকি! কি হবে,
সবাই
যখন জানবে, তার সিঁথিতে দুজন এঁকেছে রক্তের আলপথ? তিন ঘণ্টা হতে চললো, এরা ফেরত যায় না
কেন? মাথা
ঘুরছে তার। রোদে তাকাতে পারে না আর সামনে। ভ্যানওয়ালার পাশে উঠে বসে কিছুক্ষণ।
অবশেষে... অবশেষে... ছুট ছুট ছুট... নাম অ্যানাউন্স করছে ওরা। “ভরসা আছে?”
“আছে”
“বাড়ি থেকে ওরা
এসেছিলো”
“জানি, ওদের দেখেই আমি
বেরিয়ে গেছিলাম, পাশের রাস্তায় ছিলাম দাঁড়িয়ে...”
“এই টানা তিন
ঘণ্টা তুমি...!!!!!!”
“ভালো আছো তুমি?”
“নিজের বরকে
দেখতে এসেছো, এভাবে অপেক্ষা তাই, তাই না বিবি?
কথা দিচ্ছি
সামনের সপ্তাহে বাইরে তোমার সামনে দাঁড়াবো।”
অন্ধকার অন্ধকার
ভোর... বাচ্চা মেয়েটা স্কুল ড্রেস পরে লাফাতে লাফাতে হাজির খড়ের চাল ছাওয়া
বারান্দাতে। তার কালু আর নরমকে দেখতে রোজকার মতো। রক্ত... রক্ত... শুধু রক্ত দেখে
ভয়ে চিৎকার করে উঠলো মেয়েটা। তার কালু! তার নরম! কই? খাঁচা ভেঙে
কালুকে মেরে রেখে গেছে কোন হুলো, আর এক কোণে বসে নরম কাঁপছে তিরতির করে। “আমার আদরের
একজোড়া খরগোশের জোড়া ভেঙে দিলে কেন?” ওপরে তাকিয়ে স্কুলের সিস্টারদের শেখানো
প্রেয়ারের জিসাসকে অভিমান জানায় সে। কেঁদে স্কুলে যায়, আর প্রেয়ারের
সময় কিছুতেই চোখ বন্ধ করে না, কপাল বুক এ’কাঁধ ও’কাঁধ করে না তার
হাত। শুধু দাঁতে দাঁত চেপে থাকে।
পরদিন, খাঁচা খুলে ভোরে
বের করে আনে নরমের প্রাণহীন শরীর। মা বলছিলো জ্যেঠিমাকে, “কি আশ্চর্য বলুন
মেজদি, এরাও
স্বামী স্ত্রীর মতো, প্রেমিক প্রেমিকার মতোই ভালোবাসে! বলে না, তোমাকে ছাড়া
বাঁচবো না, কিন্তু বাঁচে না... তাই না?”
খবর এসেছে জামিন
মঞ্জুর হয়নি... খবর আসেনি, তার মানুষটার ফেরার। তার বৈধতায় সে হীরে পরে,
সোনায়
মোড়ায় নিজেকে, ঢেলে দেয় সংসারের জন্য, তার একমাত্র সন্তানের জন্য, তার স্বামীর
প্রতি কর্তব্যে। তার পাঁক লাগা অবৈধতায় সে পরে থাকে নিউ মার্কেটের বাইরে কেনা
স্টেনলেস স্টিলের আংটি, পরম বাঁধন এও এক।
প্রশ্ন করে সে,
রাধাকে
তোমরা অবৈধ বলো না কেন? পাঁক ছেটাও না কেন? দ্রৌপদী মেনে
নিয়েছিলো পঞ্চস্বামী... মেনে নিয়েছিলো; স্বেচ্ছায় যদি পঞ্চস্বামীর স্ত্রী হতো,
তাকে
কি বারনারী বলতে তোমরা?
#
ক্লাস টেনের
কম্পালসারি ক্লাস হতো যৌনশিক্ষার। খ্রিস্টান সিস্টাররা কনভেন্টের সুশিক্ষা দিতে
চেষ্টা করতেন সপ্তাহব্যাপী এই কার্যক্রমে। বলতেন, কোনো পুরুষের
কথা মনে আনলেও অশুচি হয়ে যেতে হয়। কেবলমাত্র বিবাহিত স্বামীর স্থান শরীরে বা মনে।
শুচিতা নিয়ে তখন থেকেই তর্ক করতো বাচ্চা মেয়েটা। বকাঝকা কম খায়নি বেখাপ্পা কথা বা
যুক্তির জন্য। তবু মেয়েটা বড্ড তর্কবাগীশ। চুপ করে গেলেও মেনে নেয় না সবকিছু এমনি
এমনি। তাই কি বেয়াড়া মেয়েটা ভালোবাসে লাগামহীন?
“কি পেলে আমাকে
ভালোবেসে? কিছুই তো দিইনি... সামাজিক স্বীকৃতি, দেদার টাকাপয়সা,
গয়নাগাটি...
তবে কেন?”
“ভালোবাসলে ওসব
পেতে হয়? জানতাম না। তুমি... তোমাকে পেয়েছি। আচ্ছা, তুমি কেন
ভালোবাসলে আমাকে? অবশ্য ভালো তো প্রথমেই বাসোনি। প্রথম থেকেই জানতে আমি ঘোরতর সংসারী,
জানতে
দাওনি তুমিও সংসারী। খেলতে নেমেছিলে, বলো?”
“খেলতে নেমে
বুঝতে পারিনি কখন সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছি। আমার সব অপূর্ণতাকে ভরিয়ে দিয়েছো,
নিজেকে
নিংড়ে ভালোবেসেছো আমায়... হেরে গেছি তোমার ভালোবাসার সামনে। দেরি করে ফেলেছি অনেক,
তবু
বুঝেছি তোমাকে জড়িয়ে আমার বাঁচা... থেকো।”
#
বর্ষার জল পেয়ে
বেড়ে উঠছে যুবতী তুলসী। উঠোনে... টবে... তাদের ঘরসংসার...। ফিরবে কবে?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন