টুম্পা মণ্ডল - মায়াজম

Breaking

৩ আগ, ২০১৫

টুম্পা মণ্ডল

                                                 ভালোবাসার কালো ঝাঁপতাল







নিন্দুকেরা বলে কালো নাকি বিষাদের রঙ। বেদনার, ভয়ের। মৌন মিছিলে দেখেছি কালো আবরণে ঢাকা মুখ। আবার ধিক্কার মিছিলে বুকের উপর সেফটিপিনে গাঁথা একফালি ত্যানা। এই সবকিছুর সাথেই আরেকটা শব্দ ওতপ্রোত জুড়ে আছে বোধহয়। ভালোবাসা। এই বোধ আমার জন্মেছিল ছোটবেলায়, ভোঁদো কাকুকে দেখে। কাকু কালো কাকিমা ঘরে এনেছিল। সঙ্গে নগদ পঞ্চাশ হাজার। প্রতিবেশীরা বলল, মেয়ের বাবার টাকার জোরেই অমন রাজপুত্রের মতো ছেলে জুটল। কথাটা ঠিক না ভুল মীমাংসা হওয়ার আগেই ওদের বিছানায় পুচকে ছেলেটা হিসু করতে লাগল। ওদের প্রথম সন্তান। সে হামা টানতে না টানতে এসে পৌঁছল মেয়ে । পরের বছর আবার। এভাবে নেই নেই করে মোট সাতটা। কালো ভালোবাসার রঙ না হলে পঞ্চাশ হাজারে এত প্রোডাকশন হয়? কস্টিংয়েই তো পোশাবে না। আবার শুনি কালো নাকি শয়তানের রঙ। অথচ আমার মাটির দেবতা, আমার বাবা কালো। কালো কে ভালোবাসি। যেদিন ওকে প্রথম দেখি, কালো টি শার্টের ভিতরে একফালি ভি শেপড বুকের উপস্থিতিতে তুমুল যৌবন নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছা করছিল, জানতাম সে আকুতি ওই ফ্যাকাসে বুকের প্রতি নয় বরং ওর তেজি কালো ঘোড়াটার দিকে আমার নজর, যাকে তখনও আমরা মঞ্চে ঢুকতে দিইনি।

কালোর প্রথম ধারণা ছোট বয়সেই হয়। লাল থালা ডুবলে তখন একমাত্র ভরসা সবুজ হ্যারিকেন। খুব জোর আলোর জন্য অনেকটা সলতে তুললে কালো আস্তরণে আলোটাই ঢেকে যেত। অল্প আলো নিয়ে শিখেছিলাম তীব্রতার রঙ কালো। বড় হয়ে বিজ্ঞানে পড়ি বর্ণহীনতা নাকি কালো। লাল কাঁচের ভেতর সবুজ রঙের ঢেউ খেলেনা বলে লালা কাঁচে পাতারা কালো। একজনের ভালোবাসার আবেদন আরেকজনের মনে ঢেউ না তুললে সেটা বেহুদা কালো। অর্থাৎ অমিলের রঙ কালো। গভীর কালো বিচ্ছেদ। বিচ্ছেদ ভালোবাসার প্রতীক।

এক একদিন ঝরিয়া হত। অবিরাম বৃষ্টি। টিপ টিপ পড়েই চলেছে। কখনও জোরে, কখনও আস্তে। থামার কোনও চিহ্ন নেই। অবিশ্রান্ত সঙ্গম। এরকম রাত্রি বিশেষ ক্ষুধার্ত। সারাদিন চলত লুচিটা, পরোটাটা, খিচুড়িটা। তারপর সন্ধ্যে নামলেই গুর গুর। দু চারটে দুম দাম। মা দু চামচ কষটে ত্রিফলে চূর্ণ সহযোগে এক গলা জল খাইয়ে বলত, যা টানটান শুই পড়। আর কোনও খাবার জুটত না। পেটটা জলের বোঝা। কিন্তু জলের যা ধর্ম। সে তো কোনকালেই সংসারী নয়। বয়ে যায় নিচের দিকে। তল চেপে আমাকেও বয়ে যেতে দিতে হত বারবার। কিছুক্ষণ পরে সে রসদও শেষ। তখন অগত্যা ঘুম না আসা চোখে গরমে মশারির ভেতর ঘেমে একসা হয়ে দেখতাম চারিদিকে পাকা তালের মতো অন্ধকার। খিদে অশ্লীল প্রেমিকের মত একরোখা। ড্যাবড্যাবে দৃষ্টির অধিক মনোযোগে তখন কালিমালিপ্ত রাত্রির পর্দায় ফুটে উঠত ঘোলাটে একফালি আকাশ। মোটা মোটা গারদ। নিঝুম গাছ। নিশ্চুপ পাতা। ঘরের ভেতর দু একটা জোনাকির চাপা গন্ধ সমেত চটচটে আলো। আর সবের সাথে মাখানো একটা অন্ধকার গন্ধ : একটা আওয়াজ। অন্ধকারের আওয়াজ বললেই কলকাতাবাসীর ঝিঁঝিঁর ডাক মনে ভাসে। কিন্তু স্মৃতি বলছে ঝিঁঝিঁ নয়, অন্ধকারে একটা উ কারান্ত আওয়াজের গন্ধ ছিল। নিরবচ্ছিন্ন। জোরালো। নেশাড়ু একটা আওয়াজ। টিপটিপ জলের শব্দের সাথে কখনও বড় বড় ফোঁটার শব্দ। শব্দ ভেদে বৃষ্টির তীব্রতা বোঝা যেত। ঘুম চোখে শ্লেষ্মা জড়ানো গলায় মা বলত, " ওউ বাঢ়লা ফের "। বৃষ্টি বেড়েছে। একটা বড় পতঙ্গের দেওয়ালে ধাক্কার শব্দ।পিপীলিকার স্বচ্ছ সেলোফিনের মতো মৃত্যু ডানার পাক। দমকা হাওয়ায় জানলায় ঝোলানো চিনির বস্তার ছটফটানি। এইসব নিয়ে স্বপ্ন ভাসতো চোখে -- সকালের জল থৈ থৈ নদী। ডোরা কাটা গামছা চ্যাংদোলা করে মাছের জন্য ওঁত পাতা। প্রতিবারই অদক্ষতায় ছিটকে যায় বড়গুলো। স্নেহ বশত কিম্বা আরো তীক্ষ্ণ লোভে কুচোগুলোর গায়ে থুতু ছিটিয়ে বলি, "থু কাঁরি তোর মা বাপ কে ডাকি আঁ(ন) "। আর সঙ্গে সঙ্গে মুচড়ে উল্টে যেত গামছার শরীর। স্বপ্নে ভাসতো নাউড়িয়ার গান, অনেক দূর থেকে। বৃষ্টিতে একূল ওকূল জল হলে তার ডগা ভাসে। চির অভ্যাসে দাঁতে বিড়ি কামড়ে সে তার সবল দেহটাকে নুইয়ে দু হাতে লগি নৌকা নিয়ে যায় এক গ্রন্থি থেকে আরেক ক্ষণস্থায়ী গ্রন্থিতে। এতেই তার আনন্দ। এটাই তার প্রাণ। নাউরিয়া আমায় রবীন্দ্রনাথ বুঝিয়েছিল।

এইসব রোমান্টিকতার বিপ্রতীপে আলতো ছোঁয়ার মতো একটা ভিনদেশি সুর ভাজত হরিদাসী ঝি। ঝি অর্থে পিসি। কুলু দিদির বিয়ে হয়েছিল দু গ্রাম পেরিয়ে। স্কুল মাস্টারের সঙ্গে। শিক্ষিত লোক। বড় ঘর। কেন যেন বনিবনা হয়নি। আড়ি করে চিরদিনের মত কুলু দিদি ফিরে আসে। চারমাসের মাথায় মাস্টারের দ্বিতীয় বিয়ে তার পুরনো প্রেমিকার সাথে। কুলু দিদির সন্তান জন্মের আগেই মরেছিল। জানা গেল সেই সূত্রে নাকি কুলু দিদির লাইকেশনও সারা। মাস্টারের বিয়ের দিনও তার হাসিমুখ টিকে ছিল। মাস্টার আর তার একইদিনে ফুলশয্যা। তার রঙিন শাড়িটা নিশ্চুপ দাঁড়িয়েছিল মাটির চারহাত উপরে, আলতা পোড়ানো -সিঁদুর লেপা প্রতিবাদী শরীরে। এসব বেদনা আমাদের মুখে লেগেছিল। নিত্যদিনের খাওয়া ধোয়ায় ক্রমশ সাফ সুতরো হলাম। একমাত্র হরিদাসী ঝি, ভালোবাসার জন্যই তো, এই কালো বুক নিয়ে বাঁচল জীবনের অবশিষ্ট বর্ষাকাল। সেদিনও ঘোর ঝরিয়া ছিল।

বহুদিন কলকাতায় কাটানোর পরও গ্রামে গেলে এখনও এই আওয়াজ পাই। হরিদাসী ঝি মারা যাবার পরও। তার শুকনো রসহীন মাই দোলা বুকের চিরন্তন কান্নার খবর পাই এখানে ওখানে। বুঝি সরকারের পক্ষে গ্রামে আলো পৌঁছানো সম্ভব নয়। আমার গ্রামটা এখনও অশিক্ষা আর ভালোবাসায় কালো হয়ে আছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র