অশোক তাঁতী - মায়াজম

Breaking

৩ আগ, ২০১৫

অশোক তাঁতী

                           একটা পেঁচা ও জুপিটার








এখন আকাশে দ্বিতীয়ার চাঁদ । সরু উজ্জ্বল । ঐ চাঁদটা তোর খুব প্রিয় । তাই আমরা ছাদে উঠে এসেছি । যদিও মনের মধ্যে ভয় । আশেপাশের বাড়ির জানালা যাতে সাক্ষী না থাকে সেজন্য ছাদে শীতলপাটি ।
তুই চিৎ শুয়ে । ছাদের কোলে নদীর অন্ধকার । রোজকার মত জ্বলজ্বলে শুকতারা চাঁদের পাশে । এই চাঁদ অস্ত যাবে আর ঘন্টাখানেকের মধ্যে । আবছা একটা আলো আমাদের মধ্যে সাঁতরাতে থাকে । হঠাৎ উল্কাপাতের মত নিরীহ ইচ্ছা সবে ঘুরপাক খেতে শুরু করেছে মনের মধ্যে, তখনই আমার হাতটা নিয়ে তুই রাখলি তলপেটের ওপরে । আর আকাশের গায়ে কুঁড়ি ফোড়ার মত একটা অন্ধকারকে দেখিয়ে তুই বললি , জুপিটার ঐখানে ফুটবে ।
জুপিটার ? এমন অক্ষম উজ্জ্বল ? তুই ঠিক জানিস ?
একটু একটু করে ওর অস্তিত্ব বোঝা যাবে । আকাশের তৃতীয় উজ্জ্বলতম । চাঁদ আর শুকতারার পর ।
আমার হাত তখনো স্থির হয়ে আছে তলপেটে । মৌসুমীবায়ু নামেনি শরীরের জিরেন কাঠে । প্রান্তরের সোঁদা গন্ধে অলৌকিক ইন্দ্রজালের মত শরীর আদিমতম উত্তরাধিকারে । তুই তোর একটা হাত বোলালি আমার হাতের ওপর । সব শান্ত হয়ে যেন উড়ি বৃষ্টি নামল । তুই প্রশ্ন করলি , শুনতে পাচ্ছিস ?
একটা পেঁচা তখন নিঃশব্দে এসে বসল ছাদের কার্নিশে । এত সন্তর্পণে ডানা বন্ধ করল যেন আমি আঙ্গুলের নীচে ওঠানামার শব্দ পেলাম , যেমন করে মাটির মধ্যে অঙ্কুরিত হয় বীজ , তেমনি নিঃশব্দ । যেন যাচাই করতে এসেছে । প্যাঁচাটা শান্ত হয়ে তাকিয়ে থাকল আমাদের দিকে ।
তুই আমার হাতটাকে তলপেট থেকে সরিয়ে রাখলি নাভির ওপর । কেমন অলীক শব্দে বেজে উঠেছে বুজকুড়ি ।
প্যাঁচা তোর একটুও ভাল লাগেনা । অবশ্য এমন উদ্ভট প্রাণীকে ভাল লাগার কোন কারণ খুঁজে পাই না । সামনে দেখেও যে প্রাণী চুপচাপ তাকিয়ে থাকে । তারপর পর্যাপ্ত কারণ ছাড়াই হঠাৎ উড়ে যায় পাশের গাছে । আর ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে থাকে ঘটনার পেছনের ঘটনাকে । বিজ্ঞের মত নিজের অসমর্থন জানায় ।
কেমন এক অদ্ভুত অন্ধকার ঘিরে রেখেছে আমাদের । বাকি সবাই অন্যদিকে । কিন্তু প্যাঁচার মুখোমুখি হয়ে মনে হচ্ছে বাকি সব অন্ধকারে । আমি একাই আলোতে । সবাই জরিপ করছে । নিজের ছায়াটাকেও দেখতে পাচ্ছি ।
আমার হাতটা নিয়ে তখন তুই স্পর্শ করছিস তোর পেট নাভি । প্যাঁচাটা তুই দেখতে পাসনি । তুই ফিসফিসিয়ে বললি , এখান থেকেই উড়ান শুরু করেছে জুপিটার ।
কোন জুপিটার ? আমি তখনো বুঝতে পারছিনা ।
তুই মুখে শব্দ করলি – শ্ শ্ । শুধু অনুভব কর ।
তোর তলপেট উঠছে নামছে । তোর নিঃশ্বাস অন্যরকম । ঘাম শুকনোর সময় এইরকম শ্বাস প্রশ্বাস থাকে না । আমি তবু যেন স্বপ্নের মধ্যে মুছলাম তোর কপালের ঘাম । তাকালাম তোর উজ্জ্বল চোখের দিকে । তোর হাসি দেখে বুঝলাম , তোর পেটের মধ্যে এক অদ্ভুত আকাশ । একটা লাল বিন্দু । এক একটা হৃদস্পন্দনে আমার দমবন্ধ অবস্থা । ভাবলাম আমার তো আনন্দ পাওয়া উচিত । অথচ আনন্দ হচ্ছে না । হাতের তালু কেঁপে উঠছে । তোর মুখ তখনো উজ্জ্বল । বললি , কি হল ? জুপিটারকে দেখলি ?
জুপিটার তখন একটু একটু করে কক্ষপথ স্থির করে নিতে চাইছে । তোর চোখে তাই উৎসবের আনন্দ । আমার হাতটা শরীরে বুলিয়ে নিতে নিতে বললি , আমি ওকে বুঝতে পারছি । আমি ওকে রেখে দেব নিজের সঙ্গে ।

দেখলাম প্যাঁচার ঘাড়টা একবার চারপাশ ঘুরে গেল । বুঝতে পারলাম তোর বক্তব্যের মানে । আমি কেঁপে উঠলাম , না প্লিজ !
কেন ? জুপিটার আলো দেখতে চাইছে । অন্ধকার ভালোবাসায় কতটা সাঁতার কাটার পর ওর জন্ম ভাব ।
আমার মনের মধ্যে ভয় জেগে ওঠে । - এটা অসম্ভব !
তুই আমার চোখের দিকে তাকালি । তোর দৃষ্টিতে পৃথিবী সৃষ্টি হল । সৃষ্টি হল বিদ্যুৎ , ঝড় , জল । সৃষ্টি হল অ্যামিনো অ্যাসিড । প্রাণ । তা সাঁতরাতে থাকল অন্ধকার গহ্বরে ।
তুই স্থির হয়ে বললি , জুপিটার আমার সাথে থাকবে । তোর কোন ভয় নেই । কেউ জানবেনা তোর কথা ।
প্যাঁচা আমার দিকে তাকিয়ে আছে । যেন সম্মতির অপেক্ষা । আমার হাত তোর পেট থেকে ছিটকে উঠল । আমার ঘাড় উঁচু হল । চোখ তাকাল আশপাশের বৃক্ষলতা গুল্ম , পীচ কংক্রিটের দিকে । শুনলাম সমবেত হাসি ঠাট্টা মশকরা ।। মাথা নীচু করে আবার অন্ধকারে ডুব দিলাম । ঘাড় বেঁকে গেছে । বললাম , আর তোর অপমান ?
তুই বললি , তোর অপমান না হলে আমারো হবে না ।
কি করে ? এটা অসম্ভব ।
বিশ্বাস কর আমার কথা । একটা প্রাণ নিয়ে অপমান কেন হবে ? জুপিটার তো এসব কিছু জানে না ।
একটা ভুল হয়ে গেছে । তাই বলে তাকে বয়ে বেড়ানোর কোন মানে হয় না ।
একটা ভুল ঢাকতে গেলে আরও যে ভুলের সমুদ্রে ডুবে যেতে হবে ।
আমি চুপ করে ভাবতে লাগলাম । অন্ধকারের ফাটল বরাবর যদি কোনো আলো দেখতে পাই । দেখলাম ঘন অন্ধকার । চাঁদটাও অস্ত যেতে বসেছে । বললাম , তবে চল আমরা তিনজন একসাথে মারা যাই ।
তুই থামলি । তাকালি আমার দিকে । বললি , তাতে কি সব ভুল সত্যি হয়ে যাবে ? কোন অপমান থাকবে না ? হবে , কিন্তু আমরা কেউ জানতে পারব না । সমস্ত পৃথিবী জোড়া অসন্মান নিয়ে আমি বাঁচতে পারব না । বলে আমি চুপ করে থাকলাম । প্যাঁচাটা কয়েকবার ঘাড় ঘুরিয়ে নিজের অসম্মতি জানাল । নরম মুখোশ উঠে গিয়ে আমার মুখে তখন ক্রুরতার আগুন । তোর সামনে নতজানু হয়ে বললাম , প্লিজ প্লীজ !
তুই চুপ করে থাকলি অনেকক্ষণ । অস্ত যাওয়া চাঁদের স্রোত থামল ।একটা জোর শ্বাস নিয়ে তুই বললি , তুই আজ স্নান করিসনি না ? তোর শরীরে আজ বড় ঘাম গন্ধ ।
আমি আরও তীক্ষ্ম ভাবে বললাম , প্লীজ !
তুই নিজের পেট থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে উদাসীন। বললি , আচ্ছা ।
তখন আকাশ জুড়ে বৃষ্টি আসছে । মেঘ ডাকছে । পৃথিবীর নাভির ওপর তখন আমাদের কারো হাত নেই । ছাদের অন্ধকারের বাইরে কেউ জানল না ওর জন্মক্ষণের কথা । জুপিটারকে একা একা পাড়ি দিতে হবে অনেকদূর , অন্ধকারে , মহাশূন্যে । ওকে বৈধতা দেওয়া গেল না । কেউ শুনল না ওর কথা ।
শুধু প্যাঁচাটা একবার কর্কশ শব্দে ডেকে উঠল । তারপর উড়ে গেল অন্ধকারের ফাটল বরাবর ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র