শতদল মিত্র - মায়াজম

Breaking

২৫ সেপ, ২০২২

শতদল মিত্র

 জগৎপুর

  



গৎপুর মাটির লব্জে জগপুর হতে পারে বড় জোর, কিন্তু জগন্নাথপুর কী করে হল সে বৃত্তান্ত জানতে মাটি খোঁড়া জরুরি আর সে খননে মাটিমগ্ন কিছু কথা উঠে আসে, বাতাসে উড়ে যায় ঝরঝরানি শীতের উত্তুরে সে বাতে কিছু ধুলো, কিছু কুটোও ওড়ে কাঁপতে কাঁপতে শীতসকালে রোদেভেজা দুটো বুড়োটে মানুষ বাড়ির বারদরজায় বসে ফুকরে ওঠে ভাপ ওঠা গরম চায়ে কথা ভিজিয়ে
     --সত্যি কাকা এমন সুখের দিন যে আসবে কোনোদিন বাপের জম্মে ভাবি নাই গো! কপালে সুখ সইলে হয়!
     --তা যা বলেছিস ওতে তা বয়স তো দুই জনারই তিন কালে গিয়ে এককালে ঠেকল নাকি! সেই কবে যি বচ্ছর ইন্দিরা রানি হল পেথ্থম বার, সি বার জম্ম আমার
     --আর তারপর বছর না ঘুরতেই আমি তা শহরের জমিদার বাবু, যার কিষেন ছিল আমাদের বাপ-পিতিমো, তিনি ভালোবেসে আমার নাম দিলে--উত্তম বড় কাংগ্রেসি নেতা হলে কী হবে, সিনেমা ভক্ত ছিল খুব মানুষটো
     --তোর চেহেরাটা জম্ম থেকেই বাবুপারা, উত্তম...
     কথায় শীতের কুয়াশামাখা ছিল, কিন্তু সে বাত পড়তে পায় না, কেননা তখুনি ঝরঝরানি শীতের উত্তুরে হঠাৎ বয়ে যায় একটা তক্ষক শরীরে সাত রঙের ঝিলিক তুলে খরখর আওয়াজে রাস্তার উল্টোবাগে উরুলি খড়কুটোর মধ্যে সেঁধোয় ফলে দুই বুড়োটে মানুষের মহাপ্রাণী গরম চায়ে চুমুক দিতে বাধ্য হয় সুরুৎ শব্দে কথারা ফের মায়ালু ভিজে
     --কী বিস্কুট খাচ্ছিস রে?
     --বাটর বাইট তোমার টো কমলা কিরিম মনে হচ্ছে?
     চায়ের গেলাসে এলিয়ে পড়া বিস্কুটের টুকরোকে কাঁপা আঙুল দিয়ে জুত করতে করতে সিধু, সুধীর মেটে, উত্তমের কাকা যে, আলগোছে কথা ভাসায়
    --এত ভালো ভালো খাদ্য... বেঁচে থাকতে বড় সাধ রে ওতে! অনেক অনেক দিন...
    --আমারও মরতে বড় ভয় কাকা ছুটুকালে বাগালি করেচি, মান্দেরি করেচি, মাঠ থেকে গোবর কুড়িয়েচি, মা ঘুঁটে দিলে সে ঘুঁটে শহরে বাবুদের বাড়ি বিক্কিরি করেচি... তবু পেট ভরে নাই কোনোদিন ভাদ্দর-আশিনে তাল চুষে পেট মানিয়েচি
     --সেই তো রে! তা লাল এলে ভাবলাম বগ্গাদার আইনে টুকুন সুরাহা হবে তা বাবুরা সে আইন হাওয়া পেতে না পেতে তার আগুতেই সব বেবাক বিচে দিলে ভিন গাঁয়ের মোচলমানদিগে এখুন ইটভাঁটা
    --নেতা কিনা! হাওয়ার বাত বুঝতে পেরেচিল আগুতেই তদ্দিনে বাবুরাও তো লাল নেতা অনেকেই তো আবার সি কবে থেকেই শহর ছেড়ে কলকেতার বাবু
     --তা ইটভাঁটাটো ছিল তাই দুটো প্যাটের ভাত জুটেচিল জৈবনকালে সংসারটো পেতিপালন করতে পেরেচি কোনো গতিকে বামুন-কায়েতদের তো জম্মতক দেখচি গাঁ ছাড়া, চাকরি লেগে কলকেতা আর আমাদের ছুটু জাতের সব্বাইও কেমুন  একে একে গাঁ ছেড়ে হিল্লি-দিল্লি চলে গেল দুটো পয়সার জন্যি গাঁটো কেমুনপারা বেবাক শূন্যি...
     ফোঁত করে নিঃশ্বাস ছাড়ে সিধু মেটে নড়বড়ে আঙুলে নাক মোছে লুঙির খুঁটে
     --তা, যাবে নাই বা কেনে? নদী নাই, কেনাল নাই এক ফসলি জমি ভগমানের দয়া হলে তবে চাষ নইলে হয় খরা, নয় জলে হাজা
     --দুখের কথা বাদ দে তা আজ টিপিন কি হচে বল তো?
     চা ভেজা বিস্কুটের তলানিটুকু গেলাস উপুড় করে মুখে ঢালতে সচেষ্ট ছিল উত্তম হাতের কাঁপুনিতে কিছুটা মুখের গহ্বরে যায়, বাকিটা ঠোঁট বেয়ে গড়িয়ে পড়ে বুকের চাদরে চাদর ঝাড়তে ঝাড়তে উত্তর দেয়-- মুড়ি-ঘুগনি আজ রোববার না!
     --তবে তো আজ মুরগির ঝোল সুরুৎ করে জিভের গড়ানো লাল মুখের ভেতর টেনে নেয়  সুধীর
     ফলে খানিক নিস্তব্ধতা ছায়, যা পরক্ষণেই টাল খায় দূরের মোটর সাইকেলের ভট ভট আওয়াজে দুই বুড়ো কান খাড়া করে এবং তাদের বাঞ্ছা পূরণে উদিত হয় অষ্টম পঞ্চাৎ
    --একশো দিনের কাজের টাকা ব্যাঙ্কে ঢুকে গেছে গো কাল তুলে দিয়ে যাব
     ধুলোর সঙ্গে কথা উড়িয়ে চলে যায় পঞ্চায়েত মেম্বার তার পেছন পেছন যেন ভেসে যায় সিধু, ওতেও
    --বেঁচে থাক বাবা শত বচ্চর পেরমায়ু হোক
     বচন প্রতিধ্বনি যাচে, ফলে মোটর যানের ছন্দে চেনা শব্দ ছড়ায়, জোড়া লাগে-- তোমাদের লেগেই তো মোরা নাকি গো দাদু... দাদুগণ!
     আর গণ শব্দটা আলটপকা লাগসই হওয়ায় পঞ্চায়েত প্রজা, উভয় পক্ষই গণতান্ত্রিক বাতাবরণে আবিষ্ট হয় শীত সকালে মোটর সাইকেলে আচমকা ব্রেক লাগে যান্ত্রিক গর্জন ছাপিয়ে কথা ঝরে
    --কাজল, রানি যেন ইস্কুল যায় মাঝে মধ্যে কষ্ট হলেও কন্যাশ্রী-রূপশ্রীর টাকা... যদিও আমি আছি, তবুও... পাঁচগাঁয়ের পঞ্চজনা পাঁচ কথা কইবে... অত ফৈজতে কি দরকার বাপু!
    --না না যায় ওরা শহরের গাড়ি-ঘোড়া... সাইকেল তো চালাতে পারে না... হেঁটেই যায়... মোটে তো দেড় কোশ পথ!
     --তা, অষ্টম, নজরটো একটু খাটো মনে লয় হাসপাতালে দেখালে...
     --স্বাস্থ্যসাথী কার্ড আছে কি করতে! ছানি অপারেশন করিয়ে দেবে আমার লোক
     মোটর গর্জন তোলে আবারও ধুলো উড়িয়ে ছুটে যায় শেষকথাটা ছুঁড়ে দিয়ে-- আসছে রোববার শহরে মিছিল মন্ত্রী আসছে মনে আছে তো?
    --লিচ্চয় লিচ্চয় প্রতিশ্রুত শব্দেরা ছুটন্ত ধুলোর পেছনে আপ্রাণ ছুটে যায়

--বড় সুখ রে ওতে! বয়সে এসে এত সুখ ভাবতেই পারি নাই মাঠে না গিয়ে একশো দিনের কাজের টাকা নগদা নগদি ঘরে বয়ে এসে ঢুকছে! তা অষ্টারা আধা ভাগ নিচ্চে, সি ওদের লেজ্য পাওনা কী বলিস?
     --তা বলতে? ওরা আচে বলেই কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, বাদ্ধক্য ভাতা
     --বাংলা আবাসের পাকা বাড়ি কোনোদিন পাকাবাড়িতে থাকবি ভেবেচিলিস? মাস গেলে ঘরে হাজার হাজার টাকা ফোকটে! তা বাদে কন্টোলের বিনি মাগনা চাল-গম
    --আবার একশো দিনের টাকা! চাকরি বাবুদের পারা বোনাস! সি টো বল!
     নিজের রহস্যে নিজেই দুলে দুলে হাসে উত্তম মেটে, সুধীরের ভাইপো যে সে দুলুনিতে রোদ দোলে, বাতাস নাচে, গাছের মরা পাতা ঘুরে ঘুরে ঝরে পড়ে, উড়ে যায় ঝরঝরানি হাওয়ার টানেই যেন আন কথা ভাসে
    --শুধু হাতদুটো কেরমে কেরমে অবশ, বেজুত... ফোঁত করে নিঃশ্বাস ছাড়ে সুধীর
     --তা জগনের মা এখনো এল না তো?
    --দাঁড়াও সময় হোক কাঁটকিরি গাছের ছায়াটা চৌকাট ছুঁলে আসবে
     ফলে সময় খানিক দীর্ঘায়িত হলে দুই বুড়োটে মানুষ কাঁপা হাতে বিড়ি ধরায় ধোঁয়া ছাড়ে নেশার মৌতাতে কথারা আবারও ঘনায়
     --জগনের মা-টো কিন্তুক ভগমানের দয়া, সি তোমাকে মানতেই হবে কাকা
     --তা, যা বলেচিস! না থাকলে টাকা থেকেও খেতে পেতাম না রে হাত নিলে কি হবে? ভগমান যেন ওর বেশে নিজে হাজির হয়েচে গেরাম দেবতার পরীক্ষে নিচ্চয় দেখচে কারা কারা দেবতার ভিটের মায়া ধরে রাখে? জয় মা মনভোলা! জয় মা সুবিক্ষে!
     খুড়োর দেখাদেখি উত্তমও জোড়হাত বশে এনে কপালে ঠেকায় ধরতাইয়ে কথা বইয়ে যায়
     --আসতো খঞ্জনি বাজিয়ে হরিনাম শোনাতে, তা আমাদের টানে গাঁয়ে থিতু হল চাল নাই, চুলো নাই, আধার নাই, ভোটার নাই, ভোট নাই বলি, পঞ্চাৎকে ধরে ভোটার-আধার করে নাও জগনের মা কন্টোল পাবে, বিধবা ভাতা পাবেতা হেঁয়ালি করে বলে, এক বচরের জগন্নাথ মারা গেলে এই দু-হাতই আমার জগন্নাথ গো দাদা তোমাদের কাজ করে দিই তোমরা ভালোবেসে দু-মুঠো দাও একলা পেট, পাঁচঘরের পাঁচমুঠো পেলেই তো...
     কথায় বাঁধ পড়ে সহসা, যেহেতু রোদ ছলকায় সে ঢেউয়ে কাঁটকিরির ছায়াটা ছুঁয়ে দেয় ঠেকনের চৌকাঠটাকে জগনের মা মুড়ির থলে আর ঘুগনির বালতি নিয়ে আসে দুই খাবুটে বুড়ো জামবাটি পাতে
     --আজ কার ঠেঙে হেঁসেল পাতলে গো জগনের মা?
    --দুকড়িদার বাড়িতে গো কাল তো তোমার বাড়ি পালা সুধীরদা
     মুড়ি মাখতে মাখতে চোখ তুলে তাকায় সুধীর চোখে তার তৃপ্তি বসে মৃদু হেসে সে আবার মুখ নামায় বাটির পানে মুখ প্রায় গুঁজে দেয় বাটিতে, যেন কাঁপা হাতে একটা মুড়িও ভুঁয়ে না পড়ে ততক্ষণে শুধু ঘুগনি মুখে পুরেছে উত্তম
     --বেড়ে রেঁধেচে ঘুগনিটা কী বল কাকা?
    --আঃ! বেশ তর রে! এর তরেই তো বাঁচা! সুখ ছেড়ে মহাদেবরা গাঁ ছেড়ে চলে গেল
     উত্তম মুড়ি মুড়ি চিবনোর ছন্দে মাথা নেড়ে সায় দেয় এক ঢোক গিলে বলে,
    --ওদের সি এক গোঁ! তা আমাদের না হয় বয়স হয়েচে, কিন্তুক যারা ছুটু... ওদের কেনে? ওদের বাপ-মায়েরা তো জোয়ান, ওদেরই বা...
     এমন অলুক্ষণে কথাটা পাড়তে দেয় না সুধীর মেটে
     --আরে, কাঁপুনি তো জলের লেগে সমিতির ডাক্তার এসে বলে গেল না! সি কবেকার সাহেব কালের ইঁদারার জল জান নাই আর ওর পঞ্চাৎ থেকে শহরের নলের জল এনে দিলেই রোগ বালাই দূরে যাবে
     একটু থামে সে দম নিতেই যেন রোদে রাখা প্লাস্টিকের বোতল থেকে জল খায় কষ বেয়ে জল গড়ালে, হাতের চেটো দিয়ে মুছে আবারও ধরতাই দেয়
     --বিভুঁয়ে গেলে কি অসুখ হবে না! যত্ত সব!#82# হঠাৎ একটা উড়ো মেঘ আনমনে ভেসে এলে রোদ মলিন হয়, একটু ক্ষণই তবুও সে মলিনতা কথা ঢাকে পর ক্ষণেই ঝরঝরানি বাতাস বয় মেঘ ওড়ে দিন জাগে আবারও ফলে কথা জাগে
    --বুঝলি ওতে, মনে লয় কি ঘরে যদি আরও একটো-দুটো বিটিছেলে থাকত! তাইলে আরও কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার আর একটুস ভালো থাকা!
     বাক্যি উত্তমের মনেরও, তাই তার জোগানো কথায় আদর মেশে
     --শুনেচ তো কাকা, দুই ঘরেই লতুন মনিস্যি আসচে গো লাতিন আসচে বোসেখেই
     --ঠাকুর, ঠাকুর বিটিছেলে দিয়ো ঠাকর
     খুড়ো-ভাইপো, দুই বুড়োটে মানুষ কষ্ট করে কাঁপা হাত জড়ো করে কপালে ঠেকায়
# # #
দিন যায়, মাস যায়, দোল আসে, চড়ক যায় আসে ভোট পরব সরকার পঞ্চায়েতে আটন গাড়ে সে পরবের বাদ্যি ছাপিয়ে জগৎপুরে খুড়ো-ভাইপো দুই বুড়োটে মানুষের ঘরে শাঁখ বাজে হ্যাঁ, ঠাকুরের কৃপায় দুইঘরেই কন্যাজন্ম হয় তবে সে জন্মে ঈশ্বরের অদ্ভুত লীলা প্রকট হয় দুই সদ্যজাতেরই হাতে কোনো আঙুল থাকে না ফলে কথা জাগে গাঁ, সে গাঁ, পঞ্চগ্রামে কথা শিকড় চারায়, পল্লবিত হয় কথা ভাবরূপ পায় শব্দে ব্রহ্ম জাগে আকাশ, বাতাস মুখরিত হয় সে ব্রহ্মে--জয় জগন্নাথ!
     জগৎপুরে মেলা লাগে নাগরদোলা চক্কর কাটে জিলিপির প্যাঁচ জড়ায় ময়রার দোকানে হরেক মাল বিশ টাকায় বিকোয় সুধীর-উত্তম, দুই বুড়োটে মানুষ কাঁপা হাতে প্রণামীর টাকা গোনে
     সে মচ্ছবে মানুষের ছায়ার আড়ালে কখন যে কাজল, রানি, দেবশ্রী, মহুয়া, শুভশ্রী আদি পঞ্চকন্যা ভেসে যায় দূরে, আরও দূরে, জগন্নাথের, জগনের মায়ের আঁচলের আচরাচর ডানার মায়ায় আপন হাতে জগন্নাথ আঁকড়ে ধরতে চেয়ে! 

    জগৎপুর কবে যে লোকমাহাত্মে জগন্নাথপুর হয়ে যায়! পরিত্যক্ত সে খণ্ডে অচেনা পথিক ঝরঝরানি হাওয়ায় আজও নাকি আনমানা কালে জগন্নাথ ধ্বনি শুনতে পায়!
 


৩টি মন্তব্য:

Featured post

সোনালী মিত্র