জনা বন্দ্যোপাধ্যায় - মায়াজম

Breaking

২৫ সেপ, ২০২২

জনা বন্দ্যোপাধ্যায়

 প্রায়শ্চিত্ত






বৈশাখ শেষ হতে চলল, তবু কালবৈশাখী মেঘের এখনো দেখা নেই। উত্তপ্ত মাটি, শুষ্ক গাছ গাছালির করুণ অবস্থা! এমন দিনে দুপুরের গরম লু সহ্য করে যারা রাস্তায় চলাফেরা করেন, তারা নেহাতই নিরুপায় হয়ে বেরোন। আকাশের দিকে তাকানো যায়না--যেন বিশাল অগ্নিসাগর!
         আজ আবার মুকুন্দবাবু ছাতা নিয়ে বেরোতে ভুলে গেছেন। পাঁচ বছর হল কোন চাকরী নেই। আগে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ করতেন। কিন্তু সেই কোম্পানি হঠাতই একসঙ্গে অনেক লোক ছাঁটাই করে দিল। এখন সকাল বিকেল দুটো টিউশনির আয়ই যা সম্বল! গত বছর স্ত্রীও চলে গেলেন। টাকার অভাবে মুকুন্দবাবু স্ত্রী রমলার ব্রেন টিউমারের চিকিৎসা করাতে পারেননি। মুকুন্দবাবুর দুই মেয়ে, তিন্নি ও তোতন। তিন্নির বয়স বাইশ, তোতনের পনেরো। তিন্নি তাদের অভাবের সংসারে কোনরকমে হায়ার সেকেন্ডারী পরীক্ষা দিয়েছিল, কিন্তু পাশ করতে পারেনি। তবু নিজের চেষ্টায় সেলাই-এর ডিপ্লোমা নিয়ে তিন্নি কাছেই একটি সেলাই স্কুলে সেলাই শিখিয়ে সামান্য রোজগার করে। খুব নরম, শান্ত আর একটু চাপা স্বভাবের মেয়ে তিন্নি। তোতন আবার দিদির স্বভাবের বিপরীত। খুব বেশী কথা বলে, ছোটফটে, প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরা। পড়াশোনায় তোতন বেশ ভালো, ক্লাস টেনে পড়ে।
         তিন্নি সকাল থেকে নীরবে সংসারের সমস্ত কাজ করে। মুখটা তার সব সময় থমথমে গম্ভীর। কোন শখ আহ্লাদ, আবদার নেই। বাবার আর্থিক অক্ষমতার কথা তিন্নি বোঝে। কয়েকমাস ধরে বাড়িওয়ালা তাদের উঠে যেতে বলছে। এক ফালি বারান্দা সহ টালির ঘরে ভাড়া থাকে মুকুন্দবাবুরা। ভাড়া তিনশো টাকা।
         মুকুন্দ দত্ত আজ প্রায় হরিপালে আছেন কুড়ি বছর হল।  দেশ ভাগের পর বিধবা মা আর তিন ভাইকে নিয়ে পশ্চিমবাংলায় এসেছিলেন তিনি। অনেক কষ্টে ভাইদের বড় করে একটু সুখের মুখ দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভাইরা নিজেরা নিজেদের পায়ে দাঁড়িয়ে সবাই আলাদা হয়ে যায়। মুকুন্দবাবুর দু ভাই-এর লরির ব্যবসা। ছোট ভাই পি. ডবলু. ডি বিভাগে কাজ করে। তারা কেউই এখন দাদার সঙ্গে যোগাযোগ রাখেনা।
        মুকুন্দবাবু একটা সামান্য মাইনের চাকরী করতেন।তাই আর বাড়ি করা সম্ভব হয়নি। ভাড়া দিতে না পারায় দু মাস ধরে বাড়িওয়ালা তাগাদা দিচ্ছে উঠে যাবার জন্য। মুকুন্দবাবুর থেকে ভাড়া আদায় করা সম্ভব নয় অনুমাণ করে বাড়িওয়ালার গিন্নী সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ছুতোয় থাকেন কি করে তিন্নি বা তোতনকে কথা শোনানো যায়! তোতন খুব মুখরা মেয়ে। তাকে কিছু বললে মুখের ওপরই জবাব দিয়ে দেয়। তাতে অশান্তি বাড়ে। একদিন তো বাড়িওয়ালার গিন্নী একটি সামান্য ব্যাপার নিয়ে চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করেন। তিন্নি ঘরের দরজা বন্ধ করে চুপচাপ কাঁদছিল। মুকুন্দবাবু বাড়ি ছিলেননা। বাড়ি ফিরে তোতনের মুখে সব কথা শুনে ক্ষোভে যন্ত্রণায় ক্ষত বিক্ষত হয়েছিলেন। কিন্তু নিরুপায় হয়েই সব সহ্য করতে হয়।
           তিন্নিকে দেখতে মন্দ নয়। রঙ বাবার মতো শ্যামলা হলেও প্রতিমার মতো মুখ। তিন্নির চলাফেরায় সুন্দর লক্ষ্মীশ্রী আছে। কিন্তু আজকাল পণ বা যৌতুক ছাড়া বিয়ে দেওয়া সম্ভব নয় এ কথা মুকুন্দবাবু বুঝেছেন। দু একজন পাত্রপক্ষ তিন্নিকে দেখে পছন্দ করলেও দেনা পাওনার ব্যাপার নিয়ে পিছিয়ে গেছে। এখন সব থেকে বড় প্রয়োজন হল টাকা। অনেক চেষ্টা করেও কোথাও কোন কাজ জোগাড় করতে পারেননি মুকুন্দবাবু। মেয়ে দুটোর মুখের দিকে তাকালে নিজেকে সংকোচে গুটিয়ে নিতে ইচ্ছে করে তাঁর। কয়েক বছরে আর্থিক সংকট,দারিদ্র্য,অভাবে মুকুন্দবাবুর স্বাস্থ্য ভেঙে গেছে। একমাত্র টাকাই মানুষের ভাগ্য বদলাতে পারে। তাই টাকার নেশা পাগল করে তুলেছে তাঁকে। তিন্নি ও তোতনকে একটু সুখের মুখ দেখাতে পারলেই তিনি স্বস্তি পাবেন।
        মাস দুয়েক আগে মুকুন্দবাবু গেছিলেন পুরোনো বন্ধু হরপ্রসাদ সেনের বাড়ি। হরপ্রসাদের পৈতৃক ব্যবসা, বিরাট  বাড়ি, স্বচ্ছল অবস্থা। মুকুন্দবাবুরা হরিপালে আসার আগে শিয়ালদায় যে পাড়ায় থাকতেন, সেখানেই হরপ্রসাদ সেনের সঙ্গে পরিচয়। হরপ্রসাদের ছিল দাবার নেশা। মুকুন্দবাবুও ভালো দাবা খেলতেন। তখন সেন বাড়িতে তাঁর নিয়মিত যাতায়াত ছিল। তারপর আর বহুদিন হরপ্রসাদ সেনের সঙ্গে মুকুন্দবাবুর যোগাযোগ ছিলনা।
          বহুদিন পর মুকুন্দবাবুকে দেখে হরপ্রসাদ খুশিতে তাঁকে জড়িয়ে ধরেন। সেদিন সেন বাড়ির বৈঠক খানায় বসে নানান গল্পে দুজনের অনেক ক্ষণ সময় কেটে গেছিল। অনেকদিন পর সেনবাড়ির অকপট আন্তরিকতায় মুকুন্দবাবুর মন ভরে ওঠে। কিন্তু নিজের অবস্থার কথা ও সেন বাড়ি যাওয়ার আসল উদ্দেশ্যটা তাঁর আর বলা হয়ে ওঠেনি। এর পর আরো দুবার রাস্তায় হরপ্রসাদ সেনের সঙ্গে মুকুন্দবাবুর দেখা হলেও হরপ্রসাদ সেনের একমাত্র ছেলের সঙ্গে তিন্নির বিয়ের প্রস্তাবটা নিজে মুখ ফুটে বলতে পারেননি। হরপ্রসাদ সেনের ব্যবসায়ে এখন আরো উন্নতি হয়েছে। আগের দোতলা বাড়ি তিনতলা হয়েছে। দুটো গাড়িও আছে। এক কথায় হরপ্রসাদ সেন এখন যথেষ্ট ধনী। শেষে গত পরশু মেয়ের বিয়ের প্রস্তাবের ব্যাপারে মন স্থির করেই সেন বাড়ি গেছিলেন মুকুন্দবাবু। কিন্তু সেখানে গিয়ে হরপ্রসাদ সেনের কাছে শুনলেন তাঁর ছেলের বিয়ে চন্দননগরের অন্যতম ধনী পালেদের মেয়ের সঙ্গে স্থির হয়ে গেছে। মুকুন্দবাবুর সমস্ত স্বপ্নের রঙ মুহূর্তে বদলে যায়! ভদ্রতা বজায় রাখতে তিনি লোক দেখানো শুভেচ্ছা জানালেও গভীর হতাশার গ্লানি অনুভব করেন। সমস্ত কল্পনা আশা চুরমার হয়ে অন্তর্দ্বন্দ্বর রূপ নেই।
      বাড়ি ফিরে চিন্তার জালে আচ্ছন্ন হয়ে যান মুকুন্দবাবু। তিন্নি ও তোতন অনেক ডেকেও তাদের বাবাকে সেদিন খাওয়াতে পারেনা। বাবার ক্লান্ত, শীর্ণ শরীর দেখে বড় মায়া হয় তিন্নির। সে বুঝতে পারেনা কোন অব্যক্ত যন্ত্রণায় ভেতরে ভেতরে ছটফট করছেন মুকুন্দবাবু।
            অনেক ভেবে মুকুন্দবাবু স্থির করেন হরপ্রসাদ সেনের ছেলের সঙ্গে তিন্নির বিয়ের সম্ভবনা না থাকলেও একসঙ্গে অনেক অর্থ লাভের সুযোগ তাঁর আছে। হরপ্রসাদ সেন পাত্রপক্ষ হিসাবে পাঁচ লাখ টাকা দাবি করেছেন। পালেরা অবশ্য শুধু নগদই নয়, সোনার গয়না সহ অনেক কিছুই দেবেন বলেছেন।
         আজ শুক্রবার। আর তিন দিন বাদেই হরপ্রসাদ সেনের ছেলের বিয়ে। সকাল সকাল টিউশনি থেকে ফিরে স্নান খাওয়া সেরে নেন মুকুন্দবাবু। ভেতরে ভেতরে একটা চাপা উত্তেজনা ক্রিয়া করছে। জীবনে যা কোনদিন করেননি, সেই কাজের জন্য নিজের মানসিকতাকে প্রস্তুত করেছেন প্রায় জোর করেই। সেই সঙ্গে কিছু আনুষঙ্গিক প্রস্তুতি নিয়েছেন। কয়েকদিন আগে তিনি সেন বাড়ির বসার ঘরের টেবিল থেকে সুকৌশলে হরপ্রসাদ সেনের নাম ছাপানো প্যাডের কাগজ সংগ্রহ করেছেন। এছাড়া হরপ্রসাদ সেনের পুরোনো চিঠি থেকে তাঁর হস্তাক্ষর নকল করেছেন। শেষে ওই প্যাডের কাগজে ধৈর্য্য সহকারে নকল করা হস্তাক্ষরে হরপ্রসাদ সেনের হবু বেয়াই শ্রীধর পালকে সম্বোধন করে মুকুন্দবাবু যে চিঠিটি লিখেছেন, তার বক্তব্য বিষয় হল-- হরপ্রসাদ সেন তাঁর পরিচিত বিশ্বস্ত বন্ধু কৃষ্ণপদ দাসকে চন্দননগরের শ্রীধর পালের কাছে পাঠাচ্ছেন। বরযাত্রীর যাতায়াতের খরচ বাবদ তিনি যেন পঞ্চাশ হাজার টাকা কৃষ্ণপদ দাসের হাতে দিয়ে দেন। জাল চিঠিটা খুলে আর একবার দেখে নেন মুকুন্দবাবু। না কিছুই ধরা পড়ছেনা। চিঠিটি খামে ঢুকিয়ে মুখ বন্ধ করে পাঞ্জাবীর পকেটে রাখেন তিনি। তিন্নি বাবাকে অবাক হয়ে দেখে-- কেমন যেন অন্যমনস্ক। আজ বার বার চশমা, রুমাল এটা ওটা খুঁজে পাচ্ছেনা, তিন্নিকে এগিয়ে দিতে হচ্ছে।
"এত ভালো জামাকাপড় পরে আজ কোথায় যাচ্ছ বাবা?"
তোতনই প্রশ্নটা করে। উত্তর দিতে গিয়ে মুকুন্দবাবু যেন হোঁচট খান। মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে স্বাভাবিক ভাবে বলেন, "যাচ্ছি একজন বিশেষ বন্ধুর বাড়ি। দেখি চাকরী-বাকরি কিছু হয় কিনা!
দুপুরের ঝাঁ ঝাঁ রোদে বেরিয়ে পড়লেন মুকুন্দবাবু। তিন্নি শাড়ির আঁচলের শেষ প্রান্ত আঙ্গুলে জড়িয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে-- প্রত্যেক বারের মতো এবারেও হয়তো তাঁর বাবা নিরাশ হয়েই ফিরবেন। তাদের সংসারে কি কোনদিনও আশার আলো জ্বলবে না!
           হরিপাল থেকে শেওড়াফুলি এসে আপের ট্রেনের জন্য মুকুন্দবাবুকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। সাড়ে বারোটা বেজে গেছে। শেষ পর্যন্ত লোক ভর্তি ট্রেন ঢোকে স্টেশনে। প্রচন্ড ভিড়ে ঠেলাঠেলির মধ্যে উঠে পড়েন মুকুন্দবাবু। চন্দননগর পৌঁছতে প্রায় কুড়ি মিনিট লাগে। অনেকদিন আগে একবার অফিসের কাজে চুঁচুড়া এসেছিলেন। চন্দননগরে এই প্রথম এলেন।
          মুকুন্দবাবুর রিক্সা চওড়া রাস্তা ধরে চলতে থাকে। চন্দননগর বেশ সমৃদ্ধ জায়গা। রাস্তার দুধারে বেশ বড় বড় দোকানপাট। বৈশাখের দুপুরে প্রায় সমস্ত দোকানেরই ঝাঁপ বন্ধ। রিক্সায় বসে মুকুন্দবাবু হাঁপাতে থাকেন। ট্রেনে ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আসতে হয়েছে। গরমে পাঞ্জাবী ঘামে ভিজে গায়ের সঙ্গে লেগে আছে। বাড়ি খুঁজে পেতে বিশেষ কষ্ট হলনা মুকুন্দবাবুর।
           হরপ্রসাদ সেনের হবু বেয়াই শ্রীধর পাল মুকুন্দবাবুর পরিচয় পেয়ে বিশেষ আপ্যায়ন করে বসালেন। দোতলা বড় বাড়ি, সামনে বড় উঠোন। মুকুন্দবাবু কি বলবেন স্থির করেই গেছিলেন। শ্রীধর পালের সামনে আগাগোড়া ভালো অভিনয় করলেন তিনি। বেশ কৌশলে গল্পচ্ছলে মুকুন্দবাবু পাত্রপক্ষ অর্থাৎ হরপ্রসাদ সেনের বাড়ির সব খবর এমন ভাবে শোনালেন যেন তিনি তাঁদের কত বিশ্বস্ত ও চেনা। শেষে চিঠিটা বের করে টাকার কথা জানালেন। চিঠিটা পড়ে শ্রীধর পালের মুখ সামান্য গম্ভীর হল। মুকুন্দবাবুর হৃদস্পন্দন যেন দ্রুত বৃদ্ধি পেল। বাইরে দিয়ে তাঁকে বোঝা না গেলেও ধরা পড়ার ভয় থেকেই গেছিল। শ্রীধর পাল উঠে একবার বাড়ির ভেতরে গেলেন, হয়তো স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করার জন্য হবে! বাড়ির এক মহিলা এক প্লেট মিষ্টি ও গোটাকয়েক লুচি রেখে গেল টেবিলে। মুকুন্দবাবু তখনও নিশ্চিন্ত হতে পারেননি টাকাটা পাবেন কিনা! ভয় মিশ্রিত উত্তেজনায় কাঁপছিলেন তিনি। শ্রীধর পাল অন্দরমহল থেকে ফিরে এসে বলেন, " সামান্য কিছু খেয়ে নিন।  অনেকটা পথ তো ফিরতে হবে। রাস্তাঘাট ভালো নয়-- এত গুলো টাকা আপনি একা নিয়ে যাবেন। আমার বড় ছেলে না হয় আপনার সঙ্গে যাবে।"
সবে মাত্র লুচির অর্ধভাগ মুখে পুরেছেন মুকুন্দবাবু, শ্রীধর পালের কথা শুনে হঠাৎ মনে হল সমস্তটাই যেন আটকে যাচ্ছে গলায়। বিষম খেলেন তিনি। কাঁপা কাঁপা হাতে জলের গ্লাস তুলতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছিল। এমন সময় শেষ অস্ত্র কাজ করল। কিছু দূরে টেবিলের ওপর ফোন বেজে উঠল। মুকুন্দবাবু ঠিক এই মুহূর্তটার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। ঘড়িতে ঠিক দুটো। শ্রীধর পাল উঠে গেলেন ফোন ধরতে। কিছু ক্ষণ পর মুকুন্দবাবুকে এসে বললেন, "হরপ্রসাদ বাবু ফোন করেছিলেন আপনি ঠিক মতো আসতে পেরেছেন কিনা জানতে।"
এর পর শ্রীধর পাল আর দেরী করলেন না। বিনা দ্বিধায় পঞ্চাশ হাজার টাকা তুলে দিলেন মুকুন্দবাবুর হাতে। চামড়ার পোর্ট ফোলিও ব্যাগে টাকাটা পুরে ভদ্রতার কৃত্রিম হাসি হেসে পাল বাড়ি থেকে বিদায় নিলেন তিনি।
          রাস্তায় বেরিয়ে এসেও যেন মুকুন্দবাবুর বিশ্বাস হচ্ছিলনা যে তাঁর ব্যাগে পঞ্চাশ হাজার টাকা। কত সহজে মিথ্যে কথায় ও নকল চিঠির দ্বারা শ্রীধর পালকে ঠকাতে পেরেছেন তিনি। হয়তো পুরো প্ল্যানটাই ধরা পড়ে যেত যদি ঠিক সময়ে ওই ফোনটা না আসতো। পাড়ার হারানকে পাঁচ হাজার টাকার লোভ দেখিয়ে নির্ধারিত সময়ে এই কাজটি করতে রাজী করিয়েছিলেন মুকুন্দবাবু,যাতে তাঁর ওপর শ্রীধর পালের আর কোন সন্দেহই না থাকে। হরপ্রসাদ সেন হয়তো কোনদিনও ভাবতে পারবেন না মুকুন্দবাবু এই কাজ করতে পারেন। মুকুন্দবাবু নিজেই কি কোনদিনও ভাবতে পেরেছিলেন তিনি এরকম নিপুণ ঠগ হতে পারবেন। অভাবের তাড়নায় মানুষ নীচে নামতে বাধ্য হয়। এই পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে মেয়েদের কিছুটা শখ আবদার মিটিয়ে কিছু দিনের জন্য আনন্দের মুখ দেখবেন। এই জগৎ সংসারে এমন কে আছে, যে স্বার্থপর নয়! নিজেকে ঘিরেই মানুষের স্বপ্ন, আর স্বপ্ন নিয়েই তো জীবন!
       বেলা সাড়ে চারটে। আকাশ তখনো গনগনে আগুনের গোলা। বারান্দায় পা দিয়ে মুকুন্দবাবু ডাকলেন "তোতন ও তোতন, তিন্নি, সব গেলি কোথায়?"
তোতন ঘর থেকে বেরিয়ে এসে কাঁদতে কাঁদতে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাবার কোলে।
"কি হল, কি হল? কাঁদছিস কেন? দিদির সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে বুঝি? আমি দিদিকে বকে দেব। কাঁদিস না।"
তোতন তখনও কাঁদছে। চোখের অঝোর ধারা বাধ মানছে না। তবু কান্না ভেজা গলায় তোতন কোনরকমে বলে, "বাবা তুমি এত দেরী করে এলে। দিদি যে..."
তোতনের গলা দিয়ে স্বর বেরোচ্ছে না।
"তিন্নির কি হয়েছে?"
টাকার ব্যাগ মাটিতে ছুঁড়ে দিয়ে মুকুন্দবাবু তোতনকে জিজ্ঞাসা করেন।
"দিদি গলায় দড়ি দিয়েছে।"
তোতন আবার কেঁদে কঁকিয়ে ওঠে। মুকুন্দবাবুর বোবা কান্নায় গলা বুজে যায়। চলচ্ছক্তিহীন শরীর, বুদ্ধি কাজ করেনা। তোতন  কান্না ভেজা স্বরে বলে, "বাড়িওয়ালার বউ দিদিকে আজ বাড়ি ভাড়ার টাকা বাকি আছে বলে যা নয় তাই বলে। আমি স্কুল থেকে ফিরে দরজা বন্ধ ঘর থেকে দিদির কোন সাড়া না পেয়ে পাড়ার বিলুদা, পটলাদাদের ডেকে আনি। ওরা শেষে দরজা ভাঙে। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। এখন ওরা গেছে ডাক্তার ডাকতে আর অন্য সব ব্যবস্থা করতে। "
কথা বলতে বলতে তোতন হাঁপাচ্ছিল।
         নিয়ম মাফিক পোস্টমর্টেমের পর শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার সময় ফুল চন্দন দিয়ে সাজানো তিন্নির সুন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে মুকুন্দবাবু ভাবেন, তিন্নির মুখখানি বড় লাবণ্যময়, পবিত্র, দেবীর মতো। হয়তো এভাবেই তিন্নি তার বাবার পাপের  প্রায়শ্চিত্ত করে গেল!.


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র