মৌসুমী বন্দ্যোপাধ্যায় - মায়াজম

Breaking

২৫ সেপ, ২০২২

মৌসুমী বন্দ্যোপাধ্যায়

     বন্ধ দরজা

                      


    


ঠিক কতবছর পর তালা খুলে বন্ধ দরজায় চাপ দেয় রিনি তা আজ মনে করতে ইচ্ছে করছে না। অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। সেদিনের পর আবার এই ঘরে তাকে পা রাখতে হবে ভাবেনি। কান্না পাচ্ছে। সেদিনও খুব কেঁদেছিল রিনি। একই মানুষের জন্য। সেদিনটা ছিল আবেগের, আজ ঘৃণার। 

সপ্তাহখানেক আগের কথা। রাত প্রায় পৌনে বারোটা, একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন আসে। কল রিসিভ করে তত অবাক হয়নি, যতটা অবাক হয়েছিল ফোনের বিপরীতে থাকা মহিলাকণ্ঠ শুনে। বলতে গেলে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। 

“হ্যালো।” ফোনের বিপরীত দিক থেকে ভেসে আসে।

মহিলা কণ্ঠস্বর রিনিকে এক ধাক্কায় অনেকগুলো দিন পিছনে টেনে নিয়ে যায়। রিনির উত্তর না পেয়ে ফোনের বিপরীতে থাকা মহিলা বলে ওঠেন, “হ্যালো। শুনতে পাচ্ছিস?”

উত্তেজিত রিনি বলে, “কে বলছেন? কে আপনি!”

ম্লান হাসি ভেসে আসে। 

“বলব বলেই ডাকছি। কাল আয় ‘লেকভিউ’তে। এই চারটে নাগাদ। অপেক্ষায় থাকব। আর একটা কথা। এই ফোনকল তোর আর আমার মধ্যেই থাকবে। বুঝেছিস?” 

ফোন কেটে যাওয়ার দশ মিনিটের মধ্যে নিজে বারকয়েক ওই নম্বরে রিং করে রিনি। ‘নট রিচেবল’ বলে। উত্তেজনায় সারারাত ছটফট করে রিনি। এমনভাবে কথা একজনই বলত। কিন্তু সে আসবে কীভাবে? যার সঙ্গে রিনি এই কথা শেয়ার করতে পারত, নির্মাল্য, তার স্বামী, আজ রিনি নিজেই তার কাছ থেকে দূরে চলে এসেছে। দুজনেরই তীব্র ইগো। সামান্য মান-অভিমান থেকে মন কষাকষি, ঝগড়া, তিক্ততা। তারপর আলাদা থাকার সিদ্ধান্ত।  

পরেরদিন নির্দিষ্ট সময়ের বেশ কিছুটা আগে পৌঁছে যায় রিনি। ‘লেকভিউ’ ছোটখাট একটা ক্যাফে। কলেজ টাইমে দুপুরের দিকে ভিড় কম থাকে। একটা ফাঁকা টেবিল দেখে বসে রিনি।

গতকাল রাতে মহিলার ফোন পাওয়ার পর থেকে আনন্দকাকু আর রমিতা কাকিমাকে বেশি করে মনে পড়ছে রিনির। এমনভাবে আনন্দকাকুর জীবন উল্টেপাল্টে যাবে কেউ ভাবতে পারেনি। আশেপাশের লোকজন, বন্ধুবান্ধব, চেনাপরিচিত সবার কষ্ট হয়েছিল রমিতা কাকিমার জন্য। রিনি অবুঝের মতো কেঁদেছিল, কষ্ট পেয়েছিল। রমিতা কাকিমার জন্য নয়, আনন্দকাকুর জন্য। 

আনন্দকাকু আর রমিতা কাকিমা ভাড়া এলেন দীপ্তেশ কাকুদের বাড়িতে তখন রিনি কীসে পড়ে? ক্লাস নাইন। রিনি, টিয়া, সুমি আরও কয়েকজন তখন জমিয়ে ‘বুড়িবসন্ত’ খেলছে। দীপ্তেশ কাকুদের বাইরের রকে খেলার ‘বুড়ি’ মানে সুমি বসে। উল্টোদিক থেকে প্রায় হুড়মুড় করে একটা রিক্সা এসে দাঁড়িয়ে পড়ল সুমির গা ঘেঁষে। সুমি তড়াক করে লাফিয়ে উঠে পড়ল রকের ওপর। টিয়া চিরকালের সাহসী। কোমরে হাত দিয়ে সোজা রিক্সাচালকের মুখোমুখি।

“দেখেশুনে রিক্সা থামাতে পারো না? আর একটু হলেই তো সুমির লেগে যেত।”

রিক্সাচালক কাঁচুমাচু মুখ করে কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই খুব সুন্দরী একজন মহিলা রিক্সা থেকে নেমে জোরে ধমক দিলেন টিয়াকে, “একে রাস্তার ওপর খেলছ, তার ওপর চোখ পাকাচ্ছ? সাহস কম নয় তো তোমার?”

টিয়া সাহসী। কিন্তু কোন সুন্দরী মহিলা দেখলে কথা হারিয়ে যায়। হাঁ করে শুধু দেখতেই থাকে, দেখতেই থাকে।  

“কী হল? কথা বলছ না যে?” 

সুন্দরী মহিলার ধমকে জেরবার রিনিরা। দুদ্দাড়িয়ে ছুটতে শুরু করে সুমি। সুমিকে অনুসরণ করে বাকিরা। শুধু টিয়া তখনও হাঁ করে মহিলাকে দেখেই যাচ্ছে। রিনি খানিকটা দৌড়ে এগিয়ে গিয়ে পিছন ফিরে টিয়ার হাতে হ্যাঁচকা টান দেয়। মোহগ্রস্তর মতো টিয়া উল্টোমুখো হয়ে রিনির টানে হাঁটা লাগায়।

খুব অল্পদিনের মধ্যেই পাড়ায় আসা নতুন দুজন মানুষের নাম জানা হয়ে গেল। আনন্দ বসু, রমিতা বসু। আনন্দকাকু আর রমিতা কাকিমা পাড়ার আলোচ্য হয়ে উঠলেন। বিশেষ করে রমিতা কাকিমা। শহরতলি বেতাইপুর তখন এমন ঝকঝকে স্মার্ট মহিলা দেখেনি। সেসময় রিনির মা, পাড়াতুতো কাকিমারা খাওয়া সেরে পান মুখে দিয়ে খিড়কির দরজায় দাঁড়িয়ে একে অপরের সুখদুঃখের খবর নিতেন। টাউনের সিনেমাহলে নতুন যে সিনেমা চলছে সেটা কেমন হয়েছে? অথবা কোন কাকিমা নতুন কাপড়ে সেলাইয়ের কোন কাজ শুরু করলেন। এইসব কথার মধ্যে টুকটাক ‘ফিসফিস’ কথা চলত। সেইসময় রিনি বা ওদের বয়সী কেউ এসে গেলে চোখ টেপাটিপি করে মুহূর্তে তাঁরা অন্য প্রসঙ্গে চলে যেতেন। অথচ তখন রমিতা কাকিমা সুন্দর করে সেজেগুজে কলকাতার ট্রেন ধরার জন্য রওনা দিতেন। প্রথমদিকে কারণ কেউ জানত না। অথচ কৌতুহল ছিল প্রবল।

মা-কাকিমারা রমিতা কাকিমাকে নিয়ে আলোচনা করত বলেই রিনির ধারণা। তবে রিনিরা মানে রিনি আর তার বাকি বন্ধুরা রমিতা কাকিমাকে নিয়ে আলোচনায় মশগুল হয়ে থাকত। কিন্তু কিছুতেই জানতে পারছিল না রমিতা কাকিমা কী করেন? আনন্দকাকুও কী করেন কেউ জানে না। কিন্তু সেই নিয়ে তাদের কোন তাপ উত্তাপ নেই। সম্ভবত মা-কাকিমাদেরও আগ্রহ ছিল না।  

একদিন টিয়া খবর নিয়ে এল। জোড়া খবর। কৌতুহল মিটল। আনন্দকাকু একটা নামী দৈনিকের সাংবাদিক। এখানকার টাউনের ব্রাঞ্চে বদলি হয়ে এসেছেন। আর রমিতা কাকিমার কলকাতায় একটা স্কুল আছে। সেখানে তিনি আবৃত্তি শেখান। তাছাড়া কলকাতারই একটা গ্রুপ থিয়েটার দলের সঙ্গে যুক্ত। শুনে রিনি এক্সাইটেড। টাউনে আবৃত্তি কম্পিটিশনে রিনি নাম দেয়। সান্ত্বনা পুরস্কার পায়। আজ অবধি প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় হবার সৌভাগ্য হয়নি। রিনি নিশ্চিত, রমিতা কাকিমা যদি একটু দেখিয়ে দেন তাহলে ফার্স্ট প্রাইজ না হোক, সেকেন্ড বা থার্ড একটা জুটে যাবে। আরও খবর এনেছিল টিয়া। আনন্দকাকু নাকি সপ্তাহে দুদিন কলকাতায় টিউশন করেন। উঁচু ক্লাসের বাংলা পড়ান। এমন গুণী মানুষজন রিনিদের পাড়ায় থাকছেন। রিনিদের গর্বের শেষ নেই। 

পাড়ার ক্লাবে রবীন্দ্রজয়ন্তী হবে। কথা হয়েছে আনন্দকাকুকে প্রধান অতিথি হিসেবে আনা হবে। বিশ্বাসকাকু, সুদীপদা আর মধুমিতাদি আমন্ত্রণ জানাতে গেছে। ফিরে আসার পর সে কী ভীষণ উচ্ছ্বাস ওদের!

“ভাবা যায় না, এত গুণী মানুষ অথচ কত সাদাসিধে।” সুদীপদার বিস্ময় তখনও কাটেনি।

“একদম তাই। এত সহজে রাজি হয়ে যাবেন ভাবতে পারিনি। কেমন আপন করে নিলেন  আমাদের। খুব ভাল লাগছে।” বিশ্বাসকাকুর গলায় নিশ্চিন্তের সুর।

“ম্যাডামকে অনুরোধ করলে কেমন হয় ?” মধুমিতাদি বলে।

“কী ব্যাপারে বলছিস?” সুদীপদা জানতে চায়।

“আমাদের ক্লাবে আবৃত্তির প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য। অনুরোধ করে দেখতেই পারি। কী বল?” মধুমিতাদি বলে।

“এটা তো খুব ভাল প্রোপোজাল। ফাংশন মিটে গেলে কথা বলব।” বিশ্বাসকাকু বলেন।

রবীন্দ্রজয়ন্তীতে রিনিদের ব্যাচের পারফরমেন্স দেখে আনন্দকাকু খুব খুশি। সুমির নাচের প্রশংসা করলেন। রিনির আবৃত্তি শুনে বললেন, “প্র্যাকটিস করে যাও মন দিয়ে। তোমার হবে।” রিনি খুশিতে আত্মহারা।

ফাংশনের পরেরদিন মল্লিকদের পুকুরঘাটে বসে রিনি, সুমি, কাবেরী, টিয়া গল্প করছিল। 

“সত্যি রিনি, গতকাল তোর আবৃত্তি খুব ভাল হয়েছে। এবারেরটা সেরা।” কাবেরী বলে।

“তাহলে তোদের একটা কথা বলি।” রিনি বলে। 

“কী কথা রে?” সুমি জানতে চায়।

“আমি ঠিক করেছি রমিতা কাকিমার কাছে আবৃত্তি শিখব। ক্লাবে যদি কাকিমা শেখাতে রাজিও হয়ে যান তাহলেও আমি আলাদা করে ওঁদের বাড়িতে গিয়ে শিখব।” রিনি বলে।

“কথাটা কিন্তু মন্দ ভাবিসনি।” সুমি বলে। 

“তোদের চুপিচুপি একটা কথা বলি।” টিয়া বলে।

“কী এমন কথা যে চুপিচুপি বলবি?” রিনি জিজ্ঞাসা করে।

“বাংলা রচনার বিষয়বস্তু কেমন আনকমন হয়ে যাচ্ছে না? বইয়ে পাই না। তাছাড়া কত আর বই কিনব? এদিকে স্কুলে যত পারছে আনকমন বিষয়ের ওপর রচনা তৈরি করতে বলছে। ভাবছি আনন্দকাকুকে বলব বাংলা রচনা যদি আমাদের একটু দেখিয়ে দেন।” টিয়া বলে।

“একদম ঠিক কথা। কাল রাতে বাবাকে বলেছি একটা রচনা বই কিনে আনতে। কিন্তু তাতেও পাব বলে মনে হয় না।  তবে তুই ভেবেছিস খুব ভাল। কিন্তু কাকু এত ব্যস্ত মানুষ, সময় পাবেন তো?’ রিনি বলে।

“একবার বলেই দেখি না। কী বলিস তোরা?” টিয়া বন্ধুদের দিকে তাকায়।

“হ্যাঁ হ্যাঁ বল।” সবাই টিয়াকে সমর্থন করে।

পরেরদিন স্কুলে টিফিনের সময় টিয়া ওদের ডাকে। ওরা মানে রিনি, সুমি, কাবেরী। দেখে মনে হয় টিয়া বেশ উত্তেজিত।

“কী ব্যাপার রে?” কাবেরী জানতে চায়।

“আর বলিস না। সাংঘাতিক ব্যাপার। স্কুলে এসে থেকে মনে হচ্ছে কখন তোদের বলব।” উত্তেজনায় টিয়ার চোখ বড়বড় হয়ে গেছে।

“আরে বাবা, কী হয়েছে বলবি তো?” সুমি বলে।

“কাল বিকেলে ফেরার পথে আনন্দকাকুদের বাড়ি গিয়েছিলাম।” 

টিয়ার কথা শেষ হওয়ার আগে রিনি বলে, “কাল বিকেলেই চলে গেছিস!”

“হ্যাঁ রে। আনন্দকাকু থাকবেন না জানতাম। রমিতা কাকিমাকে আমাদের সমস্যার কথা বলতে উনি হেসে বললেন, এই ব্যাপার! কাল সকালে এসে নিয়ে যাবি। আনন্দকে আজ রাতেই লিখে দিতে বলব।” টিয়া বলে।

“তারপর?” রিনি জানতে চায়।

“আজ স্কুল আসার পথে গিয়েছিলাম রচনাটা আনতে। কাকিমা রচনাটা হাতে দিয়ে বলল, কাল এসে টাকাটা দিয়ে যাস।” টিয়া বলে।

“টাকা! কীসের টাকা?” রিনির গলায় বিস্ময়।

“সেই তো! আমিও অবাক। জিজ্ঞাসা করলাম, কাকিমা কীসের টাকা? আমার হতবাক অবস্থা দেখে কাকিমা হেসে বললেন, এই বাজারে টাকা ছাড়া মিনিমাগনায় কিছু পাওয়া যায় নাকি? এই যে রচনাটা পেলি, তার দাম দিবি না? পাগলি মেয়ে! কেমন অবাক চোখে দেখছে দেখো! বলে আমার গাল টিপে দিলেন।” টিয়া বলে।

“বলিস কী রে! রচনা লিখে টাকা! আনন্দকাকুর ওপর সমস্ত ইমপ্রেশন নষ্ট হয়ে গেল।” রিনি হতাশ।

“দাঁড়া দাঁড়া। এখনও কথা শেষ হয়নি। ফিরে আসছি যখন কাকিমা বলল, টাকা এনে আমার হাতে দিবি। তোদের কাকু যেন ঘুণাক্ষরেও না জানতে পারে। আর শোন, এর পরে যদি রচনা লিখে দিতে হয়, আমাকে বলবি। কাকুকে নয়। কথাগুলো মনে থাকে যেন।” টিয়া কথা শেষ করে হাঁপাচ্ছে।

“রমিতা কাকিমা এই রকম! আনন্দকাকুকে সব কথা বলে দেব।” রিনি বলে। 

“কী দরকার এসব ঝামেলায় গিয়ে। তার থেকে আমরা যেমন পারি তেমন লিখব।” কাবেরী বলে।

কথাটা সেখানে শেষ হয়েও হল না। ঠিকঠাক বই না থাকার জন্য পরবর্তীকালে রিনিদের রমিতা কাকিমার সাহায্য নিতেই হল। তবে ওদের সবার সঙ্গে আনন্দকাকুর দারুণ এক ‘ফ্রেন্ডশিপ’ গড়ে উঠল। 

রিনি গ্র্যাজুয়েশনে বাংলায় অনার্স নিল। ততদিনে আনন্দকাকু কলকাতার কোচিং ক্লাস বন্ধ করে দিয়েছেন। বেতাইপুরে কোচিং সেন্টার খুলেছেন। সেখানে কলকাতা থেকে আরও দুজন শিক্ষক এসে ইংরাজি আর ইকনমিক্স পড়ান। রিনি ভর্তি হল আনন্দকাকুর কোচিং-এ। 

সেকেন্ড সেমিস্টার শুরুর দুদিনে আগে রিনির মঙ্গলকাব্যের একটা প্রশ্নে অসুবিধে হওয়ায় ছুটেছিল আনন্দকাকুর বাড়ি। বাইরের দরজা খোলা ছিল। রিনি নক না করে সোজা ড্রইংরুমে ঢুকে পড়েছিল। ‘আনন্দকাকু’ বলে ডেকে ওঠার মুহূর্তে চাপা স্বরের কথাবার্তায় থমকে যায়।

“ছাড়। আনন্দ এসে যাবে।”

“আসুক। তোমাকে ছাড়া থাকতে পারছি না রমি।”

খিলখিলিয়ে হেসে ওঠেন রমিতা।

“বাব্বা! এতো!”

“উঁউঁউঁ…  

রমিতা কাকিমা আর অপরিচিত পুরুষকণ্ঠের কথার মাদকতায় সদ্য যৌবনে পা দেওয়া রিনির সারা শরীর শিরশির করে ওঠে। কল্পনায় কিছু ভেসে আসে। চাইলেও নড়তে পারে না সেখান থেকে। মনে হয় তার পা দুটো কেউ পেরেক দিয়ে পুঁতে দিয়েছে। কতক্ষণ কেটেছে খেয়াল করতে পারে না রিনি। চমক ভাঙে রমিতা কাকিমার কথায়।

“কী রে রিনি, কখন এসেছিস? কিছু বলবি?”

রমিতা কাকিমার অতি-স্বাভাবিক আচরণে রিনি হকচকিয়ে যায়। 

“না, মানে…পরে আসব কাকিমা।” 

কোনরকমে পালিয়ে বাঁচে রিনি। তখনও তার বুকের মধ্যে হাতুড়ির ঘা পড়ছে। কিছুটা আগে শোনা কথাগুলো বারবার মনে এসে কান ঝাঁ-ঝাঁ করছে। 

‘ছিঃ ছিঃ! রমিতা কাকিমা এত নোংরা! এভাবে আনন্দকাকুকে ঠকাচ্ছে! আর আনন্দকাকুই বা কী? চোখ বন্ধ করে কাকিমাকে বিশ্বাস করছে!’

আনন্দকাকুর কথা ভেবে রিনির মন ভিজে যায়। এমনিতেই আজকাল টিয়া, সুমিরা বলে, ও নাকি দিনেদিনে আনন্দকাকুর প্রতি অনুরক্ত হয়ে উঠছে। আসলে ওরা বোঝে না, আনন্দকাকু নয়, তাঁর গুণে রিনি মুগ্ধ। আর আজকের পর থেকে… না থাক্‌। রিনি তার অনুভূতি কাউকে জানতে দেবে না।

সেদিনের ঘটনার পর থেকে রিনি আনন্দকাকুর বাড়িতে যায়নি। আশঙ্কা হতো, হয়তো আবার কিছু দেখে বা শুনে ফেলবে। অথচ তাকে আবার ওই বাড়িতে যেতে হল। এবার আনন্দকাকুর কথায়।

“রিনি, চট করে একবার বাড়িতে চলে যা তো। ড্রইং-এ সেন্টার টেবিলে নোটসের খাতাটা ভুলে ফেলে এসেছি। গিয়ে নিয়ে আয়। যদি না পাস, কাকিমাকে বলবি, দিয়ে দেবে।”

থতমত খেয়ে রিনি বলে, “আমি!”

“হ্যাঁ, তুই। হাঁ করে কী ভাবছিস? তুই যাবি, না আমি যাব?”

রিনি ধড়মড় করে উঠে বলে, “কী বলছ তুমি কাকু! আমি এক্ষুণি যাচ্ছি।”

সারা রাস্তা রিনি নিজের মনে বলতে বলতে যায়, ‘আজ যেন কোন উল্টোপাল্টা কিছু না দেখি বা শুনি।’

আজও বাইরের দরজা খোলা দেখে রিনির বুকের ভিতর ‘ধক’ করে ওঠে। কোন শব্দ করে না। অদম্য কৌতুহলে পা টিপে টিপে সোজা বেডরুমের পর্দা সরিয়ে উঁকি দেয়। দেখে রমিতা কাকিমা কারও সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলছে। কথা যত না বলছে হেসে গড়িয়ে পড়ছে তার থেকে বেশি। হাসির দমকে কাঁধ থেকে নাইটি নেমে গিয়ে গলা, বুকের অর্ধেক উন্মুক্ত করে দিয়েছে তা খেয়ালও নেই রমিতা কাকিমার। পরে অবশ্য রিনির মনে হয়েছে ইচ্ছা করে রমিতা কাকিমা অর্ধোন্মুক্ত অবস্থায় কথা বলছে ভিডিও কলে।

রিনি কোন সাড়াশব্দ না করে সেন্টার টেবিলের ওপরে রাখা খাতা নিয়ে বেরিয়ে আসে। রমিতা কাকিমার ওপর যত ঘৃণা হয়, তার থেকেও আনন্দকাকুর জন্য মন বিচলিত হয়। ‘কী দুর্ভাগ্য আনন্দকাকুর! নিজের স্ত্রীকে কত বিশ্বাস করে। অথচ সেই স্ত্রী চরম বিশ্বাসঘাতক।’

রিনির ফাইনাল সেমিস্টারের আগে আনন্দকাকু এলেন ওদের বাড়িতে।

“রিনি, আর কিছু জানার আছে?”

রিনির উচ্ছ্বাস দেখে কে?

“কাকু তুমি! এসো এসো।”

“বসব না রে। অনেক কাজ বাকি আছে। কাল তোর কাকিমাকে নিয়ে বেড়াতে যাচ্ছি। ফিরব সপ্তাহখানেক বাদে। তাই জানতে এলাম তোর আর কিছু জানার আছে কিনা।”

রিনি মাথা নেড়ে না বলেছিল। দুরন্ত অভিমানে গলায় তালগোল পাকিয়ে কথা হারিয়ে গিয়েছিল। অকারণ অভিমানে চোখ ভিজিয়ে দিয়েছিল। সেদিন রাতে বারবার মনে হচ্ছিল, আনন্দকাকুকে ফোন করে রমিতা কাকিমার স্বরূপ জানিয়ে দেয়। না, পারেনি।

এক সপ্তাহ নয়, চারদিনের মাথায় আনন্দকাকু ফিরে এল। একা। খবর আগেই এসে গিয়েছিল। গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে রমিতা কাকিমা মারা গেছে। একা মানুষ আনন্দকাকু। বডি আনেননি। ওখানে দাহকার্য শেষ করে ফিরেছেন।

আনন্দকাকুর বিধ্বস্ত চেহারা দেখে রিনির প্রথমে রাগ হলেও পরে খুব কষ্ট হয়। রমিতা কাকিমার কদর্য চেহারা আনন্দকাকুর অজানা। তাই এত কষ্ট পাচ্ছেন। পরে টের পায় বুকের ভিতর অহরহ মোচড় দিয়ে উঠছে। বারবার মনে হচ্ছে ছুটে আনন্দকাকুর কাছে চলে যায়। কাকুর হাতটা নিজের হাতের মধ্যে এনে চুপ করে বসে থাকে।

রিনি গেল। আরও একসপ্তাহ পরে। ততদিনে ওঁদের পারিবারিক বন্ধু, শুভানুধ্যায়ীদের ভিড় কমতে শুরু করেছে। 

“কাকু আসব?”

রিনির ডাকে চমকে ওঠেন আনন্দ বসু।

“তুই?”

“অসুবিধে করলাম?”

রিনির কথায় সামান্য হেসে বলেন, “ কী বলিস? আয় ভেতরে আয়।”

রিনি দৌড়ে এসে আনন্দকাকুকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ওঠে।

“তোমার দিকে তাকানও যাচ্ছে না কাকু। যদি তুমি সবটা জানতে তাহলে এত কষ্ট পেতে না। আর আমারও তোমার জন্য এত কষ্ট হতো না।”

রিনির চোখের জলে ভিজে যায় আনন্দর পাঞ্জাবি। মাথায় হাত বুলিয়ে আনন্দ বলেন, “তুই কী বলবি আমি জানি।”

রিনি ভেজা চোখে বিস্ময়, “তুমি জানো?”

“তুই কী ভাবিস? জানি না? সব জানি।”

রিনির সাহস হয় না জিজ্ঞাসা করতে। ঠিক কী জানেন আনন্দকাকু? 

তারপরে ওই বাড়িতে আনন্দ বসু প্রায় দিন কুড়ি ছিলেন। রিনি নিয়ম করে বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে আসত। নিজে হাতে খাবার পরিবেশন করে আনন্দকাকুকে খাওয়াত। চুলে বিলি কেটে ঘুম পাড়িয়ে দিত। টের পেত তার মনে তৃপ্তি আর কষ্ট হাত ধরাধরি করে চলছে।

“স্যরি, লেট হয়ে গেল। কেমন আছ?”

‘সেই কণ্ঠস্বরে’ রিনি চমকে পিছনে ফেরে। দেখে একজন বয়স্ক মহিলা পিছনে দাঁড়িয়ে।

“আপনি?”

“চিনতে পারছিস না তো? সেটাই স্বাভাবিক। যার অস্তিত্ব আজ পৃথিবীতেই নেই, সে সশরীরে সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেও মনে পড়া উচিত নয়। কী বল?”

“রমিতা কাকিমা!”

“যাক্‌, মনে পড়েছে!”

রিনি খুব উত্তেজিত হয়ে পড়ে। রমিতা কাকিমাকে দুহাতে ঝাঁকিয়ে বলে, “তুমি বেঁচে আছ! কোথায় ছিলে এতদিন? কাকুকে এত কষ্ট দিলে কেন তুমি?”

“আরে এত উত্তেজিত হচ্ছিস কেন? সব বলব বলেই এসেছি। শুধু তাই নয়, তোকে একটা সাহায্য করতে হবে আমাকে।”

রমিতা কাকিমার হাতের মুঠো থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয় রিনি।

“স্যরি। তোমাকে সাহায্য করার কোন ইচ্ছা বা রুচি আমার নেই।”

“বেশ। একটু সময় দে আমাকে। কথাগুলো শোন আমার। তারপর যেমন ইচ্ছে তাই করিস।”

রিনি বসে পড়ে। পাশে রমিতা কাকিমাও বসেন। 

“তোর মনে আছে রিনি, একদিন দুপুরে তুই এসেছিলি আমাদের বাড়িতে। তখন আমি আর পুষ্পল অন্তরঙ্গ অবস্থায় কথা বলছিলাম। আমি টের পেয়েছিলাম তুই এসেছিস। তোকে বুঝতে দিইনি। এর পর আরও একদিন। ভিডিও কলে কথা বলছিলাম। খুব ঘৃণা হয়েছিল আমার ওপর আর তোর কাকুর ওপর সহানুভূতি, তাই তো?”

“তুমি জানতে আমি গিয়েছিলাম! এর মানে কী কাকিমা?” রিনির কথায় বিস্ময় ফুটে ওঠে।

“একটা কথা বিশ্বাস কর, আজ পর্যন্ত যা কিছু করেছি সব তোর কাকুর নির্দেশে। এমনকি আমার মৃত্যুসংবাদও।”

রিনি সপাটে বেঞ্চ থেকে উঠে পড়ে।

“মানে!”

“শান্ত হ রিনি। ধৈর্য ধরে সবটা শোন। তোদের এখানে আসার কিছুদিন পর থেকেই তোর কাকুর কেরিয়ার টালমাটালের মধ্যে দিয়ে চলছিল। যে খবরের কাগজের অফিসের চাকরি করত সেখানকার কাজ চলে গিয়েছিল। ও, ভাল কথা। তোর কাকু কোনদিনই সাংবাদিক ছিল না। প্রিন্টিং ডিপার্টমেন্টে কাজ করত। সেই অফিস থেকে অন্য একটা কাগজের অফিসে চাকরি যোগাড় করে। মাইনে অতি সামান্য। সেই সময়ে রোজগার বলতে আমার আবৃত্তির স্কুল আর গ্রুপ থিয়েটার। সংসার চলত না। তোদের থেকে রচনা লেখার টাকা নিয়েছি। সেটাও তোদের কাকুর নির্দেশে।”

“তার মানে তুমি বলতে চাইছ, তোমার একাধিক সম্পর্কও কাকুর কথায়?” রিনি রেগে বলে।

“তোর হয়তো বিশ্বাস করতে অসুবিধে হচ্ছে। কিন্তু তাই। টাকার প্রয়োজন ছিল আমাদের। তবে তোর কাকুর একটা বড় গুণ ছিল। আমি ছাড়া কোনও মেয়ে তার মনে ঠাঁই পায়নি। কী রে, এটা তো ঠিক বলছি?” 

রিনি চোখ নামিয়ে নেয়। 

“তারপর শোন। তোর কাকু আর আমি প্ল্যান করে একটা বড় অঙ্কের বিমা করাই আমার নামে।  তারপর বেড়াতে যাই। এরপরে যা যা ঘটেছে সব আমাদের পরিকল্পনামাফিক। তোর কাকুর যোগাযোগের হাত অনেক দূর পর্যন্ত ছড়ানো ছিল। তাতে আমাকে মৃত প্রমাণ করতে অসুবিধে হয়নি।”

“এত বছর বাদে এসব কথা আমাকে বলছ কেন?” রিনি বিরক্ত।

“আমার মনে হয়েছে, আজ যে পরিস্থিতিতে আমি আছি তাতে তোকেই একমাত্র সব কথা বলা যায়।” রমিতা বলেন।

কাকু এখন কোথায়? তাছাড়া কী চাও আমার থেকে?” রিনি এর থেকে বেশি কথা বলার ক্ষমতাও যেন হারিয়ে ফেলছে।

“মাসখানেক হল, তোর কাকু নিরুদ্দেশ।”

রিনি চাপা গলায় তীব্র বিদ্বেষে বলে ওঠে, “এটা তোমাদের প্ল্যানিং-এর আরও একটা পার্ট নিশ্চয়ই?”

“না রে। আমি যতটা সম্ভব খোঁজার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু যে মানুষটা সমাজের চোখে মৃত সে কতটুকুই বা এগোতে পারবে?”

রমিতা কাকিমার কথার উত্তরে বলে, “তাহলে এখন কি আমাকে কাকুর খোঁজার দায়িত্ব নিতে বলছ?”

“যদি বলি, তাহলে কি অপরাধ হবে? তুইও তো একটা সময় মানুষটাকে… বাদ দে। আমি বলব না সেকথা।”

“তাহলে?” রিনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়।

“দীপ্তেশদাদের বাড়িতে তোকে একবার আমায় নিয়ে যেতে হবে। আমি জানি, আমরা যাওয়ার পর থেকে দীপ্তেশদারা নতুন করে কোন ভাড়া দেয়নি নিচের তলাটা। যেভাবেই হোক ম্যানেজ করবি দীপ্তেশদাকে। ভিতরের ঘরের জানলার পাশের খোপে কিছু চিঠি আর তোর কাকুর দেওয়া প্রথম আংটিটা রাখা আছে। ওগুলো আমার চাই।” রমিতা বলেন।

“কী বলছ তুমি কিছু বুঝছি না। যে মানুষটা তোমাকে সারা পৃথিবীর কাছে মৃত প্রমাণ করে দিল, তারপর তোমাকে একদিন ছেড়ে চলেও গেল। তাহলে তার স্মৃতি নিয়ে তুমি কী করবে?” রিনির গলায় একই সঙ্গে বিস্ময় আর ঘৃণা।

“তুই জীবনে কাউকে পাগলের মতো ভালবেসেছিস? যদি না বেসে থাকছিস তাহলে বুঝবি না।  তুই প্লিজ আর না বলিস না।” রমিতা অনুনয়ে ভেঙে পড়েন।

“তুমি একটা কথা বলো তো। সত্যি বলবে। কাকু সত্যি নিরুদ্দেশ, নাকি?”

“এক কথা কেন বারবার জানতে চাইছিস? যেটুকু বলার বললাম তো।”

রিনি অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে রমিতার চোখে চোখ রাখে। সেই চোখে জল চিকচিক করছে। তাহলে কি… 

রিনিও চেষ্টা করবে নতুন করে।  তাকে পারতেই হবে। নির্মাল্যর সঙ্গে জোড়াতাপ্পির জীবন নয়, পরিপূর্ণ এক ভালবাসার জীবন গড়ে তুলবে। তার আর নির্মাল্যর মধ্যে বন্ধ দরজা সেই খুলবে।


দীপ্তেশকাকুকে ম্যানেজ করে চাবি নিয়ে তালা খুলে বন্ধ দরজায় চাপ দেয় রিনি…  

  


-------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র