তন্ময় ধর - মায়াজম

Breaking

২৫ সেপ, ২০২২

তন্ময় ধর

 বকরাক্ষসের নগরী একচক্রায় 

                   -



অ্যান্টার্কটিকার ঝটিকা-কুজ্ঝটিকার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া সেই ভয়ঙ্কর পিচ্ছিল বরফস্তূপের ওপর ফ্রিস্টাইল কুস্তির প্যাঁচ মেরে, গ্রহবৈগুণ্য ম্যাচ ক’রে, ক্যাঁচ করে ব্রেক কষে, সহজপাঠের নন্দলালীয় ছায়াচিত্র ‘যাব না তো কক্ষনো’ স্টাইলে গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল।কর্ণের রথের চাকার মত গাড়ির চাকা বসে গিয়েছে বরফে।গাড়ির কর্ণধার ‘সমুখে শান্তি পারাবার/ ভাসাও তরী হে কর্ণধার’ গোছের কোন একটা গান শুনছিলেন ইয়ার-ফোনে। বিরক্তিতে কান থেকে ইয়ারফোন খুলে বকরাক্ষসের মত মুখ করে বললেন ‘কিছু করার উপায় নেই। গাড়ি নড়বে না।বক দেখানো বা দেখা, যা করবেন, এখান থেকেই করে নিন’। পেছনের সীটে ভাবুক বড়দা এতক্ষণ বিড়বিড় করে ‘ফিরে এসো চাকা’র কবিতা আবৃত্তি করছিলেন, এবার তিনি নিবৃত্তিমার্গে মোচড় মেরে সুকুমারীয় ‘ভাবুকদাদা জ্ঞান হারালেন মাথায় গুঁজে র‍্যাপারটা’ স্মরণ করে জ্ঞান হারালেন।

বরফের গুঁড়োর ছিটে দিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে সবাই মিলে গাড়ি ঠেলা ছাড়া উপায় ছিল না। হাড়হিম করা হাওয়া বইছে চারপাশে। যেন আদিম তুষারযুগে কয়েকটি নিয়ান্ডার্থাল আদিমানব গহন তুষারঝড়ের মধ্যে ম্যামথের মৃতদেহ ঠেলে চলেছে। মহাকালের জপের মালা থেকে বিচ্ছিন্ন সেই দিনে অনেক বিবর্তন, আবর্তন, চক্রবৎ সুখ-দুঃখের পরিবর্তন স’য়ে যখন আমরা বকরাক্ষসের নগরী একচক্রা বা চক্রাতায় পৌঁছলাম তখন বারোটা বেজে গিয়েছে। পেটে কয়েকশো বকরাক্ষসের প্রবল খিদে চুঁইচুঁই করছে। কিন্তু এই তুষারবিধ্বস্ত দিনে যে দু’একটা রেস্তোরাঁ টিমটিম করছে তাদের চাল-ডাল-আটা সবই বাড়ন্ত, বকবকও বাড়ন্ত। হোটেল ম্যানেজার বকরূপী যক্ষের ভঙ্গিতে মৌনব্রত অবলম্বন করে বসে রইলেন। আমাদের কপালে জুটল অতিশীতল থুকপা।দু’রকম হিমশীতল সস আর নানারকম অচেনা সব্জির টুকরো সহযোগে সেটাই আত্মসাৎ করে ম্যানেজারকে জিজ্ঞাসা করলাম ‘এখানে এক রাত্রি থাকার মত হোটেল পাওয়া যাবে?’




অন্য ব্রহ্মাণ্ডের কন্ঠস্বরে ম্যানেজার বললেন ‘সম্ভাবনা কম। তবে চেষ্টা করে একরাতের জন্য মেকশিফট কিছু একটা ব্যবস্থা করে দেওয়া যেতে পারে। সব বাড়িঘরের দরজা কয়েক ফিট বরফের তলায় চলে গিয়েছে’।

এসব কথা শুনতে শুনতে রেস্তোরাঁর দরজার বাইরে প্রথম পা রেখে নিখরচায় সদলবলে আছাড় খেলুম। গায়ের বরফ ঝেড়েঝুড়ে ভাবুকদাদা বললেন ‘পায়ের নীচে বরফ গলছে, জুতোর সামান্য চাপেই বাপের নাম খগেন হয়ে যাওয়ার চান্স পা হড়কে…’

আগেও গাড়ি ঠেলতে গিয়ে নতুন-পুরনো বরফের মিশ্রণে বারবার আছাড় খেয়েছি আমরা। জামাকাপড়ের ভেতরে, আঙুলের ডগায়, কানে ওই খুচরো বরফের গুঁড়ো এতক্ষণে কামড় দিতে শুরু করেছে। হোটেলে কিছুক্ষণ বিশ্রাম, আগুন পোহানো, গরম চা খাওয়া ইত্যাদির জরুরি প্রয়োজন। হাড়হিম করা হাওয়া বইছে তো বইছেই। ভোরে পারদ শূন্যাঙ্কের চার ডিগ্রি নীচে ছিল। এদিক-ওদিক হোটেল খুঁজে কয়েকবার বরফে আছাড় খেয়ে সেই পুরনো রেস্তোরাঁর ম্যানেজারের ঘরেই বকের মত লম্বা গলা বাড়াতে হল ‘স্যর, আপনার এখানেই দুপুরে আর রাতে থাকাখাওয়ার যা-হোক কিছু ব্যবস্থা করুন। কোত্থাও কিছু মিলছে না’। 

তিনি হাসিমুখে বহুবার গরম-ঠান্ডা হওয়া রিসাইকল্‌ড থুকপা গরম করতে শুরু করলেন। আমরা একটু ধাতস্থ হয়ে মুখে একটা হালকা বরফবিধ্বস্ত হাসির আভা টেনে বললাম ‘ইয়ে…মানে…এই আবহাওয়ায় আশেপাশে চট করে দেখার মত কিছু সাইটসিয়িং…’

‘প্রচুর আছে’ উপহাস করছেন না সত্যি বলছে্ন, তা ওঁর ভাবলেশহীন মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই। গড়গড় করে চৌদ্দটা জায়গার নাম বলে চললেন তিনি ‘ টাইগার ফলসে গিয়ে জলপ্রপাত দেখুন, কানাসারে গিয়ে বুগিয়াল দেখুন, কালসিতে গিয়ে অশোকের শিলালিপি পড়ুন, লাখামন্ডলে গিয়ে জতুগৃহে ঢুকুন, রামতালে গিয়ে হ্রদ দেখুন, দেওবনে গিয়ে জঙ্গল দেখুন, হানোলে গিয়ে মহাসু দেবতা দেখুন…’

কথায়-কথায় বুঝলুম, তিনি যা ছড়াচ্ছেন, সেই দেশকাল মাপতে দিন তিনেক লেগে যাবে। আর পথে খাওয়াদাওয়া বলতে হরিমটর। ম্যানেজার অবশ্য আশ্বাস দিচ্ছেন কোথাও বাসি ম্যাগি মিলতে পারে। বরাতজোর থাকলে মিলতে পারে কূর্ট গোডেলের নন-টার্মিনেটিং সিরিজে গরম-করা ঐতিহাসিক ভাত-তরকারি, হিমালয়ের পবিত্র উষ্ণজল মেশানো ডাল, প্রাগৈতিহাসিক আচার। আমরা মধ্যাহ্নভোজের থুকপার বাটি মুখের সামনে ধরে ম্যানেজারের মোবাইল ফোনের গ্যালারিতে সেইসব দ্রষ্টব্যের মায়াময় দৃশ্য দেখতে লাগলাম। 




একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকেলের দিকে বেরোনো হল চক্রাতা বা একচক্রা নগরী দর্শনে। অত্যন্ত পুরনো কিছু কাঠের বাড়ি মহাকালের প্রভাবকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে বরফ মেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে। অন্ধকার জানালায় উঁকি দিলে এখনো বোধহয় বকরাক্ষস আর ভীমের যুদ্ধ দেখা যাবে। অতিকায় সব সরলবর্গীয় আদিম মহাদ্রুম দাঁড়িয়ে আছে পথের পাশে। তাদের নিরবচ্ছিন্ন ছায়ায় অতিকায় বরফপিণ্ড জমে আছে, গলার ফুরসৎ নেই। গাছের পাতা, বাড়ির কার্নিশ থেকে তীক্ষ্ণ সূঁচের মত ঝুলছে বরফ। আর সন্ধ্যার অনুগামী হিমেল হাওয়া আরো দামাল হয়ে উঠছে। স্থানীয় আরু-আপেল-খুমানি নিয়ে পশরা সাজিয়েছে এক দোকানী। তার কাছে যেতেই বসিয়ে দিল আগুন পোহাতে। পাশের দোকান থেকে চা আর আলুপকোড়া এল। প্রাচীন যত উপকথার গল্প জমে উঠল। বরফ, পশম, উল, আপেল, অ্যাপ্রিকট হয়ে জাদুবিদ্যা, বহুবিবাহ পেরিয়ে হিমেল রাতের নির্জন পথে সে যেন আর ফুরোতেই চায় না। সামান্য চা-পকোড়া কোন সে প্রাগৈতিহাসিক যুগে ফুরিয়ে গিয়েছে।  

এদিকে কালান্তরে পেটের ভিতর বকরাক্ষসের অত্যাচারে বিষাদব্যথায় পূর্ণ হয়ে গিয়েছে। প্রবল খিদের ভাবনায় ভারাক্রান্ত ভাবুকদাদা এবং তাঁর শাগরেদেরা এবার রেস্তোরাঁ ম্যানেজারকে চেপে ধরে কোণঠাসা করে ফেললেন ‘তিন বেলা ওই থুকপা আর মুখে রুচছে না। আপনি ডাল-তরকারি-রুটির ব্যবস্থা করুন। সে যতই প্রাগৈতিহাসিক হোক, আমরা আপেল-অ্যাপ্রিকট জুসের চাকনা দিয়ে চোঁ করে মেরে দেব…’

ম্যানেজার হাসলেন ‘দেখুন স্যর, এখানে খাবার একটু অসুবিধে হয় ঠিকই, কিন্তু কাল সকালে যখন আপনি প্রথম সূর্যের আলোয় চারপাশের বরফমাখা পাহাড়গুলো দেখবেন, তখন বুঝবেন স্বর্গসুখ কাকে বলে! একটু যন্ত্রণা না থাকলে কি সুখ পাওয়া যায়, স্যর?’ দিব্য আবেশের প্রভাবে এবার জ্যোৎস্নামাখা বরফের সৌন্দর্য্য, প্রভাততরল জ্যোতি-মাখা বরফের সৌন্দর্য্য বর্ণনা করতে করতে এতটাই খেই হারিয়ে ফেললেন ম্যানেজার যে পাশের ঘর থেকে সহকারী এসে তাঁকে ডেকে নিয়ে গেল। ইঙ্গিতে বুঝলুম, পাশের ঘরে পানীয়ের আসর বসেছিল। সেই দ্রব্যগুণেই ম্যানেজার এতক্ষণ অতিসক্রিয় ছিলেন। 




শেষরাতে সত্যিই উঠল চাঁদ। কাকজ্যোৎস্নায় সত্যিই বহুস্তরীয় সৌন্দর্য্যের বৌদ্ধিক স্বর্গের মডেল ক্র্যাশল্যান্ডিং করিয়ে দিল আমাদের সামনে। তুষারমাখা সেই আলোর রূপ বর্ণনা করার সাধ্য পৃথিবীর মানুষে্র নেই। তারপর একসময় আরো অবাক করে দিয়ে ভোরের সূর্য হীরের দ্যুতি ছড়াল আমাদের চারপাশে। আমরা বহুক্ষণ কোন কথা বলতে পারি নি। ভাবুকদাদাও মূর্চ্ছিতপ্রায় অবস্থায় বসে রইলেন কয়েক ঘন্টা। 

বেলা বাড়লে বরফ-মাখা পথে পিছলে পিছলে এগিয়ে চললাম টাইগার ফলসের দিকে। প্রায় দশ কিলোমিটার পেরোনোর পর বরফের হাত থেকে নিষ্কৃতি মিলল। সবুজ অরণ্যের আতিথেয়তায় আমরা এসে দাঁড়ালুম সেই প্রবল প্রপাতের সামনে। ফ্রস্টবাইটের ধাক্কায় ভাবুকদাদার দু’দিন ধরে চিত্ত বিক্ষিপ্ত। প্রপাত দেখে তিনি শুধু বললেন ‘পপাত চ মমার চ’। 

কিভাবে যাবেনঃ-  সড়কপথে দেহরাদুন থেকে দু’ভাবে যাওয়া যায়। একটি পথ বিকাশনগর-কালসি হয়ে, অন্যটি পুরোলা-মোরি হয়ে। হিমাচলের দিক থেকে এলে রোহরু-হাটকোটি-টিউনি হয়ে আসা যায় সড়কপথে।    

 


    

  

   

    


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র