কর্ণ শীল - মায়াজম

Breaking

২৫ সেপ, ২০২২

কর্ণ শীল

 ★ভাঙা নৌকা ★




        
         


                                      ★


   কটা কালো ছেলে ছুটে গিয়ে জলে লাফিয়ে পড়লো। তার মাথাটা ভুস করে  ডুবে যেতেই একরাশ কলিচুনের গন্ধ ভেসে উঠলো।গ্রামের বিসর্জনের ঘাট। খুব বেশি কেউ আসেনা স্নানে। স্থির জলে মাছ, স্রোত, গভীরতা নেই বলেই মেছুনি, সাঁতারু আর আত্মহননকারীরা অন্য ঘাটে যায়। দুপুরে ঘুঘু ডাকে ঘু ঘু।


  জলে বুড়বুড়ি কাটে ...গ্লুব গ্লুব।


  তখনই কালো ছেলেটা দৌড়ে এসে জলে পড়লো।


ঘাটের কাছে আম জারুলের ছায়ায় একতলা ইঁটের বাড়ি। কবে তার গাঁথুনি দেওয়া হয়েছিল, কেউ জানেনা।দেওয়ালে এখনও নক্সার চিহ্ন দেখা যায় মন দিয়ে লক্ষ্য করলে। মাথার দিকটা ছুঁচলো। দূর থেকে দেখলে মনে হয় চতুস্তলকের ওপরে একটা শঙ্কু বসিয়ে রেখেছে কেউ।  সময়ের দাঁতে কাটা দেওয়ালের ওপাশে বসে কে যেন দেওয়াল আঁচড়ায় মাঝে মাঝে।


    ছেলেটা কার্তিক ঠাকুরের কাঠামোর ওপরে বসে প্যান্টের ভিতর হাত ঢুকিয়ে চোখ বুজে নাড়াচাড়া করছিল।পাথুরে ঘাটের ঠিক ওপরটায় তীব্র সঙ্গমের অভিঘাতে হাঁপাচ্ছে ঘেয়ো মেয়ে কুকুরটা। পুুরুষটা এ পাড়ার নয়।

  ইঁটের বাড়িটা থেকে একটা হাড়চওড়া লোক বেরিয়ে এলো। ঘাটের কাছে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠলো,

-এ শ্লা বেজম্মা...জলে নেমে টাকা দিয়ে আসতে হবে নাকি রে?

ছেলেটা হলুদ হলুদ দাঁত বার করে বললো,

-তুয়ে দে..পাতরে তাপা দিয়ে তুয়ে দে। তেউ নেবেনা...

  লোকটা চুনাপাথরের বড় খণ্ডটার নীচে দুটো দশটাকার নোট রেখে চলে যাচ্ছিল। কি মনে হতে ফিরে এলো। গলা তুলে বললো,

-শোন না..

ছেলেটা তাকালো।

লোকটা এদিক ওদিক তাকিয়ে একটু গলা নামিয়ে বললো,

-তিনজন একসঙ্গে পারবে? সন্ধ্যা বেলায় আসবে। একশো টাকা দেবে..

ছেলেটা আবার হাসলো।

-গাঁয়ের থবাইকে নিয়ে আয়।এত্ত বও গত্ত। থব পাব্বে। বেতি বেতি কয়ে নিয়ে আয়..

বিপিন হাসতে হাসতে চলে গেল। 


বেলা পড়ে এলে কলিজা শানিয়ে দেওয়া ঠাণ্ডা হাওয়াটা দেয়। বুকজল সাঁতরে পার হয়ে ছেলেটা ঘাটে এসে বসে। টাকাগুলো হাতে নিয়ে মাথাটা আরামে ঝাঁকায়। বিড়বিড় করে বলে,

-নং আনবো...নং আনবো...মা তোর নাং আতবে এ্যাত্ত, তাল আনবো, দাল আনবো। দুদ আনবো পত্তু ..না না, নত্তু। পায়েত থাবি তুই মা? 

                                 ★
রমাকান্ত সান্যালের গেস্ট হাউসে অতিথিরা এসেছেন কলকাতা থেকে। সপরিবারে। ঝলমল করছে আলোয়। উঠোনে বিরাট ভেপার ল্যাম্প জ্বলছে দুটো। দুটো রাস্তা দু দিকে চলে গেছে। একটি রাস্তা চলে যায় ভাগীরথীর তীরের পক্ষীনিবাসের দিকে। অন্যটি বাজার ঘুরে বড় পীচরাস্তায় গিয়ে মিশেছে।


  সেদিক দিয়ে নগর আসে নদীতীরে।


বাইরে একটা গোলমালের শব্দ শুনে রমাকান্ত বেরিয়ে এলেন। দেখলেন একটি অর্ধউলঙ্গ ছেলেকে কেয়ারটেকাররা ধাক্কা মারতে মারতে বার বার গেস্ট হাউসের চৌহদ্দির বাইরে বার করে দিচ্ছে, আর বারবারই ছেলেটি দৌড়ে ফিরে আসছে। অদ্ভুতদর্শন অর্ধনগ্ন ছেলেটিকে দেখে সান্যালের আগ্রহ হলো। তিনি কেয়ারটেকারদের ডেকে বললেন,


-ওকে নিয়ে আয় তো..


   কেয়ারটেকারদের মধ্যে বিপিন বলে একজন ছিল।স্থানীয় লোক। সান্যালের নির্দেশ শুনে তার মুখটা কালো হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি সান্যালের কাছে এসে নীচুগলায় বললো,


-আরে, স্যার চোর চাপটা, তাড়িয়ে দিন।


বিপিনের গলাটা স্বাভাবিক নয়। কাঁপা কাঁপা। প্রশ্ন করলেন সান্যাল,


-কি চুরি করেছে ও?


-ইয়ে মানে ..স্যার..


-যা, নিয়ে আয়।


     ঠোঁট কেটে গেছে ছেলেটার। বাঁ হাতটা প্যান্টের ভেতরে। জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে,


-দত্তাকা দে..দত ...মাত্ত দত তাকা দে, থবকতা নে..


    হাত মেলে ধরেছে ছেলেটা। বড় নখগুলো ভাঙা ভাঙা।হাতের মুঠোয় কাঠ দিয়ে তৈরি একটা নৌকো।তাতে দুটি মাঝি। হাল। দাঁড়। ছইয়ের গায়ে বৌমানুষের মুখ।


   ছেলেটা বলেই চলেছে,


-নঙ আনবো, নঙ কব্বো...তিনদন দাবে থন্দাবেলায়। মা আতে আমাল, এ্যত্ত বল গত্ত। একতো তাকা, পায়েত থাবো তালকে। এদুলো নাও, --দততাকা।


    সান্যালের গায়ে কাঁটা দিল।এক ঘোর কালিমালিপ্ত মহাকাব্য শুনছেন তিনি। ছেলেটার হাতের নৌকোটা ধরে বুঝলেন জলে ভেজা নরম হয়ে যাওয়া কাঠ নখ দিয়ে খুঁড়ে খুঁড়ে নৌকোটি বানানো হয়েছে। ছেলেটার কাঁধে হাত দিয়ে বললেন,


-কে দেবে তোকে একশো টাকা?


বিপিন চিড়বিড়িয়ে উঠলো। চেঁচিয়ে উঠলো,


-ওই খানকির ছেলের কথা শুনবেন না স্যার, ওরা পাক্কা ছকিয়াল জিনিস।


    ছেলেটা হাসছে হলুদ হলুদ দাঁত বার করে। সে বিপিনের দিকে তাকালো।আঙুল দেখিয়ে বললো,


-থুব ভাও..থুব ভাও...তুয়ি তাকা দেয়..তুয়ি তাকা। 


   সান্যাল নৌকোটি নিলেন। ছেলেটিকে ঘরে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,


-ভাত খাবি?


সহজভাবে মাথা নাড়লো,


-দাও..


   -নাম কি রে তোর?


-তি দানি! 


    চাকরকে ছেলেটির খাওয়ার ব্যবস্থা করতে বলে বিপিনকে ডেকে পাঠালেন অফিসরুমে। বিপিন মুখটা গোঁজ করে এলো। সান্যাল গম্ভীর গলায় বললেন,


- ব্যাজটা খুলে রাখ টেবিলে।গেস্টরা জানলে ব্যবসা লাটে তো! 


    আটত্রিশ নম্বর ব্যাজটা টেবিলে রেখে বিপিন নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। সান্যাল পিছু ডাকলেন,


-মাইনেটা নিয়ে যা..


   বিপিন ঘুরে দাঁড়ালো। চোখদুটো হলদেটে লাল। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,


-গাঁড় মারি তোর টাকার...


                                       ★


    চাঁদের টুসকি টুসকি আলোর রেখা পার হয়ে বিপিন উঠোনটায় ঢুকলো। ইঁটের ফাঁকে ফাঁকে জ্যোৎস্না চাঁদের ছায়াবাজি। জোনাকির আঁকিবুকি।অল্প আলোতেও বিপিনের হাতের রডটা চকচক করছে।


    ছেলেটার মুখে এক ফোঁটা আলো পড়েছে। নখ দিয়ে এক মনে ঘষে চলেছে কাঠের টুকরোগুলো। মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বিড়বিড় করে চলেছে,


-এদ্দ্যাক নৌতা। আও বানাবো। এ্যত্ত কাথ এনেতি দলের তলা থেকে। মা গো রে, তাপ্পর এ্যাত্তা বও নৌতা অবে, থোনাআআর নৌতা। আমনা তোলেএএ দাবো... উইইইদিতে..আল আতবোনা..


   মিষ্টি হাসি ভেসে এলো একটা ঘরের অন্ধকার থেকে।


   বিপিন হাতের মুঠোটা শক্ত করে এগিয়ে গেল। মাথা ঝুঁকিয়ে রাখা ছেলেটার ঠিক পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো।ঘরের মধ্যে একটা দমকা হাওয়া হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো। দেওয়ালের গায়ে আঁচড়াতে লাগলো অদেখা নখ। 


   কলিচুনের আঁশটে গন্ধটা আরও প্রবল হয়ে উঠলো।


                                  ★


  ছেলেটাকে পাঠিয়ে দেওয়ার পর থেকেই সান্যালের মনটা খচখচ করছিল। শুয়ে পড়ার পরও কিছুতেই ঘুমটা আসছিল না। দুবার জল খাওয়ার পর লক্ষ্য করলেন, তাঁর গরম লাগছে এই ভরা পৌষেও। 


   প্রেশার বাড়লো কি?


   আরও মিনিট দশেক অপেক্ষা করার পর দুটি লোক সঙ্গে নিয়ে নদীর পথে রওনা দিলেন তিনি।


     ইঁটের বাড়ির দেওয়ালে তিনটে টর্চের আলো ঘুরে ফিরে উঠোনে এসে থিতু হলো। ধুলোর ওপর ওপর দিয়ে একটা কিছু টেনে নিয়ে যাওয়ার দাগ।ফোঁটা ফোঁটা কালো তরলের একটা রেখা এগিয়ে গেছে জলের দিকে। আলো বরাবর আরও একটি ছোটো পায়ের দাগ। এক জায়গায় পায়ের দাগ মুছে অনেকটা জায়গা জুড়ে ধুলোর ওপর ধস্তাধস্তির চিহ্ন।


       ঘাটের পাশের একটি পাথর সদ্য ওপড়ানোর কালো গর্তটা রয়ে গেছে। প্রতিমার একটা কাঠামো উঁচিয়ে আছে জ্যোৎস্নার দিকে নৈঃশব্দের ত্রিফলা সঙিন উঁচিয়ে। নিঃশব্দ নদীতীরে শুধু হাওয়ার শোঁ শোঁ শব্দ।


    জলের একটা অংশে অজস্র বুড়বুড়ি। 


কচুরিপানার ফাঁকে ফাঁকে চর জেগে আছে। তাতে কালো শস্যের ভীড়।


   এমন সময় বাঁদিকে চোখ পড়লো সান্যালের।


যতদূর চোখ যায় কংক্রীটের সাদা রাস্তা পড়ে আছে নদীর বাঁকের সমান্তরালে। সঙ্গের লোকদুটিকে ইশারায় টর্চ বন্ধ করতে বললেন তিনি।


   দিগন্তে বেয়ে একটা কালো বিন্দু দ্রুত এগিয়ে আসছে। ক্রমশ সেটি সরলরেখায় পরিণত হলো। আরও ...আরও...এগিয়ে আসছে সেটি।


     একটা মেয়ে!


 চুলগুলো উড়ছে হাওয়ায়।


ওই তো, আরও একটু এগিয়ে এসেছে। সর্ষেক্ষেতের পাশের বাবলাগাছটার নীচে পৌঁছে গেছে। 


আরও এগিয়ে আসছে। একটা গজরানির শব্দ।


     একেবারে সামনে আসতেই আচমকা তার গায়ে আলো ফেললেন সান্যাল।


উঃ...!


 উলঙ্গ মেয়েটির চুলের একটা অংশ জট পাকিয়ে আছে। বুকে পেটে আঁচড়ের দাগ। দু পা ভেসে যাচ্ছে রক্তে।


 ঘাটের কাছটায় এসে সে সটান জলের দিকে নেমে গেল সে।  পাগলের মত জল ঘাঁটতে লাগলো। জলের ফোঁটা পড়ছে চারিদিকে ছিটিয়ে।তারপর উপুড় হয়ে পাথুরে জমিতে বুক ঘষটে জলের মধ্যে নেমে পাগলের মত কিছু একটা খুঁজতে লাগলো।


   হাঁপিয়ে গেল একসময়।


জলের মধ্যে মাথাটা সম্পূর্ণ ডুবিয়ে শুয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর খুব ক্লান্ত পায়ে ঘাট বেয়ে উঠে আসতে লাগলো। টেনে টেনে দেহটাকে চড়াই বেয়ে কিছুটা তুলে আনার পর আবার পিছন ঘুরে ঝাঁপিয়ে জলের মধ্যে পড়লো।নদীর বুক ছিঁড়ে ফেলতে চাইল যেন। 


    সান্যাল তার কাছে একবার যাবেন ভাবলেন। দু পা এগিয়ে যেতেই, মেয়েটি ঘাট বেয়ে দৌড়ে উঠে এলো। দাঁড়িয়ে পড়লো সান্যালের সামনে।


   ভয়ে টর্চের স্যুইচ টিপে দিলেন তিনি।


মেয়েটির চোখদুটো ঠেলে বেরিয়ে আসছে। গলার শির ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম। মুখ দিয়ে নিঃশব্দ থুতু ছিটকে আসছে। সটান মাটিতে শুয়ে পড়ে পাথরে মাথা ঠুকলো কয়েকবার।


   হঠাৎ নিস্তেজ হয়ে শুয়ে পড়লো। সান্যাল নীচু হয়ে তার গায়ে হাত রাখলেন। মেয়েটি কেঁপে উঠলো একবার।চকচকে নিটোল চামড়ায় শীতকাঁটা দেখা দিল। 


   সান্যাল গম্ভীর গলায় সঙ্গের লোকদুটিকে বললেন,


-হাত পা দুটো শক্ত করে ধরবি কিন্তু...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র