সহেলী রায় - মায়াজম

Breaking

২৫ সেপ, ২০২২

সহেলী রায়

 পর্ণমোচী





চারটে শুকনো লঙ্কা, এক চামচ সর্ষে, পিঁয়াজের খোসা, রসুনের খোসা সব সংগ্রহ করে হাতের মুঠোয় ভরে নিল সাধনাবেলা সোয়া এগার’টারাতুল বিছানায় শুয়ে বদ্বীপ অথবা কেন্নোর মতো কুন্ডলী রচনা করছেসাধনা  ঘরে ঢুকেই ‘বাবু বাবু’ করে চিৎকার করে পাশের পাঁচিল কিম্বা গাছের কাক চিল ওড়াতে সক্ষম হলেও,  একবিন্দুও নড়াতে পারল না রাতুলকেরাতুলের এ এক অদ্ভুত ক্ষমতা, ঘুমিয়ে পড়লে সে কুম্ভকর্ণের বংশধর হয়ে  ওঠেসাধনার চ্যাঁচামেচি বৃথা গেলকিন্তু সেও দমবার পাত্রী নয়এক হাত মুঠো বন্দী হলেও অন্য হাত   রাতুলের ঘাড়ের তলায় ঢুকিয়ে টান মেরে বসিয়ে দিল রাতুলকেঅসম্ভব বিরক্তিকর দৃষ্টিতে সাধনাকে দেখল রাতুলকিছু একটা বলতে গিয়েও গিলে নিলসাধনার জায়গায় তার মা দেবারতি হলে এক্ষুনি দক্ষযজ্ঞ বেঁধে যেতসাধনা আর বিলম্ব না করে বাম হাতের মুঠোটি তিনবার রাতুলের মাথা থেকে পা অব্দি ঘুরিয়ে নিল রাতুল ভ্রু কুচকে বোঝবার চেষ্টা করল, কী ঘটছেকিন্তু সাধনা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই তার মনে হল ওসব  জটিলতম ঘটনার জট না খুলে দুম করে শুয়ে ফের ঘুমিয়ে পড়াটা সহজসাধনা মুঠোয় রাখা জিনিসগুলো  একটা খবরের কাগজের টুকরোয় মুড়ে বারান্দার এককোণে রেখে দেশলাইয়ের কাঠি বের করলফস করে আগুন ধরিয়ে দিল মোড়া কাগজটায়কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করেই ফের চ্যাঁচাতে শুরু করল, ‘গন্ধ নাই গো বৌদি, একফোঁটা গন্ধ নাই’ 

দেবারতি দৌড়ে এল রান্নাঘর থেকেনাকে ফোঁস ফোঁস শব্দ করে গন্ধ টানার চেষ্টা করলদু’দিকে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল, সত্যি সেও কোন গন্ধ পাচ্ছে নাঅথচ একটা শুকনো লঙ্কা গ্যাসের আগুনে ধরলে হেঁচে কেশে দম আটকে আসার জো হয় ঝাঁঝে, সেখানে চারটে লঙ্কা পুরোই নিষ্ক্রিয় 

‘আমি কী বইল্লাম? নজরই লাগছে বাবুর’। 

সাধনা তার যুক্তিতে সফল হয়েছে, তার চোখমুখে সেই অভিব্যক্তি স্পষ্ট

‘সত্যি ছেলেটা ভুগেই চলেছে, মাসের মধ্যে দু’তিনবার করে জ্বর’- 

দেবারতি যতটা না নজর লাগা নিয়ে ভাবছে তার চেয়ে বেশি চিন্তিত রাতুলের বারবার অসুস্থ হওয়া নিয়ে 

‘অ তুমি চিইন্তা কোর না, পর পর তিনদিন ঝেড়ে দিব, সব ঠিক হয়ে যাবে’। 

দেবারতি রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল

আকাশ কালো করে মেঘ দাঁড়িয়েছে। গত কয়েকদিন ধরে এই দুপুরবেলাতেই কালো ধোঁয়ার মতো মেঘেদের খুব আনাগোনা হয়েছে। যেন অফিস বাবু বা স্কুল পড়ুয়াদের মতো এই সময়টিই তাদের জন্য বরাদ্দদেবারতি খুন্তি নাড়তে নাড়তে বেসিনের ওপরের জানলা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে আনমনা হয়ে  যায়।  ঝলমলে কাঁচা হলুদের মতো দিনটা কেমন রঙ বদলাচ্ছে। একটা ধূসর ছায়া  চেপে বসছে তার গায়ে। কেউ যেন সাদা জলে তুলি ডুবিয়ে আঁচড় কেটেই চলেছে যতক্ষণ না ছাদের ওপর মেয়ে বৌ’দের হুড়োহুড়ি পড়ে যায়, ‘মেঘ করেছে, কাপড় তোল’ বলে। গ্যারাজের রঙিন অ্যাসবেস্টার্সে টুপটাপ জলতরঙ্গের বোল  শুরু হয়ে গেছে, দেবারতি কান খাড়া করে শোনে, আরেকবার বুক ভরে শ্বাস নেয়, শুকনো মাটির সোঁদা গন্ধ ভরে  ফুসফুসে। 

‘বাবু যে আবার ঘুমায়ে পল্ল’ 

সাধনার গলায় বেশ আপত্তি।

‘থাক, জ্বরটা নেমেছে, ঘুমলে শরীরটা ঝরঝরে হবে। উঠলে খেতে দেব’ 

‘হ ঘুমোক তবে’। 

দেবারতির ওপরে কথা বলা চলে না। সুর পালটে নিল সাধনা। টিভিতে মেগা সিরিয়ালের পর্ব চলছে বিরতি নিয়ে নিয়ে। কেউ দেখুক ছাই না দেখুক কাজের ফাঁকে টুক করে টিভিটা চালিয়ে দিতে মোটেই ভোলে না সাধনা। এ বাড়ির সদস্যদের মতো টিভিটারও যেন সঠিক সময়ে ঘুম ভাঙা উচিত। সাধনা গিয়ে দাঁড়ায় তার সামনে সুযোগমতো। কলাকুশলীদের সুখ দুঃখ হাসি কান্নার খোঁজখবর নিয়ে আবার লেগে পড়ে কাজেকারণে অকারণে কলাকুশলীদের বার্তালাপ বন্ধ হলে দৌড়ে দেখতে আসে তাকে। এও যেন তার কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। দেবারতি ও সুতীর্থ দু’জনেই ঝঞ্ঝাটহীন মানুষ। কাজের লোকদের ব্যাপারে নাক গলানো তাদের ধাতে সয় না। সময়মতো নিজেদের কাজগুলো পেয়ে গেলেই তাদের শান্তি।  দু’জন মানুষ যেন দুই পাড়ের দু’টি শান্ত গ্রাম। রাতুল তাদের মাঝে বহমান নদীর একমাত্র খেয়া। তাদের একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা, আদানপ্রদান সবই এগিয়ে চলে রাতুলকে ঘিরে।    

'আমি এখেনেই ক'দিন থেকে যাই। বাবু একটু ভালো হোক। রেতে থাকলে তোমারও দুটি সুবিদে হয়, কী বলো?'

দেবারতির সম্মতির আশায় তাকিয়ে থাকে সাধনা। দেবারতি মগ্ন ফোনের স্ক্রিনে। তার কোন জবাব দিতে ইচ্ছে করে না। ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দিয়েছে নরম সোফায়। আরাম পেয়ে একটা ঘুমপাখি কানের কাছে ডেকে চলে যাচ্ছে। তাকে ছাপিয়ে সাধনার কথাগুলো যেন অনেক দূর থেকে মাইকে ভেসে আসা চটুল গানের মতো শোনাচ্ছে। ঠিক যেমন বিশ্বকর্মা পুজোয় রিক্সাস্ট্যান্ডের প্যান্ডেল থেকে ভেসে আসত। দেবারতি অপেক্ষা করে থাকত বাবা ফ্যাকটরি থেকে ক’ প্যাকেট মিষ্টি আনে তা গুণে দেখবে বলে। জলের শব্দ বাড়ছে। ভিজে  পাখিদের ডানার ছটফটানিতে বৃষ্টির গুঁড়ো ছড়িয়ে পড়ছে দেবারতির মুখে।  

একটা খুট শব্দে দেবারতির ঘুমের চটক ভাঙে। সাধনা জানলার শার্টার টানছে

'বিষ্টির ছাঁট আসছে, তোমার মুখে পড়ছে।' 

দেবারতি আবার চোখ বোজে।

২)

সাড়ে দশটা নাগাদ থেকে গ্রীনল্যান্ড নার্সিংহোমের সামনে ঘুর ঘুর করতে থাকে মেয়েটিমাথায় ঘোমটা কপাল অব্দি টানামাঝে মাঝে মুখ তুলে তাকাছে মূল গেটের দিকেদেখে মনে হচ্ছে কারও জন্য অপেক্ষা করছেছোট নার্সিংহোম হলেও রোগীর ভালোই আনাগোনাবিশেষত প্রসূতি বিভাগটি বেশ সচলসন্তানসম্ভবা মায়েরা কেউ ইমার্জেন্সিতে, কেউ আউটডোরে দাঁড়িয়ে আছেনমেয়েটি পায়চারি করতে করতে সকলের দিকেই চোখ বোলাচ্ছে 

সজল জোরে পা চালাল। ডিউটির সময় হয়ে গেছে। ঢোকার মুখে সাবিনাকে দেখে সে বিরক্ত হল। ছিনেজোঁকের মতো লেগে আছে মেয়েটা। বারবার এখানে আসতে বারণ করা সত্ত্বেও চলে আসছে। নিজে তো বিপদে পড়বেই সঙ্গে সজলেরও চাকরি নিয়ে টানাটানি হবে।  

‘আরও টাকা আনছি, লিয়া লও’। 

সাবিনা ঘোমটা আরো খানিক টেনে ব্যাগের চেন খুলতে উদ্যত হল।

‘আহ! এখানে বারণ করেছি তো। এখন যাও দিকিনি। পরে জানাব’। 

সজল কথা বলতে বলতেই হেঁটে সিকিউরিটি অফিস ঘরে ঢুকে গেল। সাবিনা বেশ খানিক্ষণ উঁকিঝুঁকি মেরেও সজলের পাত্তা পেল না। ওদিকে রোগীদের ভিড় বাড়ছে। একেকজন ভাবী মায়ের কী ঢলঢল চেহারা। মুখে চোখে পরিতৃপ্তির প্রসাধন লেগে রয়েছে। পরিবার পরিজনেরা এমন আগলে রেখেছেন যেন সামান্য হেরফের হ’লেই অশুভ আঁচ লেগে যাবেএই সময়টা মেয়েদের ভারি অহঙ্কারী মনে হয়। দেমাকে যেন মাটিতে পা পড়ে  না। সাবিনা নিখুঁত চোখে মাপে তাদের আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বুকের মধ্যে ঈর্ষার পোকাটা হুল ফোটাতে থাকে।  সব কিছুর ফাঁকে সে গেটগুলোর দিকে নজরও রাখেসজল একটিবার যদি বেরোয়। টাকাকটা মিটিয়ে দিতে  পারলে সজল আর না করতে পারবে না। দুপুর গড়িয়ে শেষ বিকেলের আলো বুজতে শুরু করেছে। নার্সিংহোমের সামনের ভিড় কখনো পাতলা হয় কখনো বেড়ে ওঠে। সাবিনা বিভিন্ন জায়গায় একটু দাঁড়ায়,  একটু বসে। ‘শীতল পানীয় জল’ লেখা বাক্সের কল খুলে জল খায়। সজলের দেখা মেলে না। তার শরীরেও সন্ধে নেমে আসে। আঁচলটা গলায় ভালো করে জড়িয়ে আস্তে আস্তে বাস ধরার জন্য বেরিয়ে পড়ে সে। শিয়ালদা স্টেশনের বাইরে খানিক এগিয়ে প্রথম গলি দিয়ে একটু গেলেই সাবিনাদের ঝুপড়ি। দোর খুলে ব্যাগটা রেখে, ধরে রাখা এক বালতি জলে গা ধুয়ে সবে মুড়িটুকু নিয়ে বসেছে সেতখনই করিমচাচার নাতিটা তার ফোন নিয়ে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল ঘরে  

‘দাদী তোমার ফুন এয়েচে, তাড়াতাড়ি বলে নাও, বই দেখছি’। 

সাবিনা সাবধানে ফোনটা হাতে নেয়। 

‘সজল বলছি। এখেনে আসতে বারণ করি তবু আসো। আচ্ছা জ্বালালে তো। ত টাকার কতা কী বলছ বলো’। 

‘টাকা জুগাড় হইছে, তুমায় দিব কয়েই তো গেলম’ 

‘ঠিকাচে সাতটা নাগাদ এক নম্বর প্ল্যাটফরমে এসো। কতা আচে’। 

এই প্রথম সজলের গলায় বেশ আত্মবিশ্বাসের সুর। সাবিনার ঠোঁটে সেই সুর হাসি হয়ে লেগে আছে। করিম চাচার নাতি কিছু বলার আগেই ছোঁ মেরে ফোনটা নিয়ে দৌড়ে পালাল। সাবিনা এক মুঠো মুড়ি মুখে চালান করে চিবোতে চিবোতে ব্যাগের ওপর হাত বুলিয়ে নিল। টাকাটা ঠিকঠাক আছে কিনা বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করল একবার   

৩)

জানলার কাচে বৃষ্টির ফোঁটারা এসে ধাক্কা মারছেযেন প্রবেশদ্বার খুলে দেওয়ার জন্য কতদিনের কাতর আকুতি । অভিমানে আছড়ে পড়ছে বিন্দু বিন্দু জুড়ে। দেবারতি দ্বিতীয় দফায় বৃষ্টির এই হাহাকার দেখতে দেখতে  আধো ঘুমে আধো জাগরণে ডুবিয়ে ফেলছে নিজেকে। সে সবকিছুই টের পাচ্ছে, তবু কেউ যেন তাকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা থেকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। তার খুব ইচ্ছে করছে রাতুলের কাছে গিয়ে বসতেউঠে বসা তো  দূরের কথা সামান্য পাশও সে ফিরতে পারছে না। কোথাও তার চেতনায় বারবার হাতুড়ির আঘাতের মতো কেউ যেন বলে যাচ্ছে ‘সারাদিন ছেলেটা কিচ্ছু খায়নি’, দেবারতি ভাবছে মুখোরোচক কিছু নিয়ে হাজির হবে  তার মাথার কাছে। থালা বাটি গ্লাস সব বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছেদেবারতি চেষ্টা করছে একে একে তুলে আনার, উঠোনে আছাড় খাচ্ছে। প্রচন্ড ভিজে শীতে কাঁপছে সে। মা জলপট্টি দিচ্ছে। পুড়ে যাচ্ছে পৃথিবী, পুড়ে যাচ্ছে  বর্ষার মেঘ, প্রচন্ড শব্দে তার ঝলকানি এসে দেবারতির চোখ মুখ ভাসিয়ে দেয়। চমকে উঠে বসে সে। 

ওঘর থেকে ঠুং ঠাং থালা বাটির শব্দ পেয়ে সে তড়িঘড়ি প্রায় হোচট খেতে খেতে রাতুলের বিছানার সামনে হাজির হয়। সাধনা খাটের কাছে বালতি রেখে রাতুলের মাথা ধোয়াচ্ছে। পার্শ্ব টেবিলে এঁটো প্লেট চামচ। অল্প খিচুড়ি পড়ে আছে। দেবারতি তো আজ খিচুড়ি রাঁধেনি। রাতুলের কি জ্বর বেড়েছে? দেবারতি আর্তনাদ করে উঠল। 

‘কী হল রাতুল?’

রাতুলের তখন মাথা শুকনো করে টাওয়াল দিয়ে মোছাচ্ছে সাধনাসে স্বাভাবিকভাবেই ঘাড় ঘুরিয়ে দেবারতিকে দেখল। দেখে মনে হয় না তার শরীরে কোন অসুবিধে আছে।

‘সাবুর খিচড়ি বানাইলাম, খেইছে, অনেকটাই খেইছে। বল্লাম বাদ্রুম যাও, মাতায় জল টল দাও, উইঠছেনা দেকে আমিই জল নে এসে ধুয়ে দেলাম’। 

রাতুলের মুখটা হাসিমাখা। সে আরাম পেয়েছে। সাধনাও খুশিতে গদগদ। যেন সুযোগের অপেক্ষায় ছিল দেবারতির চোখ বুঝলেই সে রাতুলের মা সাজবে, প্রমাণ করে দেবে তার মাতৃত্ব দেবারতির তুলনায় অনেক বেশি খাঁটি। পায়ের কনিষ্ঠ আঙুল থেকে যেন শির শির করে একটা আগুনের লেলিহান শিখা দেবারতির মাথায় উঠছে। ছড়িয়ে পড়ছে ক্রমশ শরীরের সমস্ত কোষে।    

‘কে বলেছে তোমায় এসব করতে? আমি ডেকেছি তোমায়? রাতুল ডেকেছে?’

হিংস্র বাঘিনীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল দেবারতি। সাধনা হতবাক। দেবারতির এমন রূপ কোনকালেই দেখেনি সে।

‘তুমি ঘুমোচ্চ দেকে, ভাবলাম বাবুর খিদে পেইচে’। 

‘আমার ঘুমোনোর সুযোগটাতেই ছিলে না? খুব শখ মা সাজার। নিজের স্বামীর কাছে যাও না? এখানে কেন  পড়ে থাকো রাতদিন? দাও না জন্ম বাচ্চার।’

দেবারতি কাঁপছে। ঠিক কতটা আগুন লেগেছে সে নিজেই বুঝতে পারছে না। হয়তো সে কথাগুলো বলতেই চাইছে না। আবার নিজেকে নিয়ন্ত্রণও করতে চাইছে না। এত অপমান শুনেও সাধনার ঠোঁটে একটা বাঁকাহাসি বিদ্যুতরেখার মতো একবার দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল। দেবারতির চোখ এড়াল না সে ঝলকানি। সে কুঁকড়ে যাচ্ছে যেন।   

‘শাট আপ মাম্মা। প্লিজ যাও এখান থেকে। আমার তো খিদে পেয়েই ছিল। সাধনাপিসি তো ভালোই করেছে’। 

রাতুলের কথায় আরো বেশি আস্ফালন করতে থাকল দেবারতি। সাধনা ধীর পায়ে সরে গেল ঘর থেকে, রান্নাঘরের পাশে স্টোর রুমটি তার বিশ্রাম নেওয়ার ঘরসেখানেই সে ধপ করে বসে পড়ল মাটিতে পাতা বালাপোষটার ওপর।   

এক ব্যস্ততম সকালে হঠাৎই হাতে আসে কাগজটাকী যেন একটা খুঁজতে গিয়ে সাধনার অনুপস্থিতিতে স্টোররুমে তার তেলচিটে বালিশের তলায় পেয়েছিল। গ্রীনল্যান্ডের নার্সিংহোমের সঙ্গে দেবারতি আর সুতীর্থর সই করা চুক্তির কাগজরাতুলকে অ্যাডপ্ট করার সময় লিখেছিল সেখানে এই বাড়ির ঠিকানাসহ যাবতীয় ডিটেইল সামান্য একটা ফটোকপি দেবারতির পায়ের তলার মাটিতে চিড় ধরিয়ে দিয়েছিল। কে এই সাধনা? একটু একটু করে বদলে যাচ্ছিল তার মনের ভাবগতিক। সুতীর্থকে জানাব জানাব করেও চুপ করে ছিল, নিজেই নিজের গর্ত খুঁড়ছিল প্রাণপণে।  

দিনের  পর দিন মেসোর শারীরিক অত্যাচার সহ্য করতে করতে পালিয়ে গিয়েছিল একদিন। গ্রিনল্যান্ড নার্সিংহোমে একজন পৌঁছে দেয়, আলাপ করিয়ে দেয় সজলের সঙ্গে। হাতে যা টাকাকড়ি ছিল তা দিয়ে  সজলকে হাত করে বাচ্চাটা নষ্ট করতে চেয়েছিল সাবিনা। কিন্তু তখন আটমাস কাবার হয়ে গেছে। ডাক্তার রাজি হল না। একমাস পরেই বাচ্চাটাকে নার্সিংহোমের সিঁড়িতে মাঝরাতে রেখে  পালিয়েছিলএকটা স্কুলে আয়ার কাজ করতে করতে বাচ্চাদের সান্নিধ্যে এসে সাবিনার নিজের সন্তানের জন্য প্রাণ কেঁদে উঠত। যোগাযোগ করল সজলের সঙ্গে। ‘পেট বাধাবে, বাচ্চা বিয়োবে, ফেলে চলে যাবে আবার দরদ উঠবে, ও ঠিকানা জানাজানি হলে আমার হাতকড়া পড়বে’নানা গঞ্জনা শুনেও চলল টাকার আদানপ্রদান। সাবিনা থেকে সাধনা হতে হল তাকে। 

 অসম্ভব নিরাপত্তাহীনতায় মুখোমুখি আজ নাড়ি ও মাতৃত্বের টানশহুরে কালবৈশাখীর দাপটে পাকাপোক্ত  ঘরেও বেরিয়ে আসছে দাঁত নখ। জায়গায় জায়গায় ফাটলে পরিণত হচ্ছে।  অশান্ত উড়ো হাওয়ায় লজ্জাবস্ত্র ছেড়ে পর্ণমোচীর মতো  দাঁড়িয়ে আছে দুই নারী।  


-সমাপ্ত- 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র