সুপর্ণা বোস - মায়াজম

Breaking

২৫ সেপ, ২০২২

সুপর্ণা বোস

  চৌকশী  







 বহুদিন পর লম্বা ট্রেনযাত্রা।হাওড়া টু পুনে।দুরন্ত এক্সপ্রেস।ট্রেনে চাপলেই ছোট্টবেলার মত ফিল হয় মীনাক্ষীর ।বাবা রেলে কাজ করতেন।  চারটে রেলের পাশ পেতেন।আত্মীয় স্বজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে সারা দেশের কোণায় কোণায়।মীনাক্ষীর বাবা মা তাঁদের আত্মীয় বন্ধুদের বড় ভাল বাসতেন।  তাঁরাও  নির্দ্বিধায় বাড়ি আসতেন এবং থাকতেন।মীনাক্ষীরাও তাদের বাড়ি গিয়েছে কতবার।ট্রেণে উঠলেই ছোটবেলার সেইসব স্মৃতি গাছের হলুদ পাতার মত ঝরে ঝরে পড়ে।


ছেলেবেলায় জানলার ধারে গুছিয়ে বসার পরেই মীনাক্ষী  জানত, ওর জন‍্যে কমিক্সের বই আসছে।বেশিরভাগ সময় ওকে সংগে নিয়ে গিয়ে প্লাটফর্মের বুকস্টল থেকে বাবা কিনে দিতেন।সারাটা রাস্তা বিভোর হয়ে সেই পড়ত । বই শেষ করে  জানলার বাইরে মাঠ ঘাটের দিকে চেয়ে থাকত।সে স্বভাব তার এখনো যায়নি।ট্রেণে বসলে এখনো একই রকম বিস্ময় বিমুগ্ধ চেয়ে থাকে।

আজ দুরন্ততে উঠে দেখল, তার বরাদ্দ লোয়ারবার্থে জানলার সামনে জাঁকিয়ে বসেছেন এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক।দেখেই মনটা খিঁচড়ে গেল ।বললো,

_"এক্সকিউজ মী।আমাদের এক আর চার" 

_আপ বইঠিয়ে না ম‍্যাডাম সিট তো খালি পড়া হ‍্যায়
ভদ্রলোক মুখে হাল্কা হাসি ফোটালেন দেখে পিত্তিশুদ্দু জ্বলে গেল মীনাক্ষীর।বিরক্ত হয়ে বললো,

_ নেহি।মেরি সিট পে হি মুঝে ব‍্যায়ঠনা হ‍্যায়।উইন্ডো সিট পে।

যাইহোক, মহিলার রুষ্টমূর্তি দেখে  ভদ্রলোক কথা না বাড়িয়ে বাঁয়ে ঘষটে গেলেন খানিক।মীনাক্ষী গিয়ে জানলার পাশে গুছিয়ে বসল।অনেকটা পথ যেতে হবে।প্রায় আঠেরোশ পঞ্চাশ কিলোমিটার।


গাড়ি ছোটে।  চোখ ছুঁয়ে যায় শালবীথি, লৌহ আকরিকের ঢিপি আর আশ্বিনের রূপটান মাখা শ্রাবণের আকাশ।এখানে সবুজ বড় ইন্ট্রোভার্ট। লাল রাস্তা আপনমনে সঙ্গ নিয়েছে।রোদের তাতে ক্রমশ রাঙা হয়ে উঠছে ধরণীর ফর্সা পিঠ।একটি বনময়না অস্থির ওড়াউড়ি করছে।মাথা ঠুকছে  শালের গুঁড়িতে।কান্নার মত ঝরে গেল কিছু শালমঞ্জরি।ও কি খবর পেয়েছে, কবি প্রবুদ্ধসুন্দর আর নেই?কষ্ট হচ্ছ খুব মীনাক্ষীর।সে নিজেও একজন কবি।নিজের মন দিয়েই সে অন‍্যের মন বোঝে।ভদ্রলোকের সাথে সম‍্যক পরিচয় এমনকি ফেসবুকেও কথা হয়নি কখনো।অথচ তাঁর কবিতা কতবার মীনাক্ষীর মন ছুঁয়েছে।মীনাক্ষী ঠিক করে ফিরে এসে তাঁর সাম্প্রতিক কবিতার বই, 'নীল উপত‍্যকার রাখাল '  সংগ্রহ করবে।  একজন কবি চলে গেলে আকাশ বাতাস বিলাপ করে।কবি ছাড়া প্রকৃতিকে কে বোঝে তেমন করে? কবি প্রবুদ্ধসুন্দরের কবিতার সাথে প্রথম পরিচিত হয়েছিল নিপুণ কবি যশোধরা রায়চৌধুরীর ফেসফুক পোস্ট থেকে।  অসাধারণ কয়েকটি কবিতা শেয়ার করেছিলেন তিনি।সেই থেকে মীনাক্ষী  প্রবুদ্ধসুন্দরের ফেসবুক  প্রফাইলে গিয়ে নিশ্চুপে কবিতা পড়েছে   বহুদিন।মুগ্ধ হয়েছে ঋদ্ধও।আজ অন্তর থেকে প্রণাম জানাল তাঁর কলমকে।

ট্রেন চলেছে নিজের মত।দিন শেষ হয়ে এলো।এখন
সন্ধে নামছে।ঝুপসি গাছেরা অন্ধকারের পুঁটলি কোলে  করে বসে আছে।কয়েকটা  সাদা বক খানিক মশকরা করে গেল।এতোক্ষণে বুঝি পাতাদের রান্নাঘরে  উনুন নিভেছে।একটা বাবলাগাছের সাথে আরেকটা বাবলাগাছ এলোচুলে পা ছড়িয়ে গল্প করছে।'ওলো,সূয‍্যি যে অস্তে গেল!চুল বাঁধলিনি?'
মীনাক্ষীর মনের মধ‍্যে কত গল্প দানা বাঁধছে।অক্ষরের শরীর চাইছে।শরীর বললেই তার মনে হয় উনুনের গনগনে আগুন।সে শরীর সে কবেই নিভিয়ে রেখেছে।কতদিন তেমন কিছুই লেখেনি সে।তবু জীবনের অন্বেষণ বন্ধ নেই।দুধের ভেতর মাখনের মত জীবনজুড়ে ব‍্যপ্ত হয়ে আছে কাহিনী।তবু মীনাক্ষী  তাদের অক্ষর দেয়নি।অলসভাবে সে চেয়ে থাকে নকশিকাঁথার মত ছড়ানো নিসর্গের দিকে।দেখতে দেখতে মনে হয় আজ যেন এক গামলা মেঘ উপুড় করে দিয়েছে আকাশ।ঝাপুর ঝুপুর বিষ্টিতে গা হাত ধুয়ে নিচ্ছে গাছেরা।দীর্ঘ সবুজের দুলুনি আর দু একটি গেরুয়াপারা নদী মীনাক্ষীকে ডেকে নিয়ে যায় ছেলেবেলায়। মনে হয় যেন, বাবা সবুজ পাতায় মিশে হাসছেন তার দিকে চেয়ে। কামরার ভিতর কি হচ্ছে সেদিকে খেয়াল নেই তার।অনিকেত মৃদু ঠেলা দিয়ে যেন জাগাল তাকে,
_ মীনু, চা খাবে? চা এসেছে।সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল মীনাক্ষী। চা খেয়ে সে আবার ডুবে গেল দৃশ‍্যরসে। 

 একসময় রাত্তির নামল।চরাচরে ছড়িয়ে পড়ল নীল রঙের দোয়াত।আধোঘুম আধো জাগোরণে মীনাক্ষী  ডুবে রইল সেই নীলের ভিতর।রাতের খাবারের পর কুপের ভিতর সব আলো নিভে গেলে আরো কিছুক্ষণ  চেয়ে রইল অন্ধকারের দিকে ।যতক্ষণ ভিতরে আলো ছিল ততক্ষণ শব্দনিরোধক কাঁচে ভিতরের ছবিগুলি ফুটেছিল।এবার বাইরের আবছায়া গাছ, ধানক্ষেত আর মাঝে মাঝে আলো ঝলমলে অথচ একা কোনো রেল স্টেশান।তার খালি বেঞ্চ তার 'পিনে কা পানির' ট‍্যাপ বড় নিঃসঙ্গ।কোথাও আবার কিছু মানুষ ব‍্যাগ বাগিচা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ট্রেণের অপেক্ষায়।এসব দেখতে দেখতে ঝিম ধরে আসে।কখন যেন গাড়ি চলতে শুরু করে।দুলুনির সাথে চোখদুটি নম্র হয়ে আসে।   একটু ঘুমোতে চাইচে মীনাক্ষী । অথচ একটা বিচ্ছিরি রকমের হাতের যন্ত্রণা  তাকে অনুমতি দিচ্ছে না।সে আর তার যন্ত্রণা পাশাপাশি জেগে আছে।দুজনে দুজনের দিকে  হেসে বলছে,' এখনো  জ‍্যোৎস্না এবং জীবন ভাল লাগে!'

ট্রেন লেট করল প্রায় চার ঘন্টা।অর্থাৎ পুনে পৌঁছতে প্রায় দুটো বেজে যাবে।আই আর টি সির লোকেরা আবার খিঁচুড়ি চাপিয়েছে।সব মিলিয়ে বেশ মজার।বাইরে একটু বৃষ্টি নামলে বেশ হতো ভাবছে মীনাক্ষী।

দেরি হোক যাইহোক যাত্রা যখন শুরু হয়েছে তখন শেষও হবেই। এক সময়  এসে গেল সাবিত্রীদেবী ফুলের শহর।পুনে।আগেও এসেছে মীনাক্ষী ।সেবার এয়ারপোর্ট চিনেছে।এবার রেল স্টেশন।চমৎকার সাজানো শহর।টগবগে চনমনে।ইয়াং পপুলেশন বেশি।বাইরে থেকে ছেলেপুলেরা পড়তে আসে।যেন সব আশার ফুল।মা বাপের প্রদীপের সলতে।মীনাক্ষীদের এবারের প্রোগ্রামে আছে সিরডির সাঁইবাবা মন্দির এবং নাসিকের ত্রম্বকেশ্বর দর্শণ। মাঝে দিন চারেক পুনেতে কাটিয়ে আবার মহাবালেশ্বর পঞ্চগনি হয়ে পুনে।এবং পরের দিন ব‍্যাক টু  হাওড়া। সবমিলেমিশে দশদিন।মীনাক্ষী আর অনিকেতের একমাত্র মেয়ে বিহু পড়ছে এখানকার কলেজে।সে হস্টেলে থাকে।মা বাবার সাথে সময় কাটাতে সেও চলে আসবে হোটেলে।সেখান থেকেই কলেজ করবে কটাদিন।সেইমত অ‍্যাপ্লিকেশন জমা করে রেখেছে কতৃপক্ষের দপ্তরে।

পুনে পৌঁছনোর পর একদিন পুনেতে থেকে পরের দিন একটা সুইফট গাড়ি ভাঁড়া করে তিনজনে    চললো সিরডি। হোটেল টোটেল নয় থাকবে সাঁই আশ্রমে। অনলাইনে ঘর বুক করাই ছিল।কিন্তু ঘর দেখে বিহুর পছন্দ হল না।    সে বলল,


_বিছানাটা দেখেছ?শুতে পারবে তো?

_বড় চাদর এনেছি।বিছিয়ে নোব ওপর দিয়ে।মীনাক্ষী সহজভাবে বলল।

_স্মার্ট লেডি!সব সলিউশান আছে তোমার কাছে! না? বিহু হাসছে।

মেয়েকে ইম্প্রেশ করতে নিপুণের ভাল লাগে।ওর বাবা যথারীতি তাড়া দিচ্ছেন

_তাড়াতাড়ি চান করে নাও নয়তো দেরী হলে  প্রসাদ পাবে না।
হ‍্যাঁ!সকলের সঙ্গে বসে প্রসাদ পাওয়াও হল।

সন্ধেবেলা সাঁইবাবার মন্দির দর্শনের অভিপ্রায়ে অটোয় চেপে বসা।মীনাক্ষী একটাই শাড়ি এনেছে।সেটাই পরেছে।বিহু লেগিন্স আর কূর্তি।রাণীরঙের কূর্তিতে কি মিষ্টি দেখাচ্ছে বিহুকে।পাক্কা তিনমাস পরে মেয়েকে দেখছে মীনাক্ষী।বাড়িতে কিকরে যে কাটে তার! সেকথা বিহুকে বলার নয়।তার মনকেমন করবে।স্নেহ যেন গলার ফাঁস হয়ে না ওঠে।



 সাঁই সমাধিমন্দির দেখতে দেখতে মীনাক্ষী  ভাবছে,     জীবন কেমন হলে মৃত‍্যুর পরে সমাধিটুকু মন্দির হয়ে যায়? আজ থেকে মাত্র একশ বছর আগে একজন মানুষ, শুধু মানুষকে ভালবেসে ঈশ্বর হয়ে গেলেন! মাত্র একটি রক্ত গোলাপে সন্তুষ্ট তিনি।করোনার জন‍্যে এখন সেটুকুও নিয়ে যাওয়াও মানা।স্টিলের ব‍্যারিকেডের ভিতর কত চক্কর কাটিয়ে তবে দোতলায় সেই শ্বেত মর্মরমূর্তি দর্শণ হল। মানুষ তার ভক্তিভাব দিয়ে জাগ্রত করেন পাথরের দেবতাকে।ঝিকমিক করে চোখের তারাদুটি।পাথর কুঁদে তৈরি ঠোঁট ভরে আছে নরম হাসির আভায়।

পরেরদিন গাড়ি বুক করে মুক্তিনাথের মন্দির।সেখানে
 রাম সীতা লক্ষণ পুজিত হন। পার্শ্ব মন্দিরে দ্বাদশ জ‍্যোতির্লিঙ্গ।আরো অনেক বিগ্রহ।মুক্তিনাথ থেকে বেরিয়ে কিছু দূর যেতে পথের বাঁকে আচমকা এক পাহাড়ের সাথে দেখা।সারা শরীরে অজস্র সবুজ জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তার পিঠের পিছন থেকে উঁকি দিচ্ছে  মেঘশিশু।যেন দুগ্ধপোষ‍্য দুধদাঁত ভাঙেনি এখনও।


ত্রম্বকেশ্বরের মন্দির যেতে বৃষ্টি নামল।একে তো শ্রাবণমাস তায়ে শিবের বার।দর্শণ করতে সাঁঝ নেবে এলো।মন্দিরের চারপাশে ছড়ানো জীবন মীনাক্ষীকে টানে। যে বৃদ্ধা কাছা দিয়ে শাড়ি পরে ফুল বেচছেন তার পাশে দুদন্ড বসতে মন করে ।শাড়ি পরার বিশেষ ধরণটি শিখতে ইচ্ছে করে।


ফিরতিপথে পঞ্চবটীর শীতল পরিসরে পৌঁছতে রাত প্রায় আটটা।কপিল নদী আর গোদাবরীর সঙ্গম দেখা হল অন্ধকারেই।মন্দিরের বাইরের দেয়ালে শিল্পকর্ম ।রাবণকে ভিক্ষা দিচ্ছেন সীতা।অন‍্যদিকে লক্ষণ সূর্পণখার নাক কান কেটে দিয়েছে।যোদ্ধাপুরুষেরা সকলেই এমন অসংবেদী হন না।ভদ্রলোক অভদ্রতার শেষ সীমায় পৌঁছে গেলেন।যাইহোক,এই   নাসিকা ছেদনের কারণেই জায়গার নাম নাসিক।

সারাটা দিন অসাধারণ কেটেছে।ডেকানের সংযমী উচ্চতায় পর্যাপ্ত সবুজ।গেহু গন্না আর মকাইয়ের সওগাত।কালোনুনিয়া ধানের স্তুপের মত খনিজ পাহাড়। সম্পদশালিনী দেশ আমাদের।কেবল সন্তানেরা অমানুষ বলে মায়ের চোখের জল শুকোয় না। 

পরের দিন খুব ভোরে নাসিক থেকে বাসে পুনে ফেরৎ।

মাঝে কয়েকদিন পুনেতে বিশ্রাম এবং রয়ে বসে আরাম করে পুনের দ্রষ্টব‍্য স্থানগুলি দেখে নেওয়া।মাঝে বিহুর ক্লাস চলবে কলেজে।এই ঘোরা গুলো কেবল নিপুণ আর অনিকেতের। বিহুকে হস্টেলে রেখে ওরা ফিরে এলো হোটেলে।


খুব ভোরে ঘুম ভাঙতেই হোটেলের চারতলার ঘরের ভারী পর্দাগুলো সরিয়ে দিল মীনাক্ষী।অনিকেত তখনো ঘুমোচ্ছে।কাচের বাইরে,মায়ের আদরের মত নরম আলো মেখে ঘুমিয়ে রয়েছে শহর।যেন আদুরে কিশোরী।তিনি একটু লেট রাইজার।পশ্চিমের এই শহরে সকাল এবং সন্ধে উভয়ই একটু দেরিতে আসে।

রুমের ভিতর টেবিলে একটি ইলেক্ট্রিক কেটল্ এবং চা বানাবার সরঞ্জাম গুছিয়ে রাখা আছে।এককাপ চা বানিয়ে আয়েস করে বসতেই বেশ স্ট্রেস ফ্রী লাগল।

 অতিমারির কারণে অনেকগুলো দিন, সমূহ বদ্ধতা ও উৎকণ্ঠায় কেটে গেছে।এখনো যদিও মাস্ক এবং স‍্যানিটাইজার সর্বক্ষণের সঙ্গী।তবু এই অচেনা শহরের অচিন আলোয় কোনো মহাশক্তির প্রতি কৃতজ্ঞতায় চিত্তটি পূর্ণ হয়ে উঠল মীনাক্ষীর ।নিস্তব্ধ ঘরের ভিতর মীনাক্ষীর  মনের মধ‍্যে প্রার্থনার মত গুঞ্জে উঠল গান   ।" আমায় অনেক দিয়েছ নাথ/তবু বাসনা আমার পুরিল না"।এই রূপ রস গন্ধ স্পর্শের পৃথিবী দুহাত বাড়িয়ে ডাকে।কাচের বাইরে একটা নতুন দিন উপহারের মোড়ক খোলার মতই অতি ধীরে নিজেকে প্রকাশ করছে। মুগ্ধ হয়ে রইল সে বহুক্ষণ।

আজ ঠিক করেছে,পেশোয়াদের নিবাসস্থল,
'শণিবারবাড়া ' দেখতে যাবে।স্থানীয় ভাষায় বাড়া শব্দের অর্থ ইমারত বা বাড়ি।সতেরোশ বত্রিশ সালের দশই জানুয়ারি,শনিবারে এই দূর্গের বাস্তুপূজা হওয়ার কারনেই এই নামকরণ।পরবর্তী সময়ে মারাঠা রাজনীতি ও ক্ষমতার কেন্দ্রে পরিনত হয় এই ইমারত।

   বেলা দশটা নাগাদ একটা অটোরিক্সা নিয়ে শনিবার ওয়াড়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল দুজনে।পৌছে গেল সৌধটির মূল ফটকের সামনে।যার নাম দিল্লি দরওয়াজা। চওড়ায় চৌদ্দ ফুট এবং লম্বায় একুশ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট এই দরজার মাঝখানে অজস্র তিক্ষ্ণ লোহার ফলা ঝাঁকেঝাঁকে উঁচিয়ে রয়েছে।যার উদ্দেশ‍্য, শত্রুপক্ষের হাতি, যাতে কনোভাবেই মাথা দিয়ে ধাক্কা মেরে দরজা ভাঙতে না পারে।উত্তরমুখী এই দরজা পেশোয়া প্রথম বাজীরাওয়ের দিল্লিবিজয়ের স্বপ্নের দ‍্যোতক।

এই বিশাল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কেমন যেন ঘোর লেগে যায় মীনাক্ষীর।কল্পনার চোখে দেখতে পায়।অপরাজেয় সেই রাজপুরুষ প্রতিবার যুদ্ধ জয় করে এই দরজা দিয়ে প্রাসাদে ফিরতেন।কল্পনায় ভেসে ওঠেন পেশোয়া প্রথম বাজীরাও। যোদ্ধাপুরুষ।ছয় ফুটের ওপরে উচ্চতা।আজানুলম্বিত বাহু।নীলা,গঙ্গা, সারঙ্গা অথবা ওলক নামের প্রিয় ঘোড়াগুলির মধ‍্যে যেকোনো একটির ওপর আসীন।

প্রথম বাজীরাও ছিলেন অত‍্যন্ত সমরকুশলী নেতা।তাঁর পিতা বিশ্বনাথ রাও এর মৃত‍্যুর পর মাত্র কুড়ি বছর বয়েসে ছত্রপতি শিবাজীর পৌত্র শাহু কতৃক পেশোয়া পদে নিযুক্ত হন ।শোনা যায়, তিনি তাঁর উনচল্লিশ বছরের জীবিতকালে একচল্লিশটি যুদ্ধ করেছিলেন এবং প্রতিটি যুদ্ধেই  জয়লাভ করেন।   এগারো বছর বয়সে,সাত বছরের কাশীবাই এর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়।তাঁদের তিন পুত্র ,   নানাসাহেব ।রঘুনাথ রাও এবং  জনার্দন রাও।এছাড়া বুন্দেলখন্ডের রাজা ছত্রশালের কন‍্যা মস্তানিবাইকেও বিবাহ করেন তিনি। তাঁদের পুত্রের নাম শামসের বাহাদূর।পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে মারাঠাদের পক্ষে যুদ্ধে তাঁর মৃত‍্যু হয়। প্রথম বাজিরাওয়ের পিতার নাম বালাজী বিশ্বনাথ এবং মাতার নাম শ্রীমতি রাধাবাই। সহধর ভাই চিমাজীআপা তাঁকে পেশোয়াকর্মে সহায়তা করতেন।তিনিও একজন প্রথম সারির সামরিক নেতা ছিলেন।

    প্রথম বাজীরাও সাসোর থেকে পেশোয়াকার্য পরিচালনা করতেন।পরবর্তীতে পুনেতে বসবাসের উদ্দেশ‍্যে 1730 সালে শণিবার ওয়াড়া   দূর্গের নির্মাণকার্য শুরু করেন।এটি সম্পূর্ণ হতে দু বছর সময় লেগেছিল।ইমারতটি নির্মাণ করতে জুনারের জঙ্গল থেকে সেগুন কাঠ,জেজুরির চুন বেল্ট থেকে চুন আসে এবং পাথরও ব্যবহার করা হয়।দূর্গের দেয়ালগুলিতে মহাভারত এবং রামায়ণ মহাকাব্যের নৈসর্গিক সৌন্দর্যকে চিত্রিত করা হয়েছিল।এবং পারস‍্যের মার্বেল দিয়ে মেঝে প্রস্তুত করা হয়।সাততলা ইমারতটির বেশিরভাগ অংশ কাষ্ঠ  নির্মিত।সেকারণেই পরবর্তীকালে ইংরেজরা দূর্গটিকে পুড়িয়ে খাক করে দিতে সমর্থ হয়।এখন আমরা যেটুকু দেখতে পাই তা দূর্গের ধ্বংসাবশেষ।যাইহোক যেটুকু রয়ে গেছে তার মধ‍্যে দূর্গের আরেকটি মনোগ্রাহী বস্তু হল,  অবশ্যই ষোল-পাপড়ির পদ্ম-আকৃতির ঝর্ণা যা সেই যুগের সুবর্ণ সময়ের প্রতীক। এটি হাজারী করঞ্জে নামেও পরিচিত। এছাড়াও দূর্গের সৌর্য_স্মৃতি হিসেবে দুটি কামান দেখতে পাওয়া যায়, একটি  প্রবেশদ্বারে  এবং অন‍্যটি দুর্গের ভিতরে।এছাড়া আছে প্রথম বাজীরাও এর একটি অশ্বারোহী প্রস্তরমূর্তি।

 দিল্লি দরওয়াজা ছাড়াও এই ইমারতের আরো চারটি দরজা আছে।গনেশ দরওয়াজা,যার পূব দিকে একটি গনেশের মন্দির থাকার কারনেই এই নাম।দ্বিতীয়টি মস্তানি দরওয়াজা।পেশওয়া প্রথম বাজীরাওয়ের দ্বিতীয় পত্নী মস্তানিবাঈয়ের বাসস্থান শণিবারবাড়ার বাইরে ছিল।তিনি দেখা করতে এলে এই দরজাটি ব‍্যবহার করতেন।এছাড়া আরো দুটি দরজা আছে,যথাক্রমে জাম্বাল এবং খিড়কি দরওয়াজা।জাম্বাল দরজাকে নারায়ন দরজাও বলা হয়।কারন, প্রথম বাজীরাওয়ের পৌত্র,অর্থাৎ নানাসাহেবের কনিষ্ঠপুত্র নারায়ণরাওয়ের মৃতদেহ এই দরজা দিয়ে নিয়ে গিয়ে নদীতে বিসর্জন দেওয়া হয়। পেশোয়া নারায়ণরাও হত‍্যার বিধুর ও ভৌতিক ইতিহাস আজও অসংখ্য পর্যটককে টেনে নিয়ে যায় প্রায় 625 একর জুড়ে অবস্থিত দূর্গটির  ধ্বংসাবশেষের ভিতর।আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে সেই করুণ কাহিনী।

গাইডের মুখে ইতিহাস শুনতে শুনতে মীনাক্ষীর মনে হয় মানুষের নিরাপত্তার বোধ তাকে গৃহবাসী করে।অথচ কখনো এমনই নিয়তির পরিহাস, ঘরের ভিতরেই সে সবথেকে বেশি অরক্ষিত এবং বিপন্ন।

নানাসাহেবের তিন পুত্র।বিশ্বাস রাও,মাধবরাও এবং নারায়ণরাও।পানিপথের যুদ্ধে  বিশ্বাসরাও মারা গেলে পুত্রশোকে নানাসাহেও আর বেশিদিন বাঁচেননি।মেজছেলে মাধবরাও পেশোয়াপদ লাভ করেন।তিনি এগারো বছর সফলভাবে রাজ‍্য পরিচালনা করেন।যক্ষারোগে তাঁর মৃত‍্যু হলে মাত্র সতের বছর বয়েসে নারায়ণ রাও পেশোয়াপদে আসীন হন।  নাবালকত্বের কারণে তাঁর কাকা নারায়ণরাও ব-কলমে সাম্রাজ্য পরিচালনা করতেন।তিনি এবং তাঁর পত্নী আনন্দীবাঈ ছিলেন ক্ষমতালিপ্সু ও নিষ্ঠুর।কথিত আছে তাঁদেরই ষড়যন্ত্রে এক অমাবশ‍্যার রাতে শণিবারবাড়া প্রাসাদের মধ‍্যেই নারায়ণরাও আততায়ীদের হাতে নিহত হন।স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস আজও তার আত্মা দূর্গের ভিতরে " কাকা মালা বাচাওয়া"অর্থাৎ "কাকা আমাকে বাঁচাও" বলে আর্তনাদ করে ফেরে।যে দরজা দিয়ে বার করে নিয়ে গিয়ে তাঁর দেহ নদীতে ভাসান হয় সেই দরজার নাম নারায়ণ দরওয়াজা।এখানে এসে মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। সারাদিন প্রায় সেখানে কাটিয়ে তুলসীবাগ মার্কেটে কেনাকাটা করে এবং লাঞ্চ করে মীনাক্ষী  ও অনিকেত হোটেলে ফিরে এল।আজ রাতেই বিহু চলে আসবে হস্টেল থেকে।আগামীকাল ভোরে তারা রওয়ানা দেবে মহাবালেশ্বরের জন‍্যে।


স্বরগেট বাস টারমিনাস থেকে বাস ছাড়ল সকাল ন টা ছেচল্লিশে।    বেশ ভাল বাস সার্ভিস।জানলার ধারে চম‍ৎকার সিটও মিলেছে।  বাস ঘুরে ঘুরে পাহাড়ে উঠতে থাকে।মেঘলা আকাশ।সবুজ পাহাড়।চমৎকার পিচের রাস্তা।একটা পাথুরে টানেলের মধ‍্যে দিয়ে যাচ্ছে বাসটা।ঘুটঘুটে অন্ধকার বেশ কিছুটা পথ।বিহু ঘুমে ঢুলে পড়ছে মায়ের কাঁধে।  জানলা দিয়ে ঝাঁপিয়ে আসা হাওয়া ওর চুল নিয়ে দাপাদাপি করছে।পাহাড়ের কাঁধের ওপর মেঘশিশুরা এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে।চারিদিকে বেড় দিয়ে অনুচ্চ পাহাড়।মাঝে একটা টলটলে ঝিল।রোদ পড়ে হীরা মানিকের মত জ্বলছে।যেন কার জারদৌজি শাড়ির মহার্ঘ আঁচল।মীনাক্ষীর মনে হয় এমন জায়গায় কংক্রিটের কন্স্ট্রাক্শন সৌন্দর্যের মহতী বিনষ্টি। সরকারী অনুমতি পাওয়া উচিত নয়।প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে ঢেকে দিচ্ছে মানুষের মূর্খামির অহমিকা। 

 দিনট া মোটের ওপর ঝলমলে হলেও আকাশে শ্রাবণমেঘ মেষপালকের মেষের মতই সঞ্চরমান।মীনাক্ষীর বুকের মধ‍্যে একটা পোষা বিষাদ আছে।এইসব সুন্দরদিনে কেন জানি মনেমনে  সেটাকে স্ফটিকের কচ্ছপের মত কোলে নিয়ে আদর দেয় সে।কল্পনা করে বিষাদের হাত ধরে ঢুকে পড়ছে কোনো ফরাসী অধ‍্যুষিত মশ আর শ‍্যাওলা ঢাকা প্রাচীন রিসোর্টে।যেখান থেকে কেউ তাকে খুঁজে পাবে না।

মহাবালেশ্বরে চারাশে বৃষ্টিবন। মাঝে মেঘ-লপেট পিচরাস্তা।এপাশে ওপাশে শিরা উপশিরার মত কিছু পায়ে চলা পথ।জঙ্গল যেন গাছের জাল।

শঙ্কর ভগবানের মন্দির মহাবালেশ্বরের পুরণো মন্দির।বৃষ্টি হচ্ছে খুব।ছাতা মানছে না।মন্দিরের ভিতর শিবলিঙ্গ।ড্রাইভার বললেন ইঁহা পে চার পয়েন্ট হ‍্যায়।দেখ কে আইয়ে। হাম ইধারই খড়া হ‍্যায়।"

মহাবালেশ্বর মন্দির থেকে একটু এগোলে মহাবকেশ্বর মন্দির।কালো পাথরের অসাধারণ মনদির।বহু পুরণো।লোকাল লোকজন বললো পাঁচ হাজার বছরের পুরণো।পান্ডবরা ঘুরতে ঘুরতে এখানে এসেছিলেন।আবার কেউ বললেন, শিবাজী মহারাজ এই মন্দিরটি নির্মাণ করেন।

সেখান থেকে কয়েক পা এগোলে পঞ্চগংগা মন্দির।কথিত আছে পাঁচ নদীর জল মিশেছে এখানে।সাবিত্রী গংগা কোয়েনা বেন্না কৃষ্ণা।


 

সেখান থেকে বেরিয়ে আবার বনপথ।জাম্বুল গাছের জাল।গাছে গাছে কেমন বন্ধুতা।মানুষ কি পারে এভাবে আঁকড়ে থাকতে?

এবার গন্তব‍্য, কৃষ্ণা নদীর ওপর দুম ড‍্যাম।জায়গার নাম ইকো পয়েন্ট। চারটে পয়েন্ট আছে এখানে।  Kate's point, Needle's  hole point,  Echo point এবং Elephant's head point.এখানে রোস্টেড সুইটকর্ণ খাওয়া হল ।বৃষ্টি একটু ধরেছে।গাড়ি চলল স্ট্রবেরি ফার্মের দিকে।
d_lite strawberry firm কাম রেস্তোরাঁ।D-Lite.সেখানে বসে স্ট্রবেরি আইসক্রিম আর মিল্কসেক খেল ওরা।  স্ট্রবেরি প্লান্টগুলো বেশ ছোটছোট।মাটি থেকে দেড়হাত মত উচ্চতা হবে।খুব যত্নকরে সারবন্দিভাবে লাগানো হয়েছে।সবুজ পাতায় ছেয়ে আছে।তবে ফল নেই এখন।ফলের সময়টা হল এপ্রিল নাগাদ। সম্ভবত বাঁদরের হাত থেকে বাঁচাতে গাছগুলির ওপর মশারির শামিয়ানা টাঙানো হয়েছে।এখানে কিছুটা সময় কাটিয়ে আবার উঠে পড়ল গাড়িতে।পরবর্তী গন্তব‍্য ভেন্না লেক।


চমৎকার লেক।বর্ষায় টলটলে জল ঈষৎ ঘোলাটে।সারি সারি বোট বাধা আছে পাড়ে।জলের আঘাতে দুলছে।বৃষ্টি পড়ছে রিমঝিম।এখানে বেশকিছু ঘোড়া বাঁধা আছে পথের ধারে।বৃষ্টি না পড়লে বিহু নির্ঘাৎ ঘোড়সওয়ারি করতে বায়না ধরত।

ড্রাইভারসাব বললেন, 

_আভি হাম গনপতি মন্দির লে চলেঙ্গে।উঁহা সে আপ গাইড লে কে উপর মে টেবল ল‍্যান্ড প্লেটু পয়েন্ট দেখ কে আ জানা। 


গনেশ মন্দিরের সামনে থেকে একজন গাইড নিল ওরা।পাহাড়ি লোক।পেটানো চেহারা।দু কিলোমিটার পাহাড়ে চড়লে তার ওপর এক মস্ত বড় প্লেটু।যাকে বলা হচ্ছে টেবল ল‍্যান্ড।অনি উঠে যাচ্ছে।বিহু বুট পরেও উঠে যাচ্ছে তরতরিয়ে।মীনাক্ষী হাঁফিয়ে পড়ছে দেখে গাইড এসে হাত ধরল। যত্ন করে নিয়ে গেল পাহাড়পথ।বনপথে ছড়িয়ে আছে রিঠাফল।মীনাক্ষীর ইচ্ছে করছে দু একটা তুলে নিতে।

উপরে পৌঁছে সত‍্যিই চোখ জুড়িয়ে গেল।কুয়াশা আর মেঘ না থাকলে পুরো অঞ্চলটা দেখা যেত।গুঁড়ো বৃষ্টি আর প্রচন্ড হাওয়া।খানকতক ছবি তোলা হল।তারপর আবার ফিরতি উৎরাই।এই জায়গার নাম কিনচর প্ল‍্যাটো পয়েন্ট।

ভেন্না নদীর ওপর লিঙ্গমালা জলপ্রপাতের দিকে হাঁটছে ওরা।প্রায় 750 মিটার দূরের লাল পাথরের সিঁড়িপথ। কষ্ট হচ্ছে মীনাক্ষীর ।নিজের নীল রঙের স্নিকারের দিকে চেয়ে আছে।হাঁটু ঘিরে থাকা নীল ড্রেসের কিনার দেখছে আর  মনে হচ্ছে শুরুর দিকে তার মা আর শেষের দিকে  বাবা দুহাত বাড়িয়ে রয়েছে।প্রপাতের শব্দের সাথে মিশে যাচ্ছে তার  শ্বাসের শব্দ।এক পা এক পা করে নেবে যাচ্ছে ক্রমশ।বাঁ পায়ের কড়ে আঙুলটা অল্প বেঁকে যাচ্ছে জুতোর নরমের ভিতর।মাথার ওপর মিহি নুনের মত বৃষ্টি। গাছগুলি শক্তকরে ধরে রেখেছে পরস্পরের হাত।অনিকেত নেবে যাচ্ছে কয়েকধাপ আগে।মানুষ পারে না গাছেদের মত করে হাতে হাত জড়িয়ে থাকতে।

মাটিধোয়া গেরুয়া জলে ছপ ছপ করে পা পড়ছে। সেই ছেলে বেলার মত নির্ভার।

লাল নুড়িকে ঘিরে ঘিরে নৃত‍্যরত জল বয়ে যাচ্ছে।লাফিয়ে পড়ছে লাস‍্যে বয়ে যাচ্ছে প্রগলভ।

কতকিছু দেখা হল।কতকিছু হল না।তারজন‍্যে দুঃখ নেই।কারণ মীনাক্ষীর  এই ভ্রমণ আসলে টিপিকাল ভ্রামণিকের ভ্রমণ নয়।ছাপোষা গেরস্থের বেড়িয়ে ফেরা।একঘেয়ে জীবনে কিছুটা বৈচিত্র নিয়ে আসা।এবারে অবশ‍্য মূল উদ্দ‍্যেশ‍্য ছিল পুনেতে মেয়ের সাথে দেখা করা।লকডাউনের অভিশাপ পেরিয়ে এতোদিনে মেয়ে কলেজে এসেছে।সেও প্রায় তিনমাস হয়ে গেল।মেয়ের সাথে দেখা হল।ভ্রমণও হল।কত কিছুই তো দেখা হল।আবার কতকিই হল না।জলপ্রপাত দেখা হল।মন্দির দেখা হল।বেশকিছুটা চড়াই উঠে   টেবল ল‍্যান্ড দেখা হল।এদিকে কাস প্লেটু আর তার ফুল-প্রজাপতির উপত‍্যকা দেখা হল না।শুনেছে,2012 সালে এই জায়গাটিকে ইউনেসকো হেরিটেজ হিসেবে ঘোষনা করে।অগাষ্ট থেকে অক্টোবর এটি ঘুরে দেখার আদর্শ সময়।দেখার ইচ্ছে ছিল ' দেবরাই আর্ট ভিলেজ'।এটি একটি অলাভজনক উদ‍্যোগ।প্রকৃতি ও সৃজনীপ্রতিভার মধ‍্যে যোগসৃষ্টির উদ্দ‍্যশ‍্য‍ে কাজ করা হয়।
যা হল না।তা হল না।যেটুকু হল সেও বড় কম তো নয়।যাইহোক,পঞ্চগনিতে এক রাত্তির থেকে পরেরদিন বাসে করে পুনে রিটার্ণ। এবং পুনেতে একদিন থেকে পরদিন দুপুরে হাওড়ায় ফেরা।

মেয়েকে ছেড়ে আসতে হবে তাই মীনাক্ষী  আর অনিকেত দুজনেরই মন খারাপ।তবুও মেয়ে দিব‍্যি ভাল আছে হস্টেলে।নিজের পড়াশোনা সামলাচ্ছে দেখে ভাল লেগেছে।মন শান্ত হয়েছে বৈকি।হোটেলের রুমের নির্জনতায় হঠাৎকরে দুজনে একসংগে বলে উঠেছে, " আমাদের মেয়েটা বড় হয়ে গেল!তাই না?" 
পরেরদিন দুপুরে হাওড়া ফেরার ট্রেন।অটো নিয়ে পুনে স্টেশনে ঢুকতে ঢুকতেই প্লাটফর্মে ট্রেন ঢুকে পড়ল।

দুরন্ত এক্সপ্রেসে পুনে থেকে হাওড়ায় ফেরা।স‍ত‍্যি বলতে কি,দুরন্ত নামের দীর্ঘদেহী ট্রেনটি তার নামের সমস্ত গরিমা ধুলিস‍্যাৎ করে দিয়ে যে হারে চলছে তাতে তার নাম ঘুমন্ত হলেই যথার্থ হত। হাওড়ায় পৌঁছনোর নির্ধারিত সময় থেকে  ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে।সহযাত্রী একজন যুবতীর সঙ্গে আলাপ হয়েছে মীনাক্ষীর ।নদিয়ার বাংলাদেশ বর্ডারের কাছে বাড়ি।ছমাস হল বিয়ে হয়েছে।গত তিনমাস পুনেতে স্বামীর কাছে এসে থাকছিল।অন্তসত্ত্বা হবার পর সে নদিয়ায় মায়ের বাড়িতে যাচ্ছে।স্বামী এখানে কোনো হোটেলে বেয়ারার কাজ করেন।ভারি মিষ্টি মেয়েটি।তার ভাইব্র‍্যান্ট হলুদ ওড়নার মতই চনমনে তার কথাবার্তা।অনেকটা সময় সে তার স্বামীর সাথে ফোনে কথা বলতে লাগল।যেকোনো সপ্রেম কথাবার্তায় মীনাক্ষীর  শ্রবনেন্দ্রীয় অতিসক্রিয় হয়ে ওঠে। সেসব প্রেমভাষ‍্য কর্ণকূহরে গিয়ে হয়ত মস্তিষ্কে কিছু রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটালো কেন জানি দুকলম লিখতে মন হল তার।কয়েক পংতি আঁক পড়ল সাদা পাতায় পেন্সিলে।


        অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করলে 

        আমি একটি কথাই বলি, ' ভালবাসা '

        এই স্তোত্রমুখরতায় পাঁজরে পুষে রাখা

        মনকেমন আর রক্তগোলাপের সুগন্ধ


        দেবভূমি প্রদক্ষিণের কালে ভালবাসা                  জপ করে চলি...


 নৈশ আহারের পর,রাত্রি দশটায়  যাত্রীগন যে যার মত মোবাইল ঘাঁটছিলেন।গুটিকতক সহযাত্রীর  পারস্পরিক আলাপের মৃদু শব্দ আসছিল।রাত কিঞ্চিত অগ্রবর্তী হলে আই আর টি সির খাবার খেয়ে তাদের দেওয়া সাদা চাদর সিটের ওপর বিছিয়ে এবং অন‍্য চাদরটি নাক পর্যন্ত টেনে দিয়ে প্রায় সকলেই শুয়ে পড়লেন।  কামরার ভিতরের আলো নিভে যেতেই কাঁচের বাইরের দৃশ‍্যপট তার অপার সৌন্দর্য নিয়ে প্রকাশিত হল।গাছপালা মাটি আকাশ আর দূরের আলোকবিন্দুগুলি কিই এক ছন্দে ক্রমাগত সরে যেতে থাকল। শুয়ে শুয়ে সেই দিকেই চেয়ে রইল মীনাক্ষী।   রাত আরেকটু বাড়লে   ট্রেন খানিক হিক্কা তুলতে তুলতে এগোতে লাগল। কখনো আবার কোনো আলোকিত রূপসীস্টেশনে এসে থামলে  আর চলতেই চায় না। খানিক আবিষ্ট থেকে আবার চলে। যাত্রীদের মধ‍্যে দু একজন কদাচিৎ উঠে টয়লেটে যাচ্ছেন।কেউ পাশ ফিরছেন।মীনাক্ষীর নির্ঘুম চোখে জেগে উঠছে পুনের পেশোয়াদের বসতবাড়ি।তার জমকাল প্রবেশপথ।  হাজারি করঞ্জে ফোয়ারা।মস্তানিবাঈ আর প্রথম বাজীরাওয়ের ভালবাসার গল্প।গাইডের বলা গল্পের তানাবানায় তার মস্তিষ্ক তখন অ‍্যাম্পিথিয়েটার। মীনাক্ষী  অন্ধকারে চোখ সইয়ে আবার দুচার পংক্তি লিখল।


এমন চাঁদের রাতে,

জল আর মাটি যথাযথ মিশে গেলে 

কি ভীষণ রক্তারক্তি! নাকি রাগমোচন! 

এইমতো ঢলাঢলি শালবন আর রাঙাপথ ডাকছে আমায়।

কিই অপরূপ  এই বৃক্ষবাসর।

আহা মেঘ! ওহো মেঘ! আমাকে কহিছে শ‍্যাম কথা...


  এটুকু লিখে, উঠে বসে বোতল থেকে দুঢোক জল খেয়ে চাদর টেনে শুতেই দেখে, মেঝের ওপর একটি নধর আরশোলা নাইট ওয়াকে বেরিয়েছে।রিফ্লেক্সে আর্তনাদ করতে গিয়েই সামলে নেয় সে।
 সাদা চাদরে নিজেকে আপাদমস্তক এমন মুড়ে ফেলে যেন মর্গস্থ মড়া।আশ্চর্যজনকভাবে কিছুক্ষণের মধ‍্যে ঘুমিয়েও পড়ে ।সকালে ঘুম ভাঙলে দেখে আইআরটিসি টেবিলে রেখে গেছে গরমজল টিব‍্যাগ আর দুধচিনির পাউচ।

আর কয়েকটা ঘন্টা।তারপরেই আবার গতানুগতিক জীবন।তারমধ‍্যেই ছোটছোট দ্বীপের মত জেগে থাকবে এইসব ভ্রমণের স্মৃতি।ভ্রমণ মানে কেবল বাইরে বেড়ানো নয়।নিজের ভিতরেও হেঁটে যাওয়া ক্রোশপথ।নিজেকেও দেখা এবং অন্বেষণ করা।নিজের মনের জানলায় উঁকি দিয়ে অনুসন্ধান করা।' চৌকশী' একটি মারাঠিশব্দ।যার অর্থ 'অনুসন্ধান'।।



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র