মানসী কবিরাজ - মায়াজম

Breaking

২৫ সেপ, ২০২২

মানসী কবিরাজ

 লক্ষ্মণরেখা



ই তো সেদিনও আমার হাত দুটো নিজের মুঠোয় নিয়ে হাঁটতে চেয়েছিল সে । অদ্ভুত একটা বৃষ্টি গন্ধে ভরে গেছিল আমার শহর ।বাইপাসের ধারে বড় বড় জারুল গাছগুলোর গা বেয়ে গড়িয়ে নামছিল আশাবরী রাগ । কৃষ্ণচূড়ার চিরল চিরল পাতারা ঝরে পড়ছিল রাস্তায় আর তারই মধ্যে বুক-পকেটে ফ্লুরোসেন্ট আলো মেখে আমার হাত ধরে দাঁড়িয়েছিল সে । আচমকা পরাশর- কুয়াশা এসে ঢেকে দিল আমাদের হাঁটার অভিমুখ অথচ যোজনগন্ধা হওয়া হল নাআমার ! স্নান সেরেই , সে তার বৈঠাখানা ছুঁড়ে ফেলে দিল জলে , জলের অতল থেকে ফিনকি দিয়ে ভেসে উঠল নিষ্ঠুর বুদ্বুদ আর সে , নির্বিকার সাঁতারে উঠে পড়ল পাড়ে । গা থেকে মুছে ফেলল ভেজা সংলাপ । তেজস্ক্রিয় লক্ষ্মণরেখা পেরতে না পেরতেই আমার আঁচল থেকে গড়িয়ে পড়ে গেল লেবু ফল । সমস্ত সুগন্ধ ছানা কেটে গেল । আচ্ছা আমি কে ! আমি কী বাতিল প্ল্যাটফর্মে বসে থাকা জন্ম বাউন্ডুলে নাকি পুজো শেষে পাকুড়তলায় ফেলে আসা মাটির প্রতিমা যার পাটের চুলের ডগায় জমে গেছে রাশি রাশি ধুলোদের ভীড় ,উপোষী চাঁদ চেটে খায় যার শাড়ির আঁচল। কে আমি ! যে আমাকে এভাবে মাঝরাস্তায় ফেলে রেখে চলে যাওয়া যায়! আমার সমস্ত জানালা ঝাপসা হয়ে আসে ক্রমশ । বাদাবনের বাঘ তার ডোরাকাটা রঙের ভিতরে আস্তে আস্তে গিলে নেয় আমার গল্প । আমার ধমনীর ভিতরে নিঃশব্দে ফেটে যায় রক্তকণারা , বুকের মধ্যে ঝুপ ঝুপ করে ভেঙে পড়ে মাটি আর আমার ভিতরের ঘরে দাঁড়িয়ে থাকে এক অনন্ত বধির , কালোয়াতির ধারণা যে জীবনেও পাবে না কখনও আর ।
আর আমি আমি জানি জানি / চোরাবালি কতখানি / গিলেছে আমাদের রোজ / আর আমি আমি জানি জানি/ প্রতি রাতে হয়রানি / হারানো শব্দের খোঁজ ……” কী খুঁজি আমি ! ভিতরের মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে বাইরের মেয়েটি । সামনে তার অনন্ত আয়না । আয়না নাকি ভারী সত্যবাদী ! যে আয়না আইলাইনার উজিয়ে পড়ে নিতে পারে চোখের ক্লান্ত বলিরেখা ,সেই আয়না কী পড়ে নিতে পারে আমার ভিতর- মেয়েটির পর্যটন ! না না বাইরের আমার নয় , আমার যে ভিতর-মেয়েটি , সব বেড়াজালের মধ্যেও শ্বাস নেওয়া যে মেয়েটি । তার নিজস্ব ভ্রমণের দিনলিপি পড়তে পারে সেই আয়না !
হাওয়া-মোরগের ডানায় সন্ধ্যা নেমে আসে আমার শহরে। উপচে পড়ে রাস্তা জুড়ে ঘরমুখী মানুষের ভিড় । টোটোতে খুচরো গুনে নেয় চালক। চায়ের গুমটিতে ঢুকে পড়ে এলোমেলো পায়ের শব্দরা । পতঙ্গরা ঝাঁপিয়ে পড়ে শাঁসালো আলোক শিখায় । আমি দূরে দাড়িয়ে দেখি ধূপকাঠির ধোঁয়ার মতো কিছুটা মনখারাপ ছড়িয়ে একাই উড়ে যাচ্ছে ম্যাজিক কার্পেট । দেখতে দেখতে একটা বিভ্রমে ঢুকে পড়ি আমি। ভুলে যাই নিজের নামটাই । নাম ভুলে বা খুলে যাওয়ার পর থেকে বাড়ির রাস্তাটাও আমার মনে পড়ে না আর । আদৌ বাড়িটা ছিল কিনা সে বিষয়ে আমি যথেষ্ট সন্দিহান হয়ে পড়ি , বা থাকলেও সেই বাড়িতে বাগান ছিল কিনা , বাগানে গত বর্ষায় পঞ্চমুখী জবার যে ডালটা লাগানো হয়েছিল তার শিকড় বেরিয়েছে নাকি , সাদা গোলাপটার গোড়ার মাটি আলগা করা হয়েছে কিনা, বাগান সংক্রান্ত এসব কিছুই মনে পড়ে না আমার…
শুধু সরু সুতোর মতো আবছা আলোয় টের পাই দোপাটি গাছের পাতায় একটা শুঁয়োপোকা রোদ মাখছে । আর আমি প্রতীক্ষা করছি ঐ শুঁয়োপোকাটা অনায়াসে সবগুলো জীবন বৃত্ত পেরিয়ে একদিন ঠিক ফুল-ছাপ প্রজাপতি হবে । তবে সেই প্রতীক্ষর মধ্যেও বেশ কিছু গড়মিল আছে , যেমন কোনও দুষ্টু এবং নিষ্ঠুর শিশু, (আসলে ছোটোরা অজান্তেই নিষ্ঠুর হয় আর বড়রা জেনেশুনে) প্রজাপতিটাকে ধরে কাঁচের গ্লাস চাপা দিয়েছে আর আমি পরিষ্কার মনে করতে পারছি বাঁচার জন্য ওর পাখনার থিরথিরে আকুতি।অথচ নিজের নাম বা বাড়ির রাস্তা কিছুতেই মনে পড়ছে না আমার ।তারপর থেকেই আমি কেবলই হাঁটছি, ধুলো এবং কালো ধোঁয়ায় ভরা শহর, শহর ভর্তি যান-জট আর মিছিল পিছনে ফেলে হাঁটছি আমি, হাঁটতে হাঁটতে পুড়ে যাচ্ছে পা ঝলসে যাচ্ছে গা যেন আমি এক আস্ত চলমান টেরেকোটা… চলতে চলতে খোঁজার ক্রমান্বয় নিচ্ছি সাজিয়ে । বাড়ি না নাম , নাম না বাড়ি !
আমার দুচোখ জুড়ে ঘুম… ঘুমের ভিতরে নাম আর বাড়ির লুকোচুরি …..

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র