নন্দিতা মিত্র - মায়াজম

Breaking

২৫ সেপ, ২০২২

নন্দিতা মিত্র

 

হায়দ্রাবাদের অস্তমিত নবাবী গরিমা 





পাহাড় আর সমুদ্রের পাশাপাশি ইতিহাসও আমায় বরাবর টানে। কারণ ইতিহাসের একটা নিজস্ব আকর্ষণ আছে, আছে অদ্ভুত একটা তলিয়ে যাওয়া বোধ। চট করে বর্তমানের সমস্যা থেকে পালিয়ে যাওয়া যায় বলে ইতিহাসের প্রতি আমার বরাবরের দুর্বলতা। অতীতের কুয়াশামাখা ইতিহাসের পাঁজর দেখতে ভালো লাগে। বুকের ভিতর একটা রোমাঞ্চ অনুভব করি। এই গা-ছমছমে অনুভূতি নিয়ে নিঃশব্দে ঘুরে বেড়ানোর মজাই আলাদা। এই টানেই চলে এলাম নিজামের শহরে। হ্যাঁ, দাক্ষিণাত্যের অন্যতম ইতিহাসপ্রসিদ্ধ জায়গা হায়দ্রাবাদের কথাই বলছি। ঐতিহ্যবাহী শহর। চূড়ান্ত শহুরে ব্যস্ততাপূর্ণ কোলাহলও একফোঁটা টলাতে পারেনি পুরনো নবাবী আভিজাত্যকে। তাইতো স্কাইস্ক্রাপার, শপিং মলে পূর্ণ এই হাইটেক সিটির পাশাপাশিই অবস্থান করছে চারমিনারের ঘিঞ্জি বাজার। যেহেতু ইতিহাসের শহর তাই এই ভ্রমণকথায় মাঝে-মাঝে ইতিহাসকেও ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করব ভ্রমণ অভিজ্ঞতার সাথে সাথে।

মুসি নদীর তীরে তেলেঙ্গানার রাজধানী হায়দ্রাবাদের পত্তন ১৫৯১ সালে গোলকোন্ডার পঞ্চম নবাব কুতুব শাহর হাত ধরে। এই শহরের নামকরণের পিছনেও একটি গল্প চালু আছে। কুতুবশাহর হিন্দু প্রেমিকার নাম ছিল ভাগ্যমতী যার নামে এই শহরের নাম হয় ভাগ্যনগরী। পরে তিনি নবাবের বেগম হলে নাম পরিবর্তিত হয়ে হয় হায়দার বেগম

এই নাম থেকেই শহরের নতুন নামকরণ হায়দ্রাবাদ। হায়দ্রাবাদের যমজ শহর সেকেন্দ্রাবাদ হুসেন সাগর দ্বারা বিচ্ছিন্নতথ্যনগরী হিসেবে হায়দ্রাবাদ সারা ভারতে বিশিষ্ট আসনলাভ করেছে। উর্দুভাষী মুসলিম ও ইসলামী সংস্কৃতির এই শহর রাতের আলোয় ঝলমলে হয়ে ওঠে। এখানকার আকাশে বাতাসে আজও চিকমিক করে ওঠে ইতিহাসের অভ্র। শহরের মোগলাই খাবারের সাথে বাদশাহি আদব-কায়দায় পর্যটকগণ পরিতৃপ্ত হন। আবার পাশাপাশি রামকৃষ্ণ মিশনের দুর্গাপুজো ও সেকেন্দ্রাবাদের বাঙালি সমিতি ও ইস্কনের মন্দির দুই ধর্মের প্রকৃত মেলবন্ধন ঘটিয়েছে।


 

আমরা ভাইজ্যাগ ভ্রমণ সেরে হায়দ্রাবাদ গিয়েছিলাম। সকালে ট্রেন থেকে স্টেশনে নেমেই মনটা ভালো হয়ে গেল। হোটেলে পৌঁছে বিশ্রাম নিয়ে শুরু হল সিটি ট্যুর। দর্শনীয় স্থানগুলো হল- চারমিনার, মক্কা মসজিদ, ফলকনামা প্যালেস, চৌমহল্লা প্যালেস কমপ্লেক্স, পুরানি হাভেলি ইত্যাদি। প্রথমেই গেলাম হায়দ্রাবাদের মূল আকর্ষণ চারমিনারে। শহরের দক্ষিণদিকে অবস্থিত এই জায়গাটা ‘পুরানা শহর’। এর চারপাশে চারটি মিনার। ১৫৩০ সালে হায়দ্রাবাদে প্লেগের আক্রমণে প্রচুর মানুষ মারা যায়। তাদের স্মৃতির উদ্দেশে ১৫৯০-৯২ সালে হায়দ্রাবাদের প্রতিষ্ঠাতা মহম্মদ কুলি কুতুব শাহ চারমিনার তৈরি করেন। এর প্রতিটি মিনারের উচ্চতা ৫৬.৭ মিটার। মিনারের গায়ে ঘোরানো সিঁড়িও আছে। যদিও ওপরে যাওয়ার অনুমতি নেই কয়েকবছর আগে দুর্ঘটনা ঘটার জন্য। একতলায় দাঁড়িয়ে টেলি-রবোটিক ক্যামেরার লেন্সে ধরা চারমিনারের মাথা থেকে শহরের দৃশ্য টাচস্ক্রিন কন্ট্রোলের সাহায্যে বড়পর্দায় দেখতে হবে। এ-ও একধরণের দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতোই। উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম- চারমুখেই রয়েছে চারটি গেট। একসময় চারমিনার মসজিদ আর মাদ্রাসা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। তবে এখন দর্শনীয় স্থান হিসেবে পরিণত হয়েছে। চারমিনারকে কেন্দ্র করে একটি বাজার বসে যা ‘লাডবাজার’ নামে পরিচিত। এই বাজারের মেজাজই আলাদা। প্রাণবন্ত, নানা রঙের বিস্ফারে মোহময়। খুশবুদার মশলা থেকে আতর-তামাকে মেদুর গন্ধ সমগ্র এলাকা জুড়ে। সেইসঙ্গে উপচে পড়া ভিড়। রাস্তা জুড়ে অসংখ্য দোকান। শাড়ি, চুড়ি, শেরওয়ানি, দোপাট্টা, বাসন, নানা ধরনের ঝাড়-লন্ঠন ও অ্যান্টিক জিনিস নিয়ে দোকানিরা পসরা সাজিয়ে বসে আছেন। সন্ধেবেলা আলোর সাজে সজ্জিত হয়ে ওঠে। তবে সেই সাজ দেখার সৌভাগ্য এবার আর হল না। 

চারমিনারের পাশেই আছে মক্কা মসজিদ। পরিচিতির দিক থেকে চারমিনার এগিয়ে থাকলেও আভিজাত্যের দিক থেকে মক্কা মসজিদ অনেকটাই এগিয়ে। রাজপুত ঘরানার স্থাপত্যে নির্মিত এই মসজিদটি নির্মাণের কাজ শুরু করেন মহম্মদ কুলি কুতুবশাহ আর শেষ করেন ঔরঙ্গজেব। কথিত আছে এই মসজিদের ইট নাকি মক্কা থেকে আনা হয়েছিল। তাই এ’রকম নামকরণ। রমজান মাসে এখানে প্রায় ১০,০০০ লোক একসাথে বসে নামাজ পড়তে পারেন। মসজিদের পাশেই আছে নিজাম পরিবারের সমাধিক্ষেত্র। পুরানি হাভেলি, চৌ-মহল্লা প্যালেস কমপ্লেক্স, ফলকনামা প্যালেস সম্পর্কে বিশেষ কিছু বলার নেই। একেক সময় একেকজন অভিজাত রাজপুরুষ একেকটি প্রাসাদ তৈরি করেছিলেন। সেগুলোই এখন দর্শনীয় স্থান হিসেবে রাখা হয়েছে। আমাদের সিটি ট্যুর পর্বের এখানেই সমাপ্তি ঘটল। ফিরে এলাম হোটেলে। 








পরেরদিন চলে গেলাম হায়দ্রাবাদ শহরের মূল আকর্ষণ সালারজং মিউজিয়ামে। এখানকার অন্যতম বৃহৎ মিউজিয়াম। এখানে ৪০টি রুমে প্রায় সাতচল্লিশ হাজার অ্যান্টিক সংগ্রহ আছেমিউজিয়ামের সামনে এসে দাঁড়াতেই মনটা সম্ভ্রমে ভরে গেল। বিরাট রাজপ্রাসাদের মতো অট্টালিকা। বিশালাকার স্তম্ভগুলোর যদি কথা বলার ক্ষমতা থাকত তাহলে ইতিহাসের অনেক না-বলা, অজানা অধ্যায়গুলোর কাহিনী জানা যেত। প্রবেশপথে রয়েছে মহাত্মা গান্ধীর আবক্ষ মূর্তি। এই মিউজিয়াম ভারতের সেরা মিউজিয়ামগুলোর মধ্যে একটি। প্রতিষ্ঠাতা নিজামের মুখ্যমন্ত্রী মীর ইউসুফ আলি খান সালারজং তৃতীয়। তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে একটি সংগ্রহশালা গড়ে তোলেন। পরবর্তীকালে জওহরলাল নেহেরু জাতীয় স্বার্থে এই প্রাসাদটি মিউজিয়াম হিসেবে গড়ে তোলেন নিজামদের ব্যবহৃত নানা জিনিসের পাশাপাশি স্থান পেয়েছে ভারতের মিনিয়েচার পেইন্টিং, ইউরোপের শিল্পসামগ্রী, দুর্লভ ম্যানুস্ক্রিপ্ট, দক্ষিণ ভারতীয় ব্রোঞ্জের কাজ। মিউজিয়ামটি মূলত তিনভাগে বিভক্ত-মেইন, ইস্টার্ন আর ওয়েস্টার্ন জোন। অন্য দেশ যেমন চীন, জাপান, বার্মার-ও পৃথক হল আছে। নানা ধরনের অলংকার, ফরাসি ও ইউরোপীয় চিত্রকলা, ভাস্কর্য, ঘড়ি, বিদেশি পুতুল, সাজপোশাক, বাসনপত্র, অস্ত্রশস্ত্র, কাশ্মীরি কার্পেট, নুরজাহানের বড় ছুরি, টিপু সুলতানের হাতির দাঁতের চেয়ার, জাহাঙ্গীরের মদ্যপানের কাপ- কী নেই এখানে! যতই দেখি ততই আশ্চর্য হয়ে যাই। এখানে রেবেকার একটি মূর্তি আছে যেটি ১৮৭৬ সালে ৭ লক্ষ টাকা ব্যয়ে আনা হয়েছিল। আপাদমস্তক ঢাকা শ্বেতপাথরের একটি নারীমূর্তি। নাম ‘ভেইলড রেবেকা’। প্রথমে ভেবেছিলাম যে ধুলোবালি থেকে বাঁচাতে বোধহয় মূর্তিটাকে একটা পাতলা, স্বচ্ছ চাদর দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে কিন্তু মূর্তিটার পিছনে গিয়ে দেখলে সেই ভুল ভেঙে যায় এটা তো সত্যিকারের কাপড়ের কোন চাদর নয়! শ্বেতপাথরের অপর সুন্দরভাবে কারুকার্যকরা একটি চাদর রয়েছে আর তার নীচ থেকে ফুটে উঠেছে এক সুন্দরীর নিটোল অবয়বের স্পষ্ট আভাস চাদরের ভাঁজগুলো পর্যন্ত আসল বলে ভ্রম হয় কী আশ্চর্য শিল্পকর্ম! প্রকাশ্য দিবালোকে সাধারণ মানুষের চোখে ধোঁকা দেওয়ার চমৎকার নিদর্শন ভাস্করের নাম জি. ডি. বেঞ্জনি জন্মসুত্রে ইতালিয়ান এক জায়গায় কাঠের গুঁড়িকে কেটে একইসাথে এমনভাবে একটি নারী আর পুরুষের মূর্তি তৈরি করা হয়েছে যা দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যেতে হয় 

বিভিন্ন ঘর ঘুরতে ঘুরতে একটি ঘরে প্রবেশ করলাম যেখানে রয়েছে সাতজন নিজামের অয়েল পেইন্টিং শিল্পীর নাম আর. ডব্লিউ. দিউস্কর এই নিজামদের প্রকৃত চেহারা কেমন ছিল তা অয়েল পেইন্টিং দেখে ঠিক বোঝা যায় না তবে তাঁদের সুখী-সুখী, আত্মবিশ্বাসী ও নিশ্চিন্ত মুখ দেখে মনে হল প্রতি পদে পদে নিজেদের মান-সম্মান খুইয়ে ইংরেজদের দাসত্ব করে যারা ‘নবাব’ উপাধি পেয়েছিলেন তাঁদের অন্তরে কি এতটাই আত্মতৃপ্তি ছিল! কে জানে এ কেবলমাত্র ছবিই হয়তো! তাঁদের আসল চেহারা নয় একটি ঘরে রয়েছে শুধুই পোর্সেলিনের বাসনপত্র। আসাধারণ সব তার কারুকাজ। একবার দেখে আঁশ মেটে না। স্বচ্ছ পোর্সেলিন রয়েছে নানা রকমের - যেমন ডেসড্রন, সভ্রেম, ওয়েজ উড, অস্ট্রিয়ান, ক্যাপোডিমন্টে, ভিয়েনা, স্যুভেনির প্রভৃতি। তবে অস্বচ্ছ পোর্সেলিনের মধ্যে ইংলিশটাই শুধুমাত্র চোখে পড়ল। প্রত্যেকটি গ্যালারি ঘুরে দেখতে অনেকটা সময় লেগে গেল। এবার একটু জিরিয়ে নেবার পালা। দুপুরের খাবারের সময়ও হয়ে এসেছে। এই অঞ্চল বৈভবে উপছে পড়ছে। ঝাঁ-চকচকে এক রেস্তোরাঁ দেখে সেখানে হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানির অর্ডার করা হল। সাথে মাটন শাহী কোর্মা আর মুর্গ মুসল্লমের শাহী সঙ্গতে দুপুরের আহার বেশ ভালভাবেই সাঙ্গ হল। 






বিকেলে চলে গেলাম হুসেন সাগর লেকের ধারে হায়দ্রাবাদ আর সেকেন্দ্রাবাদ শহরের মাঝখানে এই হুসেন সাগর লেক এটা রীতিমতো একটি পিকনিক স্পট প্রায় ষাট বর্গকিলোমিটার ক্ষেত্রফলবিশিষ্ট জলাশয়টি ইব্রাহিম কুলি কুতুব শাহ খনন করান এই লেককে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে লুম্বিনি পার্ক শীতকালে পরিযায়ী পাখির আনাগোনা বৃদ্ধি পায় এখানকার মূল আকর্ষণ হ্রদের জলে ভাসমান দ্বীপ দ্বীপের মাঝে রয়েছে বিশালাকার এক বুদ্ধমূর্তি লুম্বিনি পার্কের অন্যতম আকর্ষণ ‘লেসার শো’ জলের ফোয়ারার সাথে সাথে শুন্যে হওয়া লেসার শো-র অদ্ভুত কারিকুরি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম সন্ধেবেলায় চারদিক আলোয় আলোকিত এই আলোকমালা লেকের পরিবেশ মোহময় করে তুলেছে লেকের বুকে বোটিং-ও করা যায় আজকের মতো ঘোরাঘুরি শেষ এবার হোটেলে ফেরার পালা হায়দ্রাবাদে অনেক রাত পর্যন্ত রাস্তাঘাট সরগরম থাকে তুলনায় শহরের ঘুম ভাঙে কিছুটা দেরিতে নবাবী মেজাজ বলে কথা! 






পরেরদিন আমাদের সারাদিনের প্রোগ্রাম ‘রামোজি ফিল্ম সিটি’-তে দক্ষিণের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির প্রাণকেন্দ্র এই ফিল্মসিটি। ফিল্মের সেটের চাহিদা মেটাতে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গার আদলে এটি তৈরি করা হয়েছে। দেখে সত্যি বলে ভ্রম হয়। বৃহত্তম ফিল্ম সিটির জন্য গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের (১৯৯১) প্রশংসাও পেয়েছে। আবার শ্রেষ্ঠত্ব ও উদ্ভাবনী শক্তির জন্য ২০০৭ সালে পেয়েছে ‘পোনি পুরস্কার’ আর ২০১৩ সালে পেয়েছে ‘ডিপার্টমেন্ট অফ ট্যুরিজ্‌ম’ পুরস্কার। ছবির মতো সুন্দর প্রায় ২০০০ একর জুড়ে তৈরি হয়েছে জায়গাটি। টিকিট কেটে হাতে একটি করে ব্যাজ পরে প্রবেশ করলাম। এরপর রামোজির নিজস্ব বাসে করে ঘুরতে হবে। প্রতি বাসেই রয়েছেন একজন করে গাইডডাইনে-বাঁয়ে নানারঙের বিল্ডিং চোখে পড়ল। সবকটারই ইতিবৃত্ত বলতে থাকলেন গাইড। এখানে কোন না কোন বিখ্যাত ফিল্মের শুটিং হয়েছে। পাহাড়-পর্বত, বনজঙ্গল, চাষের জমি, বস্তি থেকে শুরু করে বড় বড় অট্টালিকা, রেস্তোরা, চার্চ, মন্দির, মসজিদ, সুইমিং পুল, স্কুল-কলেজ, বাস, ট্রেনের স্টেশন, এয়ারপোর্ট কি নেই এখানে! সারাবিশ্বের বিখ্যাত জায়গাগুলোর রেপ্লিকাও করা আছে। দেখলাম মহাভারতের সেট, কৃপালু গুহা, জাপানিজ গার্ডেন, হাওয়ামহল, হলিউড সাইনেজ, বাটারফ্লাই পার্ক, বার্ড স্যাঙ্কচুয়ারি, বনসাই বাগান, মুভি ম্যাজিক ও আরও কত কী! এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের শো-এর পাশাপাশি রয়েছে বাচ্চাদের অ্যামিউজমেণ্ট পার্ক। তবে একটাই অসুবিধা পায়ে হেঁটে সব জায়গায় ঘোরা যাবে না। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়ার একমাত্র ভরসা ফিল্ম সিটির ভিণ্টেজ বাস। এখানে থাকারও সুন্দর ব্যবস্থা আছে। প্রায় সব জায়গাই আমরা দেখে নিয়েছিলাম। উপরি পাওনা একটি দক্ষিণী ফিল্মের শুটিং-এর দৃশ্য। সারাদিন ঘুরে ঘুরে সবাই খুব ক্লান্ত। এবার হোটেলে ফেরার পালা। আজ আর কোথাও যাওয়া নেই। 






চতুর্থদিন আমাদের গন্তব্য মূল শহর থেকে ১১ কিমি দূরে অবস্থিত গোলকোণ্ডা ফোর্ট যাওয়ার সময় রাস্তাতেই পড়ল হাইটেক সিটি, অ্যাসেম্বলি হল, সরোজিনী দেবী আই হসপিটাল, এল.ভি.প্রসাদ আই হসপিটাল চিকিৎসার ক্ষেত্রে চেন্নাইয়ের পর খুব দ্রুত ভরসার জায়গা হয়ে উঠছে হায়দ্রাবাদ ফরতে প্রবেশ করার গেটের সংখ্যা মোট ৮ টি- নামগুলো হল জামালি, নয়াকিলা, ফতে, পাঠান চেরু, বহমনি, মকাই, আর বানজারা দরওয়াজা টিকিট কেটে আমরা প্রবেশ করলাম বানজারা দরজা দিয়ে এর প্রবেশ পথ অনেকটা ইংরাজি S আকৃতির মতো বাইরে রয়েছে একটা বিশালাকার পুকুর এটাই ছিল তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে বড় মোটরট্যাঙ্ক- নাম ‘কাটোরা হাউস’ এখানে রাজারা গোলাপজল দিয়ে স্নান করতেন সত্যিই রাজকীয় শখ বটে! সামনের বাগান পেরিয়ে দূর থেকে দেখা ফোর্টটিকে দেখে উপলব্ধি করতে পারছিলাম ইতিহাসকে কত ঘটনার নীরব সাক্ষী এই ফোর্ট গ্রানাইট পাথর দ্বারা নির্মিত গোলকোণ্ডা শহর ও ফরত্তি প্রতিরক্ষার উদ্দেশে ১১৪৩ সালে কাকতীয়দের দ্বারা নির্মিত হয় পরবর্তীকালে রানি রুদ্রমা ও তাঁর বংশধরগণ পুনর্নির্মিত করেন গুগুল আর ইন্টারনেটের জগতে প্রচুর তথ্য পাওয়া গেলেও গাইডের মুখ থেকে গোলকোণ্ডা ফোর্টের প্রাচীন ইতিহাস শুনতে শুনতে সেই সময় যেন চোখের সামনে প্রত্যক্ষ করছিলাম সম্পূর্ণ অঞ্চলের দৈর্ঘ্য প্রায় সাত মাইল যে পাহাড়টির ওপর দুর্গটি অবস্থিত তার নাম ‘ডেকান রক’ দুর্গের ভিতরেই ছিল রাজকীয় ভবন, মন্দির, মসজিদ, অস্ত্রাগার, আস্তাবল সবার নীচে বাইরের দিকে রয়েছে একটি দরজা যা দরদালান নামে পরিচিত এই দরজার সামনে হাততালি দিলেই ওপরে দরবার মহলে সেই আওয়াজ শোনা যেত বুঝলাম মোবাইল, সিসিটিভি বিহীন সেই সময় এটাই ছিল জনপ্রিয় যোগাযোগ ব্যবস্থা কালের গর্ভে আজ সবই বিলীন হয়ে গেছে তবে কিছু কিছু ধ্বংসস্তূপ অতীতের সাক্ষ্যবহন করে চলেছে আজও   ৮০ লাখের ওপর জনসংখ্যা একসময় শাসিত হয়েছিল পাঁচটি রাজবংশ দ্বারা ১১৪৩ সালে দেবগিরির যাদব বংশ থেকে গোলকোন্ডার গৌরবময় ঐতিহাসিক যাত্রা শুরু হয়ে বরাঙ্গলের কাকতীয় বংশ, বহমানি রাজা, কুতুবশাহি বংশের দ্বারা শাসিত হয়ে অবশেষে ১৮৬৭ সালে ঔরঙ্গজেবের আক্রমণের ফলে গোলকোন্ডার পতন ঘটে এরপর অবশ্য আসফজাহি বংশের হাত ধরে ইতিহাসের ধারা অন্যদিকে বয়ে গেছে গোলকোণ্ডা আর তারসাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পেরে ধীরে ধীরে সে তলিয়ে গেছে ভাঙন ধরেছে ইটে বাসা বেঁধেছে বাদুড়, চামচিকে, মাকড়সা…ম্লান হয়েছে তার উজ্জ্বল ইতিহাস গাইডের মুখেই শুনলাম প্রতিদিন এখানে অমিতাভ বচ্চনের কণ্ঠে ১ ঘণ্টার লেসার শো হয় দুর্গের বানজারা দরওয়াজা থেকে প্রায় ১ কিমি গেলেই রয়েছে কুতুব শাহির সমাধি এখানে হিন্দু, পার্সি, পাঠান স্থাপত্যশৈলী মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে অনান্য অনেক সৌধ থাকলেও নজর কাড়ে হায়াত বক্সী বেগমের সৌধ প্রতি বছর রাজ্য সরকারের উদ্যোগে এখানে অনুষ্ঠিত হয় ‘ডেকান ফেস্টিভ্যাল’ 

হায়দ্রাবাদের ট্র্যাজেডি মনকে বিষণ্ণ করে তোলে এই যে মহান ভারতবর্ষের সুবিশাল ইতিহাসের এক টুকরো এখানে এসে ভেঙে পড়েছে তার জন্য ভারতীয় ইতিহাসের পাতায় ক’টা লাইন বরাদ্দ করা হয়েছে? অথচ এর গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না মহাকালের যুদ্ধে হয়তো সে পরাজিত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু রেখে গিয়েছে গৌরবময় অতীতের কাহিনী বার্নিয়ে, তাভার্নিয়ের মতো বিদেশী পর্যটকও এর ঐশ্বর্য দেখে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন ক’জন জানেন শাহজাহানের প্রিয় হিরে ‘কোহ-ই-নূর’ এই গোলকোণ্ডার খনি থেকে উত্তোলিত হয়েছিল? কতজন খবর রাখেন যে ‘কুচিপুরি’ নামক বিখ্যাত নৃত্যশিল্পটির এখানেই জন্ম হয়েছিল? 

বেশ কয়েক ঘণ্টা এখানে কাটিয়ে ফিরে এলাম হোটেলে আজ আর কোথাও যাওয়া নেই রাতে হাওড়াগামী ট্রেন ধরতে হবে কিন্তু হায়দ্রাবাদ মুক্তোর পীঠস্থান তাই এখানে এসে মুক্তোর স্মারক না কিনলে ভ্রমণ অসম্পূর্ণই থেকে যাবে মুক্তোর বাজার হিসেবে খ্যাত ‘তুতি বাজার’-এ গিয়ে বেশ কিছু মুক্তোর জিনিস কেনা হল হায়দ্রাবাদ ভ্রমণের নিদর্শন হিসেবে এখানকার বিস্কুট, কুকিজও খুব বিখ্যাত ইরানি চা পান করে বেশ রকমারি কিছু বিস্কুট আর কুকিজের প্যাকেট কিনে হোটেলের পথ ধরলাম 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Featured post

সোনালী মিত্র